Scientists

বিজ্ঞানীদের নোটবই

আবিষ্কারের আলোয়, প্রকাশিত গবেষণাপত্রে, বক্তৃতায় ধরা পড়ে না এমন অনেক কথা, অনেক ঘটনার সাক্ষী থাকে বিজ্ঞানীর নোটবই, যাকে সেই বিজ্ঞানীর গবেষণার খসড়াও বলা যায়।

Advertisement

রূপালী গঙ্গোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ০৪:৫৩
Share:

যেখানে তাঁরা লিখে রাখতেন নানা গবেষণার প্রথম ফলাফল। একান্ত নিজস্ব, সংক্ষিপ্ত ও গোপন। সেখান থেকেই জানা যায়, সোনা তৈরি করতে মেতে উঠেছিলেন আইজ়্যাক নিউটন, জলাতঙ্কের টিকা নিয়ে সব সত্য সামনে আনেননি লুই পাস্তুর। আজ জাতীয় বিজ্ঞান দিবসে সেই সব বিখ্যাত রাফ খাতার গল্প।

Advertisement

মারি কুরির নাম শোনেননি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার। তিনিই প্রথম মহিলা, যিনি বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। এক বার পদার্থবিদ্যায় (১৯০৩) আর এক বার রসায়নে (১৯১১)। ফ্রান্সের জাতীয় গ্রন্থাগারে তাঁর গবেষণার কাগজপত্র, নোটবই সব কিছুই খুব যত্ন করে সংরক্ষিত আছে। কিন্তু সে সব রাখা আছে সিসার আবরণের ভিতরে, আর সে সব দেখতে হলে, আপনাকে বিশেষ ধরনের পোশাক পরে যেতে হবে। কারণ মারি কুরি কাজ করতেন ভয়ানক তেজস্ক্রিয় পদার্থ, রেডিয়াম-২২৬ আর পোলোনিয়াম-২১০ নিয়ে, যাদের তেজস্ক্রিয়তার ফলাফল বিষয়ে তিনি নিজেও কিছুটা অসাবধানই ছিলেন। তাই তাঁর নোটবইয়ে তেজস্ক্রিয়তার প্রভাব এখনও অটুট। এই প্রভাব অর্ধেক হতেই সময় লাগবে প্রায় ১৬০০ বছর, আর পুরোপুরি শেষ হতে ১১,০০০ বছরেরও বেশি। তেজস্ক্রিয় বিকিরণের পাহারা ভেদ করে তত দিন সে সব ধরা-ছোঁয়া যাবে না।

এই রকম ভাবেই বিজ্ঞানীর নোটবই তাঁর বিজ্ঞানচর্যার অংশ হয়ে ওঠে। আবিষ্কারের আলোয়, প্রকাশিত গবেষণাপত্রে, বক্তৃতায় ধরা পড়ে না এমন অনেক কথা, অনেক ঘটনার সাক্ষী থাকে বিজ্ঞানীর নোটবই, যাকে সেই বিজ্ঞানীর গবেষণার খসড়াও বলা যায়। প্রসঙ্গত মনে পড়ে যায়, সত্যজিৎ রায়ের বিখ্যাত খেরোর খাতার কথা। তাঁর সেই নোটবইয়ে প্রতিটি দৃশ্য, চরিত্রের মেকআপ ও পোশাক-সমেত স্কেচ করে রাখতেন তিনি। সেই অনুযায়ী তাঁর ছবির দৃশ্যগুলো চলচ্চিত্রায়িত হত। কারণ এক জন সৃজনশিল্পীও তো বিজ্ঞানীর মতোই আবিষ্কারক।

