তাঁর স্থাপিত ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউট-এর মডেল অনুসরণ করল আমেরিকা
Statistics

দেরিতে ছাড়া জাহাজে চেপে ভারতে এল রাশিবিজ্ঞান

নিয়ে এলেন প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ। এই প্রবাদপুরুষের মৃত্যুর ৪৯ বছর পূর্ণ হবে আগামীকাল। পরশু তাঁর ১২৮তম জন্মবার্ষিকীও।

Advertisement

অতনু বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ২৭ জুন ২০২১ ০৭:১৯
Share:

রাশিবিজ্ঞানী: প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ। মানুষের কল্যাণই ছিল তাঁর সব গবেষণার অভিমুখ।

বাঙালি বিজ্ঞানী নিজে হাতে যন্ত্র তৈরি করলে প্রোফেসর শঙ্কুর কথা মনে পড়তে পারে। রাশিবিজ্ঞানী প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ তাঁর নিজের হাতে দু’টি যন্ত্র তৈরি করেছিলেন, একটি ‘কোঅর্ডিনেটোগ্রাফ’, যা দরকার হত শস্য-সম্পর্কিত সমীক্ষার প্রয়োজনে, অন্য যন্ত্রটি ‘ফোটোগ্রাফিক প্রোফাইলোস্কোপ’, যা প্রয়োজনীয় নৃতাত্ত্বিক গবেষণায় নির্ভুল প্রোফাইল পিকচার বা পার্শ্বচিত্র পরিমাপের জন্য। মহলানবিশের পদার্থবিদ্যার শিক্ষাই এই উদ্ভাবনী প্রয়াসে সাহায্য করেছে। কিন্তু ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউট (আইএসআই)-এর ‘প্রোফেসর’ প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের সঙ্গে গিরিডির একান্তেবাসী প্রোফেসর শঙ্কু তাঁর গবেষণাকে মানুষের সার্বিক প্রয়োজনে প্রয়োগের কথা বড় একটা ভাবেননি। উল্টো দিকে মানব-কল্যাণের জন্যই এই উদ্দেশ্যেই সংখ্যা নিয়ে লোফালুফি খেলেছেন প্রশান্তচন্দ্র। রাশিবিজ্ঞান বিষয়টাকেও তিনিই হাতে ধরে এ দেশে নিয়ে এসেছেন সাতসাগরের ও পার থেকে। গড়ে তুলেছেন দেশের প্রয়োজনের সঙ্গে মিলিয়ে মিশিয়ে।

Advertisement

বাঙালি কবি নোবেল পাওয়ার বছরখানেক আগেই প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে পদার্থবিদ্যায় অনার্স পাশ করে তরুণ প্রশান্তচন্দ্র ট্রাইপস পড়তে গিয়েছিলেন কেমব্রিজে। ফেরার সময় একটা জাহাজ সামান্য দেরিতে ছেড়েছিল। এইটুকু ঘটনাতেই অনেকটা বদলে গেল ভারতীয় বিজ্ঞানের ইতিহাস। কেমন করে, সে কথাতেই আসছি। রাশিবিজ্ঞানের সঙ্গে প্রশান্তচন্দ্রের মোলাকাত একেবারেই আচমকা। ১৯১৫-তে কেমব্রিজের পাট শেষ করে দেশে ফিরবেন প্রশান্ত। তখন অশান্ত মহাযুদ্ধের সময়। তাঁর জাহাজ ছাড়তে কিছু দেরি হয়ে গেল। বাক্সবিছানা সবই তো গোছানো, এখন সময় কাটাবেন কী করে? ইত্যবসরে প্রশান্তচন্দ্র গেলেন কিংস কলেজের লাইব্রেরিতে। ঘুরে ঘুরে বই দেখে চললেন। প্রশান্তর বিজ্ঞান বই সম্বন্ধে আগ্রহ চোখে পড়ল সেখানকার শিক্ষক ম্যাকালের। তিনি প্রশান্তচন্দ্রর দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন ‘বায়োমেট্রিকা’ নামক সেই সময়কার বিশিষ্ট স্ট্যাটিসটিক্স জার্নালের দিকে। এক সেট বই কিনে নিলেন মহলানবিশ। যেন বাস্তবিক অর্থেই সোনার ধানে তরী ভরে নিলেন। পড়তে পড়তে বুঁদ হয়ে গেলেন, কলকাতায় ফিরেও চলল তাঁর ন’খণ্ডের ‘বায়োমেট্রিকা’ পড়া। বদলে গেল জীবনের গতিপথ। জন্ম হল এক যুগস্রষ্টা রাশিবিজ্ঞানীর। এ দেশে সূচিত হল এক নতুন ধরনের বিজ্ঞান-চর্চার ধারা, যা প্রবাহিত হয়ে চলেছে আজও, সাড়ম্বরে। তিনি বুঝিয়ে দিলেন, জীবন যেন সম্ভাবনার খেলা, হঠাৎ আলোর ঝলকানি লেগে ঝলমল করে ওঠা জগৎ।

মহলানবিশকে বলা হয় ভারতের রাশিবিজ্ঞানের ভগীরথ। কিন্তু সে অভিধা যথেষ্ট নয়। ভারতের রাশিবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে মহলানবিশের অবদান ভগীরথের চেয়েও বেশি। তিনি নিজের হাতে রাশিবিজ্ঞানের বিস্তীর্ণ ক্ষেত্র খনন করেছেন, সে পথে বীজ বপন করেছেন, যত্ন করেছেন, ক্রমে তা মহীরুহ হয়েছে তাঁর হাত ধরেই। এই যাত্রাপথে তাঁকে যোগ্য সঙ্গত দিয়েছেন এক ঝাঁক দক্ষ তরুণ, পরবর্তী কালে যারা নিজেরাও হয়ে উঠেছেন এক-এক জন মাইলস্টোন। এঁদের মধ্যে অধ্যাপক সি আর রাও শতবর্ষ পেরিয়েছেন গত বছর— পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত জীবিত রাশিবিজ্ঞানী তিনি।

Advertisement

ইউরোপে, বিশেষ করে ব্রিটেনে, রাশিবিজ্ঞান সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে কয়েকশো বছর ধরে। বহু বিজ্ঞানীর হাত ধরে। ১৬৬২-তে জন গ্রান্ট বানিয়ে ফেলেন ‘লাইফ টেবিল’, যাকে আধুনিক রাশিবিজ্ঞানের সূত্রপাত বলেই ধরা হয়। স্কটিশ ডাক্তার জন আরবুথনট ১৭১০-এ করলেন রাশিবিজ্ঞানের ‘টেস্ট’ থিয়োরির প্রয়োগ। ১৭৬১-তে পাদ্রী টমাস বেয়েস প্রমাণ করলেন ‘বেয়েস উপপাদ্য’। এ সবের সঙ্গে আরও অনেকের প্রচেষ্টায় একটু একটু করে তৈরি করছিল রাশিবিজ্ঞানের কাঠামো। ও দিকে রয়্যাল স্ট্যাটিসটিক্যাল সোসাইটি স্থাপিত হয়েছে ১৮৩৪-এ চার্লস ব্যাবেজ, অ্যাডলফ কুইটেলেট, টমাস ম্যালথাস প্রমুখ মহারথীদের হাত ধরে। সোসাইটির জার্নালও যাত্রা শুরু করেছে ১৮৩৮-এ। প্রথম আন্তর্জাতিক স্ট্যাটিসটিক্যাল কংগ্রেসও অনুষ্ঠিত হয়েছে ১৮৫৩-তে, ব্রাসেলসে, কুইটেলেটের প্রচেষ্টায়। উনিশ শতকের শেষে এবং বিশ শতকের শুরুতে রাশিবিজ্ঞান এক স্বতন্ত্র বিষয় হয়ে উঠে স্পষ্ট ছাপ রাখতে শুরু করে সমাজের নানা ক্ষেত্রে। এর কৃতিত্ব ফ্রান্সিস গ্যালটন, কার্ল পিয়ারসন, উইলিয়াম গসেট, রোনাল্ড ফিশারের মতো বিজ্ঞানীদের। কার্ল পিয়ারসন ১৯০১-এ প্রকাশ করেন ‘বায়োমেট্রিকা’ জার্নাল— গ্যালটন আর রাফায়েল ওয়েলডনের সঙ্গে। ১৯১১-তে বিশ্বের প্রথম কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে রাশিবিজ্ঞান বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন পিয়ারসন, ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনে।

এই দীর্ঘ-লালিত বিজ্ঞানচর্চার সূত্রে তখনকার ভারতকে বেঁধে ফেলা সহজসাধ্য ছিল না। সেই দুঃসাধ্য কাজটাই করেছেন মহলানবিশ। বহু জন জ্ঞানী মানুষের দীর্ঘমেয়াদি মেধা-অনুশীলনে যতটা অগ্রসর হওয়া সম্ভব হত, তিনি নিজের জীবনব্যাপী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে একক ভাবে তা-ই করেছেন। স্বপ্নদর্শী নেতা মহলানবিশের সাধনা তাই তাঁর গবেষণার চৌহদ্দি ছাড়িয়ে বিশ্বপর্যায়ে ব্যাপ্ত, রাশিবিজ্ঞানের একটা নিজস্ব সংস্কৃতি তিনি নির্মাণ করেছেন এ দেশে, তাকে লালনও করেছেন সযত্নে।

আজকের দিনে ‘বিগ ডেটা’র মহাসমুদ্র মন্থন করে অমৃত পাওয়ার সাধনায় মশগুল রাশিবিজ্ঞানীরা, ডেটা সায়েন্টিস্টরা। কিন্তু সে যুগেও বেশ কিছু বড় মাপের স্টাডি করেছেন মহলানবিশও। সরকার ১৯২২-এর উত্তরবঙ্গের ভয়াবহ বন্যা সম্পর্কিত বিশেষজ্ঞ কমিটির রিপোর্ট নিয়ে প্রশান্তচন্দ্রের মতামত জানতে চেয়েছিল। ৫০ বছরের বৃষ্টিপাত ও বন্যার পরিসংখ্যানগত বিশ্লেষণ করেন প্রশান্তচন্দ্র, যা কার্যকরী হিসেবে প্রমাণিত হয়। একই ভাবে ওড়িশার ১৯২৬ সালের বন্যা প্রসঙ্গে তাঁর ৬০ বছরের তথ্যের বিশ্লেষণ-ভিত্তিক সুপারিশের নির্ভুল যুক্তিতেই মহানদীতে হীরাকুঁদ বাঁধ তৈরি করা হয়। তিরিশের দশকে মহলানবিশ এক উল্লেখযোগ্য নমুনা সমীক্ষা করেন বাংলার পাট উৎপাদন নিয়ে। ৮২ লক্ষ টাকা ব্যয়ে সরকারের সম্পূর্ণ গণনায় পাটের মোট পরিমাণ হয় ৬৩০৪ বেল (১ বেল=৪০০ পাউন্ড)। কিন্তু অসাধারণ মেধাবী এই বিজ্ঞানী গণনার খরচ নামিয়ে এনেছিলেন মাত্র ৮ লক্ষ টাকায়। সরকারি প্রকল্পের পঞ্চাশ ভাগের মাত্র এক ভাগ লোকবল নিয়ে মহলানবিশের নমুনা সমীক্ষায় মোট পাটের অনুমান আসে ৭৫৪০ বেল। শুল্ক এবং বাণিজ্য বিভাগের হিসেবে পাটের পরিমাণ ছিল ৭৫৬২ বেল। মহলানবিশের সমীক্ষার ফলাফল প্রায় নিখুঁত হিসেবে প্রতিপন্ন হয়। অনেকে মনে করেন, এই অভিজ্ঞতাই ভবিষ্যতে জন্ম দেয় ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভে (এনএসএস)-এর। চল্লিশের দশকে বাংলার দুর্ভিক্ষের প্রেক্ষিতে ১৯৪৪-৪৫ সময়সীমায় একটি বড় ধরনের সমীক্ষা করেন মহলানবিশ। দেখা যায়, প্রায় চল্লিশ লক্ষ মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হয়েছে দুর্ভিক্ষের ফলে। সে সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে মহলানবিশ কাজ করেছেন ‘বিগ ডেটা’ নিয়েই। আমেরিকায় এ রকম বড় বড় সমীক্ষা পরিচালনা করেছেন মহলানবিশের প্রায় সমসাময়িক মরিস হানসেন।

বলা হয়, মহলানবিশ নাকি প্রবৃত্তিগত ভাবে ছিলেন এক জন রাশিবিজ্ঞানী, আর বিশ্বাসের দিক থেকে ছিলেন এক জন অর্থনীতিবিদ। ১৯৫০-এ এনএসএস, ১৯৫১-তে সেন্ট্রাল স্ট্যাটিসটিক্যাল অর্গানাইজ়েশন স্থাপনের পিছনেও প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ। তাঁর উদ্যোগেই প্রতিষ্ঠিত হয় স্টেট স্ট্যাটিসটিক্যাল ব্যুরো। ব্রিটেন বা ইউরোপের তুলনায় ভারত যে অনেক দেরিতে এই শাস্ত্রের চর্চা শুরু করেছে, সেই পিছিয়ে-থাকা একক কৃতিত্বে পূরণ করেছিলেন এই বিজ্ঞানী। একই সঙ্গে দেশে এক অনন্যসাধারণ রাশিবিজ্ঞানের পরিকাঠামোও তৈরি করতে পেরেছিলেন তিনি।

প্রেসিডেন্সি কলেজেই মহলানবিশ প্রতিষ্ঠা করেন স্ট্যাটিসটিক্যাল ল্যাবরেটরি। এর গণ্ডির মধ্যেই রেজিস্টার্ড সোসাইটি হিসেবে যাত্রা শুরু ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউট-এর, ১৯৩১ সালে। এ দিকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাশিবিজ্ঞান বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৪১-এ, যা এশিয়ার কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম স্নাতকোত্তর স্ট্যাটিসটিক্স ডিপার্টমেন্ট। মহলানবিশ তার বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব সামলান।

ভারতে রাশিবিজ্ঞানের গবেষণার জন্যে জার্নালের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছিলেন প্রশান্তচন্দ্র। আইএসআই প্রতিষ্ঠার দু’বছর পরেই ১৯৩৩-এ তিনি শুরু করলেন রাশিবিজ্ঞানের ভারতীয় জার্নাল ‘সংখ্যা’। প্রথম খণ্ডের সম্পাদকীয়তে অথর্ববেদ, অমরকোষ আর গীতার উল্লেখ করে মহলানবিশ বর্ণনা করেন ‘সংখ্যা’-র দ্বিবিধ অর্থ— নিখুঁত জ্ঞান এবং অঙ্ক (নাম্বার)। তিন দশক পরে যখন মহলানবিশ পিছু ফিরে তাকিয়েছেন, এই জার্নাল শুরু করাটাকে দেখেছেন তাঁর দুঃসাহসিক, এমনকি হঠকারী সিদ্ধান্ত হিসেবে মনে হয়েছে। কারণ সে সময় ভারতে গবেষণার সম্পদ এবং সরঞ্জাম ছিল যথেষ্ট কম! কিন্তু বিজ্ঞানের ইতিহাস সাক্ষী, এমন দুঃসাহসী এবং হঠকারী সিদ্ধান্তই জাতির জীবনে আনে নতুন অধ্যায়।

উন্নত গণনার সুবিধের জন্যে আইএসআই-ই আমদানি করে ভারতের প্রথম কম্পিউটার। সালটা ১৯৫৬। খরচ পড়েছিল ১০ লক্ষ টাকা। আইএসআই-এর লোগো-তে সংস্কৃতে লেখা ‘ভিন্নেষ্বৈক্যস্য দর্শনম্‌’— বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের ভিত্তিতে, এক অনন্য মডেলে গড়ে উঠেছিল ভারতের রাশিবিজ্ঞানের সংস্কৃতি, যা অবশ্যই পড়শির ঈর্ষার বস্তু। ১৯৫৮-তে আমেরিকায় যখন স্ট্যাটিসটিক্সের প্রথম ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে গারট্রুড কক্সের নেতৃত্বে, নর্থ ক্যারোলিনার রিসার্চ ট্রায়াঙ্গেলে, আইএসআই হয়েছে তার মডেল। একটি উন্নয়নশীল দেশের মডেল গ্রহণ করেছে একটি উন্নত দেশ, এমন উদাহরণ বাস্তবিকই
বিরল। আইএসআই-এর প্রখ্যাত আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অতিথি-দর্শনার্থীদের মধ্যে ছিলেন চৌ-এন-লাই, হো চি মিন, চে গুয়েভারা, নিকিতা ক্রুশ্চেভ। এঁরা এসেছিলেন নিজেদের রাষ্ট্রের প্রয়োজনে নতুন বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তির সন্ধানে— ভারতের প্রজ্ঞার আলোক উৎস থেকে মশাল জ্বালিয়ে নিয়ে যেতে।

মহলানবিশ তীব্র ভাবে অনুভব করেছিলেন ভারতে রাশিবিজ্ঞানের কনফারেন্সের প্রয়োজনীয়তা। তিরিশের দশকের মাঝামাঝি থেকেই চেষ্টা করেছেন রাশিবিজ্ঞানকে ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের অন্তর্ভুক্ত করতে। অকৃতকার্য হয়ে ১৯৩৮-এ তিনি রাশিবিজ্ঞানের প্রথম কনফারেন্সের আয়োজন করেন কলকাতায়, সে বছরের ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের ঠিক পরে। আসেন ভাইসরয়। সে সময়ে দুনিয়ার সবচেয়ে বিখ্যাত রাশিবিজ্ঞানী রোনাল্ড ফিশার হন কনফারেন্সের প্রেসিডেন্ট! ফিশার কনফারেন্সকে দেন আন্তর্জাতিক চরিত্র এবং ভাবমূর্তি। পরবর্তী চার বছরে অনুষ্ঠিত হল এমনই আরও কিছু কনফারেন্স। সংশ্লিষ্ট মহলে উদ্দীপনা জাগাতে এ সবের মূল্য ছিল অপরিসীম। ১৯৪২-এ প্রশান্তচন্দ্রের উদ্যোগেই ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসে আলাদা অধ্যায় হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয় গণিত এবং রাশিবিজ্ঞান। তার তিন বছর পরে তৈরি হয় রাশিবিজ্ঞানের আলাদা অধ্যায়।

১৯৫০-এ পুণে সায়েন্স কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট মহলানবিশের বক্তৃতার শিরোনাম ছিল ‘হোয়াই স্ট্যাটিস্টিক্স?’ আসলে সমাজকে রাশিবিজ্ঞানের গুরুত্ব বোঝানোর তাগিদ ছিল তাঁর। যেমন ১৯৫৬-তে আমেরিকান স্ট্যাটিসটিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট গারট্রুড কক্সের বক্তব্যের শিরোনাম ছিল ‘স্ট্যাটিসটিক্যাল ফ্রন্টিয়ার্স’।

প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ তখন ভারতীয় বিজ্ঞানের আন্তর্জাতিক আইকন। তাঁর আশপাশে জড়ো হতেন দেশবিদেশের নামজাদা সব প্রতিভা, অনন্য মনীষারা। একটা খণ্ডচিত্র দেখা যাক। আইএসআই-এর দিল্লি শাখায় প্ল্যানিং ইউনিট শুরু হল। সেটা মহলানবিশ জমানার শেষ দিক। মহলানবিশ সেখানে নিয়ে এলেন কয়েক জন যুবক অর্থনীতিবিদকে। এঁদের মধ্যে জর্জ অ্যাকেরলফ অর্থনীতিতে নোবেল পেয়েছেন তার কিছু পরে, ২০০১-এ। তাঁর নোবেলজয়ী গবেষণাপত্র ‘দি মার্কেট ফর লেমনস…’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭০-এ। সেই কাজ তিনি শুরু করেছিলেন তাঁর আইএসআই-এ থাকার সময়সীমাতেই। তাঁদের মধ্যে প্রণব বর্ধন আর টি এন শ্রীনিবাসন প্রবাদপ্রতিম অর্থনীতিবিদ, বি এস মিনহাস প্ল্যানিং কমিশনের সদস্য ছিলেন ১৯৭১-৭৩ সময়সীমায়। এবং সি রঙ্গরাজন পরবর্তী কালে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর হয়েছেন।

আজকের অতিমারি-বিধ্বস্ত দুনিয়ায় রাশিবিজ্ঞানের সুষ্ঠু ব্যবহারিক প্রয়োগের প্রয়োজন ছিল আরও বেশি। প্রচুর মডেল বানিয়েছেন ডেটা সায়েন্টিস্টরা, রাশিবিজ্ঞানীরা, কম্পিউটার-বিশেষজ্ঞরা, মহামারি-বিশেষজ্ঞরা। সেগুলি প্রায় সবই মুখ থুবড়ে পড়েছে। তাই কোথাও যেন চোখে পড়েছে এক দক্ষ রাশিবিজ্ঞানী আর তাঁর নেতৃত্বের অভাব। অতিমারির দাপটে জিডিপি নেমেছে তলানিতে। কাজ হারিয়েছেন অগণিত মানুষ। রোজগার প্রতিনিয়ত কমে চলেছে বহু মানুষের। উপযুক্ত সমীক্ষার মধ্য দিয়ে ক্ষয়ক্ষতির একটা উপযুক্ত অনুমান এই মুহূর্তে বিশেষ প্রয়োজন— আগামী দিনের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সুরক্ষার পরিকল্পনার পথনির্দেশের জন্যে। কোভিড-বিধ্বস্ত দেশের দরকার বাংলার দুর্ভিক্ষের প্রেক্ষিতে করা মহলানবিশের সার্ভের মতোই নিখুঁত যুক্তিনিষ্ঠ পরিমাপ, যাতে রাশিবিজ্ঞানের তত্ত্বের সঙ্গে থাকবে বুদ্ধি, প্রজ্ঞা এবং বাস্তবের মিশেল। দেশ ও সমাজের এই ক্রান্তিকালে প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ আজও প্রবল ভাবেই প্রাসঙ্গিক।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement