কর্ণধার: গিরিশচন্দ্র ঘোষ। রঙ্গালয়ের প্রাথমিক প্রসারে তাঁর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। ডান দিকে, শিশিরকুমার ভাদুড়ী। তাঁর হাতে বদলায় নাট্যচর্চার অভিমুখ
তৎকালীন কলকাতার চিৎপুরে ‘ঘড়িওয়ালা বাড়ি’ নামে বিখ্যাত ছিল মধুসূদন সান্যালের বাড়ি। সে বাড়ির উঠোন মাসিক চল্লিশ টাকায় ভাড়া নিয়ে শুরু হয় ‘ন্যাশনাল থিয়েটার’। তাদের উদ্যোগেই দেড়শো বছর আগে ১৮৭২ সালের ৭ ডিসেম্বর, দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ নাটক অভিনয় এবং টিকিট কেটে থিয়েটার দেখার প্রচলন শুরু, সেটাই সাধারণ রঙ্গালয়ের সূচনাক্ষণ বলে চিহ্নিত নাট্যশালার ইতিহাসে। এর প্রভাব প্রবল ভাবে পড়ে পরবর্তী শতকের বাঙালির সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিবর্তনে। যাত্রা, পাঁচালি, কবিগান, হাফ-আখড়াইতে অভ্যস্ত বাঙালি ইংরেজি শিক্ষার প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে ইউরোপীয় বিনোদনের অভাব অনুভব করতে শুরু করে। গতানুগতিক দেশীয় আমোদ তখন তাদের কাছে অনেকটাই রুচিহীন মনে হয়।
এই নব্য ইংরেজি-শিক্ষিতদের জন্য প্রয়োজন হল ইংরেজি ধাঁচের বিনোদন, যাতে ইন্ধন জোগাল ১৮১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হিন্দু কলেজের ছাত্ররা। এর আগে প্রায় আশি বছর, ১৮৯৫ সালের রুশদেশবাসী লেবেদেফের বাংলা নাট্যশালা তৈরির প্রয়াসের সময় থেকে, ধনী বা অভিজাত বাঙালিরা বাংলা নাটক অভিনয়ের জন্য নাট্যশালা প্রবর্তনের কম চেষ্টা করেননি। কিন্তু সেই সব উদ্যোগ ছিল ধনী বা অভিজাত কারও ব্যক্তিগত আগ্রহের সুফল। তাঁদের মৃত্যু বা আগ্রহ হারিয়ে ফেলার সঙ্গে সঙ্গে সেই প্রচেষ্টার অবলুপ্তি ঘটে। সাধারণের জন্যও এ সব নাট্যশালা উন্মুক্ত ছিল না, আমন্ত্রিতরাই আসতে পারতেন। আমন্ত্রিতদের বেশির ভাগই ছিলেন উচ্চপদস্থ ইংরেজ অথবা অভিজাত বাঙালি। যাঁরা নাট্যশালা প্রতিষ্ঠা করতেন, তাঁদের নাট্যপ্রীতি ছাড়াও কাজ করত ইংরেজদের সঙ্গে সম্প্রীতি গড়ে তোলার আগ্রহ। বাবু সম্প্রদায়ের কাছে নাট্যশালা প্রবর্তন হয়ে উঠেছিল ‘স্টেটাস সিম্বল’ও। শোনা যায়, ১৮৫৮ সালে পাইকপাড়ার রাজা প্রতাপচন্দ্র সিংহ আর তাঁর ভাই ঈশ্বরচন্দ্র সিংহ বেলগাছিয়া নাট্যশালা প্রবর্তন করে ‘রত্নাবলী’ নাটক প্রযোজনায় দশ হাজার টাকা খরচ করেছিলেন। ইংরেজদের জন্য এই নাটক তাঁরা ইংরেজিতে অনুবাদও করিয়েছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্তকে দিয়ে। এই নাটকের প্রযোজনা দেখে মাইকেল নাটকে আগ্রহী হন, লেখেন ‘শর্মিষ্ঠা’।
ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগের একটু আগে থেকে গড়ে ওঠা এই নাট্য-সংস্কৃতি, রাজা-রাজড়া জমিদার থেকে ক্রমশ অবস্থাপন্ন গৃহস্থকেও আগ্রহী করেছিল। তখন উত্তর কলকাতার বাগবাজার অঞ্চলের জনা কয়েক যুবকের উদ্যোগের ফলশ্রুতি ‘বাগবাজার এ্যামেচার থিয়েটার’, পরে এর নাম হয় ‘শ্যামবাজার নাট্যসমাজ’। এই যুবকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, গিরিশচন্দ্র ঘোষ, রাধামাধব কর আর অর্ধেন্দুশেখর মুস্তফী। এঁদের হাত দিয়েই সাধারণ রঙ্গালয়ের সূচনা।
নিজেদের তেমন আর্থিক বাহুল্য নেই, তাই প্রযোজনায় খরচ কম এমন যে নাটক তাঁরা প্রথমে বেছে নিয়েছিলেন তা হল দীনবন্ধু মিত্রের ‘সধবার একাদশী’। এর চতুর্থ অভিনয়ে দীনবন্ধু মিত্র নিজে দর্শক ছিলেন। এর পর তাঁরা বাছেন দীনবন্ধু মিত্রের ‘লীলাবতী’। চাঁদা তুলে এই নাটক প্রযোজিত হয়। এর সুখ্যাতি এত বিস্তৃত হয়েছিল যে, অনেককে ফিরে যেতে হয়েছিল।
‘লীলাবতী’র সাফল্যেই নগেন্দ্রনাথের মনে টিকিট বিক্রি করে সাধারণ রঙ্গালয় প্রতিষ্ঠার কথা মাথায় আসে, যেখানে সাধারণ মানুষজন নাটক দেখতে আসতে পারবেন। অবশ্য এর আগে আহিরীটোলার রাধামাধব হালদার ও যোগীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় ‘দ্য ক্যালকাটা পাবলিক থিয়েটার’ নামে সর্বসাধারণের জন্য একটা নাট্যশালা খোলার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু তা ফলপ্রসূ হয়নি।
শ্যামবাজার নাট্যসমাজ-এর যুবকদের কেউই কিন্তু থিয়েটারের টিকিট বিক্রি করে অভিনয়ের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহের কথা ভাবেননি। থিয়েটার প্রযোজনার জন্য তখন আয়না থেকে চিরুনি সবই কিনতে হত। প্রযোজনার ব্যয়ভারের জোগান হত চাঁদা তুলে। বার বার চাঁদা চাইতে গেলে পাড়া-প্রতিবেশী বিরক্ত হতেন। যে হেতু নাটকে অভিনেতাদের মাইনে দেওয়ার ব্যাপার নেই, টিকিট বিক্রির টাকায় অন্তত প্রযোজনার খরচটা মেটানো যাবে আর টিকিটমূল্যের পরিবর্তে আগ্রহী যে কেউ এসে থিয়েটার দেখতে পারবেন, চাঁদা চাইতে গিয়ে কারও বিরক্তির মুখে পড়তে হবে না— এই ভাবনা থেকেই টিকিট বিক্রির সূচনা।
অথচ শুরুটা বিশেষ মসৃণ হয়নি। টিকিট বিক্রি করে থিয়েটার করার জন্য নির্বাচিত হল দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’। দলের নামকরণ প্রস্তাবিত হল ‘ন্যাশনাল থিয়েটার’। আর এখানেই আপত্তি জানালেন চার বন্ধুর এক জন, গিরিশচন্দ্র ঘোষ। তাঁর বক্তব্য ছিল, “ন্যাশনাল থিয়েটার নাম দিয়া, ন্যাশনাল থিয়েটারের উপযুক্ত সাজ-সরঞ্জাম ব্যতীত, সাধারণের সম্মুখে টিকিট বিক্রয় করিয়া অভিনয় করা আমার অমত ছিল। কারণ একেই তো তখন বাঙালির নাম শুনিয়া ভিন্ন জাতি মুখ বাঁকাইয়া যায়, এরূপ দৈন্য অবস্থার ন্যাশনাল থিয়েটার দেখিলে কি না বলিবে— এই আমার আপত্তি।” কিন্তু সেই আপত্তি বাকিরা শোনেননি। তাঁদের মত ছিল যেমন সামর্থ্য, তেমনই আয়োজন হবে। ফলে গিরিশচন্দ্রের দলত্যাগ, আর তাঁকে বাদ দিয়েই সাধারণ রঙ্গালয়ের সূচনা। টিকিটের মূল্য অনুযায়ী দর্শকাসন ভাগ করা হয়েছিল তিনটে শ্রেণিতে— সবচেয়ে কম দামের টিকিটের দর্শক নাটক দেখবেন রোয়াকে বসে!
‘নীলদর্পণ’-এর প্রযোজনা আর অভিনয়ের প্রশংসা তখন সব সংবাদপত্রেই প্রকাশ পেয়েছিল। ‘ইন্ডিয়ান মিরর’ পত্রিকায় ১৮৭২-এরই ১৯ ও ২৭ ডিসেম্বর ‘নীলদর্পণ’ প্রযোজনা সম্পর্কে দুটো চিঠি বেনামে প্রকাশিত হয় যা আগাগোড়াই বিদ্রুপ আর নিন্দায় ভরা। বেনাম অর্থে একটির প্রেরকের জায়গায় স্বাক্ষর ছিল ‘আ ফাদার’, অন্যটিতে ‘আ স্পেকটেটর’— কারও নাম ছিল না। মনে করা হয়, এই দুটো চিঠিরই প্রেরক গিরিশচন্দ্র।
‘নীলদর্পণ’ নাটকের দুটো অভিনয় হয়েছিল। প্রথম ও দ্বিতীয় বার অভিনয়ের মধ্যে ‘জামাই বারিক’ নাটকের অভিনয় হয়। এ ছাড়া ‘সধবার একাদশী’, ‘নবীন তপস্বিনী’, ‘লীলাবতী’, ‘বিয়ে পাগলা বুড়ো’ নাটকের অভিনয় হয়। ন্যাশনাল থিয়েটারের সাফল্যের পর গিরিশচন্দ্র পুনরায় দলে ফিরে আসেন, মাইকেলের ‘কৃষ্ণকুমারী’ নাটকে তাঁর প্রত্যাবর্তন ঘটে। যদিও নাটকের বিজ্ঞাপনে তাঁর নাম গোপন রাখা হয়েছিল।
এই যে সাধারণ রঙ্গালয়ের সূচনা, এর প্রথম পর্বের স্থায়িত্ব ছিল মাত্র ছ’মাস। ১৮৭৩-এর ৮ মার্চ মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ’ আর রামনারায়ণ তর্করত্নের ‘যেমন কর্ম তেমন ফল’ এই দুটো নাটকের অভিনয় দিয়ে প্রথম পর্ব শেষ হয়। এর কারণ বর্ষা এসে পড়ায় সান্যালবাড়ির প্রাঙ্গণে জল ঢোকার জন্য অভিনয় করা বন্ধ করে দিতে হয়।
এর পর পরই কৃষ্ণচন্দ্র দেবের বাড়িতে ‘ওরিয়েন্টাল থিয়েটার’ নাম দিয়ে কয়েকটি নাটক অভিনীত হয়। এই সময় কলকাতার বিখ্যাত ছাতুবাবুর (আশুতোষ দেব) দৌহিত্র শরৎচন্দ্র ঘোষ, অনেক বিশিষ্টজনকে নিয়ে একটা কমিটি তৈরি করে ‘বেঙ্গল থিয়েটার’ নাম দিয়ে একটা নাট্যালয় স্থাপন করেন। এই বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে বিদ্যাসাগর, মাইকেলও ছিলেন। এই প্রথম সাধারণ রঙ্গালয় নিজস্ব নাট্যগৃহ পেল। ১৮৭৩ সালের অগস্টে মাইকেলের ‘শর্মিষ্ঠা’ নাটক অভিনয় দিয়ে বেঙ্গল থিয়েটারের সূচনা। নানা কারণে সাধারণ রঙ্গালয়ের ইতিহাসে বেঙ্গল থিয়েটার গুরুত্বপূর্ণ। এখানেই প্রথম মহিলা চরিত্রে মেয়েদের দিয়ে অভিনয় করানো হয়। ‘দুর্গেশনন্দিনী’ নাটকে জগৎ সিংহের ভূমিকায় শরৎচন্দ্র ঘোষ ঘোড়ায় চেপে মঞ্চে উপস্থিত হতেন। ১৯০১ সাল অবধি বেঙ্গল থিয়েটার টিকে ছিল।
অন্যের বাড়ি বা প্রাঙ্গণ ভাড়া নিয়ে থিয়েটার করার যে অনিশ্চয়তা, পরিবর্তে নিজেরা নাট্যশালা বানাতে পারলে তার স্থায়িত্ব হয়তো বেশি, এমন ধারণা থেকে আর বেঙ্গল থিয়েটারকে দেখে উদ্দীপ্ত হয়ে ধর্মদাস সুর, এখন যেখানে মিনার্ভা থিয়েটার সেখানে গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার নাম দিয়ে নাট্যশালা গড়ে তুলতে উদ্যোগী হন। প্রথম অভিনয়ের রাতে থিয়েটারে আগুন লাগলেও আরও বছর চারেক এই থিয়েটার চলে। এই থিয়েটারেই ইংরেজদের ব্যঙ্গ করে নাটক প্রযোজনা হয়, যার ফলে তৈরি হয় ‘ড্রামাটিক পারফরম্যান্স কন্ট্রোল বিল’, যা পরে ‘অ্যাক্ট অব ১৮৭৬’ নামে আইন হয়ে নাট্যশালার স্বাধীনতার খর্ব করে।
১৮৭৭ সাল নাগাদ গিরিশ ঘোষ গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার ইজারা নিলেন, আর তার পর থেকে তিন দশক বাংলা নাট্যশালার অধীশ্বর হয়ে ছিলেন তিনিই। তাঁর অভিনয়প্রতিভার পূর্ণ বিকাশও এই সময়। তিনি অভিনয়ের জন্য স্বনামে বেনামে নাটক লিখেছেন, নিজে অভিনয় করেছেন, অন্যদের দিয়ে অভিনয় করিয়েছেন, নাট্যশালা নির্মাণের জন্য নিজের অর্জিত অর্থ অনায়াসে দান করেছেন। কলকাতার বিখ্যাত ধনী গোপাললাল শীল ‘স্টার’-এর জমি কিনে নিয়ে ‘এমারেল্ড থিয়েটার’ স্থাপন করেন। গিরিশ ঘোষকে ম্যানেজার করে নিয়ে আসেন কুড়ি হাজার টাকা বোনাস আর মাসিক তিনশো টাকা মাইনেতে। এই টাকার ষোলো হাজার টাকা গিরিশচন্দ্র স্টারের সত্ত্বাধিকারীদের দিয়ে দেন নতুন নাট্যশালা নির্মাণের জন্য। গিরিশ ঘোষের সঙ্গে গোপাল শীলদের শর্ত ছিল, আর কোথাও নাটক দিতে পারবেন না। সেই শর্ত এড়ানোর জন্য বেনামে নাটক লিখতে শুরু করেন গিরিশ, যা ‘স্টার’-এ অভিনীত হতে থাকে। সাধারণ রঙ্গালয়ের প্রসার আর উন্নতির প্রকল্পে গিরিশ ঘোষের অবদানের মতো কোনও দ্বিতীয় উদাহরণ আর হয়নি। এই সময়টা নাট্যশালার ইতিহাসে ‘গিরিশ যুগ’ বলে চিহ্নিত।
আসলে প্রথম জীবনে বুককিপারের চাকরি গিরিশ ঘোষকে দিয়েছিল বাস্তববাদী ও ব্যবসায়িক বুদ্ধি। সাধারণ রঙ্গালয় শুরুর সময় কাজ করেছিল বাবু-সংস্কৃতির অহঙ্কারের বিরুদ্ধে মধ্যবিত্ত সংস্কৃতির আত্মপ্রতিষ্ঠার আদর্শ। কিন্তু শুধু আদর্শ দিয়ে পেশাদার থিয়েটার চলে না, তার জন্য চাই ব্যবসায়িক বুদ্ধি আর ব্যবস্থাপনা, যা গিরিশ ঘোষের ছিল। সেই প্রয়োজনীয় বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গির কাছে হারিয়ে যায় অন্য আদর্শ। সাধারণ থিয়েটার পেশাদারি হয়ে ওঠার বদলে হয়ে যায় ব্যবসায়িক থিয়েটার। অনেক অবস্থাপন্ন বড়লোক বাড়ির ছেলে থিয়েটারে আসেন যেখানে অভিনয়ের চেয়েও প্রাধান্য পেতে থাকে নানা স্থূল গিমিক। একাধিক নাট্যশালা গজিয়ে উঠতে থাকে যাদের আয়ু হত নেহাতই সংক্ষিপ্ত। থিয়েটার লাভজনক ব্যবসা ভেবে অনেক অবাঙালিও এতে লগ্নি করতে আগ্রহী হন, গিরিশ ঘোষের প্রশ্রয়ও পান। যদিও ব্যবসার বাইরে এই লগ্নিকারীদের বিশেষ আকর্ষণ ছিল, সহজে সুন্দরী অভিনেত্রীদের সান্নিধ্য লাভ। সাধারণ রঙ্গালয়ের প্রতিষ্ঠার দিকে নজর দিতে গিয়ে থিয়েটারের অন্যান্য সূক্ষ্ম দিকে নজর দেওয়ার সুযোগ তিনি পাননি। সেই সময় নাটক হত দীর্ঘ, সারা রাত্রি অভিনয় হত। নাটকে অনেক নাচ আর গান, দর্শকের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য জমকালো পোশাক ব্যবহৃত হত সামঞ্জস্য ছাড়াই। দর্শককে আকর্ষণ করতে, ব্যবসায়িক চাহিদা মেটাতে এই ধাঁচ মেনে নিতে হয়েছিল গিরিশ ঘোষকে। পরে শিশিরকুমার ভাদুড়ী এসে বাংলা থিয়েটারের অভিমুখকে অন্য ধারায় নিয়ে গেলেন। থিয়েটারে এল একটা শিক্ষার আবহাওয়া, সার্বিক সমন্বয়।
শিশিরকুমারের সঙ্গে সঙ্গে আরও কিছু শিক্ষিত ব্যক্তিত্ব যেমন রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় সরাসরি ভাবে না হলেও যুক্ত হলেন থিয়েটারের সঙ্গে। যে থিয়েটার ছিল মধ্যবিত্ত সমাজের চোখে বিপথে যাওয়ার রাস্তা, শিশিরকুমার তাকে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজের কাছে গ্রহণযোগ্য করলেন। শিশিরকুমারের আকর্ষণে মঞ্চে এলেন কঙ্কাবতী সাহু, মঞ্চে প্রথম শিক্ষিত গ্র্যাজুয়েট মহিলা, যা ভবিষ্যতে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েদের থিয়েটারে যোগদানের পথ প্রশস্ত করে। আজকের যে থিয়েটার মডেলটা আমরা দেখি তা অনেকটাই শিশিরকুমারের অবদান। সাধারণ রঙ্গালয়ের জনক ও কৈশোর-উত্তীর্ণ সময় অবধি অভিভাবক যদি গিরিশ ঘোষ হন, তা হলে তার যৌবনের সারথি অবশ্যই শিশিরকুমার, যিনি রঙ্গালয়কে দিয়েছিলেন সামাজিক কৌলীন্য। তাঁর সময়টা ‘শিশির যুগ’ বলেই অভিহিত।
সাধারণ রঙ্গালয়ে গিরিশ ঘোষ বা শিশিরকুমারের সঙ্গে আরও অন্যরা প্রয়াসী না হলে এর ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটত না। ১৮৮৪ সালে ‘স্টার’ থিয়েটারে বিনোদিনী অভিনীত ‘চৈতন্যলীলা’ অভিনয় দেখতে রামকৃষ্ণদেবের প্রথম নাট্যশালায় আসাও সাধারণ রঙ্গালয়ের সামাজিক স্বীকৃতির জায়গায় এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।
শিশিরকুমার সাধারণ রঙ্গালয় ছেড়ে দেন, বা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন ১৯৫৬ সালে। বাড়ি ভাড়া দিতে পারছিলেন না। তত দিনে গণনাট্য সঙ্ঘ এসে গিয়েছে, শম্ভু মিত্র, বিজন ভট্টাচার্য প্রমুখ এসে গিয়েছেন, সাধারণ রঙ্গালয়ের অভিমুখ এঁদের হাত ধরে গড়াল অন্য পথে। শিশিরকুমারের সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ রঙ্গালয়ের গৌরবের দিন শেষ হলেও আরও প্রায় দু’দশক তা টিকে ছিল। মহেন্দ্র গুপ্ত শেষ অবধি স্টার থিয়েটারে অভিনয় করে গেছেন, উত্তমকুমার অভিনীত ‘শ্যামলী’ নাটকও হইহই করে বহু দিন চলেছে। সারকারিনা বা কাশী বিশ্বনাথ মঞ্চ অথবা রঙমহল বা অসীম চক্রবর্তীরা চেষ্টা করেছেন সাধারণ রঙ্গালয়কে বাঁচিয়ে রাখতে, নিয়ে এসেছেন নানা আকর্ষক উপকরণ, কিন্তু মূলত আর্থিক সমস্যার জন্য তা স্থায়ী হয়নি। উৎপল দত্ত বা অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়রাও কিছু দিনের জন্য চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে তা চলেনি।
দেড়শো বছর পেরিয়ে সাধারণ রঙ্গালয় তাই এখন স্মৃতিমাত্র।a