রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে সরাসরি চিঠি লিখে প্রশ্ন করেছিলেন তিনি । তাঁর সম্পাদনাতেই প্রকাশিত কবির গ্রন্থসম্ভার।
Rabindranath Tagore

‘জনগণমন’ কি আসলে ব্রিটিশ শাসকের জয়গান

উত্তরে লেখা কবির বিস্তারিত ব্যাখ্যা অবসান ঘটিয়েছিল বহু বিভ্রান্তির। সেই পত্রলেখকই পুলিনবিহারী সেন। লেখার ভুলত্রুটি শুধরোতে প্রধানত তাঁর মতামতই মেনে নিতেন কবি।

Advertisement

পীতম সেনগুপ্ত

শেষ আপডেট: ২২ অগস্ট ২০২১ ০৮:৩৬
Share:

সম্পাদক: পুলিনবিহারী সেন। নিজেকে বরাবর আড়ালে রাখতেই ভালবাসতেন তিনি।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বয়স তখন ৭৬। ২৯ বছর বয়সি এক যুবকের একটি চিঠির কৈফিয়ত লিখতে বসলেন। তারিখটি ১৯৩৭ সালের ২০ নভেম্বর। সেই চিঠিটি পরে একটি ঐতিহাসিক দলিল হয়ে উঠেছিল। ১৯১১-র ২৬-২৮ ডিসেম্বর কংগ্রেসের ২৬তম অধিবেশন বসেছিল এই শহরে। দ্বিতীয় দিন অধিবেশন শুরু হল সরলাদেবী চৌধুরী, অমলা দাশ, দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অমল হোম প্রমুখের সমবেত কণ্ঠে ‘জনগণমনঅধিনায়ক’ গানটি দিয়ে। সে বার ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লিতে স্থানান্তর উপলক্ষে ডিসেম্বরে ইংল্যান্ডের সম্রাট পঞ্চম জর্জ সস্ত্রীক দিল্লি হয়ে কলকাতায় আসেন।

Advertisement

কংগ্রেস অধিবেশনের দ্বিতীয় দিন, অর্থাৎ ২৭ ডিসেম্বর, উদ্বোধনী সঙ্গীতের পর কংগ্রেস নেতারা পঞ্চম জর্জ ও তাঁর স্ত্রীকে সৌজন্যবশত স্বাগত জানান, বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ার জন্য কৃতজ্ঞতাও জ্ঞাপন করেন। পরের দিনে শহরের দু’টি নামী ইংরেজি পত্রিকায় এই সংবাদটি একটু কায়দা করে ছাপা হওয়ায় আগুনে ঘি পড়ল! রবীন্দ্রবিরোধীরা এই বিভ্রান্তিমূলক সংবাদকে সামনে রেখে মিথ্যে প্রচারে নেমে পড়লেন।

এর প্রায় আড়াই দশক পর, কবির থেকে ৪৭ বছরের ছোট এক যুবক কবির কাছে সরাসরি এই গানের সঠিক তথ্য এবং ব্যাখ্যাও জানতে চান। কবি সেই প্রশ্নের উত্তরেই যুবককে লিখেছিলেন—

Advertisement

‘শ্রীযুক্ত পুলিনবিহারী সেন—

জনগণমনঅধিনায়ক গানটি কোনো উপলক্ষ্য-নিরপেক্ষ ভাবে আমি লিখেছি কিনা তুমি জিজ্ঞাসা করেছ। বুঝতে পারচি এই গানটি নিয়ে দেশের কোনো কোনো মহলে যে দুর্বাক্যের উদ্ভব হয়েছে তারই প্রসঙ্গে প্রশ্নটি তোমার মনে জেগে উঠল।’

তখন বাজারে রটেছিল যে, পঞ্চম জর্জের কলকাতা আগমন উপলক্ষ্যেই কবির ‘জনগণমনঅধিনায়ক’ গানটি রচনা। সেদিন ইংরেজি পত্রিকাদু’টিতে লেখা হয়েছিল ‘কয়েকজন বাঙালি ছেলেমেয়ে সমবেত কণ্ঠে হিন্দিতে পঞ্চম জর্জের প্রশস্তিসূচক জয়গান গেয়েছে।’

রবীন্দ্রনাথ পুলিনবিহারীর পাশাপাশি রবীন্দ্রবিরোধীদের উদ্দেশ্যেও সেই চিঠিতে লিখলেন— ‘সে বৎসর ভারতসম্রাটের আগমনের আয়োজন চলছিল। রাজসরকারে প্রতিষ্ঠাবান আমার কোনো বন্ধু সম্রাটের জয়গান রচনার জন্যে আমাকে বিশেষ করে অনুরোধ জানিয়েছিলেন।’

রবীন্দ্রনাথ অনুরোধের গান যে লেখেননি তা তো নয়, তবে সম্রাটের জয়গান লিখবেন এমনটা আশা করা বাড়াবাড়িই হয়েছিল। কবি এ কথা শুনে খুবই বিস্মিত হয়েছিলেন। লিখেওছেন সে কথা— ‘শুনে বিস্মিত হয়েছিলুম, সেই বিস্ময়ের সঙ্গে মনে উত্তাপেরও সঞ্চার হয়েছিল।... আমি জনগণমনঅধিনায়ক গানে সেই ভারতভাগ্যবিধাতার জয়ঘোষণা করেছি, পতনঅভ্যুদয়বন্ধুর পন্থায় যুগযুগান্তরের মানবভাগ্যরথচালক যে পঞ্চম বা ষষ্ঠ বা কোনো জর্জই কোনোক্রমেই হতে পারেন না সে কথা রাজভক্ত বন্ধুও অনুভব করেছিলেন। আজ মতভেদবশতঃ আমার প্রতি ক্রুদ্ধ ভাবটা দুশ্চিন্তার বিষয় নয়, কিন্তু বুদ্ধিভ্রংশটা দুর্লক্ষণ।’

তরুণ বয়সি পুলিনবিহারী সেনকে লেখা কবির সেই চিঠিটি বহু বিভ্রান্তির উত্তর দিয়েছিল, সেই কারণেই চিঠিটি ঐতিহাসিক।

এ ছাড়াও পুলিনবিহারী সেন যে বাংলার সর্বাগ্রগণ্য রবীন্দ্র-বিশারদ, তা বুদ্ধদেব বসু, শঙ্খ ঘোষ, প্রশান্তকুমার পাল প্রমুখ এক বাক্যে স্বীকার করেছেন। অথচ চির কালই তিনি আড়ালে থেকে নীরবে কাজ করে গেছেন। জীবনের উপান্তে এক সংবর্ধনা সভায় নিজের সম্বন্ধে পুলিনবিহারী বলেছিলেন, ‘আমি একজন সামান্য শ্রমিক মাত্র।’

১৯০৮ সালের ১১ অগস্ট পুলিনবিহারী ময়মনসিংহের ব্রাহ্মপল্লিতে জন্মেছিলেন। সে দিন মুজফ্ফরপুরের জেলে বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসুর ফাঁসি হয়। তাই পরিবারে তাঁর ডাকনাম ছিল ‘খুদু’ বা ‘খুদি’। বাবা বিপিনবিহারী ছিলেন চিকিৎসক। ময়মনসিংহের জাতীয় বিদ্যালয়ে পড়া শেষ করার পর অগ্রজপ্রতিম নীহাররঞ্জন রায়ের পরামর্শে ১৯২৫ সালে শান্তিনিকেতনে এসে আশ্রম বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তখন রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন বক্তৃতা ছাত্র পুলিনবিহারী স্বেচ্ছায় অনুলিখন করতেন এবং পরে কবিকে দেখিয়ে অনুমোদনও করিয়ে নিতেন। ১৯৩০ সালের ৩০ জুন একটি চিঠিতে এ প্রসঙ্গে কবি লিখেছিলেন, ‘হি হ্যাজ় লিটারারি গিফ্টস অ্যান্ড হ্যাজ় অফ্ন হেল্পড মি বাই টেকিং রিলায়েবল নোট্‌স অব মাই এক্সটেম্পোর স্পিচেস ইন বেঙ্গলি।”

১৯২৬ সালে বিশ্বভারতীর পক্ষ থেকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হিসেবে ম্যাট্রিকুলেশনে প্রথম বিভাগে পাশ করেন। দু’বছর পর একই ভাবে ইন্টারমিডিয়েটে উত্তীর্ণ হন। এর পর অর্থনীতিতে অনার্স নিয়ে পড়ার জন্য কলকাতায় চলে আসেন। স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে বি এ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এ কৃতিত্বের সঙ্গে পাশ করেন। তার পর পরই বিমা কোম্পানিতে মোটা মাইনের কাজের সুযোগ আসে। অল্প কিছু দিন সেই কাজ করে হাঁপিয়ে ওঠেন। তখন আবার নীহাররঞ্জন রায়ের শরণাপন্ন হন। নীহাররঞ্জন শেষে রবীন্দ্রনাথকে পুলিনবিহারীর কথা জানালে কবি সুপারিশ করেন ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় সহকারী সম্পাদনার কাজের জন্য। তখন ‘প্রবাসী’র অভিজ্ঞ সহকারী সম্পাদক চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার কাজে ‘প্রবাসী’ ছেড়ে চলে যান। তাঁর জায়গায় দায়িত্ব নেন নবীন পুলিনবিহারী। দায়িত্ব পেয়ে ‘প্রবাসী’র প্রধান সহকারী সম্পাদক ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে সম্পাদনার নিপুণতা, সূক্ষ্মতা মন দিয়ে পর্যবেক্ষণ করেন। পাশাপাশি নিয়মিত রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পত্র মাধ্যমে যোগাযোগ রেখে ‘প্রবাসী’র জন্য তাগাদা দিয়ে লেখা পর্যন্ত আদায় করতেন। পত্রে এমনও লিখেছেন— ‘অনেকদিন আগে আপনি একবার বলেছিলেন যে আপনার পুরাতন চিঠি অনেক আছে, সেগুলি ছাপা চলতে পারে।’ কিংবা ‘প্রচলিত দণ্ডনীতি’ সম্বন্ধে আপনার বক্তৃতার প্রুফ পাঠাই।’ কখনও লিখতেন ‘প্রাকৃত বাংলা’ কথাটির সম্বন্ধে আপনি যা বলেছিলেন তার সম্বন্ধে আপনি যদি একটি প্যারাগ্রাফ লিখে দিতেন তা হলে সেটা ছাপা যেত’ ইত্যাদি।

‘প্রবাসী’র সূত্রেই তখন তিনি বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগের ‘রবীন্দ্র-রচনাবলী’র সম্পাদনার কাজে লিপ্ত হন। নিপুণ ভাবেই দু’টি কাজ করে গেছেন বেশ কিছু দিন। এর পর ১৯৩৯-৪০ সালে ‘প্রবাসী’ ছেড়ে বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগে যোগ দেন। রবীন্দ্র-রচনাবলীর প্রথম খণ্ডটি যে দিন মুদ্রিত হয়ে বই আকারে আসে, সে দিন বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগের অধ্যক্ষ চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য পুলিনবিহারীর হাতে একটি বই দিয়ে বলেছিলেন কবির কাছে নিয়ে যেতে। পুলিনবিহারী ‘যে আজ্ঞে’ বলে সদ্য প্রকাশিত নতুন প্রথম খণ্ডটিকে নিয়ে বিকেলবেলায় কবির কাছে চলে গিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ বইটিকে হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখে শুধু বলেছিলেন, ‘দেখে তো মনে হচ্ছে যেন উনিই লিখেছেন।’ সে দিনের এই ঘটনার অন্যতম সাক্ষী হীরেন্দ্রনাথ দত্ত বলছেন, পুলিনবিহারীকে পিছনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রবীন্দ্রনাথ তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে পরিহাস করে এও বলেছিলেন, ‘ইস! ভাবটা যেন কৃতিত্বটা ওঁরই!’ কৌতুকভরা এই দু’টি মন্তব্যেই পুলিনবিহারী বুঝে যান রবীন্দ্রনাথের বইটি পছন্দ হয়েছে। এর পর পুলিনবিহারী বিপুল উদ্যমে কাজে লেগে পড়েন। কবির জীবদ্দশাতেই রচনাবলীর সপ্তম খণ্ড প্রকাশিত হয়েছিল। পরবর্তী ২৯ খণ্ডের রবীন্দ্র রচনাবলীর সম্পাদনা ও প্রকাশেও পুলিনবিহারীর কৃতিত্ব আজও অম্লান। শঙ্খ ঘোষ পুলিনবিহারী সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এই প্রসঙ্গে বলেছেন, “কোনো কবিতার শব্দশুদ্ধি নিয়ে সংশয় তৈরি হচ্ছে, কোথাও সংশয় দেখা দিচ্ছে শব্দছুট নিয়ে, কোনো লেখায় ভুলভাবে এসে গেছে কোনো কথা— সেসব দিকে নজর ফেরানো তো সম্পাদনার স্বাভাবিক এবং প্রত্যাশিত দায়।...এসব সন্দেহ-সংশয়ে, বেশির ভাগ সময়েই রবীন্দ্রনাথ মেনে নিয়েছিলেন পুলিনবিহারীর পরামর্শ।’

এই কথা থেকে বোঝাই যায় রবীন্দ্রনাথ এই তরুণ সম্পাদকটিকে কতটা গুরুত্ব দিয়েছিলেন। মনে রাখতে হবে, রবীন্দ্রনাথ কিন্তু ‘সংগীত-চিন্তা’ বা ‘পল্লীপ্রকৃতি’ নামে কোনও বই লেখেননি। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গীতবিষয়ক বা পল্লীবিষয়ক সমস্ত অগ্রন্থিত লেখা একত্রে সঙ্কলিত করেন পুলিনবিহারীই। এবং তা কবির মৃত্যুর পর একত্রে প্রকাশিতও হয়। মৃত্যূকাল পর্যন্ত অগ্রন্থিত এমন অনেক লেখাই অক্লান্ত পরিশ্রম করে বিষয়বিন্যাসে সঙ্কলিত করেছিলেন তিনি। বুদ্ধদেব বসু পুলিনবিহারী সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘ভাবতে ভালো লাগে যে... লোকচক্ষুর অন্তরালে এক অতি সাধু পরিশ্রমে তিনি লিপ্ত হ’য়ে আছেন;— যে-কর্ম প্রকাশিত হ’লে বৃহত্তর পাঠকসমাজে কোনো রেখাপাত হবে না, এক সহস্র পাঠকের মধ্যে হয়তো মাত্র একজন যা লক্ষ করবেন, তা-ই তিনি রচনা ক’রে যাচ্ছেন তিলে তিলে, বছরের পর বছর ধ’রে, স্বাধীন ও স্বপ্রণোদিতভাবে, শুধু নিজের আন্তরিক উৎসাহে, শুধু রবীন্দ্রনাথের প্রতি আসক্তিবশত এবং সুনির্বাচিত অনুধ্যায়ীদের সাহায্যকল্পে।’

তিনি কখনও নিজেকে এই কৃতিত্বের একক দাবিদার বলে মনে করেননি, বরং নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কানাই সামন্ত, শোভনলাল গঙ্গোপাধ্যায়, জগদিন্দ্রনাথ ভৌমিক, শুভেন্দুশেখর মুখোপাধ্যায় প্রমুখ সহযোগীদের নামও শ্রদ্ধার সঙ্গে উল্লেখ করেছেন। ১৯৫৭ সাল নাগাদ তিনি বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগের অধ্যক্ষ পদে আসীন হন। তিন বছর এই পদে কাজ করেন। ১৯৬০ সালে বিশ্বভারতীর সঙ্গে তাঁর মতানৈক্য হয়। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রশতবর্ষ উপলক্ষে পশ্চিমবঙ্গ সরকার রবীন্দ্ররচনাবলির একটি সুলভ সংস্করণ প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেয়। বিশ্বভারতীর কাছে অনুমোদনের প্রস্তাব এলে পুলিনবিহারী বলেন কাজটি হোক, তবে বিশ্বভারতীর সঙ্গে যৌথ ভাবে। কারণ তাঁর আশঙ্কা ছিল, সরকার পক্ষ একক ভাবে কাজটি করলে কাজের সামগ্রিক মান ক্ষুণ্ণ হতে পারে। বিশ্বভারতীর তৎকালীন উপাচার্য সুধীরঞ্জন দাসের নেতৃত্বে গড়া কমিটি সে দিন পুলিনবিহারীর এই প্রস্তাবটি নাকচ করে দেয়। ফলে তিনি পদত্যাগ করেন। প্রতুলচন্দ্র গুপ্তর মতে, ‘তাঁর এই পদত্যাগ কোনো পক্ষেই শুভ হয়নি— পুলিনবিহারী সেনের পক্ষেও নয়, বিশ্বভারতীর পক্ষেও নয়।’ পরে যদিও তাঁকে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল, তবে সে ক্ষত আর শুকোয়নি।

ফিরে এসে তিনি রবীন্দ্রভবনের ‘রবীন্দ্রচর্চা প্রকল্প’ বিভাগে কাজে যোগ দেন। ১৯৭৩ সালে পুলিনবিহারী সঙ্কলিত কবির মুদ্রিত গ্রন্থের তালিকা ‘রবীন্দ্রগ্রন্থপঞ্জী’ প্রথম খণ্ড প্রথম প্রকাশিত হয়। কবির জীবনের মাত্র ২৫টি বই ও পুস্তিকাকে তিনি প্রকাশের কালানুক্রমে সাজিয়ে বিন্যস্ত করেছিলেন। অন্যান্য উপবিভাগে আছে বিভিন্ন গ্রন্থাবলী, সঙ্কলিত গ্রন্থ এবং কবির মৃত্যুর পর প্রকাশিত গ্রন্থাবলি। এই কাজটি স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই করেছিলেন, বিশ্বভারতী তাঁর উপর চাপিয়ে দেয়নি। তাঁর সম্পাদিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি হল, রবীন্দ্রশতবর্ষপূর্তি উপলক্ষে প্রকাশিত স্মারক গ্রন্থ ‘রবীন্দ্রায়ণ’ প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড, সীতা দেবী রচিত ‘পুণ্যস্মৃতি’, রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘পিতৃস্মৃতি’ ইত্যাদি। বিশ্বভারতী প্রকাশিত বইগুলিতে তাঁর দ্বারা সঙ্কলিত ‘গ্রন্থপরিচয়’ তথ্যাদি বাংলা প্রকাশনার জগতে এক বিরলতম প্রয়াস। পুলিনবিহারী শুধু রবীন্দ্রনাথের গ্রন্থপঞ্জিই নয়, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গ্রন্থপঞ্জি, গগনেন্দ্রনাথের রচনাপঞ্জি, বিপিনচন্দ্র পালের গ্রন্থপঞ্জি, প্রমথ চৌধুরীর রচনাপঞ্জি, সতীশচন্দ্র রায়ের রচনাপঞ্জিও আনন্দের সঙ্গে সম্পাদনা করেছেন।

এ ছাড়া নিয়মিত ‘বিশ্বভারতী পত্রিকা’ সম্পাদনায় তাঁর জুড়ি মেলা ভার। কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ যখন ‘বিশ্বভারতী পত্রিকা’র সম্পাদক ছিলেন, সেই সময় পত্রিকার জন্য লেখা সংগ্রহ থেকে সম্পাদনার কাজ পুলিনবিহারীর হাতে নিশ্চিন্তে ছেড়ে দিয়েছিলেন। পরে যখন নিজে সম্পাদনার ভার পেয়েছিলেন, পুলিনবিহারী তখন শিল্পীবন্ধু বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের লেখাঙ্কনে ‘বিশ্বভারতী পত্রিকা’র নামকরণ ও নানা রকমের চিত্র ব্যবহার শুরু করেন। সত্যজিৎ রায় তাঁর কাজ সম্পর্কে বলেছিলেন ‘সুরুচি এবং আভিজাত্যের এক চমৎকার দৃষ্টান্ত’।

এই ধীর স্থির মানুষটিই বিশ্বভারতীর কাজে ছেদ পড়ায় শেষ জীবনে পেনশন পেতেন না, রবীন্দ্রভবনের থেকে নামমাত্র মাসিক ভাতাই ছিল তাঁর বেঁচে থাকার সম্বল। অন্যায়ের সঙ্গে কখনও আপস করেননি। জীবনের উপান্তে কলকাতার ৫৪ বি, হিন্দুস্থান পার্কের ছোট ছোট দু’টি ঘরে স্বেচ্ছায় বইবন্দি হয়ে অত্যন্ত অর্থকষ্টে দিন কাটিয়েছেন। এই বাড়িতেই প্রতি রবিবার সকাল ন’টায় বিদ্বজ্জনদের সভা বসত। প্রমথনাথ বিশী, অন্নদাশঙ্কর রায়-সহ সাহিত্যের অনেক দিকপাল হাজির হতেন।

অকৃতদার পুলিনবিহারীর মুখে নির্মল হাসিটি লেগেই থাকত। রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষে সাহিত্য অকাদেমি তাঁকে বিশেষ রবীন্দ্র পুরস্কার দেয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সরোজিনী বসু স্বর্ণপদক, আনন্দবাজার পত্রিকা থেকে সরলাবালা সরকার পুরস্কারও (১৯৬২) পেয়েছিলেন তিনি।

আগাগোড়া নিজেকে আড়ালে রাখার প্রয়াসে তাই তাঁর স্বভাব-কণ্ঠে বার বার ফিরে এসেছে কবির গান, ‘ভয় হয় পাছে তব নামে আমি আমারে করি প্রচার হে’। যখন ভারত সরকার থেকে তাঁকে একটি বৃত্তি আজীবন দেওয়ার সিদ্ধান্ত পাকা হয়, তিনি তা গ্রহণ করতেও দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। সেই বৃত্তি আর নেওয়া হয়ে ওঠেনি। ১৯৮৪ সালের ১৪ অক্টোবর ৭৬ বছর বয়সে তাঁর জীবনদীপ চিরতরে নিভে যায়।

তথ্যঋণ: পুলিনবিহারী জন্মশতবার্ষিক শ্রদ্ধার্ঘ্য (১৯০৮-২০০৮) বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ; রবীন্দ্রতাপস পুলিনবিহারী - সত্যরঞ্জন বিশ্বাস সম্পাদিত; বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ পঞ্চাশৎ বর্ষ-পরিক্রমা (১৯২৩-১৯৭৩), বিশ্বভারতী, ১৯৭৮; বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ ও চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য (১৯৮৪); রবীন্দ্রায়িত পুলিনবিহারী সেন - অনাথনাথ দাস, কোরক, জানুয়ারি ২০১১;
শারদীয় দেশ, ১৩৯৩ বঙ্গাব্দ

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement