ছবি: বৈশালী সরকার
গাড়িটা বড় রাস্তার বাঁক ঘুরে একটা ঘিয়ে রঙের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। ছাদের হ্যাঙ্গিং টব থেকে মাধবীলতার ঝাড় বাড়ির গা বেয়ে নেমে এসেছে। সাদাটে লাল সেই ফুলের বাহারে গোটা বাড়িটা অন্য মাত্রা পেয়েছে। ফুলের কারণেই হয়তো ম্যাদামারা রোদ সত্ত্বেও সারা বাড়ি ঝলমল করছে আজ। এই মাধবীলতাটা কি ঝিমলির লাগানো? কয়েক মাস আগে যখন এই বাড়িতে এসেছিল, তখন তো কই চোখে পড়েনি মঞ্জীরার।
মঞ্জীরা গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াল।
তার পিছন পিছন গাড়ি থেকে নেমে এল আকাশদীপ। সামান্য কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে সে বাড়িটার দিকে তাকাল। তার হাতে একটা ছোট লাঠি। বিয়াল্লিশ বছরের এক জন লোক কুঁজো হয়ে চলছে এটা স্বাভাবিক ঘটনা নয়, এমন জোয়ান লোকের হাতে লাঠি থাকাও আশ্চর্যের। আকাশদীপের এই দুটোই আছে। এত ক্ষণ তার দৃষ্টিও ছিল ঘোলাটে, কিন্তু বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়াতেই চোখের সেই ধূসরতা উধাও। মঞ্জীরা এগিয়ে যেতে গিয়েও ফিরে এল, সৌজন্য ভরা গলায় সে জিজ্ঞেস করল, “তুমি নিজে হাঁটতে পারবে, না কারও সাপোর্ট লাগবে?”
তত ক্ষণে ছুটে এসেছে ড্রাইভার রমেন, “আমায় ধরুন ছোড়দা। আমি নিয়ে যাচ্ছি।”
গত সপ্তাহখানেক যমে-মানুষে টানাটানি চলেছে আকাশদীপকে নিয়ে। একলা ফ্ল্যাটে যখন এক পার্টিকর্মী তার শরীরটাকে আবিষ্কার করে তখন সেই শরীরে প্রাণের স্পন্দন প্রায় ছিল না বললেই চলে।
ছেলেটিকে তারিফ করতেই হবে। যে অবিশ্বাস্য দ্রুততায় সে আকাশদীপকে নিয়ে কাছাকাছি হসপিটালের এমার্জেন্সিতে পৌঁছেছিল, তার জন্য কোনও প্রশংসাই যথেষ্ট নয়।
আকাশদীপের মুখ থেকে তখন গ্যাঁজলা বেরোচ্ছিল, হাত-পায়ে সাড় নেই, প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে, ডান দিকের চোখ বিস্ফারিত। আরএমও ভদ্রলোক মুহূর্তমাত্র দেরি না করে আকাশদীপকে স্ক্যান করতে পাঠিয়েছিলেন, রিপোর্ট পাওয়া অবধি অপেক্ষা করতে হয়নি, প্লেট দেখেই তিনি আকাশদীপকে লাইফ সাপোর্ট সিস্টেমে স্থানান্তরিত করেন।
পার্টির ছেলেটি অবশ্য তত ক্ষণ বসে থাকেনি। প্রথমেই সে ফোন করেছিল লোকাল পার্টি অফিসে। বাড়ির ফোন নম্বর নিয়ে আকাশদীপের ফ্যামিলি মেম্বারদেরও সে-ই খবরটা দিয়েছিল।
আধ ঘণ্টার মধ্যে ছুটে এসেছিল অনলদীপ আর ড্রাইভার রমেন। ছোকরা আরএমও গম্ভীর মুখে ওদের চেম্বারে ডেকেছিলেন, “আমি পেশেন্টকে আইসিইউ-তে নিয়ে নিলাম। ব্যাপারটা ভাল ঠেকছে না। সেরিব্রাল স্ট্রোক হওয়ার পর অনেক ক্ষণ উনি আনঅ্যাটেন্ডেড অবস্থায় পড়ে ছিলেন। সেটাই মেজর কনসার্ন। সাধারণত ব্লাড ছাড়া ব্রেন চার মিনিট নর্মালি কাজ করতে পারে, তার পর ঝিমিয়ে পড়ে, সেল ডেথ হয় আর ব্রেনের সেল তো, এক বার নষ্ট হয়ে গেলে আর ফিরে পাওয়া যায় না। তাই এক দিকের শরীর অথবা ওয়ার্স্ট কেসে চার হাত পা-ই প্যারালাইজ়ড হয়ে যাওয়া আশ্চর্য নয়। তবে সে সব পরের কথা, আপাতত লেট মি সেভ হিজ় লাইফ। এই ডিক্লারেশন ফর্মটায় একটু সই করে দিন।”
শেষ অবধি পেশেন্ট ফিরে এসেছে। সৌভাগ্যবশত এই স্ট্রোক সুদূরপ্রসারী ছায়া ফেলেনি আকাশদীপের ওপর। তবে শরীরের বাঁ দিক এখনও বেশ দুর্বল। গ্লাস ধরে জল খেতে পারছে না। আজ সে ছাড়া পেয়েছে। এখন পরিপূর্ণ বিশ্রাম, টানা ফিজ়িয়োথেরাপি আর তিন মাস পরে আর এক বার রুটিন ভিজ়িট।
প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর পর নিজের ঘরে ঢুকল আকাশদীপ। এই বাড়ি তার ঠাকুরদার আমলের। বাবার আমলে দোতলা বাড়ি তিনতলা হয়েছে। এই বাড়িতেই জন্ম, বেড়ে ওঠা, কর্মজীবনে প্রবেশ, বিয়ে। তার পর কী দারুণ অবহেলায় এই বাড়ি ছেড়ে এক দিন চলে গিয়েছিল আকাশদীপ। ভাবলেও অবাক লাগে তার। কী করে পেরেছিল? একটা বাড়ি তো শুধু ইট-কাঠ-পাথরের কাঠামো নয়, তার মধ্যে দিয়ে বয়ে যাওয়া এক-একটা দমকা হাওয়া এক একটা স্মৃতিপথের ইশারা দিয়ে যায়।
দীর্ঘশ্বাস ফেলল আকাশদীপ। শরীরের বারোটা বেজে গেছে। দোষ শরীরের নয়। যে ভাবে দিনের পর দিন নাওয়াখাওয়া ভুলে পার্টির পিছনে সে সময় দিয়েছে, তাতে শরীরের কলকব্জা বিগড়োনোই স্বাভাবিক। তার উপর অত বড় মানসিক স্ট্রেস নিতে পারেনি আকাশদীপ। সে সব কথা ও ভাবতে চায় না এই মুহূর্তে। সে অন্য দিকে মন ঘোরানোর চেষ্টা করল।
তার ঘরটা আজ ঝাড়পোঁছ করে পরিষ্কার করে রাখা হয়েছে। টেবিল চেয়ার বসার ডিভান ঝকঝক করছে । বিছানায় নতুন চাদর পাতা। পর্দা সরানো। এই ঘরে ক্রস ভেন্টিলেশন আছে, দক্ষিণের ঘর। এপ্রিল-মে মাসের প্রবল গরমেও এসির দরকার প্রায় পড়েই না।
আকাশদীপ দেখল, সেই ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে মঞ্জীরা তার দিকে তাকিয়ে আছে।
ঘরে ঢুকতে গিয়ে একটু টাল খেয়ে গেল আকাশদীপ। হসপিটালের ডিসচার্জ শিটে লেখা আছে ‘পেশেন্ট ইজ় স্টেবল’। কথাটা পুরোপুরি সত্যি নয়। আকাশদীপ জানে, সুস্থতা এখনও অনেক দূরে। শরীরের বাঁ দিক ভয়ানক দুর্বল, চেয়ারে না বসে কোনও মতে বিছানাতেই ধপ করে বসে পড়ল সে। হাতের ইশারায় ফ্যানের দিকে দেখাল।
মঞ্জীরা শান্ত ভাবে গিয়ে ফ্যান চালিয়েছে।
ঝলমলে সকালে ঘরের আলো কেটে কেটে ঘুরছে ফ্যানের ব্লেড। আকাশনীলের গায়ে খয়েরি টি-শার্ট, গায়ে জমে থাকা ঘামে ফ্যানের হাওয়ায় হিমের মতো স্পর্শ লাগছে। ভারী আরাম। এই আরাম বিশ্বের আর কোথাও পাওয়া যায় না, এই আরাম নিজের ঘরের আরাম।
ঝিমলি আকাশনীলের কাছে ঘেঁষতে সাহস পাচ্ছিল না, দূর থেকে দেখছিল কাকাইকে। আকাশনীল কাছে ডেকে নিয়েছে তাকে, খুচখুচ কথা চলছে কাকা-ভাইঝিতে।
মঞ্জীরা ঘর থেকে বেরিয়ে লম্বা করিডরে পা রাখল। বাড়িতে আজ খুশির হাওয়া। শুধু লোপামুদ্রাই নয়, অনলদীপ, দেবিকা, ঝিমলি, রমেন... সবার মধ্যেই খুশির ভাব।
মঞ্জীরার কি খুশি হওয়া উচিত? অথবা সত্যিই কি সে ভিতরে ভিতরে খুশি হয়েছে?
নিজেকেই চিনতে পারছে না মঞ্জীরা।
সে দিন ডাম্বোর ক্রিকেট ক্লাবে লোপামুদ্রার ফোনটা পেয়ে চমকে উঠেছিল মঞ্জীরা, লোপামুদ্রার গলার স্বর উত্তেজনায় কেঁপে কেঁপে উঠছিল, “মঞ্জি! তুই কোথায় মঞ্জি! এক বার আয় মা। ছোটখোকার স্ট্রোক হয়েছে। ওরা হাসপাতালে চলে গেল। আমি বুড়ো মানুষ, ছোটখোকার কিছু হয়ে গেলে আমি কী করে সহ্য করব মঞ্জি? এক বার আয় মা, আমার জন্য অন্তত আয়।”
ফোন রেখে কিছু ক্ষণ চুপ করে বসে ছিল মঞ্জীরা। উত্তীয় লিফট দিতে চেয়েছিল, মঞ্জীরা রাজি হয়নি। নিজেই একটা ট্যাক্সি নিয়ে বালিগঞ্জের বাড়িতে গিয়েছিল, আর তার পর অথর্বপ্রায় বৃদ্ধা শাশুড়িকে নিয়ে ছুটেছিল হাসপাতালে।
আকাশদীপ ভোগালেও খুব বেশি ভোগায়নি। সব মিলিয়ে মাসখানেক তার হাসপাতালে থাকার মেয়াদ। এই সময়টায় মঞ্জীরা ঘিরে ছিল লোপামুদ্রাকে। বৃদ্ধা সম্পূর্ণ মুহ্যমান হয়ে পড়েছিলেন, সামান্য নিজস্ব প্রয়োজনটুকু মেটানোর জন্য পর্যন্ত আয়ার সাহায্য লাগছে। আর তারই সঙ্গে এসেছে মঞ্জীরার ওপর অপার নির্ভরতা। ছেলের অমঙ্গল আশঙ্কায় ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠছিলেন লোপামুদ্রা। এই অবস্থা বেশ কিছু দিন চলেছিল। এক দিন তো বাধ্য হয়ে রাতে লোপামুদ্রার কাছে থেকেই যেতে হল মঞ্জীরাকে।
পাঁচ বছরে প্রথম বার।
প্রথম দিনই অবাক লেগেছিল মঞ্জীরার। ডাম্বোর মাঠ থেকেই কি ফোনে বারণ করে দেওয়া যেত না লোপামুদ্রাকে? হাজারটা অজুহাত দেওয়া যেত। তবু কেন ছুটে এসেছিল মঞ্জীরা?
সে দিন কি লোপামুদ্রা ডেকেছিলেন তাকে? না কি সে ডাক ছিল মহীরুহসম এক নারীর, যিনি পরিবারের সামনে দাঁড়িয়ে বৌমার পক্ষ নিয়েছিলেন নির্দ্বিধায়। বাড়িছাড়া করেছিলেন নিজের ছেলেকে।
আকাশদীপের জন্য কি এতটুকু উৎকণ্ঠা নেই তার! অমন দাপুটে দামাল মানুষ নিষ্প্রাণ একটা গাছের গুঁড়ির মতো আইসিইউ-এ পড়ে আছে... প্রথম দেখায় তো চিনতেও পারেনি মঞ্জীরা। আকাশদীপের মুখে অক্সিজেন মাস্ক ছিল। শুধুমাত্র মাস্কের জন্য পাঁচ বছর এক ছাদের নীচে এক সঙ্গে কাটানো মানুষটাকে অপরিচিত লাগার কথা নয়, তবু চিনতে সময় লেগেছিল মঞ্জীরার। বেড নম্বর মিলিয়ে লোপামুদ্রাকে আকাশদীপের সামনে নিয়ে গিয়েছিল মঞ্জীরা। প্রায় হপ্তাদুয়েক আকাশদীপ ব্যস্ত রেখেছিল সবাইকে, আজ সে বাড়ি ফিরেছে।
শুধু মঞ্জীরা নিজের প্রশ্নের উত্তর পায়নি। নির্ঘুম রাত কেটেছে।
রান্নাঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল মঞ্জীরা। দেবিকা গ্যাস ওভেনের সামনে দাঁড়িয়ে, চায়ের পাত্র ওভেনে ঢাকা দিয়ে রাখা।
মঞ্জিরা বলল, “ওর চা-টা নিতে এলাম দিদি।”
দেবিকা ব্যস্ত স্বরে মঞ্জিরাকে বলল, “মঞ্জি, চিনির কৌটোটা একটু দাও না।”
মঞ্জিরা অভ্যস্ত হাতে তাক থেকে কৌটো দিল দেবিকাকে। দিয়েই চমকেছে সামান্য, এত বছর পরে এই রান্নাঘরে পা দিয়েছে সে, তবু মনে হচ্ছে এ তার চিরপরিচিত স্থান।
সে দেবিকাকে বলল, “ওর চায়ে লিকারটা একটু বেশি হবে দিদি। ও একটু কড়া খায়।”
দেবিকা তাকাল মঞ্জীরার দিকে, “আমি জানি মঞ্জি। মনে আছে আমার।”
সহজ ভাবেই মঞ্জীরার হাতে কাপ তুলে দিয়েছে দেবিকা, তবু তার চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নিল মঞ্জিরা। কী ছিল দেবিকার চোখে? শ্লেষ! করুণা! বিস্ময়! না কি কিছুই ছিল না। নিজের মনের ছায়া দেবিকার চোখে দেখতে পেয়েছে সে!
বাবার অসুস্থতার খবর শুনে কেঁদে ভাসিয়েছিল ডাম্বো, বার বার জেদ ধরেছে বাবাকে দেখবে বলে। এখনও পর্যন্ত তাকে ঠেকিয়ে রেখেছে মঞ্জীরা, কিন্তু কত দিন ছেলের জেদের সামনে অনড় থাকতে পারবে জানে না সে।
মিহিকা নিরুত্তাপ ছিল। সে তার কাফে নিয়ে ভয়ানক ব্যস্ত আজকাল। কাফে খুলতে না খুলতে নাকি ভিড় উপচে পড়ছে। কাছাকাছি একটা হোটেল ম্যানেজমেন্ট কলেজের ফেস্ট চলছে বলে জনসমাগম হচ্ছে খুব। সেই ভিড়ের একটা অংশ চুঁইয়ে এসেই নাকি ভরিয়ে দিচ্ছে মিহিকার কাফে।
আর তা ছাড়া খুব গোড়ার দিকে আকাশদীপের সঙ্গে তার একটা সুন্দর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল ঠিকই, কিন্তু তার পর থেকে ছোট শালির সঙ্গে কোনও যোগাযোগই রাখেনি আকাশদীপ। তাই আকাশদীপের অসুস্থতায় মিহিকা যে উতলা হয়ে পড়বে, এমনটা ভাবেনি মঞ্জীরা। এ দিকে কিন্ডারগার্টেন স্কুলে পড়ানোর চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে বসে আছে মিহিকা, সেটা অবশ্য তেমন বড় কথা কিছু নয়।
তবে এখন সারাটা দিন কাফে সামলাতেই কেটে যাচ্ছে, কলেজে ক্লাস কখন করবে? দুটো সিমেস্টার এখনও বাকি। এই চিন্তাটা একা মঞ্জীরা নয়, মিহিকাও করে মাঝে মাঝে।
দুই বোনের সম্পর্ক অনেক সহজ। বাড়ি ফিরে চায়ের কাপ হাতে বসছে দুই বোন আজকাল। কারণে-অকারণ প্রচুর কথা হয় দু’জনে, প্রিয় বান্ধবীর মতোই। সে সব কথার একটা বড় অংশ জুড়ে উত্তীয়র আনাগোনা চলে। দশ বছরের বড় দিদির সঙ্গে খুব সাবধানে খুনসুটি করে মিহিকা।
মঞ্জীরা ঘরে ঢুকে দেখল, এরই মধ্যে কখন যেন ছেলের পাশে এসে বসেছেন লোপামুদ্রা। ঘরের জানলার পর্দা টেনে দেওয়া হয়েছে, ঘরে আবছায়া ভাব। প্রথম নভেম্বরের দুপুরবেলার রোদও সম্ভবত সহ্য হচ্ছে না আকাশদীপের।
লোপামুদ্রা স্নেহের হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন আকাশদীপের পিঠে, মাথায়। চোখ বন্ধ করে রেখেছে আকাশদীপ, মায়ের আদর যতটা পারছে শুষে নিচ্ছে সে। মঞ্জীরাকে দেখে উঠে দাঁড়ালেন লোপামুদ্রা, ঘরের বাইরে যেতে যেতে চোখের ইশারায় মঞ্জীরাকে ডাকলেন এক বার।
শান বাধানো লাল মেঝের বারান্দায় এসে পিছন ফিরলেন লোপামুদ্রা, “ছেলেটা অনেক কষ্ট পেয়েছে মঞ্জি। জানি না জীবনে আর কোনও দিন ঘুরে দাঁড়াতে পারবে কি না,” লোপামুদ্রার হাতে একটা স্টিক, সেই স্টিকের নীচে চারটে রাবারের ফলা মেঝে আঁকড়ে ধরে আছে। সে দিকে দৃষ্টি স্থির করে লোপামুদ্রা বললেন, “আমি জানি সে তোর কাছে অপরাধী। তবু দিনের শেষে আপনার জন যদি আহত হয়ে ফিরে আসে তাকে দেখাটাও তো ফ্যামিলি মেম্বারদেরই দায়িত্ব।”
মঞ্জিরা মাথা নিচু করল।
তাকে এক ঝলক দেখে লোপামুদ্রা বললেন, “এখনও কাগজে কলমে তোরা স্বামী-স্ত্রী, তাই না? ছেলেটাকে এক দিন বাবার কাছে নিয়ে আয়। তোরা নিজেরাও একটু কথা বল। এক জন ফ্যামিলি মেম্বার সাহায্য চাইলে তাকে ফিরিয়ে দেওয়াটাও তো অপরাধ, তাই না? একটা অপরাধ আর একটা অপরাধের রিভেঞ্জ হতে পারে, জাস্টিফিকেশন হতে পারে কি?”
ঘুরে দাঁড়িয়েছেন লোপামুদ্রা। ঠক ঠক শব্দ করে এগিয়ে যাচ্ছেন স্টিলের স্টিক হাতে নিয়ে। এমন ভারী শরীরে, ওই সামান্য স্টিক হাতে তিনি সিঁড়ি দিয়ে তিনতলায় নিজের ঘরে যাবেন, বাইরে থেকে দেখে এ জিনিস ভাবাই যায় না।
মঞ্জীরা ঘরে ঢুকল, খাটের উপর একই ভাবে বসে আছে আকাশদীপ। চায়ের কাপটা পর্যন্ত উঠে টেবিলে রেখে আসতে পারেনি। মঞ্জীরাকে ঘরে ঢুকতে দেখে মাথা তুলল সে। বলল, “মঞ্জি! তোমার কাছে ক্ষমা চাওয়ার মুখ নেই। তবু আমার মনে হয় কিছু বিষয় তোমার জানা প্রয়োজন।”
মঞ্জিরা সহজ ভাবে খাটে বসল। সৌজন্যসীমা বাঁচিয়ে, যেমন কোনও অর্ধপরিচিত পুরুষের পাশে বসে কেউ।
“ক্ষমতার নেশা সবচেয়ে বড় নেশা মঞ্জি। সব নেশা এক দিন ঘুচে যায়, কিন্তু ক্ষমতার নেশা থাকে আজীবন। সেই নেশাতেই এতগুলো বছর পার্টিকে দিলাম। ঘর সংসার সব ছেড়ে দিনের পর দিন পার্টি অফিসে রাত কাটিয়েছি। কিন্তু শেষমেশ কী পেলাম? আমার লেজিটিমেট রাইট যে এমএলএ ইলেকশনের টিকিট, সেটা পর্যন্ত আমায় না দিয়ে কাকে দেওয়া হল জানো? যে ছেলে পলিটিক্সের কিস্যু বোঝে না, সিনেমায় অভিনয় করে, রুলিং পার্টির সঙ্গে কাটমানি নিয়ে ঝামেলায় দল ছেড়ে এসেছে। আর আসামাত্র আমাদের পার্টি লুফে নিল তাকে। শুধু কি তা-ই? আমার জায়গায় স্ট্রেট বিধানসভা ইলেকশনের টিকিট দিয়ে দেওয়া হল। মাত্রাছাড়া স্ট্রেস তো ছিলই, চাপা উত্তেজনা... তার ওপর প্রচুর স্মোক করে ফেলেছিলাম, সেই রাতেই অসুস্থ হয়ে পড়লাম। তুমি শুনছ মঞ্জি?”
মঞ্জীরা শুনছিল, অথবা শুনছিলও না। আজ বহু বছর পর তারা স্বামী-স্ত্রী কথা বলছে। হাসপাতালের এই কয়েক দিনেও খুব প্রয়োজনীয় টুকরো কথা ছাড়া কোনও কিছু আদানপ্রদান হয়নি তাদের।
আজ হঠাৎই কোনও ভূমিকা ছাড়াই অনর্গল কথা বলছে আকাশদীপ। কাকে শোনাচ্ছে? মঞ্জীরা আদৌ শুনতে আগ্রহী বলে মনে হচ্ছে তার? মঞ্জীরা কি একটা কনফেশন বক্স! না কি নিজেকেই নিজের গল্প শোনাচ্ছে আকাশদীপ?
নিতান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও অথবা নিছক কৌতূহলের বশেই মঞ্জিরা তির্যক প্রশ্ন ছুড়ল, “আর তোমার সেই অন্তরা শর্মা, তার কী হল?”
“উফ! মঞ্জি প্লিজ়! কাগজে পড়া খবর নিয়ে কেন তোমরা এত রিঅ্যাক্ট করলে?” জোরে মাথা ঝাঁকাল আকাশদীপ, “হ্যাঁ, কয়েক দিন তার সঙ্গে একই ফ্ল্যাট শেয়ার করতে হয়েছিল আমায়, তবে আমরা দু’জন একা ছিলাম না। পার্টির কাজে পাঁচ জন কর্মী এক সঙ্গে ছিলাম। ফর গড’স সেক, আমি লিভ-ইনে ছিলাম না। আর তা ছাড়া তুমি কি জানো, আজ পাঁচ মাস হল অন্তরা শর্মা ওয়েস্ট বেঙ্গল সার্কেল ছেড়ে চলে গেছে! সে এখন মহারাষ্ট্রে কাজ করছে?”
মঞ্জীরা ঘড়ি দেখল, “উঠি, ডাম্বোর টিউশন শেষ হয়ে যাবে। ওকে নিয়ে বাড়ি ফিরব।”
আকাশদীপ গভীর চোখে তাকাল, “ফিরে এসো মঞ্জি। আমি অপরাধী, কিন্তু এক বারের জন্যও আমায় আটকেছ তুমি? কেন যেতে দিলে আমায়? আমরা তো ভালই ছিলাম। আজ বুঝি কত বড় ভুল করে ফেলেছি। কিন্তু ভালবাসায় কি একটুও বাঁধতে পারতে না আমায় মঞ্জি! ফিরে এসো প্লিজ়, লেট’স স্টার্ট ইট আফ্রেশ। আমি তোমার পায়ে ধরে ক্ষমা... ”
বলতে বলতেই আকাশদীপ নিচু হয়ে মঞ্জীরার পা ছুঁতে গেল।
আর একটু হলেই সম্ভবত আকাশদীপ সত্যি সত্যিই পা ধরে তুমুল নাটকীয় পরিস্থিতি তৈরি করত, মঞ্জীরা প্রায় লাফিয়ে সরে গেল। চাপা গলায় ধমক দিয়ে বলল, “থাক। অনেক হয়েছে। আর লোক হাসাতে হবে না।”