কোয়রান্টিনে বিছানায় শুয়ে মেরি ম্যালন
জলজ্যান্ত একটা মানুষ মারণ রোগের বাহক। অপেক্ষাকৃত অল্প পরিসরে বিরাট রোগ ছড়ানোর ক্ষমতা নিয়ে তিনি সকলের মধ্যেই হেঁটেচলে বেড়াচ্ছেন। উনিশ শতকের শুরুতে এমনই এক বাহককে নিয়ে রাতের ঘুম উড়ে গিয়েছিল আমেরিকার। একের পর এক পরিবারে টাইফয়েড ছড়িয়ে তাঁর নামই হয়ে গিয়েছিল, ‘টাইফয়েড মেরি’। তাঁর হাত থেকে দেশ বাঁচাতে দুই পর্যায়ে প্রায় আঠাশ বছর তাঁকে মূল ভূখণ্ড থেকে দূরে, একটি দ্বীপের মধ্যে আলাদা বাড়িতে কোয়রান্টিনে রাখা হয়েছিল। রোগ মোকাবিলায় হাত ধোওয়া, ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা এবং কোয়রান্টিনের গুরুত্ব প্রায় ১১৪ বছর আগে প্রমাণিত হয়েছিল ‘টাইফয়েড মেরি’-র ঘটনায়।
নিউইয়র্ক শহরের ওয়েস্টার বে এলাকায় ১৯০৬ সালের গ্রীষ্মকাল। মিসেস জর্জ টমসনের বিশাল বাড়ির একাংশ কয়েক মাস হল ভাড়া নিয়েছেন জেনারেল উইলিয়াম হেনরি ওয়ারেন। স্ত্রী-ছেলেমেয়ে নিয়ে পরিবারে তাঁরা চার জন, আর চাকরবাকর রয়েছে আরও সাত জন। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, ছবির মতো সেই বাড়িতে আচমকা টাইফয়েডের প্রাদুর্ভাব! ওয়ারেন পরিবারের মোট এগারো জন সদস্যের মধ্যে ছ’জন গুরুতর অসুস্থ হলেন।
মিসেস টমসন পড়লেন মহা সঙ্কটে। তাঁর বাড়িতে রোগ ছড়াচ্ছে, এই খবর এক বার খবর ছড়িয়ে পড়লে বাড়ি ভাড়া দেওয়াই দুষ্কর হবে। দুর্নাম খণ্ডাতে তাড়াতাড়ি মোটা অঙ্কের ডলার খরচা করে তিনি নিয়ে এলেন জর্জ এ সোপার নামের এক নামী স্যানিটারি ইঞ্জিনিয়ারকে। গোটা বাড়ি, এমনকি পাশের একাধিক বাড়ি, লন, পুল সব তন্ন-তন্ন করে পরীক্ষা করলেন তিনি। কোথাও এমন কিছু পেলেন না, যা থেকে টাইফয়েড হতে পারে।
সেই সময়টা ছিল একেবারে অন্য রকম। ১৯৩৯ সালের ১০ মে সোপারের একটি লেখা থেকে জানা যায়, ১৯০৬ সালে শুধু নিউইয়র্ক শহরে সরকারি হিসেবে ৩৪৬৭ জন টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়েছিলেন। মৃত্যু হয়েছিল ৬৩৯ জনের। আসল সংখ্যাটা ছিল তার চেয়েও অনেক বেশি। ইতিউতি পাড়ায় বা গ্রামে এলাকাভিত্তিক সংক্রমণও ঘটছিল। ইতিহাস বদলায় না। সে দিন টাইফয়েড, আজ করোনা।
আদা-জল খেয়ে পাকা গোয়েন্দার মতো তদন্ত শুরু করলেন সোপার। এবং দ্রুত সিদ্ধান্তে এলেন, ওয়েস্টার বে-র ওই বাড়িতে এমন কোনও মানুষ রয়েছেন যিনি টাইফয়েডের বাহক। অর্থাৎ তাঁর দেহে টাইফয়েড সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া ‘সালমোনেলা টাইফি’ রয়েছে। কিন্তু তিনি নিজে অসুস্থ না হয়ে অন্যের দেহে রোগ ছড়াচ্ছেন। এমন মানুষ কোনও বাড়িতে বা পাড়াতে টাইফয়েডের প্রকোপের মতো পরিস্থিতিও তৈরি করতে সক্ষম। বাড়ির প্রত্যেকের সঙ্গে কথা বলে শেষ পর্যন্ত তিনি এক রকম নিশ্চিত হলেন যে, বাড়িতে নিয়মিত রান্না করেন এমন কেউ রয়েছেন এর পিছনে। খোঁজ পড়ল বাড়ির রাঁধুনির। সোপার জানতে পারলেন, পরিবারের সদস্যেরা একে-একে টাইফয়েডে আক্রান্ত হতে শুরু করা মাত্র সেই রাঁধুনি নাকি চাকরি ছেড়ে চলে গিয়েছেন!
মিসেস ওয়ারেন জানালেন, সেই রাঁধুনির নাম মেরি ম্যালন। বছর চল্লিশ বয়স। দুর্দান্ত রান্না করতেন। বেতন নিতেন ৪৫ ডলার। একটু মেজাজি, কিন্তু এমনিতে চাপা স্বভাবের। বাড়ির অন্য চাকরদের সঙ্গে তেমন কথা বলতেন না। নিজের মতো থাকতেন। তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের কথাও কখনও বলেননি। ‘মিসেস স্ট্রিকার্স অ্যান্ড স্ট্রিকার্স’ এমপ্লয়মেন্ট এজেন্সি থেকে এই রাঁধুনিকে নেওয়া হয়েছিল। ৪ অগস্ট মেরি কাজে যোগ দেন। আর বাড়ির প্রথম ব্যক্তি অসুস্থ হন ২৭ অগস্ট। একেবারে শেষে যিনি আক্রান্ত হন তাঁর অসুস্থ হওয়ার দিনটি ছিল ৩ সেপ্টেম্বর। প্রথম অসুস্থ হওয়ার ঘটনা যখন ঘটল, তার আগের দিনই মেরি ফল-মেশানো আইসক্রিম বানিয়েছিলেন। তা এত অপূর্ব হয়েছিল যে বাড়ির সবাই চেটেপুটে খেয়েছিলেন।
সোপার আরও নিশ্চিত হলেন। কারণ, ভাল করে রান্না করা গরম খাবারের মধ্য দিয়ে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ সহজ নয়, ঠান্ডা খাবারের মাধ্যমেই এমনটা সম্ভব। এ বার শুরু হল মেরির খোঁজ। চার মাসের চেষ্টায় শেষ পর্যন্ত ১৯০৭ সালের মার্চে তাঁর খোঁজ মিলল। তখন তিনি নিউ ইয়র্কের পার্ক অ্যাভিনিউয়ের এক পরিবারে রাঁধুনির কাজ করছেন। এবং তত দিনে ওই পরিবারের মালকিন টাইফয়েড আক্রান্ত হয়ে হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা করিয়ে কোনও মতে বেঁচে ফিরেছেন। পরিবারের একমাত্র সন্তান, ফুটফুটে একটি মেয়ের টাইফয়েডে মৃত্যু হয়েছে। প্রথম যে দিন সোপার মেরির সঙ্গে দেখা করে তাঁকে বোঝাতে যান, সে দিন ধারালো কাঁটা চামচ নিয়ে তিনি তাঁর উপর হামলা চালিয়েছিলেন। তার পর নিউ ইয়র্ক শহরের স্বাস্থ্য দফতরকে বুঝিয়ে তাদের একাধিক কর্মীকে নিয়ে সোপার মেরিকে আনতে যান। তখনও রান্নাঘরের জানলা গলে পালিয়ে বাঁচতে চেয়েছিলেন তিনি। কয়েক ঘণ্টার চেষ্টায় তাঁকে ধরা সম্ভব হয়।
প্রথমে তাঁকে রাখা হয় উইলার্ড পার্কার হাসপাতালে, তার পর নর্থ ব্রাদার দ্বীপের রিভারসাইড হাসপাতাল চত্বরে একটি বাংলোয় কোয়রান্টিনে রাখা হয়। তাঁর মল-মূত্র পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছিল, শরীরে টাইফয়েডের ব্যাকটেরিয়া গিজগিজ করছে, বহু চিকিৎসাতেও তা দূর করা যায়নি। সোপার তাঁর ‘দ্য কিউরিয়াস কেরিয়ার অব টাইফয়েড মেরি’ প্রবন্ধে জানিয়েছেন, পর পর অন্তত সাতটি পরিবারে মেরি টাইফয়েড ছড়িয়েছেন। সব মিলিয়ে অন্তত ৫৩ জন মানুষ তাঁর দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন। মারা গিয়েছেন অন্তত ৪ জন। সংখ্যাটা বাস্তবে অনেক বেশি, সে কথাও জানিয়েছেন সোপার। হাত ধোওয়ায় মেরির অনীহা এবং মল-মূত্র ত্যাগের পর নিজেকে ঠিক মতো পরিচ্ছন্ন না করে রান্না করা মেরিকে ‘টাইফয়েড মেরি’ বানিয়েছিল, সে কথাও লিখে গিয়েছেন সোপার।
মেরি সারা জীবন শুধু পালিয়ে বেড়িয়েছেন, এক পরিবার থেকে অন্য পরিবারে। কোথাও রাঁধুনি হিসেবে টিকতে পারেননি। কারণ, কিছু দিন কাজ করার পরেই সেখানে টাইফয়েডের প্রকোপ শুরু হয়েছে, তক্ষুনি মেরি পাততাড়ি গুটিয়েছেন। সোপারের কথায়, ‘‘মানসিক সমস্যা ছিল মেরির, যা কোনও দিন চিহ্নিত হয়নি। আমি বহু বার তাঁকে তাঁর সমস্যা বোঝাতে চেয়েছি, কিন্তু সে একবগ্গার মতো তা অস্বীকার করেছে। সে যদি এটা মেনে নিয়ে নিজের দৈনন্দিন কাজকর্মের পদ্ধতি বদল করার চেষ্টা করত, তা হলে হয়তো তার জীবন অন্য রকম হত।’’
শিরোনামে: সে কালের সংবাদপত্রে ‘টাইফয়েড মেরি’।
প্রায় পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চি লম্বা, দশাসই চেহারা ছিল মেরির। তাঁর জন্ম ১৮৬৯-এ আয়ারল্যান্ডে। সেখান থেকে এক কাকা-কাকিমার সঙ্গে ভাগ্যান্বেষণে আমেরিকায় আসেন। কিন্তু এর চেয়ে বেশি তাঁর পরিবার বা আত্মীয়দের সম্বন্ধে কিছু জানা যায় না। খুব চাপা স্বভাবের, কিন্তু বদমেজাজি ছিলেন। কারও সঙ্গে বেশি বন্ধুত্ব বা আলাপ ছিল না। সোপারের মনে হয়েছিল, খুব নিঃসঙ্গ ছিলেন মেরি।
প্রথম দফায় প্রায় তিন বছর কোয়রান্টিনে থাকার পর ১৯১০ সালে কোর্ট মেরিকে শর্তসাপেক্ষে মুক্তি দেয়। শর্ত ছিল, প্রতি তিন মাস অন্তর মেরি স্বাস্থ্য দফতরে হাজিরা দেবেন, এবং আর কোনও দিন কোথাও রান্নার কাজ করবেন না। কিন্তু অচিরেই তিনি শর্ত ভাঙলেন এবং বিভিন্ন ছদ্মনামে ফের রান্নার কাজ নিতে থাকলেন। এ বার আর কোনও বাড়িতে নয়, কাজ নিলেন রেস্তরাঁ, নানা সংস্থা বা হাসপাতালে। তার ফল হল আরও ভয়ঙ্কর। আরও বেশি সংখ্যায় মানুষ অসুস্থ হতে থাকলেন।
সোপারের মনে হয়েছিল, দু’টি কারণে মেরি এটা করেছিলেন। প্রথমত, রান্না ছাড়া অন্য কোনও কাজ তিনি তেমন ভাল জানতেন না। রান্না ছিল তাঁর প্যাশন এবং সে যুগে মেয়েদের চাকরির ক্ষেত্রে এটাই ছিল মোটামুটি নিরাপদ, সুপরিবেশের কাজ। মাইনেও ভাল ছিল। ফলে ‘টাইফয়েড মেরি’ টাইফয়েড ছড়াতে লাগলেন। ১৯১৫ সালে সোপার একটা ফোন পেলেন স্লোয়েন হসপিটাল ফর উইমেন-এর চিকিৎসক এডওয়র্ড বি ক্র্যাগিন-এর কাছ থেকে। তাঁর হাসপাতালে হঠাৎ টাইফয়েডের প্রাদুর্ভাব শুরু হয়েছে। ২০ জনেরও বেশি আক্রান্ত। অন্য পরিচারকরা এর কারণ হিসেবে নতুন এক রাঁধুনিকে সন্দেহ করছে! আবার খুঁজে পাওয়া গেল মেরিকে।
আটচল্লিশ বছরের মেরি এ বার ধরা দিতে বিন্দুমাত্র বেগ দিলেন না। জনস্বাস্থ্যের পক্ষে অত্যন্ত মারাত্মক বলে চিহ্নিত করে তাঁকে নর্থ ব্রাদার দ্বীপে কোয়রান্টিনে রাখা হল। সরকার থেকে তাঁকে ছোট্ট একটা বাংলো দেওয়া হল। তাঁর খাবারও জোগাত সরকার। সেখানকার এক হাসপাতালের ল্যাবরেটরিতে তাঁকে সামান্য কাজ দেওয়া হল। বাংলোয় একাই থাকতেন। মাঝে মাঝে কেনাকাটা করতে বা ঘুরতে মেনল্যান্ডে আসতেন। এই ভাবে ২৩ বছর রইলেন কোয়রান্টিনে। ১৯৩২ সালে ক্রিসমাসের দিন সকালে স্ট্রোক হল তাঁর। ফল— পক্ষাঘাত। প্রায় ছয় বছর শয্যাশায়ী থাকলেন। ১৯৩৮ সালের ১১ নভেম্বর মারা গেলেন। তাঁর শেষকৃত্যে যোগ দিতে চার্চে এসেছিলেন মোটে ন’জন। তাঁর যে সামান্য কিছু টাকা সঞ্চিত ছিল, তা দাবি করতেও কেউ কোনও দিন আসেননি।
মেরির কথা তবু রয়ে গিয়েছে আমেরিকা তথা বিশ্বের জনস্বাস্থ্য ও রোগ-অসুখের ইতিহাসে।