প্রতিভাময়ী: রোসালিন ইয়ালো। ছবি: গেটি ইমেজেস।
ছোটবেলায় বাবা বলতেন, একটা মেয়ে একটা ছেলের মতোই সব কাজ করতে পারে। জেদি আর একরোখা মেয়েটির বই-পড়ার তীব্র নেশা ছিল। আট বছর বয়সেই মনস্থির করে ফেলেছিল, বড় হয়ে বিজ্ঞানী হবে, বিয়ে করবে, আর ছেলে-মেয়ের মা-ও হবে! প্রতিজ্ঞা রেখেছিল মেয়েটি, পুরুষ-কেন্দ্রিক বিজ্ঞান-গবেষণার জগতে এক নক্ষত্র হয়ে।
নিউ ইয়র্কের ব্রঙ্কস অঞ্চলে জন্ম রোসালিন সাসমান-এর। ১৯২১ সালের ১৯ জুলাই, অসচ্ছল ইহুদি পরিবারে। স্কুলের পড়া শেষ হলে দরিদ্র পরিবারের মেয়েটি নিউ ইয়র্কের অবৈতনিক হান্টার কলেজে কেমিস্ট্রি নিয়ে পড়তে গেল। ত্রিশের দশকের শেষ ভাগে নিউক্লিয়ার-ফিজ়িক্স সারা পৃথিবীতে বিজ্ঞানচর্চার নতুন দরজা খুলে দিয়েছিল। ইভ কুরির লেখা, মারি কুরির জীবনী পড়ে সতেরো বছরের রোসালিনের মনে হয়েছিল, বইটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য, প্রতিটি প্রত্যাখ্যানের পরেও মারি সাফল্য পেয়েছেন। তাঁর ঝোঁক চাপে তেজস্ক্রিয় পরমাণুর দিকে।
রোসালিন ফিজ়িক্সে স্নাতক হল। কোনও ভাল গ্র্যাজুয়েট স্কুল তখন দরিদ্র ইহুদি মেয়েকে ফিজ়িক্স নিয়ে মাস্টার্স পড়ার সুযোগ বা আর্থিক সাহায্য দিত না। সময়টা ১৯৪১ সাল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য ছাত্ররা দলে দলে যোগ দিচ্ছে যুদ্ধে, সেই সুবাদে চারশো ছাত্রের মধ্যে একা ছাত্রী হয়ে রোসালিন পড়ার সুযোগ পেল ইলিনয় ইউনির্সিটিতে। অনেক পরে এ কথা মনে করে বলেছিলেন, ‘ভাগ্যিস তখন ছেলেরা যুদ্ধে গিয়েছিল, তা না হলে পড়ার সুযোগ, নোবেল প্রাইজ় কিছুই হত না।’ পিএইচ ডি করলেন নিউক্লিয়ার-ফিজ়িক্সে। তত দিনে সহপাঠী ইহুদি যুবক অ্যারন ইয়ালোর সঙ্গে বিয়ের পর নাম হয়েছে রোসালিন ইয়ালো। কেরিয়ার শুরু করলেন প্রথমে নিউ ইয়র্কে এক টেলিকমিউনিকেশন ল্যাবরেটরিতে, পরে হান্টার কলেজে ফিজ়িক্স পড়াতেন। পড়ানোর পর দীর্ঘ অবসর, ছটফট করেন রোসালিন, টাকা-পয়সা না পেয়েও মেডিক্যাল-ফিজ়িক্সে যদি গবেষণার সুযোগ হয়! প্রথম জীবনে চিকিৎসক হওয়ার ইচ্ছে ছিল, অর্থাভাবে সম্ভব হয়নি। মাদাম কুরি, তাঁর মেয়ে আইরিন ও আইরিনের স্বামী ফ্রেডরিকের গবেষণা তাঁর চোখে অন্য আলো জ্বেলে দিয়েছে। তিনি জেনেছেন পরমাণুর ভেতরে লুকিয়ে থাকা নিউক্লিয়াসের প্রচুর শক্তির কথা, যা নিউক্লিয়াস ভেঙে গেলে বাইরে বেরিয়ে আসে। তত দিনে পরমাণু থেকে তৈরি হয়েছে কৃত্রিম রেডিয়ো-আইসোটোপ। যে সব মৌলের পরমাণুর নিউক্লিয়াসে প্রোটনের সংখ্যা সমান, তাদের একে অপরের আইসোটোপ বলে। কৃত্রিম উপায়ে তেজস্ক্রিয় রশ্মির সাহায্যে পরমাণুর নিউক্লিয়াসকে তেজস্ক্রিয় রশ্মি দ্বারা ভেঙে যে আইসোটোপ তৈরি হয়, তাদের বলে রেডিয়ো আইসোটোপ। রোসালিন হাঙ্গেরির নোবেলজয়ী-বিজ্ঞানী জর্জ হেভেসের লেখা বই পড়ে জেনেছেন রেডিয়ো-আইসোটোপ দিয়ে প্রাণীর শরীরের মধ্যে অবিরাম ঘটে চলা রাসায়নিক-বিক্রিয়া কী ভাবে শনাক্ত করা যায়।
স্বামী অ্যারনের সহায়তায় ব্রঙ্কসের ভেটারান্স অ্যাডমিনিস্ট্রেশন হাসপাতালের রেডিয়ো-আইসোটোপ সার্ভিস বিভাগে অস্থায়ী গবেষণা-পরামর্শদাতার পদ পেলেন। জীবনের ৪৫ বছর এই হাসপাতাল ছিল তাঁর গবেষণাস্থল। ১৯৪৭-এর ডিসেম্বরে শুরু হল চাকরি। করিৎকর্মা রোসালিন দারোয়ানদের শৌচাগারকে ক্রমে ক্রমে করে তুললেন আমেরিকার প্রথম দিকের অন্যতম রেডিয়ো-আইসোটোপ ল্যাবরেটরি। তখন এ বিষয়ে গবেষণার যন্ত্রপাতি পাওয়া যেত না। রোসালিন তাঁর ইঞ্জিনিয়ারিং জ্ঞান কাজে লাগিয়ে নিজস্ব পরিকল্পনায় তেজস্ক্রিয়তা শনাক্তকরণের জন্য তৈরি করলেন রেডিয়েশন ডিটেক্টর। গবেষণার তাগিদে কলেজ ছেড়ে পাকাপাকি ভেটারান্স হাসপাতালে যোগ দিলেন।
যন্ত্র প্রস্তুত। কিন্তু মেডিক্যাল-ফিজ়িক্স নিয়ে কাজ করতে হলে মানুষের শরীরের খুঁটিনাটি জানতে হবে। প্রয়োজনীয় বইপত্র পড়লেন, তবু দরকার এক জন যোগ্য গবেষণার সঙ্গীর, যাকে তিনি ফিজ়িক্স শেখাবেন, বিনিময়ে নিজে শিখবেন মেডিসিন সম্পর্কে। পেয়েও গেলেন এক অসাধারণ মানুষকে। সলোমন বারসন। তাঁদের যৌথ গবেষণার সম্পর্ক ছিল বাইশ বছর।
নিজেদের জ্ঞান-অভিজ্ঞতা সঙ্গী করে রোসালিন ও বারসনের যৌথ গবেষণা শুরু হল। তখন সবাই জানত শরীরে ইনসুলিন হরমোনের অভাবে ডায়াবেটিস হয়। রোসালিন ঠিক করলেন, সহজে ও বিশুদ্ধ অবস্থায় সংগ্রহযোগ্য ইনসুলিন নিয়ে কাজ করবেন। এ ব্যাপারে তাঁর ব্যক্তিগত আগ্রহের দিক ছিল স্বামী অ্যারনের ডায়াবেটিস। ১৯৫০ সালে গরুজাতীয় প্রাণীর শরীর থেকে পাওয়া ইনসুলিন ব্যবহার করে মানুষের ডায়াবেটিসের চিকিৎসা হত। কিন্তু বিজ্ঞানীরা দেখেছিলেন কিছু সময় পরে রোগী এই ইনসুলিনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। রোসালিন ও বারসন পরীক্ষা করলেন অন্য ভাবে। ইনসুলিন একটা খুব ছোট আকারের অণু, জৈব-রসায়নের ভাষায় এদের বলে পেপটাইড। তাঁরা এই ইনসুলিন অণুর সঙ্গে আয়োডিনের রেডিয়ো-আইসটোপ আটকে দিলেন, যাতে এদের সহজে চেনা যায়। ডায়াবেটিক মানুষের রক্তে এই বিশেষ ইনসুলিন প্রবেশ করিয়ে দেখলেন, ইনসুলিন নিতে অভ্যস্ত ডায়াবেটিক রোগীদের রক্ত থেকে ইনসুলিনের মাত্রা কমছে। রোসালিন অনুমান করলেন, ডায়াবেটিকদের শরীরের প্রতিরক্ষা-ব্যবস্থা নিশ্চয়ই অন্য প্রাণীর দেহজাত ইনসুলিনের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি করে। সে দিনের বিজ্ঞানীরা জানতেন আন্টিজেন-অ্যান্টিবডির বিক্রিয়া মানে দ্রবণে তলানি অধঃক্ষেপ বা দানাদার জমাটবদ্ধ বস্তু দেখতে পাওয়া। এখানে তেমন কিছু হল না। কিন্তু প্রমাণ হিসেবে তাঁরা দেখালেন রেডিয়োঅ্যাকটিভ-আয়োডিন যুক্ত ইনসুলিন রক্তের মধ্যে গ্লোবিউলিন জাতীয় প্রোটিনের সঙ্গে যুক্ত অবস্থায় উপস্থিত। এর আগে কেউ রেডিয়ো-আইসোটোপ ব্যবহার করে কোনও দ্রবণে অ্যান্টিজেন-অ্যান্টিবডির প্রাথমিক বিক্রিয়া দেখাতে পারেনি। সমকালীন বিজ্ঞানীরা মানতে চাননি যে, ইনসুলিনের মতো ছোট পেপটাইড অণুর বিরুদ্ধেও শরীর অ্যান্টিবডি তৈরি করে। রোসালিনদের এই পরীক্ষার মধ্য দিয়ে গড়ে উঠল জৈব বস্তুর ন্যূনতম পরিমাণ শনাক্তকরণের এক নতুন পদ্ধতি, যার নাম তাঁরা দিলেন রেডিয়ো-ইমিউনো-অ্যাসে (আরআইএ)। বৈজ্ঞানিক মহল তবুও সন্দিহান। ১৯৫৫ সালে তাঁদের মূল গবেষণাপত্র প্রত্যাখ্যান করল ‘জার্নাল অব ক্লিনিক্যাল মেডিসিন’। অনেক তর্কের পর ১৯৫৬ সালে গবেষণাপত্র গৃহীত হল। এ ঘটনা রোসালিনের মনে ভীষণ তিক্ত স্মৃতি রেখে দিয়েছিল, নোবেল-সভায় সেটি উল্লেখ করতে ভোলেননি।
এটুকুতেই তাঁরা থামলেন না। পরবর্তী দিনে আরও নিখুঁত, গভীর গবেষণা চলল। আরআইএ ব্যবহার করে হরমোনে অ্যান্টিবডির উপস্থিতি ও পরিমাণ মাপার পাশাপাশি একটি পরিপূরক প্রক্রিয়ায় হরমোনকে, সরাসরি মাপলেন। কোনও বিজ্ঞানী আগে এমন করেননি।
১৯৭২ সালে সহ-গবেষক বারসনের আকস্মিক মৃত্যুতে অনেক বিজ্ঞানী বলতে শুরু করলেন রোসালিনের ভবিষ্যৎ এ বার অন্ধকার। মেয়েদের আবার বৈজ্ঞানিক প্রতিভা! বারসনের মৃত্যুতে সাময়িক ভেঙে পড়লেও অদম্য রোসালিন সপ্তাহে প্রায় একশো ঘণ্টা কাজ করে চললেন। চার বছরের মধ্যে প্রায় ষাটটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হল। চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিভিন্ন বৃত্তে, যেমন রক্তে হেপাটাইটিস ভাইরাসের উপস্থিতি জানতে ও রক্ত-সংবহনে, ভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে, দেহে যক্ষ্মার ব্যাকটিরিয়া উপস্থিতি বুঝতে, ক্যানসার নির্ণয়ে, বিভিন্ন হরমোন ভিটামিন, ড্রাগ, বিষাক্ত-বস্তু প্রভৃতির পরিমাণ মাপতে, হরমোন ঘটিত রোগের শনাক্তকরণে আরআইএ-র সূক্ষ্ম সংবেদী ভূমিকা অনিবার্য হয়ে পড়েছিল। নোবেল কমিটির কাছে চাপ আসছিল এই আবিষ্কারের স্বীকৃতি দেওয়া হোক। ১৯৭৭ সালে রোসালিন পেলেন সেই স্বীকৃতি, নোবেল-সভায় এসে সঙ্গী বারসনের অভাব বোধ করেছিলেন খুব। কানে এল তাঁর কাজ সম্পর্কে বলা হচ্ছে— ‘হরমোন-সংক্রান্ত গবেষণার এক যুগান্তকারী আবিষ্কার, যা বহু গবেষকদের জীবন বদলে দেবে...’
অনেক লড়াই করে পুরুষকেন্দ্রিক বিজ্ঞানের জগতে নিজের জায়গা করে নিলেও রোসালিনের কাছে পূর্ণ নারীত্বের সংজ্ঞা ছিল গৃহপালন ও মাতৃত্ব। পেশা বা শিক্ষার জগতে মেয়েদের সংরক্ষিত অবস্থান সম্পর্কে ক্ষুব্ধ হয়ে বলতেন, এতে মেয়েদের অসম্মান করা হয়। শুধুমাত্র নারী বলে বিশেষ সম্মান, যেমন ‘ফেডারাল উওম্যান্স অ্যাওয়ার্ড’ অথবা ‘উওম্যান অব দি ইয়ার পুরস্কার’ রোসালিন বিনীত ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন। বলতেন, ‘বিজ্ঞানের দুনিয়ায় পুরুষ আর নারীর মধ্যে একটাই প্রভেদ, নারীরা সন্তানের জন্ম দেয়। সেটি নারী বিজ্ঞানীদের পক্ষে আরও বেশি কষ্টদায়ক, কিন্তু অন্য অনেক চ্যালেঞ্জের মতো একটি আর একটি চ্যালেঞ্জ মাত্র।’ নোবেল পাওয়ার পর ছোট্ট একটি জীবনী লিখেছিলেন। সেখানে বর্ণনা করেছেন কী ভাবে উপেক্ষা, অপমান সঙ্গী করে আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্রে এক নতুন যুগের জন্ম দিয়েছিলেন। রেডিয়ো-ইমিউনো-অ্যাসে আবিষ্কারের পেটেন্ট তিনি নেননি। তাই এই শতকেও আরআইএ-পদ্ধতির মুল নীতি অবলম্বন করে অনেক আধুনিক টেকনিকের সৃষ্টি হয়েছে।
তাঁর জীবনের সমাপ্তি ২০১১ সালের ৩০ মে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে তিনি চিরস্মরণীয়া।