Advertisement

বিজ্ঞানীরা তাঁর পরীক্ষার প্রাথমিক ধারণা, যন্ত্রসজ্জা থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ের গণনা ও ফলাফল, লিখে রাখেন নোটবইতে। সব ফলাফল প্রত্যাশিত হয় না, পরীক্ষায় ভুল হয়, সেই সব ব্যর্থতার ফলাফলও পাওয়া যায় রোজকার নোটবইতে। তবে এই লিপিবদ্ধ তথ্য যে হেতু একান্ত নিজস্ব এবং প্রকাশ করার জন্য নয়, তাই সব সময়ই কিছুটা সংক্ষিপ্ত। অনেক সময় নিজের বোঝার মতো করে কিছুটা সাঙ্কেতিক ভাবেও লেখা হয়। সুতরাং, বিজ্ঞানীর নোটবই শুধুমাত্র খসড়া বা রাফ খাতা নয়, ব্যক্তিগত দিনলিপিও নয়, কিন্তু তা বিজ্ঞানীর নিজস্বতার চিহ্ন ধরে রাখে। তাকে বরং গবেষণার অগ্রন্থিত ধারাবিবরণী ভাবা যেতে পারে, যার নির্যাসটুকুই শুধু গবেষণাগারের বাইরে আসে।

যে বিজ্ঞানী তাঁর নোটবই-এর জন্যই বিখ্যাত তাঁর নাম লিয়োনার্দো দা ভিঞ্চি (১৪৫২-১৫১৯)। অবশ্য শুধু বিজ্ঞানীই নন, তিনি ছিলেন একাধারে চিত্রকর, ভাস্কর, স্থপতি ও প্রযুক্তিবিদ। প্রায় ৭০০০ পাতার নোটবইয়ে তিনি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ে তাঁর যাবতীয় ধারণা ও উদ্ভাবনের কথা রেখাচিত্র ও বর্ণনা-সহ ধারাবাহিক ভাবে বিধৃত করেছেন। কিছু নোটবইয়ের আকারেই পাওয়া গিয়েছিল, কিছু বিচ্ছিন্ন পাতাকে গ্রথিত করে ‘কোডেক্স ফরস্টার’ নামে এই নোটবইয়ের সম্ভার এখন ডিজিটাল আকারে ব্রিটিশ গ্রন্থাগারে পাওয়া যায়। এখানে চোখ রাখলে নদীর প্রবাহ থেকে চাঁদের আলো, অবতল দর্পণের প্রতিফলন থেকে পাখির ডানার গঠন ও উড়ানের রকমফের— এই রকম বহু বিচিত্র বিষয়ে তাঁর বিশ্লেষণ ও তাদের প্রয়োগ (যেমন, আকাশে ওড়ার যন্ত্র, জলের নীচে শ্বাস নেওয়ার যন্ত্র ইত্যাদি কী ভাবে তৈরি করা যায়) নিয়ে ভিঞ্চির ভাবনা জানা যাবে। যে হেতু এগুলো প্রকাশ করার কোনও বাসনা তাঁর ছিল না, তাই এই নোটের আনাচে-কানাচে কিছু কিছু ব্যক্তিগত কথাও লেখা থাকতে দেখা যায়। তবে অত্যাশ্চর্য বিষয় হল সমস্ত নোটই ‘আয়না হরফে’ লেখা, অর্থাৎ আয়নার সামনে না ধরে তাকে পড়ার উপায় নেই। সুতরাং নোটবইয়ে যা লেখা আছে, তার সঙ্গে এই অনন্য লিখন পদ্ধতিও এই বিজ্ঞান-অনুসন্ধিৎসু মানুষটির অসাধারণত্বকে তুলে ধরে।

তবে লিয়োনার্দোর নোটবই তাঁর একান্তই ব্যক্তিগত কাজের নথি যা তিনি প্রকাশ করার বা বিচার জন্য কোথাও পাঠাননি, তাই তাঁর নোটবই চরিত্রে অন্যান্য বিজ্ঞানীর তথাকথিত ‘ল্যাবনোটবুক’ থেকে আলাদা। প্রকাশিত গবেষণাপত্র শুধু বিজ্ঞানীর সাফল্যটুকুকে দেখিয়ে দেয়, কিন্তু এক জন পেশাদার বিজ্ঞানীর নোটবুকই তাঁর মাঠে নামার আগের নেট প্র্যাকটিস আর ড্রেসিং রুমের গল্প তুলে ধরে। তাঁর নিষ্ঠা, সততা, অধ্যবসায়, দায়বদ্ধতা, এমনকি জীবনদর্শনের পরিচয়ও বহন করে। একটি সফল পরীক্ষা কতগুলো ব্যর্থতা, সংশোধন ও কাটাকুটির উপরে দাঁড়িয়ে থাকে, তার নীরব সাক্ষ্য বহন করে নোটবই। সে দিক থেকে বলা যেতে পারে, বিজ্ঞানীর নোটবই গবেষণার ‘হাইওয়ে’-র সমান্তরাল এক ‘সার্ভিস রোড’-এর মতো, যে রাস্তার খবর খুব কম লোকে জানে।

স্মরণ করা যাক একটি নাম, স্যর আইজ়্যাক নিউটন (১৬৪২-১৭২৭), আধুনিক বিজ্ঞানের জনক, যিনি আমাদের জ্ঞানবৃক্ষের আপেল খাইয়েছেন। ভূপৃষ্ঠে গতিমান একটি কণা থেকে মহাজাগতিক বস্তু অবধি আমাদের মহাবিশ্বে প্রায় কোনও কিছুই তাঁর প্রতিভার বর্ণালী থেকে বঞ্চিত হয়নি। সারা জীবনে হাজার হাজার পাতা কাজ করেছেন, যার সামান্যই প্রকাশিত। মৃত্যুর পরে তাঁর যাবতীয় কাগজপত্র তাঁর ভাগ্নী ক্যাথরিনের কাছে যায় এবং সেখান থেকে বংশপরম্পরায় নানা হাত ঘুরে ১৮৭২ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে পৌঁছয়। নিউটনের সেই অপ্রকাশিত নোটবই শ্রেণিবিভাগ করে ক্যাটালগ তৈরি করতে গিয়ে দেখা যায়, তিনি সরাসরি বিজ্ঞানবিষয়ক যে সব কাজকর্ম করেছেন, তার চেয়ে হয়তো কিছু বেশিই কাজ করেছেন ধর্মতত্ত্ব (থিয়োলজি) এবং অপরসায়ন (অ্যালকেমি) নিয়ে। হ্যাঁ, যিনি আমাদের ইন্টিগ্রাল ক্যালকুলাস চিনিয়েছেন, প্রিজ়মের সাহায্যে সাদা আলোকে সাত রঙে ভেঙেছেন, টেলিস্কোপের উন্নতি করেছেন, তাঁর নোটবই বলছে তিনিই সিসা থেকে সোনা তৈরির চেষ্টায় আর ‘শেষের সে দিন ভয়ঙ্কর’ নিয়ে জীবনের অনেকখানি সময় কাটিয়েছেন। এই পাণ্ডুলিপি আবিষ্কার হওয়ার পর বিজ্ঞানসমাজ এতই হতাশ হয়েছিল যে, ধর্মতত্ত্ব ও অপরসায়ন নিয়ে তাঁর যাবতীয় কাজ কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় তাদের হেফাজতে রাখতে পর্যন্ত চায়নি। অনেক টালবাহানার পর ১৯৩৬ সালে নিউটনের নিজের হাতে লেখা সেই সব কাগজপত্র মাত্র ৯০০০ পাউন্ডে নিলাম হয়ে বিভিন্ন গ্রন্থাগার ও ব্যক্তিগত মালিকানায় চলে যায়। তবে পরে তার অনেকটা অংশই উদ্ধার করা গেছে।

জীবিতকালে আইজ়্যাক নিউটন তাঁর যে রূপটি মানুষের অগোচরে রেখেছিলেন, তাঁর নোটবই অবশেষে তা প্রকাশ করল। তত দিনে বিজ্ঞানীদের এই অপবিজ্ঞান চর্চাকে অস্পৃশ্য করে না রেখে তাঁদের একনিষ্ঠ পরিশ্রম (যদিও বিফল), পরীক্ষাপদ্ধতি, তথ্যসংগ্রহ, সাঙ্কেতিক ভাষার ব্যবহার ইত্যাদিকেও এক ধরনের স্বীকৃতি দেওয়া শুরু হয়েছে। নিউটনের এই অন্য রকম কাজকর্মের মধ্য থেকেও অনেক আশ্চর্য বিষয় খুঁজে পাওয়া গেল।

যেমন একেবারে সাম্প্রতিক কালে উদ্ধার হয়েছে নিউটনের নিজের হাতে লেখা একটি নোট, যেখানে তিনি অন্য এক জনের লেখা থেকে টুকে নিচ্ছেন ‘(ফিলো)সফিক মার্কারি’ তৈরির পদ্ধতি। সফিক মার্কারি হল সেই বস্তু, যা যে কোনও ধাতুকে তার মৌলিক উপাদানে ভেঙে ফেলতে পারে। অতঃপর এই উপাদানগুলো ইচ্ছেমতো জোড়া দিয়ে পছন্দমতো ধাতু (অবশ্যই সোনা) তৈরি করা যাবে। তবে সে জন্য ওই সফিক মার্কারি থেকেই তৈরি করতে হবে পরশপাথর বা ফিলসফার্স স্টোন। সেটা তৈরির জন্য তাঁর নিজের উদ্ভাবিত পদ্ধতি, অর্থাৎ সিসার আকরিকের ঊর্ধ্বপাতনের বর্ণনা আছে ওই কাগজের উল্টো পিঠে। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে যখন পদার্থের মৌলিক গঠন অনেকটাই জানা, তখন এই সব ধারণা আমাদের কাছে আজগুবি মনে হয়। কিন্তু তিনশো বছর আগে যখন অণু-পরমাণুর কথাও জানা ছিল না, তখনকার প্রেক্ষাপটে ভাবলে ব্যাপারটা তেমন মনে হবে না। সেই সময়ে নিউটন-সহ অপরসায়নবিদরা যে কোনও পদার্থকে তার মৌলিক উপাদানে ভাঙার কথা ভাবতে পেরেছিলেন, এও নেহাত এলেবেলে কথা নয়! আর যতই আমরা নিউটনের বিজ্ঞানী সত্তা আর অপবিজ্ঞানী সত্তাকে আলাদা ভাবে মূল্যায়ন করি, আসলে তো তারা একই মানুষ। তাই অ্যালকেমির চর্চা যে নিউটনের বিজ্ঞানচর্চাকে (এবং উল্টোটাও) প্রভাবিত করেনি এমন ভাবা ঠিক নয়। বিশেষ করে সাদা আলোকে সাত রঙে ভেঙে ফেলা, আবার মিলিয়ে দেওয়ার ধারণা অনেকটাই যে কোনও ধাতু থেকে সোনা তৈরির ধারণার সঙ্গে মেলে। সুতরাং, এমনও হতে পারে, নিউটন অ্যালকেমিস্ট না হলে তাঁর প্রতিভার এমন বিচিত্র বিচ্ছুরণ হয়তো সম্ভবই হত না!

বিজ্ঞানের ছাত্র হাতে-কলমে প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস করতে গিয়ে যা ফলাফল পায়, তা প্রথমে লেখে রাফ খাতায়। সেখান থেকে পরিষ্কার বা ফেয়ার করে লিখে জমা দেওয়া হয় প্র্যাকটিক্যাল খাতা। প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষার শেষে অভিজ্ঞ শিক্ষক কিন্তু ওই বাঁকাচোরা হরফে লেখা, নানা রকম ছোপ লাগা রাফ খাতাটিই দেখতে চান, কারণ ওখানেই পাওয়া যাবে সত্যিকারের ‘ডেটা’ কিংবা ‘রিডিং’। এই ছাত্রই বড় হয়ে যখন বিজ্ঞানী হয়, তার গবেষণার রেখাচিত্র, রোজকার হিসেব-নিকেশ লেখা থাকে তার নোটবইয়ে, যেখান থেকে ডেটা নিয়ে গবেষণাপত্র লেখা হয়। বিজ্ঞানীর সেই রাফ খাতাটি সচরাচর বাইরে আসে না। নিউটনের বিজ্ঞানচর্চা ছিল তাঁর একার সাধনা, তাই তাঁর নোটবই থেকে তিনি ইচ্ছেমাফিক কিছুটা প্রকাশ করেছেন বা গোপন করেছেন। কিন্তু যে সব বিজ্ঞানী ছাত্রদের সঙ্গে সম্মিলিত হয়ে কাজ করেন, তাঁদের ক্ষেত্রে নিজের দলের কিছু গোপনীয়তা বজায় রাখাটা অবশ্যকর্তব্য। কারণ গবেষণা একটি তীব্র প্রতিযোগিতামূলক বিষয় এবং কোনও একটি আবিষ্কার কে আগে করেছেন, তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে। এমনকি কোনও আবিষ্কারের পেটেন্ট নিতে গেলেও অনেক সময় শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞানীর ল্যাবনোটবুকের তারিখ দেখে ঠিক হয়, কে আগে আবিষ্কার করেছে। তাই নোটবইয়ের গোপনীয়তা গবেষণাবৃত্তে অতি পরিচিত বিষয়। কিন্তু এই বিষয়টা বাড়াবাড়ির পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন ফরাসি বিজ্ঞানী লুই পাস্তুর (১৮২২-১৮৯৫)। নিজের নোটবইয়ে খুঁটিনাটি সমস্ত তথ্য তিনি লিখে রাখতেন, কিন্তু ঘনিষ্ঠতম ছাত্রকেও সেই খাতার ধারেকাছে ঘেঁষতে দিতেন না। তাঁর মৃত্যুর অনেক বছর পর তাঁর নোটবইয়ের বিশাল সম্ভার (১০২টি বই, মোট ১০,০০০ এরও বেশি পাতা) সরকারি দফতরে স্থান পেল। তখন বিজ্ঞানের ইতিহাস নিয়ে প্রিন্সটন বিশ্ববদ্যালয়ে গবেষণা করতেন গেরাল্ড গেইসন। দীর্ঘ ১২ বছর এই নোটবইয়ের সমুদ্রে ডুবে থেকে গেইসন খুঁজে পেলেন বহু মণিমুক্তো।

বর্তমান সময়ে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হল টিকা। যে কোনও টিকা প্রয়োগের আগে কী কী পর্যায়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয় তার মোটামুটি একটা ধারণা এখন আমাদের সকলের হয়ে গেছে। লুই পাস্তুরের দু’টি যুগান্তকারী আবিষ্কার হল ভেড়ার অ্যানথ্রাক্স আর মানুষের জলাতঙ্ক রোগের টিকা। পাস্তুরের উদ্যোগে সেই প্রথম এই দুই টিকার প্রতিষেধক প্রয়োগের ফলাফল মুক্তমঞ্চে জনগণের সামনে দেখানো হয়েছিল। প্রথমে অ্যানথ্রাক্সের টিকা (১৮৮১)। দু’দল ভেড়াকে অ্যানথ্রাক্স জীবাণু ইঞ্জেকশন দেওয়া হল। টিকা পেয়েছে এমন ভেড়াগুলো বেঁচে রইল, আর যারা টিকা পায়নি তারা মারা গেল। এ ক্ষেত্রে পাস্তুর দাবি করেছিলেন যে, তিনি প্রতিষেধকটা তৈরি করেছেন বাতাসে রেখে। সেই পদ্ধতি সমকালীন বিজ্ঞানী চার্লস চেম্বারল্যান্ডের চেয়ে উন্নত, কারণ দ্বিতীয় জন সেটা তৈরি করেছিলেন পটাশিয়াম ডাইক্রোমেটের উপস্থিতিতে। কিন্তু পাস্তুরের নোটবই জানাচ্ছে, উনি তখনও পর্যন্ত বাতাসে রেখে টিকাটা তৈরি করতে পারেননি। আসলে উনি চেম্বারল্যান্ডের পদ্ধতিই অনুসরণ করেছিলেন। কিন্তু সে কথা কাউকে জানতে দেননি। কয়েক মাসের মধ্যেই অবশ্য পাস্তুর বাতাসের উপস্থিতিতেই টিকা বানাতে পেরেছিলেন, সে কথাও নোটবইয়ে উল্লেখ করা আছে।

জলাতঙ্কের টিকার ক্ষেত্রে বিষয়টা আরও জটিল। পাস্তুর দাবি করেছিলেন যে, তাঁর আবিষ্কৃত টিকা কুকুর এবং মানুষ উভয়কেই সংক্রমণ থেকে রক্ষা করবে। কথাটা যে মিথ্যে ছিল না, সেটা আমরা হাড়ে হাড়ে জানি। কারণ, সেই পদ্ধতিই দীর্ঘ দিন অনুসরণ করা হয়েছে কুকুরে কামড়ানোর পর জলাতঙ্ক প্রতিহত করতে। কিন্তু টিকার ‘ট্রায়াল’ এবং কার্যকারিতা বিষয়ে পাস্তুর সর্বসমক্ষে যা দাবি করেছিলেন (৬ জুলাই ১৮৮৫), অর্থাৎ যতগুলো কুকুরের ওপর পরীক্ষা হয়েছে এবং তার যা ফলাফল পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছিলেন, তার সব কিছু তখনও পর্যন্ত সত্যি ছিল না। এমনকি জোসেফ মেইস্টার নামে যে আহত ছেলেটিকে প্রথম টিকা দেওয়া হয়েছিল, তার আদৌ সংক্রমণের আশঙ্কা ছিল কি না, তাও স্পষ্ট নয়। সুতরাং যাঁর নামে এখনও প্রতিদিন সকালে আমাদের দুধের পাউচ সংক্রমণমুক্ত করা হয়, মুক্তমঞ্চে তিনি যে জনগণকে কিছুটা বিভ্রান্ত করেছিলেন, এ কথা জানাল তাঁর নোটবই। সে কথা পাস্তুর নিজেও জানতেন খুব ভালো করে, তাই এই পরীক্ষার তথ্য তিনি কোথাও প্রকাশ করেননি। কিন্তু শুধু সকলের আগে থাকার প্রবল উচ্চাশায় তিনি এই প্রতারণাটুকুর আশ্রয় নিয়েছিলেন।

নোটবই কাণ্ডে আর একটি নাম বিজ্ঞানী রবার্ট মিলিকান (১৮৬৮-১৯৫৩)। বিশ্ববিখ্যাত তৈলবিন্দু পতনের পরীক্ষায় তিনি ইলেকট্রনের আধান (১.৬০২২ × ১০-১৯ কুলম্ব) নির্ণয় করেছিলেন। অত্যন্ত জটিল এই পরীক্ষায় সমান্তরাল ধাতব পাতের মধ্যবর্তী অঞ্চলে পতনশীল তৈলবিন্দুর গতিবিধির হিসেব রাখতে হয়েছিল। ‘ফিজ়িক্যাল রিভিউ’ জার্নালে প্রকাশিত তাঁর গবেষণাপত্রে (১৯১৩) মিলিকান টানা দু’মাস ধরে গবেষণা চালিয়ে ৫৮টি তৈলবিন্দুর তথ্য প্রকাশ করে জানিয়েছিলেন, মোটের ওপর সমস্ত তৈলবিন্দুই একই রকম আচরণ করে। খুব তাড়াতাড়ি তাঁর এই কাজ নোবেল পুরস্কার পেয়ে গেল (১৯২৩)। মিলিকান মারা যাওয়ারও (১৯৫৩) অনেক দিন পর গেরাল্ড হলটন নামে এক জন পদার্থবিজ্ঞানী মিলিকানের সেই ‘রাফ খাতা’-র সন্ধান পান। দেখা গেল, ৬০ দিনের ওই দীর্ঘ পরীক্ষায় ওই ৫৮টি বিন্দুর বাইরে আরও অজস্র তৈলবিন্দুর তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছিল, যারা সবাই মিলিকানের দেওয়া ধারণা অনুযায়ী প্রত্যাশিত আচরণ করেনি। তাদের পত্রপাঠ বাদ দেওয়া হয়েছিল। নোটবইয়ে অন্তত ১৪০টি বিন্দুর ফলাফল পাওয়া যায়, যাদের পাশে পাশে মিলিকানের নিজের হাতে ‘দারুণ!’, ‘ঠিক যেমন চাই’, ‘ভুলভাল’, ‘বাদ দাও’, ‘মিলল না’, এই রকম সব মন্তব্য লেখা আছে। অর্থাৎ মিলিকান তাঁর সমস্ত তৈলবিন্দুর ডেটা থেকে ৫৮টা ভাল বিন্দুকে নির্বাচন করে সেই তথ্য প্রকাশ করেছিলেন এবং বাকি তথ্য সযত্নে গোপন করেছিলেন। না করলে তিনি তাঁর গবেষণাপত্র ঠিক সময়ে প্রকাশ করতে পারতেন কি না, সেটা একটা প্রশ্ন। এ ভাবেই প্রখর মেধা ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন বিজ্ঞানীর নোটবইয়ের ‘ব্যক্তিগত বিজ্ঞান’ তাঁর কিছুটা বিড়ম্বিত চেহারা প্রকাশ করে, যার কিছু উদাহরণ এখানে দেখতে পাওয়া গেল।

তবে এই সব বিচ্যুতি চাঁদের গায়ে কলঙ্কমাত্র। ইলেকট্রনের আধানও গত একশো বছরে বিশেষ বদলায়নি আর পাস্তুরের নির্দেশিত পদ্ধতিও শুধু জলাতঙ্ক নয়, পরবর্তী কালে অন্য অনেক জীবাণুবাহিত রোগের (যেমন ডিপথেরিয়া, যক্ষ্মা, প্লেগ ইত্যাদি) টিকা তৈরি করতে কাজে লেগেছে। বিজ্ঞানী তাঁর কাজের প্রতি সৎ থাকলে নোটবইয়ে ধরা পড়া সামান্য বিচ্যুতি সারা জীবনের কাজকে বিশেষ প্রভাবিত করতে পারে না। আর বিজ্ঞানী অন্তত তাঁর নোটবইয়ের কাছে সৎ না থাকলে তো এই সব কথা কোনও দিন জানাই যেত না!

হাতে লেখা চিঠি যেমন প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে, তেমনই বিজ্ঞানীদের হাতে লেখা নোটবইও হয়তো ধীরে ধীরে বিরল হয়ে আসছে। এখন সফ্‌ট কপি-র যুগে সবই হয়তো ডক ফাইল বা এক্সেল শিট হিসেবে থাকে, যেখানে কাটাকুটি নেই, হাতের লেখা নেই। তার সুবিধে অনেক, কিন্তু সবচেয়ে বড় সুবিধে হল— সংশোধন সেখানে কোনও চিহ্ন ফেলে রাখে না! এই পদ্ধতির উদাহরণও পাওয়া গেছে হাতে হাতে। গত শতকের শেষের দিকে বেল ল্যাবরেটরিতে কাজ করতেন তরুণ বিজ্ঞানী জাঁ হেনড্রিকসন। কনডেন্সড ম্যাটার, ন্যানোটেক্‌নোলজি-সহ তিন-চারটে বিষয়ে এক সঙ্গে কাজ করতেন আর হইহই করে গবেষণাপত্র প্রকাশ করতেন ‘নেচার’, ‘সায়েন্স’ ‘ফিজ়িক্যাল রিভিউ’-এর মতো শীর্ষস্থানীয় জার্নালে। তার পর এক দিন কাজে ও কথায় অমিল ধরা পড়ল, নানা দিক থেকে অভিযোগ পেয়ে হেনড্রিকসনকে তলব করা হল। আত্মপক্ষ সমর্থনে তাঁকে তাঁর নোটবই (মানে আসল ডেটা) দেখাতে বলা হল। কিন্তু হেনড্রিকসন তো কোনও নোটবই রাখেননি! সব পেপারের ডেটা নাকি শুধু কম্পিউটারেই ছিল, কাজ মিটে যাওয়ার পর হার্ড ডিস্ক খালি করার জন্য সব ‘ডিলিট’ করে দেওয়া হয়েছে। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই হেনড্রিকসনের কাজ বা কথা বিশ্বাস করার কোনও উপায় থাকল না, অবিলম্বে তিনি বিজ্ঞান-জগৎ থেকেই বিতাড়িত হলেন। সুকুমার রায় শুনলে নিশ্চয়ই মুচকি হেসে বলতেন, ‘কী করে বলবে বল, তোমরা যে নোটবই লেখোনি!’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement