ছবি: সুব্রত চৌধুরী
এই রকম একটা ক্লিশে দিয়েই শুরু করা যাক— ‘ডন কো পকড়না মুশকিল হি নহি, নামুমকিন হ্যায়।’ সত্তরের দশকের এই হিট ডায়ালগটা আজকের প্রজন্মের কাছে খুব অপরিচিত ঠেকত হয়তো, যদি না কিং খান ‘ডন’ ছবির রিমেকটি না করতেন। সুতরাং দুই ডন, অমিতাভ বচ্চন এবং শাহরুখ খানকে যখন পেয়েই গিয়েছি, তাঁদের ধরেই এন্ট্রি নিলাম মঞ্চে। এ বার আলো-টালো জ্বালিয়ে, ‘মুখে রঙ মেখে, চক্রবেড় ধুতি পরে, লাল-নীল জোড়া আর ছত্রি পরে’ গান-টান গেয়ে ডনের কথা বলব। তবে এই ডন সেই ডন নয় যার জন্যে শুধু ‘গয়ারা মুলুক’-এর পুলিশ নাকানিচোবানি খাচ্ছে।
আমাদের এই ডন বোধহয় পৃথিবীর ১৯৫টা দেশের বহু সাধারণ এবং অসাধারণ মানুষকে ভিরমি খাইয়েছে গত ৪০০ বছরের বেশি সময় ধরে তার বিকট এবং উদ্ভট কার্যকলাপে। ইংরেজি ভাষা তাঁকে ‘ডন’ বানালেও জন্মসূত্রের স্প্যানিশ ভাষায় তিনি অবশ্যই দন। দন কিহোতে। আর চার পাঁচ জন বাঙালির মতো আমিও ছোটবেলা থেকে জানতাম, লোকটার নাম ডন কুইকসোট! পরে জানলাম, ভুল জানতাম। তখন ঢুকেছি যাদবপুরের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগে। ঢুকেই বুঝলাম শুধু কুইকসোট কেন, এত দিন ধরে যা জেনে এসেছি, যা বুঝে এসেছি সবই ভুলে ভরা। আবার শুরু হল বিভাগীয় তাড়নায় নতুন পড়াশুনো— সমাজ, রাজনীতি, শিল্প-সাহিত্যের অনুষঙ্গে। জানলাম, চরিত্রটি যে বিশ্বকর্মার হাতে সৃষ্টি তিনি স্পেনীয় লেখক মিগুয়েল দ্য সেরভান্তেস (১৫৪৭-১৬১৬)। উপন্যাসের প্রকৃত নাম আরও খটোমটো… দ্য ইনজেনিয়াস নোবল ম্যান স্যর কিহোতে অব লা মানচা। মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ও শিবাজি বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো শিক্ষকেরা পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দিলেন, দনের অলীক সব ব্যাপারস্যাপার যুগ যুগ ধরে উসকে দিয়েছে অস্তিত্বের গভীর গোপন অভিসন্ধি, খুঁচিয়ে দিয়েছে লুকনো অন্তর্ঘাতী চেতনা, খুঁড়ে বার করেছে চাপা-পড়া পালটে দেওয়ার স্বপ্ন, ঠেলে দিয়েছে লড়াকু
অভিযানে, ভাবনায় ঘটিয়েছে বিপ্লবী বিস্ফোরণ, বা চিতিয়ে দিয়েছে গোঁয়ার্তুমির বিরোধাভাস। তবুও তাকে আটকে রাখা যায়নি মানুষের গড়ে তোলা সেই সব কারাগারে যেখানে চিন্তার শাসন হয়, ইতিহাসের বদল হয়, মুক্ত ভাবনাকে একঘরে করা হয়, ‘মগজে কারফিউ’ জারি করা হয়। এই দনকে ছোঁয়া যায় না বলেই ‘কী ভাবে বিস্ফোরণ ঘটবে এবং কে ঘটাবে সে সম্বন্ধে জানতে রাষ্ট্রযন্ত্রের এখনো বাকি আছে’।
সেরভান্তেসের উপন্যাস দু’ভাগে বিন্যস্ত। প্রথমটি প্রকাশিত হয় ১৬০৫ সালে এবং দ্বিতীয়টি ১৬১৫-তে। সেই প্রকাশকাল থেকে আজ পর্যন্ত এই উপন্যাস ঘিরে নানা পাঠ, নানা বিশ্লেষণ চলেই এসেছে। দনকে ঘিরে যে রহস্যের উদ্ভব হয়েছে, ৪০০ বছর ধরে ঘনীভূত হওয়ার পরেও তার কোনও একমুখী কিনারা করা যায়নি, এবং যাবেও না। কারণ মহৎ শিল্পের এটাই অন্যতম শর্ত। কিন্তু চার শতাব্দী ধরে দন কোন শৈল্পিক ঘূর্ণাবর্তে আমাদের নাকাল করল? কী সেই অতল ধন্ধ যা কালো গহ্বরের মতোই দুর্বোধ্য? আবার নতুন করে পাগলাটে লোকটার ফেরে পড়লাম পঁচিশ বছর বাদে বাংলা মঞ্চে অভিনয় করতে এসে। এই মাসের শেষেই করব এই ডনের চরিত্র। মূল নাটক ‘ম্যান অব লা মাঞ্চা’ যা এই উপন্যাস এবং তার স্রষ্টা সেরভান্তেসকে নিয়ে লেখা। বাংলা নাটকের নাম দেওয়া হয়েছে ‘ডন— তাকে ভালো লাগে’। কিন্তু প্রশ্ন হল, এ রকম একটা বেহাল, গোঁয়ারগেলে, পাগলাটে, স্বপ্নালু, সব অর্থে ‘ইমপ্র্যাকটিক্যাল’ মানুষকে এত ভাল-লাগার কী আছে?
তা হলে একটু ইতিহাস নেড়ে-ঘেঁটে দেখা যাক। হ্যারল্ড ব্লুম-এর মতো সাহিত্যতাত্ত্বিক তো বলেই দিলেন, ‘দন কিহোতে’ এমন এক বৈপ্লবিক উপন্যাস যা ধ্বংসতত্ত্ব এবং নৈরাজ্যবাদকে উসকে দেয় এবং এটি হল প্রথম আধুনিক ‘নভেল’। খুব সংক্ষেপে যদি বলা যায়, গল্পটা এক জন কল্পনাপ্রবণ সাধারণ গ্রাম্য মানুষকে নিয়ে যার নাম আলন্সো কিহানা। দিনের পর দিন মধ্যযুগীয় নাইটদের বীরত্বের কাহিনি পড়তে পড়তে ভাবতে শুরু করে দিলেন যে তিনি নিজেই এক জন নাইট, অর্থাৎ ন্যায়রক্ষাকারী যোদ্ধা। এক দিন বেরিয়েও পড়লেন ঘোড়া নিয়ে। নিজের নামকরণও করে ফেললেন— দন কিহোতে। আর বেতো ঘোড়াটার নাম দিলেন রসিনান্তে। জোগাড় করে নিলেন এক জন পার্শ্বচর বা সহকারীকেও। এক জন সাধারণ গৃহস্থ এবং অশিক্ষিত মানুষ। সেও বিশেষ কিছু না বুঝেই পথে নেমে পড়ল। তার নতুন নাম হল সানচো পানসা।
শুরু হয়ে গেল তাদের কাল্পনিক অভিযান, খামখেয়ালের পরিক্রমণ। সত্যিকারের জগতের কোনও কিছুই তাদের আর সত্যি বলে মনে হচ্ছে না। যা কিছু বর্তমান, ঘটমান, সব কিছুই বদলে যাচ্ছে এক কল্পজগতে, এক মনগড়া অবাস্তবে। দনের চোখে সরাইখানা হয়ে যাচ্ছে দুর্গ, সাধারণ এক পরিচারিকা আলদনসা তার স্বকপোলকল্পনায় বদলে হয়ে যাচ্ছে মহীয়সী আরাধ্যা প্রেয়সী দুলসেনিয়া। ‘ছিল রুমাল হয়ে গেল একটা বেড়াল’-এর নিয়মেই চলছে যত ‘ননসেন্স’ কাজকারবার। তা না হলে দন কেন প্রকাণ্ড হাওয়াকলকে দেখে ভাববে এক ভয়ংকর দৈত্য? তার পর লড়তে গিয়ে যন্তরের হাতে নাস্তানাবুদ। কিন্তু হাল ছাড়ার পাত্র দন নয়। তার ভাইঝি এবং স্থানীয় পাদ্রি এবং নাপিত সবাই মিলে যখন তাকে ধরেবেঁধে বাড়ি নিয়ে আসে এবং জানতে পারে সব নষ্টের মূলে হল লাইব্রেরির সব রূপকথার ছাইপাঁশ বই আর শৌর্য-বীর্যের আজগুবি উপাখ্যান, তখন তারা সেই বই পোড়াতে শুরু করে। নৈতিকতা, যৌক্তিকতার ধারক ও বাহক পাদ্রিমহাশয় হলেন এই অগ্নিযজ্ঞের প্রধান হোতা। এক ‘বীভৎস মজার’ আলেখ্য রচনা করেছেন সেরভান্তেস। পাদ্রি যে-সব বই পোড়াচ্ছেন, বোঝা যায়, সব ক’টাই তাঁর পড়া। মনে পড়ে যায় উৎপল দত্তের ‘টিনের তলোয়ার’ নাটকে বাচস্পতি ঠাকুর যখন লাঠিয়াল সহযোগে বেণিমাধব ও তার অভিনেতাদের পাড়াছাড়া করার উদ্যোগ নিয়েছেন এবং নেশাগ্রস্ত অভিনেতারা কী সব ব্যাভিচার করে থাকেন তার বর্ণনা দিচ্ছেন, তখন বেণিমাধব বলেন, ‘‘এইবার বুঝিলাম ঠাকুর আমার গুরুভাই, উনিও খুব টানেন। নইলে নেশার সব লক্ষণ আপনি জানলেন কী করে?’ বই পোড়ানোর প্রসঙ্গে স্মরণে আসে গত শতাব্দীর সেই সব নারকীয় অধ্যায়, যখন স্বাধীন চিন্তাকে ধ্বংস করতে বই পোড়াতে হয় বা নিষেধাজ্ঞা জারি করতে হয়। আজও কল্পনায় লাগাম পরানোর কত ফন্দিফিকির, নৈতিক পাহারাদারদের হাতে ‘ব্যান’ নামক মারণাস্ত্র। সভ্যতার ইতিহাস ৪০০ বছরের উথালপাথাল পেরিয়েও রেকারিং ডেসিম্যালের মতো প্রবহমান পুনরাবর্তন। ফ্যাসিবাদীরাও কি এই উপন্যাস থেকে পাঠ নিয়েছিলেন?
‘দন কিহোতে’ কী করে পড়তে হবে বা এটা ঠিক কোন ঘরানার লেখা, সেই নিয়ে নানা মুনির নানা মত। দনের কীর্তিকলাপে যেমন কৌতুকের বিশাল আয়োজন, তেমনি তলায় তলায় চোরাগোপ্তা ব্যঙ্গ, লুকনো বিষাদগাথা। সেরভান্তেস পাঠককে কখনও বিশ্রাম দেন না। এই হাসতে হাসতে মজছেন, ভাবছেন এই বুঝি ধরে ফেললাম, পরক্ষণেই ছক উলটে গিয়ে গুগলি। একপেশে, একঠেরে কোনও দৃষ্টিতে বাঁধা যায় না বলেই আজও দন ঘোড়ায় চড়ে, বল্লম হাতে ছড়িয়ে যাচ্ছে উন্মাদনার বীজ, নিশির ডাকের মতো ফিসফিসিয়ে মনের অবচেতনে গুঁজে দিচ্ছে ‘অসম্ভবের স্বপ্ন’। সাহিত্যিক মিলান কুন্দেরার ‘দ্য আর্ট অব দ্য নভেল’ বইয়ের প্রথম অধ্যায় সেরভান্তেস-কে উৎসর্গিত। কুন্দেরা ইউরোপিয়ান নভেলের বিবর্তন আলোচনা করতে গিয়ে আনছেন বিজ্ঞান প্রসঙ্গ। গালিলেও-পরবর্তী পৃথিবীকে বিজ্ঞান নির্দিষ্ট করে দিল, সভ্যতা তখন সব কিছুর পিছনে যুক্তি খুঁজছে। ঈশ্বর নামক সেই নির্বিকল্প, পরম চিহ্ন তখন এক জটিল প্রশ্নের সামনে দাঁড়িয়ে। মানুষ এই দুনিয়াটাকে একটা বিশেষ নিয়মে পড়তে পারছে না, নিজেকেও আর চিনতে পারছে না। সেরভান্তেস সেই অনিশ্চিত, অনির্দিষ্ট ব্যক্তিকে তাঁর নায়ক করছেন। যে নায়ক সময়ের এই বিশেষ লগ্নে বুঝতে পেরেছে, তার জীবনে আর অপরিবর্তনীয় বলে কিছু নেই, ধ্রুব কোনও নোঙর নেই— অবাধ তার স্বাধীনতা। তাই দন বেরিয়ে পড়েছে অভিযানে, সব কিছু যেখানে সম্ভব। দন কিহোতে যেন গোটা পৃথিবীর বিরুদ্ধে একটা যুদ্ধ ঘোষণা করছে। কল্পনাই তার অস্ত্র, যা সমস্ত নিয়মকে চ্যালেঞ্জ করে, কোনও শাসন মানে না।
পরবর্তী কালের নাটক, সাহিত্য, চিত্রকলা, সংগীত, চলচ্চিত্র থেকে দর্শন, উত্তর-আধুনিক চিন্তা, সাহিত্যতত্ত্ব, বৈপ্লবিক দর্শন— সব কিছুর ওপর দনের প্রবল অভিঘাত। কার নাম বাদ যাবে তালিকা থেকে? কিয়ের্কেগার্ড, ফ্লব্যের, দস্তয়ভস্কি, গ্রাহাম গ্রিন, টেনেসি উইলিয়ামস, বর্হেস, কাফকা, রুশদি, ফুকো, স্ট্রাউস, মেন্ডেলসন, পিকাসো, দালি, অরসন ওয়েলস— এঁরা সরাসরি দনকে নিয়ে কাজ করেছেন, কিন্তু এমন কেউ বোধহয় নেই যিনি দনকে নিয়ে বিস্তারে লেখেননি। শোপেনআওয়ারের মতো দার্শনিকও এই বইকে পৃথিবীর সেরা চার উপন্যাসের তালিকায় রেখেছিলেন। সবাই সেই নায়ককে বলছেন পাগল, কিন্তু সেই উন্মাদনার জয়গান গাইছেন, খ্যাপামিকে দিচ্ছেন পরম মান্যতা। এই পাগলামো থেকেই জন্ম নিয়েছে যত বিরোধী ভাষ্য, রুখে দেওয়া চিন্তন, লড়াকু ছবি, দিনবদলের কবিতা— ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত— সেই কল্পনাবিলাস যা মানুষকে উলটো ভঙ্গিতে দেখতে শেখায়, অন্তর্ঘাতের গূঢ় সঙ্কেত চেনায়। এই বেপরোয়া আকাশকুসুমের ঘোরেই বিদ্যাসাগর খরস্রোতা নদীতে ঝাঁপান, মানবেন্দ্রনাথ রায় মেক্সিকো গিয়ে কমিউনিস্ট পার্টির জন্ম দেন, ভিয়েতনাম লড়ে যায় আমেরিকার বিরুদ্ধে, দুনিয়া পালটানোর স্বপ্ন নিয়ে তাজা প্রাণ বিসর্জন দেয় লক্ষ লক্ষ তরুণ, ডাক্তার বেথুন চিনের বিপ্লবের শরিক হন, সোলানাস ক্যামেরা-কাঁধে নেমে পড়েন যুদ্ধক্ষেত্রে, তিয়ানমান স্কোয়ারে ট্যাঙ্কের সামনে দাঁড়িয়ে যায় একাকী এক যুবক। ‘ফেক নিউজ’-এর রমরমার এই দিনেও কি আমরা মনে রাখব না এই উপন্যাসের সেই চমকপ্রদ সূচনা যেখানে লেখক জানাচ্ছেন, শুধু প্রথম পরিচ্ছেদটিই তিনি লা মানচা-র লেখ্যাগার থেকে নিয়েছেন, বাকিটা চাইড হ্যামেত বেনেগালি নামে এক আরবীয় লেখকের অনুবাদ থেকে।
কল্পনা, সাহিত্য, সংবাদ, স্বপ্ন, সবই এই উপন্যাসের দৌলতে একাকার। চে গেভেরা তাঁর বাবা-মা’কে লিখেছিলেন, ‘আবার আমার গোড়ালিতে রসিনান্তের (কিহোতের ঘোড়ার নাম) পাঁজরের অস্তিত্ব টের পাচ্ছি। আবার এক বার, আমি রাস্তায় নেমেছি, আমার হাতে ধরা ঢাল।’ এই বলে বলিভিয়ার জঙ্গলে চলে গিয়েছিলেন বিপ্লব করতে। সেইখানেই চে ধরা পড়েন এবং তাঁকে হত্যা করা হয়। দন কিহোতে যেমন সাধারণ মানুষকে দিয়েছে গোপন কল্পনার উড়ান, তেমনই বিপ্লবীকে দিয়েছে অনুপ্রেরণার ভাষা। তাই চে বলতে পারেন, ‘...যুদ্ধে জেতা বা হারা বড় কথা নয়— লড়াই করেছি... শত্রুর বিরুদ্ধে।’ পাশাপাশি চারু মজুমদার ‘নকশালবাড়ির শিক্ষা’-য় লিখছেন, ‘যে নিজে স্বপ্ন দেখে না এবং অন্যকে স্বপ্ন দেখাতে পারে না, সে বিপ্লবী হতে পারবে না।’
তাই চারশো বছর পরেও দন এত জ্যান্ত, এত প্রাসঙ্গিক। আবার কুন্দেরার কথা ধার করেই বলতে হয়, ‘উপন্যাসটি আমাদের শিখিয়েছে কী ভাবে এই পৃথিবীকে বুঝতে হয় প্রশ্ন দিয়ে।’ দন তাই একগুঁয়েপনা করে স্বপ্ন দেখবেই, গলা ফাটিয়ে বলবেই— ‘পৃথিবীও হবে সুন্দরতর, একটি মানুষ শুধু একা, বিক্ষত হয়ে যদি লিখে যায়, রক্ত-রঙিন ভাষায়, শেষ যুদ্ধের ইতিহাস, নিয়ে শেষ সাহসের কণা, যদি রাখে তবু, নাগাল পেরিয়ে ফোটা, তারাকে ছোঁওয়ার আশা।’ কিন্তু সানচো পানসা, ডনের সহচর, সে তো বীরত্বের গাথায় মশগুল ছিল না, সে তো পড়েনি সেই সব ভয়ংকর কল্পনা-উঁচানো উপকথা, সেও কী করে মেতে গেল এই সব মায়ার খেলায়? সেও প্রভুর কাছে থেকে পাঠ নিচ্ছিল বাস্তবকে উলটেপালটে দেখার। সে জানত ‘প্রভু তো যুদ্ধ করেই খালাস, তাকে মাটি থেকে তোলে কে?’ সুতরাং স্বপ্নিল অভিসারে একক হলেও, বারবার তাকে জায়গা থেকে ঠেলে ফেলে দিলেও, মাটি থেকে তোলার লোক দু-একটা ঠিকই জুটে যায় সানচোর মতো। সে প্রভুর মতোই বিশ্বাস করতে শুরু করে— ‘জীবন যেরকম, সেটা খুবই ক্লান্তিকর। জীবন যা হতে পারে তারই স্বপ্ন দেখা উচিত।’ সমকালে যেখানে স্বপ্নের আঁচ নিভু-নিভু, কল্পনার রসে তেমন গাঢ়ত্ব নেই, তখন দনকে এক বার জাগিয়ে তুললেই আবার একটা বোম্বাচাক হয়ে যেতে পারে। চারশো বছরের পুরনো দন কিহোতে আজও তার মহীয়সী নারীর উদ্দেশে গেয়ে ওঠে: ‘থেমো না কখনো তুমি তৃপ্তির মুমূর্ষু টানে, স্থবির সময় ভেদ করে তুমি যেও গান গেয়ে, এ গান ফুরোলে চলে যেও তুমি আগামীর গানে, স্থাণু স্বরলিপি দেখে চিরকাল হেসো তুমি মেয়ে...’