শুধু ‘দত্তা’-র ক্ষেত্রেই নয়, ‘দেবদাস’-এর চন্দ্রমুখী কিংবা ‘পথের দাবী’-র সুমিত্রা— শরৎচন্দ্রের নায়িকাদের অন্য মাত্রায় নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি।
Actress

Chandravati Devi: তিনিই লেখকের মনোনীত ‘বিজয়া’

অভিনয়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রযোজক হিসেবেও চন্দ্রাবতী দেবী সফল। আগামী পরশু তাঁর ১১২তম জন্মদিন।

Advertisement

পৃথা কুণ্ডু

শেষ আপডেট: ১৭ অক্টোবর ২০২১ ০৯:০৩
Share:

মেয়েরা অভিনয় করবে! তাও শিক্ষিত অভিজাত পরিবারের মেয়ে! এ যে অসম্ভব! সে যুগে জমিদার এবং অনারারি ম্যাজিস্ট্রেট গঙ্গাধরপ্রসাদ সাহুর মেয়েদের পক্ষে অভিনয়ের জগতে আসা তাই সহজ ছিল না মোটেই। উপরন্তু লেখাপড়ায় ভাল ছিলেন দুই বোনই। তবু অভিনয়ের নেশায় রক্ষণশীলতার আগল ভাঙলেন বড় বোন কঙ্কাবতী, জায়গা করে নিলেন তিরিশের দশকে বাংলা রঙ্গমঞ্চের নামী অভিনেত্রী হিসেবে। দিদিকে সামনে রেখেই ছোট বোনের পথ চলা। তিনি চন্দ্রাবতী। তবে মঞ্চ নয়, তাঁর স্বপ্ন ছিল চলচ্চিত্র জগৎকে ঘিরে। তাঁর নিজের কথায়, “রাতে ঘুমোতে পারি না— স্বপ্নের মধ্যে আসা যাওয়া করে লুপে ভ্যালের অপূর্ব অভিনয়, চার্লি চ্যাপলিনের ভাবে ভরা মুখ, গ্রেটা গার্বোর মহিমময় অভিব্যক্তি। না, স্টেজ নয়—সিনেমা, আমার নিজস্ব জগৎ...”

Advertisement

বিহারের মজফ্‌ফরপুরে ১৯০৯ সালের ১৯ অক্টোবর জন্ম চন্দ্রাবতীর। খুব কম বয়সেই কলকাতায় চলে আসেন, ভর্তি হন ব্রাহ্ম বালিকা বিদ্যালয়ে, পরে বাংলা সাহিত্যে স্নাতক হন বেথুন কলেজ থেকে। পড়াশোনার পাশাপাশি দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের তত্ত্বাবধানে গান শিখেছেন, পেয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্নেহস্পর্শও। সরাসরি নির্বাক ছবিতে অভিনয়ের সুযোগ আসে বিয়ের সূত্রে। স্বামী বিমল পাল ফিল্ম এবং পত্রিকা জগতের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। স্বামীর সঙ্গে মিলে চন্দ্রাবতী গড়ে তুললেন নিজস্ব প্রযোজনা সংস্থা ‘মুভি পিকচার্স’। এই সংস্থার ব্যানারেই তাঁর প্রথম অভিনয় ‘পিয়ারী’ (১৯২৯) ছবিতে। পরিচালক বিমল পাল, আর প্রযোজক হিসেবে নাম ছিল চন্দ্রাবতীর। সে ক্ষেত্রে বাংলার প্রথম মহিলা চলচ্চিত্র প্রযোজক হিসেবে কৃতিত্বের দাবিও সম্ভবত তাঁরই। চন্দ্রাবতী সিনেমাহলের মালিকানাও নিয়েছিলেন, যে ঘটনা তখনকার বিচারে বিরল। নদিয়া জেলার রানাঘাট টকিজ় গড়ে ওঠে ১৯৩৭ সালে, এর মালিক ছিলেন তিনি। ‘বায়োস্কোপ’ নামে একটি পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্বও ছিল চন্দ্রাবতীর।

‘পিয়ারী’ ছবির পর অশোক কুমারের বিপরীতে অভিনয়ের জন্য বম্বে যাবার সুযোগ এসেছিল। ছবির কাজ শুরু হলেও, কোনও অজানা কারণে আর শেষ হয়নি। চন্দ্রাবতী ফিরে আসেন কলকাতায়। বাংলা সবাক ছবিতে তাঁর আত্মপ্রকাশ এই সময়ই। শিশিরকুমার ভাদুড়ী ‘সীতা’ নাটকের চলচ্চিত্রায়ন +করবেন বলে ঠিক করলেন। ঊর্মিলার ভূমিকায় মনোনীত করলেন চন্দ্রাবতীকে। মেকআপ টেস্ট দিতে নিউ থিয়েটার্স স্টুডিয়োয় এলেন চন্দ্রাবতী— আর তাঁকে দেখেই পছন্দ হয়ে গেল দেবকীকুমার বসুর। তাঁর ‘মীরাবাঈ’ (১৯৩৩) ছবিতে গায়িকা-নায়িকার ভূমিকায় অনবদ্য অভিনয় করলেন চন্দ্রাবতী। অবশ্য শুটিংয়ের সময় এক দিকে পরিচালক আর অন্য দিকে সুরকার রাইচাঁদ বড়াল— দুই দিকপালকে খুশি করতে নাজেহাল অবস্থা হত তাঁর। পরের বছর ‘দক্ষযজ্ঞ’ ছবিতে সতী-র চরিত্রে অভিনয় করেও চিত্রসাংবাদিকদের প্রশংসা পেয়েছিলেন তিনি।

Advertisement

প্রমথেশ বড়ুয়ার ‘দেবদাস’ ছবিতে চন্দ্রমুখীর ভূমিকায় অভিনয় চন্দ্রাবতীকে অনন্য মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করে। নাচে গানে অভিনয়ে মাতিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। স্বয়ং শরৎচন্দ্র তাঁকে বলেছিলেন, ‘আমার রচনার চেয়ে অনেক বেশি সতেজ হয়েছে তোমার অভিনয়।’ শোনা যায়, ‘দত্তা’ ছবিতে বিজয়ার ভূমিকায় অভিনয়ের জন্য লেখক নিজেই অনুরোধ করেছিলেন তাঁকে। চন্দ্রাবতীর মৃত্যুর পর এক প্রবীণ চিত্রসাংবাদিক লিখেছিলেন, পরবর্তী কালে ‘বিজয়া’ চরিত্রে অভিনয় করেছেন সুনন্দা দেবী এবং সুচিত্রা সেন। তিনটি ছবিতে তিন জনেরই অভিনয় দেখার সৌভাগ্য তাঁর হয়েছে, কিন্তু তাঁর মতে চন্দ্রাবতীই সেরা। অভিনয়ের গুণে, নিষ্ঠায় হোক বা বাংলা সাহিত্য শিক্ষার কারণেই হোক— শরৎচন্দ্রের নায়িকাদের চরিত্র যেন বিশেষ করে প্রাণ পেত তাঁর হাতে। ‘পথের দাবী’ ছবিতে সুমিত্রা চরিত্রে তাঁর বাচনভঙ্গি, অভিব্যক্তি সবাইকে মুগ্ধ করেছিল।

সমসাময়িক আর এক বিশিষ্ট অভিনেত্রী কানন দেবী চন্দ্রাবতী সম্পর্কে অকপটে বলেছিলেন, “‘দিদি’ ছবিতে চন্দ্রাবতীর প্রেসিডেন্টের অভিনয় এখনও চোখের সামনে ভাসে। ব্যক্তিত্বপূর্ণ ও ডিগনিফায়েড রোলে ওকে দারুণ মানাত। আর সেসময় ওর জোড়া রূপসী এ লাইনে খুব কম ছিল।” যিনি এ কথা এমন অকপটে স্বীকার করেছেন তাঁর নামটা শুনলে অবাক হতে হয়, তিনি কানন দেবী। লিখেছেন তাঁর আত্মকথা ‘সবারে আমি নমি’তে। সুচিত্রা-যুগের আগেই, সেটে ‘ম্যাডাম’ বলে ডাকা হত এই অভিজাত অভিনেত্রীকে— জানিয়েছেন বিকাশ রায়।

সৌন্দর্য আর ব্যক্তিত্ব সহজাত হলেও, সাজতে বড় ভালবাসতেন চন্দ্রাবতী। মেকআপ রুমে কাটিয়ে দিতেন দু’-তিন ঘণ্টা। রূপসজ্জার ‘ফাইনাল টাচ’ নিজেই দিতেন। প্রবীণ বয়সে ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’ ছবিতে ভৈরবী চরিত্রে অভিনয় করতে এসেও মেকআপের জন্য বাচ্চা মেয়েদের মতো অস্থির হতেন। বিকাশ রায় অনুযোগ করলে বলতেন, “বা রে, মেকআপ না করলে যে শুটিং করছি মনেই হবে না— কত দিনকার অভ্যেস বলুন তো! আমি রোজ একটু আধটু মেকআপ করেই আসব, আপনিও রোজ সেগুলো তুলে দেবেন।” অন্য শখটি ছিল পান। শুটিং-এর অবসরে সর্বক্ষণের সঙ্গী পানের ডিবে। নিজের মুখ তো চলতই, অন্যদেরও পান সেজে খাওয়াতেন।

কঠিন দৃশ্যে ক্যামেরার দিকে পেছন-ঘোরা শটে কে তাঁর ‘ডামি’ হবে, সেই ব্যাপারে খুব খুঁতখুঁতে ছিলেন। ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’-এ উটের পিঠে চড়ার দৃশ্যে ছোটখাটো চেহারার উটচালক কুল্লুন খাঁ-কে শাড়ি পরিয়ে, ঘোমটা দিয়ে তাঁর ডামি সাজানো হত। ব্যাপারটা একেবারেই পছন্দ হত না চন্দ্রাবতীর, “এতজন থাকতে শেখ কুল্লুন খাঁ আমার ডামি!— আমি কি এতই খারাপ দেখতে?”

অসামান্য ব্যক্তিত্ব আর শিশুর মতো সারল্যে গড়া এই শিল্পী চরিত্র এবং অভিনয়কে অনুভব করতেন আপন আত্মায়। চরিত্রের প্রয়োজনে নিজেকে ভাঙাগড়ায় তিলমাত্র দ্বিধা ছিল না তাঁর। তা না হলে নায়িকার চরিত্রে অভিনয় করতে করতে হঠাৎ মায়ের চরিত্রে অভিনয় করে সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার পাওয়া সহজ কথা নয়। ১৯৪০ সালে ‘শুকতারা’ ছবিতে নায়কের মায়ের চরিত্রে অভিনয় করে পেয়েছিলেন বিএফজে পুরস্কার, আবার পরের বছরই নায়িকা হিসেবে অভিনয়, দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিপরীতে ‘প্রিয়বান্ধবী’ ছবিতে। কাহিনিকার প্রবোধকুমার সান্যাল, পরিচালক সৌমেন মুখোপাধ্যায়। এটি দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের শেষ ছবি। ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৪৩ সালের জানুয়ারিতে। তা দেখে যেতে পারেননি দুর্গাদাস। জেনে যেতে পারেননি কী রকম প্রশংসা পেয়েছিল চন্দ্রাবতী ও তাঁর অভিনয়। “রচনার সম্পূর্ণ মর্যাদা রক্ষা হত না যদি প্রধান চরিত্র দুটিতে দুর্গাদাস ও চন্দ্রাবতীর মত শিল্পী না পাওয়া যেত,” লেখা হয়েছিল ‘দেশ’ পত্রিকায়। বঙ্গীয় চলচ্চিত্র দর্শক সমিতির বিচারে এ ছবির নায়ক-নায়িকা দু’জনেই শ্রেষ্ঠত্বের সম্মান পেয়েছিলেন। ‘দুই পুরুষ’ (১৯৪৫) চলচ্চিত্রেও ছবি বিশ্বাসের বিপরীতে বিমলা চরিত্রে অভিনয়ের জন্য সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার পান চন্দ্রাবতী। নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের সামনে নিয়ে আসতেও তাঁর উৎসাহ ছিল পুরোমাত্রায়। সুপ্রিয়া দেবীর পরিবার ছিল চন্দ্রাবতীর প্রতিবেশী। মেয়ের অভিনয়ের জন্য সুপ্রিয়ার বাবাকে রাজি করাতে পরিচালক নীরেন লাহিড়িকে সঙ্গে নিয়ে তাঁদের বাড়ি এসেছিলেন তিনি।

পঞ্চাশ বা ষাটের দশকে প্রধানত চরিত্রাভিনয়ের দিকে সরে আসেন চন্দ্রাবতী দেবী। ‘অগ্নিপরীক্ষা’, ‘ত্রিযামা’, ‘একটি রাত’, ‘জীবনতৃষ্ণা’, ‘পথে হল দেরি’, ‘বিচারক’, ‘কায়াহীনের কাহিনী’, ‘রাজকন্যা’, ‘আমি সিরাজের বেগম’ প্রভৃতি ছবিতে স্মরণীয় হয়ে আছে ছোট অথচ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় তাঁর অভিনয়। সত্তরের দশকের শেষ দিকে নিজেকে গুটিয়ে নেন অভিনয়ের দুনিয়া থেকে। সুলেখিকাও ছিলেন চন্দ্রাবতী। শিল্প ও শিল্পীর শুদ্ধতায় আজীবন বিশ্বাসী এই ব্যতিক্রমী অভিনেত্রী স্মৃতিকথায় লিখে গেছেন— “যে পিচ্ছিল পথে আমায় কর্মজীবনে চলতে হয়েছে তাতে শুদ্ধ থাকবার বাধা প্রতি পদেই। তবু এক অনাবিল শুদ্ধতার স্বপ্ন চিরদিনই দেখেছি। কতটা পেরেছি সে প্রশ্ন বড়ো নয়।”

একাধারে অভিনয়-গান-প্রযোজনা-পত্রিকা সম্পাদনা সব কিছুতেই স্বতন্ত্র প্রতিভার আলো ছড়িয়ে যাওয়া এই অনন্যার চিরবিদায়ের দিনটি ছিল ২২ এপ্রিল, ১৯৯২। তখনই প্রায় বিস্মৃত তিনি। পত্রপত্রিকায় তাঁর প্রয়াণের খবর ছাপা হয়েছিল দায়সারা ভাবে। অথচ ইতিহাসের তো মনে রাখা উচিত ছিল তাঁকে। আগামী ১৯ অক্টোবর তাঁর ১১২তম জন্মদিন। তাঁকে স্মরণ না করলে বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাস সম্পূর্ণ হয় না।

তথ্যঋণ: ‘চন্দ্রাবতী দেবী স্মৃতিকথা ও অন্যান্য’, সম্পাদনা: সুমিতা সামন্ত, ঋত প্রকাশন; ‘কিছু স্মৃতি কিছু কথা’: বিকাশ রায়, করুণা প্রকাশনী

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement