Drug Peddlers

মাদকচক্রের মোহময়ী

শশিকলা বেবি পাটানকর। স্বামী তাড়িয়ে দেওয়ার পর দুধ বিক্রি করে পেট চালানো। তার পর ড্রাগ পেডলিং। মুম্বইয়ের নেশার জগৎ দখলে এনেছিল সে। এই মেয়ে জানত, কী ভাবে কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে হয়।

Advertisement

সুবর্ণ বসু 

শেষ আপডেট: ২৫ এপ্রিল ২০২১ ০৭:৪৫
Share:

ছবি: কুনাল বর্মণ।

সালটা ১৯৮২। এক মেঘলা দিন। মাথা নিচু করে সিদ্ধার্থ নগর চওলের দিকে হেঁটে যাচ্ছে কুড়ি পেরনো বৌটি। সঙ্গে দুই ছেলে। কানে বাজছে বরের শেষ কথাগুলো। “দূর হ’... তোর নোংরা মুখটা যেন আমায় আর দেখতে না হয়...” মেয়েটিকে বার করে দিয়েছে তার বর। কাপড়জামা ছুড়ে ফেলে দিয়েছে রাস্তায়। ছেলেদের নিয়ে কী করবে, কোথায় যাবে, জানা নেই। শেষ অবধি বাপের বাড়িই ভরসা। তাই গন্তব্য সিদ্ধার্থ নগর। ওর্লি মুম্বই। সেখানে তার ভাইয়েরা থাকে।

Advertisement

মেয়েটির নাম বেবি, ভাল নাম শশিকলা পাটানকর। বর রমেশ পাটানকর। ভাইয়ের বাড়ির দরজায় টোকা দিতেই দরজা খুলে দিল ভাইয়ের বৌ। ভিতরে ডেকে চা-জলখাবার দিল। সব কথা শুনল। বলল, “আমি তোমাদের সঙ্গে আছি, দিদি!”

আট ফুট বাই আট ফুটের ঘর। সেখানেই ভাইবৌয়ের সঙ্গে ছেলেদের নিয়ে থাকতে শুরু করল বেবি পাটানকর।

Advertisement

ভাইয়ের বৌয়ের চেষ্টায় জুটল কয়েকটা বাড়িতে দুধ দেওয়ার কাজ। চলে যাচ্ছিল এক রকম। কিন্তু এক দিন অন্যরকম ঘটনা ঘটল। দুধ দিয়ে ফিরতে ফিরতে শরীরটা খারাপ লাগছিল বেবির। রাস্তার ধারে বেঞ্চে বসে পড়েছিল সে। অনেকটা পথ। চড়া রোদ। ক্লান্তিতে চোখ বুজে এসেছিল বলে খেয়াল করেনি, বেঞ্চের অন্য ধারে বসা লোকটি এক দৃষ্টিতে তাকেই লক্ষ করছে।

“এখন কি শরীরটা একটু ভাল লাগছে, বহেন?”

পাশ থেকে আসা প্রশ্নটা শুনে তাকাল বেবি। ‘বহেন’ কথাটা বেশ লাগল। সে অল্প হেসে মাথা নাড়ল। তত ক্ষণে লোকটির বেবিকে মাপা হয়ে গিয়েছে। একই রকম মোলায়েম গলায় সে আবার বলল, ‘‘জানো বহেন, মুম্বইয়ে এক জনই ভগবান...”

জানে বেবি। ম্লান হেসে বলে, “গণপতি বাপ্পা।”

হেসে ফেলল লোকটি। তার পর গম্ভীর হয়ে বলল, “না। মুম্বইয়ের ভগবান হল রুপাইয়া... থাকলে সবই ভাল, না থাকলে মুম্বইয়ে তুমি পোকামাকড়ের বেশি কিছু নও।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে শশিকলা ওরফে বেবি।

লোকটি জানায় যে, সে ড্রাগ পেডলার। তার বসও বছর দশেক আগে ড্রাগ ডিলার ছিল, এখন নিজেই একটা বড় র‌্যাকেটের বস। তার পরই ঝুলি থেকে বেড়াল বার করে সে, “করবে এ কাজ? বাড়ি বাড়ি দুধ দিয়ে কত পাও... মাসে হাজার?”

মাদক-রানি: মধ্যবয়সি বেবি পাটানকরের প্রতিকৃতি। ছবি: কুনাল বর্মণ।

দুঃখের হাসি হাসে বেবি, বলে, ‘‘পাগল! বড়জোর ছ’শো-সাতশো...”

“আমার কথায় রাজি হলে তুমি সারা বছরের রোজগার এক-এক মাসে পাবে।”

মনটা দুলে ওঠে বেবির, তবু দ্বিধা যায় না, সে বলে, “কিন্তু পুলিশ?”

“পুলিশ তাদের পাওনা পেয়ে যায় বহেন, ওদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই।”

অবিশ্বাস্য মনে হয় বেবির। সে কি করবে এ কাজ! চোখের সামনে ভেসে ওঠে দুই ছেলের মুখ, “কিন্তু আমার যদি কোনও বিপদ হয়! আমার ছেলে দু’টো যে খুব ছোট...”

‘‘বিপদ কীসে নেই বহেন! আর এই ক’টা টাকা রোজগার করে তুমি ওদের কী ভাল করবে! ভেবে দেখো। কী ঠিক করলে জানিয়ো। কাল এইখানে, এই সময়...”

মাথার ভিতর চিন্তার ঝড় নিয়ে বাড়ি ফিরল বেবি। বহু দোলাচলের শেষে অর্থাভাবেরই জিত। ব্রাউন শুগার আর হাশিশ দিয়ে হাতেখড়ি হল বেবির। শহরের পাঁচতারা হোটেলগুলো কভার করত সে। খুব দ্রুত বেবি বুঝল, ড্রাগের চাহিদা যত, জোগান তত নয়। আর মেয়ে বলেই সহজে সবাই বিশ্বাস করে তাকে। সে-ও কাউকে ঠকায় না, দাম ঠিক রাখে, গোলমাল করে না। দু’বছরের মধ্যে তার হাতে বেশ ভাল টাকা জমল। সে সিদ্ধার্থ নগর চওলে নিজের একটা ঘর নিল। তার দুই ছেলে এখন ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ে। আর পিছু ফিরে তাকানোর প্রয়োজন নেই।

১৯৮৫ সাল। শশিকলা বেবি পাটানকর এখন আরও পাকাপোক্ত। তার নিজের ড্রাগের ব্যবসা। ড্রাগ ডেলিভারির জন্য সে একটা ট্যাক্সি কিনেছে। ট্যাক্সি করে তার ছেলেরা ড্রাগ সাপ্লাই করে। তাদের বেবি জোগাড় করেছে নেশাখোরদের মধ্যে থেকেই। এদের পিছনে টাকাপয়সা খরচ নেই। বরাদ্দ নেশাটুকু জুটলেই এরা খুশি। কয়েক বছর উদ্দাম নেশা করে কেউ ফৌত হয়ে গেলে নেশাড়ুদের মধ্য থেকেই ফের কাজের ছেলে তুলে নেয় বেবি। সাপ্লাইয়ের আগে-পরে ড্রাগের সব স্টক জমা থাকে বেবির নিজের বাড়িতেই।

এ ভাবেই চলছিল। বছর সাতেক কেউ টিকিটিও ছুঁতে পরেনি বেবির। কিন্তু একটু চড়াই-উতরাই না থাকলে কি কোনও গল্পই আদৌ গল্প হয়ে ওঠে!

১৯৯২ সালের এক নিস্তব্ধ দুপুর। ছেলেরা ট্যাক্সিতে সে দিনের ডেলিভারির ড্রাগ নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছে। বাকি স্টক নিয়ে বেবি বাড়িতে একা। হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ। বেবি পাটানকর দরজা খুলে হতবাক। পুরোদস্তুর উর্দি পরা এক কনস্টেবল। এই প্রথম পুলিশের মুখোমুখি। ঘরে তখনও বেশ কয়েক কেজি ড্রাগ মজুত। আর অনেক টাকা। তার এখন এত টাকা যে, সে বছরখানেক আগে গোনাই ছেড়ে দিয়েছে। ভয়ে বুক শুকিয়ে গেল বেবির। কিন্তু বুদ্ধি হারাল না সে।

কনস্টেবল হুকুমের সুরে বলল, ‘‘তোমার ঘর সার্চ করার অর্ডার আছে।’’

শশিকলা ওরফে বেবি দরজার চৌকাঠ ঠেসান দিয়ে দাঁড়াল। তার উদ্ধত কোমরে, বুকে আগুনের ইশারা। মদির চোখে কনস্টেবলের চোখের দিকে তাকিয়ে সে বলল, ‘‘শুধু ঘর, সাহেব? আমাকে সার্চ করবে না?’’

বিনা প্রতিরোধে পতঙ্গের মতো ধরা দিল সেই কনস্টেবল। চলে যাওয়ার সময় লাজুক হেসে বলেছিল, ‘‘আসলে খবর ছিল, তোমার ঘরে নাকি অনেক ড্রাগ মজুত আছে, তাই...’’

তত ক্ষণে হারানো আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছে বেবি। তার জামাকাপড় পরা হয়ে গিয়েছিল। এগিয়ে এসে কনস্টেবলের চিবুকে আঙুল রেখে চোখ টিপে সে বলেছিল, ‘‘আমিই তো সেই ড্রাগ, সাহেব! দেখো না, তোমারও কেমন নেশা হয়ে যাবে!’’

কনস্টেবলের নাম ধর্মরাজ কালোখে। সে প্রতি সপ্তাহে বেবির কাছে আসতে লাগল। শুরু হল বেবির জীবনের নতুন অধ্যায়। মাঝে-মাঝেই তাকে জুহু বিচে দেখা যেত সেই কনস্টেবলের সঙ্গে। খোঁপায় বেলফুলের মালা জড়িয়ে সে ধরমের সঙ্গে খেতে বেরত। কখনও বড়া পাও, কখনও আইসক্রিম। এরই মধ্যে বেবি বুঝেছিল, নিজের ঘরে ড্রাগ মজুত রাখা আর নিরাপদ নয়। সে কাছাকাছিই একটা ঘর নিল। ঘরটা চার দিক দিয়ে বন্ধ। শুধু অন্য একটা বাড়ির ছাদের পাঁচিল টপকেই ঢোকা যায় সেই ঘরটায়। নতুন ঘরে পুরো স্টক লুকিয়ে ফেলল বেবি।

এ রকমই একবার, বেবির এক ভাই, কিসান মাজগাঁওকরের বাড়িতে ড্রাগের স্টক রাখা নিয়ে বিস্তর ঝামেলা করেছিল কিসানের বৌ। কিসানকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিতে দেরি করেনি বেবি। সে শত্রুর শেষ রাখায় বিশ্বাস করত না। কিসানের ছোট্ট ছেলে মনীশ দেখেছিল কেমন করে তার বাবা, তার মাকে বেধড়ক মেরে অজ্ঞান করে খুন করেছিল, আর দ্রুত জ্বালিয়ে দিয়েছিল লাশ। এগারো বছরের ছোট্ট ছেলেটা বড় হয়ে আইনজীবী হয়ে মামলা করে বাবার বিরুদ্ধে। হাজতবাস হয় কিসান মাজগাঁওকরের। কিন্তু ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যায় বেবি পাটানকর। ধর্মরাজের ছক্কাপাঞ্জায় আঁচও আসেনি তার বেবির।

ধর্মরাজ পরে বলেছিল, সে প্রথম থেকেই সব বুঝতে পেরেছিল, কিন্তু সে বেবিকে ভালবেসে ফেলেছে, তাই ঝামেলা করেনি। কথাটা শুনে ধরমকে তার ব্যবসায় পার্টনার করে নিল বেবি। ধরম মোটা কমিশন পেতে আরম্ভ করল, আর পুলিশের জিপে করেও ড্রাগ সাপ্লাই করা শুরু করল বেবি। মসৃণতর হল রাস্তা। এখন তার ভাইরাও এসে দিদির সঙ্গে ড্রাগের ব্যবসায় যোগ দিয়েছে। সমস্যা হল ক্রমেই বেড়ে চলা টাকার পরিমাণ নিয়ে। এত টাকা কোথায় রাখা যায়! নিজের ঘরে স্তূপাকার টাকা রেখে নিশ্চিন্তে থাকা যায় না কি! ভাইদের পরামর্শে ভুয়ো ব্যবসার রোজগার দেখিয়ে বিভিন্ন নামে, আত্মীয়স্বজনের নাম মিলিয়ে মোট উনত্রিশটা ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খোলা হল বেবির। তাতেও হল না, বেবি সোনার গয়না কিনতে শুরু করল। তার পর রিয়েল এস্টেট। শশিকলা বেবি পাটানকরের উড়ান আরও উঁচুতে উঠল।

বিপদ এল ২০০১-এর মার্চে। ৩০ গ্রাম হাশিশ-সহ ধরা পড়ে গেল বেবি। শশিকলা বেবি পাটানকর তখন বড় নাম। ধর্মরাজ কালোখের সাধ্য ছিল না তাকে বাঁচানোর। বিস্তর ক্ষতি হল শশিকলার ব্যবসার। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে সে দেখল, তার ব্যবসা তলানিতে। আশেপাশে গজিয়ে উঠেছে আরও ভুঁইফোঁড় ড্রাগ-ডিলার। দেখেশুনে মাথায় আগুন জ্বলে গেল বেবির। দলের সবাইকে যাচ্ছেতাই গালমন্দ করার পর ঠান্ডা মাথায় ভাবতে বসল বেবি। অনেক ভেবেচিন্তে ধর্মরাজকেই মেসেজ করল সে।

ধরমকে বেবি জানাল, “আমি আমার এলাকায় ফালতু কম্পিটিশন মেনে নেব না। ঝামেলা হঠাও।” ধর্মরাজ তাকে প্রস্তাব দিল পুলিশ ইনফর্মার হয়ে যাওয়ার। ধর্মরাজ খবরি হিসেবে পুলিশ মহলে বেবির পরিচয় করিয়ে দেবে। আর বেবি ধরমের হাতে তুলে দেবে এলাকার সমস্ত নতুন ড্রাগ-কারবারিদের হালহদিস। পরামর্শ মতোই কাজ হল। নিজের এলাকা পুনরুদ্ধার তো হলই, গোটা মুম্বইয়ে সাম্রাজ্য বিস্তৃত হল ড্রাগ-সম্রাজ্ঞীর।

২০১২ সালে মুম্বইয়ের ড্রাগ-দুনিয়ায় একটা আশ্চর্য পালাবদল এল। সৌজন্য, মেফিড্রোন, ডাকনাম মিউ-মিউ। নতুন ধরনের ড্রাগ, যা ভারতে বেআইনি নয়। নামটা বেবির পছন্দ হল। তার ক্ষুরধার মস্তিষ্ক বুঝল, মিউ-মিউই ভবিষ্যৎ। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই প্ল্যান করে ফেলল সে। ধর্মরাজ কালোখে-কে সঙ্গে নিয়ে রাজস্থান, গুজরাত, মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশের সব ক’টি মিউ-মিউ ফ্যাক্টরি নিজের দখলে আনল। তার পর প্রায় সমস্ত ড্রাগ-ক্রেতাকে মিউ-মিউ ধরিয়ে সে হয়ে উঠল ড্রাগ-দুনিয়ার অপ্রতিদ্বন্দ্বী মালকিন। সব চেয়ে বড় কথা, মিউ-মিউ বেআইনি নয়। ফলে পুলিশের প্রতি নির্ভরতাও কমল। ধরমকেও আর দরকার হল না তেমন। যদিও ড্রাগ-ব্যবসার পার্টনারশিপে সে এখনও আছে। তার বাড়িতেও থাকে স্টক। কিন্তু সেই পুরনো ট্র্যাজেডি! বিধাতা বেবির কপালে স্থায়ী শান্তি লেখেননি। শোনা যায়, হঠাৎই নাকি এক বিশ্বস্ত অনুচরের সূত্রে খবর এল, বেবির ধরম অন্য একটি মেয়ের প্রেমে পড়েছে। তার ঘরেই এখন ধরমের নিয়মিত যাতায়াত। বেবির কপালে ভাঁজের রেখা বাড়ল। ধরমের সঙ্গে তার শুধু কাজের সম্পর্ক নয়, তার চেয়ে একটু বেশি। অন্য মেয়ের খবরটা তার পছন্দ হল না। বেবি ঠিক করল, ধরমকে শিক্ষা দিতে হবে।

খুব দ্রুত এবং নির্ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাই বেবির বরাবরের প্রধান অস্ত্র। ধরমকে শিক্ষা দিতে তার দেরি হল না।

থানার নম্বর ডায়াল করল পুলিশের পুরনো খবরি বেবি। জানিয়ে দিল, পুলিশ কনস্টেবল ধর্মরাজ কালোখের সাতারার বাড়িতে ড্রাগের স্টক রয়েছে।

ঠিক দু’দিন পর খবরের কাগজে ধর্মরাজের গ্রেফতার হওয়ার খবর দেখে আপনমনে মুচকি হাসল বেবি। ফাঁদে পড়েছে পুরনো আশিক... এক বার দেখা করবে না সে?

সে দিনই দেখা করল বেবি। তাকে দেখেই চোখ নামিয়ে নিল ধরম।

“কী গো...”

ধরম নীরব। চাপা রাগে তার নাকের পাটা ফুলে উঠেছে।

“শিক্ষা হয়েছে এ বার?”

কোনও উত্তর নেই।

“আমি কিন্তু তোমাকে বাঁচিয়ে দিতে পারি। তুমি আর আমায় ভালবাস না জানি, আমি কিন্তু সেই আগের আমিই আছি...”

এ বারেও কোনও কথা বলল না ধর্মরাজ কালোখে। শুধু রাগী চোখে চেয়ে রইল বেবির দিকে। বেবি বুঝল, তার ক্ষতি করার কোনও ক্ষমতা ধরমের নেই।

কিন্তু এইখানেই তার হিসেব মেলেনি। সপ্তাহখানেকের মধ্যেই সে খবর পায়, ড্রাগ-ব্যবসার পার্টনার হিসেবে তার সমস্ত কীর্তিকলাপ ধর্মরাজ ফাঁস করে দিয়েছে পুলিশের কাছে। পুলিশ তদন্ত করে জেনেছে যে, ধর্মরাজ এবং বেবির পরস্পরের বাড়িতে নিয়মিত যাতায়াত ছিল। ধর্মরাজের সাতারার প্রতিবেশীরা সকলেই বেবি পাটানকরের ছবি দেখে শনাক্ত করেছে। নিজের বাড়ির মিউ-মিউয়ের স্টক সরানোর সময়টুকুও পেল না বেবি। তাকে গ্রেফতার হতে হল।

আচমকা আঘাতে বেবির ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল। চেনা উকিলকে ডেকে সে বলল, “যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জামিনের ব্যবস্থা করুন।”

উকিল জানাল, ব্যাপারটা অতটা সোজা হবে না। কারণ সরকারের তরফে মিউ-মিউকে নিষিদ্ধ ড্রাগের তালিকায় আনার চেষ্টা হচ্ছে। এক বার নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়ে যাওয়ার পর যদি মামলার শুনানি হয়, তা হলে কেস সামলাতে বেগ পেতে হবে।

উকিলের ভয়টাই সত্যি হল। শুনানির ঠিক আগেই নিষিদ্ধ হল মেফিড্রোন বা মিউ-মিউ।

শুনানিতে বেবি পাটানকরের উকিল বলল, অভিযুক্ত নির্দোষ, কারণ যে সময়ে বেবির ঘর থেকে মিউ-মিউয়ের স্টক বাজেয়াপ্ত হয়েছে, তখন এই ড্রাগ নিষিদ্ধ ছিলই না।

যুক্তিটা মানলেন না বিচারক, তিনি বললেন, “এই ড্রাগ স্টোর করার জন্যই ধর্মরাজ কালোখে-র চাকরি গিয়েছে। তা হলে তার সহ-অভিযুক্তের ক্ষেত্রে এতটা উদারতা দেখানো যাবে কী করে?”

বেবি বুঝল, বিচারক সোজা পাত্র নন। সে স্পষ্ট গলায় বলল, “ধর্মাবতার, আসল কথা হল, যা বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে, তা কিন্তু ওই মিউ-মিউ নয়।”

বিচারসভা নিস্তব্ধ। বেবির উকিল পর্যন্ত নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। তিনি অবিশ্বাসীর দৃষ্টিতে বেবির দিকে তাকালেন। বেবির ঠোঁটে আত্মবিশ্বাসের চাপা হাসি।

বিচারক বললেন, পুলিশের রিপোর্ট যথেষ্ট নয়। সরকারি পরীক্ষাগার থেকে উপযুক্ত রাসায়নিক পরীক্ষা করে রিপোর্ট পেশ করা হোক। তত দিনের জন্য বেবি কিছু কড়া শর্তসাপেক্ষে জামিনে ছাড়লেন তিনি।

ছাড়া পাওয়ার পর তিন দিন কেটে গিয়েছে। বেবি নিরুত্তাপ। হঠাৎ ফোন। ধরতেই অচেনা এক পুরুষকণ্ঠ, সাতারা থানার সুপারিন্টেন্ডেন্ট অব পুলিশ বেবির সঙ্গে কথা বলতে চান। এসপি সাহেব জানালেন বেবিকে জেল খাটা থেকে বাঁচাতে তাঁর পাঁচ লাখ টাকা লাগবে।

বেবি মৃদু হেসে বলল, “একটু কিছু কম হয় না, সাহেব?”

পুলিশি গাম্ভীর্যসহ উত্তর, “না। পাঁচ লাখ ক্যাশ। মামলা ঘুরে যাবে।”

রাজি হয়ে গেল বেবি। কিন্তু এই এসপি-কে তার পছন্দ নয়। লোকটা আগেও বেবির থেকে দশ লাখ নিয়েছিল। সুযোগ বুঝে আবার টাকা চাইছে। একেও শিক্ষা দিতে হবে। পুলিশ মহলের উপরতলায় একটা ফোন করল বেবি। এসপি-র নাম বলে জানিয়ে দিল, তাকে বাঁচানোর জন্য এই পুলিশ পাঁচ লাখ টাকা ঘুষ চাইছে। তার পর আরও কিছু ক্ষণ তার কথা চলল পুলিশের বড়বাবুর সঙ্গে।

নির্দিষ্ট দিনে মুম্বইয়ের এক জনবহুল বাজারে বেবির হাত থেকে পাঁচ লাখ টাকা নিতে গিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়ে গেলেন সাতারার এসপি।

তার পর কেটে গেল এক সপ্তাহ। এল সেই শুনানির দিন। ল্যাব টেস্টের রিপোর্টে জানা গেল, ধর্মরাজ কালোখে বা বেবি পাটানকরের বাড়ি থেকে বাজেয়াপ্ত হওয়া সাদা গুঁড়োর মতো পদার্থটি আসলে আজিনা মোটো। রাসায়নিক নাম মোনোসোডিয়াম গ্লুটামেট। চাইনিজ় রান্নায় ব্যবহার করা হয়। দু’টো আলাদা-আলাদা শহরের সরকারি ল্যাব তাদের রিপোর্টে একই তথ্য জানিয়েছে। ধরম এবং বেবি— দু’জনেই বেকসুর খালাস। আইন শুধু সাক্ষ্য এবং প্রমাণ বোঝে। তার বাইরে কিছু নয়। কারণ তার চোখ বাঁধা। না হলে হয়তো সে প্রশ্ন করত, এক জন পুলিশ কনস্টেবল তার বাড়িতে কিলো-কিলো আজিনা মোটো জমিয়ে রেখেছিল কেন!

জানা যায়, জেল থেকে বেরনোর পর দাঁতে দাঁত ঘষে ধরম তার বেবিকে বলেছিল, ‘‘আর যেন কখনও আমাদের দেখা না হয়...’’

বেবি মিষ্টি করে হেসে বলেছিল, ‘‘অত জোর দিয়ে কি কিছু বলা যায়!’’

মিউ-মিউয়ের সেই বিশাল স্টক কী করে রাতারাতি আজিনা মোটো হয়ে গেল, শশিকলা বেবি পাটানকরের এই রহস্যের হদিস আজও মেলেনি।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement