কর্মযোগী: খগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়। ডান দিকে,
রবীন্দ্রনাথ সেই সময় বেশ জনপ্রিয় হলেও তখনও তাঁর নোবেলপ্রাপ্তি ঘটেনি। ফলে খ্যাতির বিড়ম্বনা তখনও সে ভাবে ছিল না। এই সব বিড়ম্বনার একটি মস্ত সুবিধে, খ্যাতির দরুন কপিরাইটের ঝামেলা থেকে রেহাই এবং ন্যায্য প্রাপ্য দুই-ই পাওয়া যায়। সে কালে রবীন্দ্রনাথের গান রঙ্গমঞ্চে গাওয়া হলে বেশ জনপ্রিয় হত এবং রেকর্ডেও জায়গা করে নিত। এতে গানের বহুল প্রচার হত বটে, কিন্তু রেকর্ডের লেবেলে গীতিকারের নাম রাখার রেওয়াজ তখনও না থাকায় গানটি যে তাঁরই রচনা, কবির কপালে এই স্বীকৃতি জুটত না। আবার অনেক ক্ষেত্রে রঙ্গমঞ্চে কবির গানকে এতটাই বিকৃত করে পরিবেশন করা হত যে, তা রবীন্দ্রসঙ্গীত বলে চিহ্নিত করাই দুঃসাধ্য হত। নির্লিপ্ত কবি নোবেল জয়ের আগে পর্যন্ত বিষয়টি নিয়ে মাথা ঘামাননি। নোবেল পাওয়ার পরও মাথা ঘামাতে চাইতেন বলে মনে হয় না, যদি না তাঁর সলিসিটর খগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় নাছোড় হতেন। ১৯১৫ সালের ১০ মার্চ, রবীন্দ্রনাথ রচিত গানের রয়্যালটি দাবি করে গ্রামোফোন কোম্পানির কাছে চিঠি লেখেন খগেন্দ্রনাথ। গ্রামোফোন কোম্পানির পক্ষে সলিসিটর ফার্ম মর্গ্যান অ্যান্ড কোম্পানি এ বিষয়ে খগেন্দ্রনাথের সঙ্গে বাদানুবাদে লিপ্ত হলেও অবশেষে রবীন্দ্রনাথের গানের ওপর তাঁর স্বত্ব মেনে নিতে বাধ্য হয়। প্রায় এক দশক লড়াইয়ের পর ১৯২৬ সালের ৫ অক্টোবর গ্রামোফোন কোম্পানির সঙ্গে কবির চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। আর সেই সূত্রে কবিই হলেন ভারতের প্রথম গীতিকার, যাঁর কপালে রয়্যালটির প্রাপ্তিযোগ ঘটেছিল। আর এর পিছনে যে মানুষটি সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন, তিনি খগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়।
তবে খগেন্দ্রনাথকে শুধু রবীন্দ্রনাথের ব্যবহারজীবী ভাবলে তাঁর সম্পূর্ণ পরিচয় পাওয়া যাবে না। তিনি একাধারে যেমন কবির আদি জীবনীকার, তেমনি অন্তরঙ্গ বন্ধু এবং আত্মীয়ও। তাঁর মধ্যেও সাহিত্যসৃষ্টির মেধা ও মনন ছিল। এবং সেখানেও রবীন্দ্রনাথকেই অনুসরণ করেছিলেন তিনি। আইনজীবীর ব্যস্ততা তাঁকে সাহিত্যের জগৎ থেকে সমকালে অনেক দূরে সরিয়ে দিয়েছিল। উত্তরকাল তাঁকে হয়তো মনে রাখবে নিতান্তই ‘রবীন্দ্র কথা’-র রচয়িতা হিসেবে, কিন্তু তাতে তাঁর সাহিত্যিক সত্তাকে পূর্ণ মর্যাদা দেওয়া হবে না।
খগেন্দ্রনাথের জন্ম জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির লাগোয়া সিংহবাগানে, ১২ মদন চ্যাটার্জি লেনে, প্রপিতামহ-আবাসে। তাঁর প্রপিতামহ স্বনামখ্যাত ধনী মদনমোহন চট্টোপাধ্যায়— যাঁর নামাঙ্কিত ওই রাস্তাটি— ছিলেন দ্বারকানাথ ঠাকুরের আপন ভাগনে। তাঁর সহোদর চন্দ্রমোহন ছিলেন দ্বারকানাথের বিলেতযাত্রার অন্যতম সঙ্গী। এই সূত্রেই রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের মর্যাদা পেয়েছিলেন তিনি। দার্শনিক হীরেন্দ্রনাথ দত্তের ভাষায়, কবির সঙ্গে ‘এক চালায় ঘর’ করেছিলেন খগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়।
আগাগোড়াই মেধাবী ছাত্র। হেয়ার স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ভর্তি হয়েছিলেন প্রেসিডেন্সি কলেজে। সেই মধ্য-কৈশোরে তাঁর মধ্যে দেখা গিয়েছিল কাব্য-প্রেমের জোয়ার, সাহিত্যগুরু হিসেবে পেলেন তাঁর আর এক নিকটাত্মীয়, বঙ্গরঙ্গমঞ্চের প্রখ্যাত নট-নাট্যকার-নির্দেশক অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফির সুযোগ্য সন্তান ব্যোমকেশ মুস্তাফিকে। ব্যোমকেশ তাঁর সম্পাদিত ‘সাহিত্য কল্পদ্রুম’ পত্রিকায় খগেন্দ্রনাথকে কাব্যচর্চার সুযোগ করে দিলেন। এই পত্রিকায় প্রকাশিত ‘বিজয়া’, ‘বিরাগ’, ‘বাসন্তী-পূর্ণিমা’, ‘মোহিনী’, ‘কবি টেনিশন’ প্রভৃতি কবিতায় তাঁর সাহিত্য-সাধনা সঠিক দিশা পায়। সেই সময় ‘রাজা ভর্তৃহরি’ শিরোনামে প্রবন্ধও লিখেছিলেন তিনি। তবে আমাদের আগ্রহ অন্যত্র। সমকালে ‘সাধনা’ পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ ‘রাজার ছেলে ও রাজার মেয়ে’ নামে একটি কবিতা লিখেছিলেন। ওই সময়ই ১৮৯২ সালে খগেন্দ্রনাথ তাঁকে অনুকরণ করে ‘হাতী-ঘোড়া’ নামে একটি কাব্য সৃষ্টি করলেন। অসম্ভব কৌতুকাবহ এই কবিতাটি ‘রাজার ছেলে ও রাজার মেয়ে’-র প্যারডি কি না, কাব্য-সমালোচকরাই তা বলতে পারবেন, কিন্তু খগেন্দ্রনাথের এহেন নকলনবিশি নিঃসন্দেহে কবি হিসেবে রবীন্দ্রনাথের নবীন প্রতিভার যোগ্য সমাদর করেছে। কারণ কবিতাটির মুখবন্ধে তিনি লিখেছিলেন— ‘কবি হতে সাধ যায়; কিন্তু ক্ষমতা কই? কাজেই কারও নকল করা আবশ্যিক।...আমি আজকালকার দিনে কবি হব, কাজেই এখনকার কোনো সুকবিকে নকল করতে হবে। হেম নবীন নিভে গেছেন অনেক দিন, এক রবি এখন কিরণ দিতে পাচ্ছেন, কাজেই তাঁকে নকল করা উচিৎ। তাঁর এতদিনের সাধনার ধন ‘রাজার ছেলে ও রাজার মেয়ে’ নকল করবার জিনিসও বটে; কারণ, কোনো মহাকবি আর কখনো এমন কবিতা লেখে নাই, লিখবেও না; কাজেই আমার অরিজিন্যালিটি বজায় থাকবে। এই মনে করে, আমি তারই নকলে কবিতা লিখেছিলেম। আজ তাই ছাপালেম। ...উদ্দেশ্য— রবিবাবুকে যখন পাবলিকে সুকবি বলে, তখন আমিও তাই, এইটে প্রমাণ করবো।’
নেহাতই মজা করে লেখা, কিন্তু তার মধ্যেও নিহিত ছিল তখনকার বাংলা সাহিত্যজগতের অমোঘ সত্যটি। দুই যশস্বী প্রবীণ কবি, হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ও নবীনচন্দ্র সেনের মহিমা নতুন রবির আগমনে অস্তমিত-প্রায়। পরবর্তী সময়ে বাঙালির কাব্যচর্চা ছিল মূলত রবীন্দ্র-অনুসারী, তাঁর বিরোধিতাও হয়েছে রবীন্দ্র-অনুসারী কাব্যকে মাধ্যম করেই। খগেন্দ্রনাথের রবি-অনুগমনের আকুলতা কিন্তু বাঙালির কাব্যচর্চার শতাব্দীব্যাপী ধারাটিও সুনির্দিষ্ট করে দিয়েছিল। তাই সম্পাদকীয় টিপ্পনীতে ব্যোমকেশ মুস্তাফি লিখেছিলেন: ‘সাধে হেম নবীন নিভিয়াছে? এরূপ কবিতা যখন জন্মিতেছে, তখন কাব্য-কাননে সুরভিত কুসুমের আর অভাব থাকিবে না। রবীন্দ্রবাবুর পন্থানুসরণ করিয়া খগেন্দ্রবাবু ভালোই করিয়াছেন; তাঁহার ভরসায় হেম-নবীন আরও কিছুদিন নিশ্চিন্ত হইয়া ঘুমাইতে পারেন।’
পরবর্তী কালে কর্মব্যস্ত জীবনে কাব্যচর্চার সুযোগ সে ভাবে পাননি খগেন্দ্রনাথ, তবে পুরোপুরি ছেড়েও দেননি। তাঁর সাহিত্যগুরু ব্যোমকেশ মুস্তাফিকে অনুসরণ করেই বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের মাধ্যমে সাহিত্য-সংগঠনে তাঁর কর্মকুশলতার নানা নজির পাওয়া যায়। ১৯১৯ সালের ১ জুন যতীন্দ্রনাথ চৌধুরীর প্রস্তাবে ও কুঞ্জলাল সিংহ সরস্বতীর সমর্থনে পরিষদের সম্পাদক পদে মনোনীত হন তিনি। প্রস্তাবকালে যতীন্দ্রনাথের স্বীকারোক্তি: ‘তাঁহার মধ্যে স্বর্গীয় মুস্তফি মহাশয়ের ছায়া দেখা যায়।’ পরিষদের সক্রিয় কর্মকর্তারূপে, চার বছর সহকারী সম্পাদক এবং পরবর্তী চার বছর সম্পাদক হিসেবে অতিবাহিত করেন তিনি। এই সময়ে পরিষদ ভবন সংস্কার ও সম্প্রসারণ এবং গ্রন্থাগার সংস্কারেও তাঁর আন্তরিক যত্ন ও চেষ্টা নিঃসন্দেহে উল্লেখযোগ্য। আরও বড় কথা— অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ, জ্ঞানেন্দ্রনাথ ঘোষ, মনমোহন গঙ্গোপাধ্যায়, নলিনীরঞ্জন পণ্ডিতের মতো এক দল তরুণ কর্মোদ্যোগীকে তিনি গড়তে পেরেছিলেন, যাঁরা শুধু তাঁদের লেখনীর মধ্য দিয়েই নয়, সাংগঠনিক কর্মদক্ষতা দিয়েও পরে সাহিত্যের সেবা করেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন: ‘পরিষৎ বাংলার জাতীয় প্রতিষ্ঠান। ইহা সমগ্র বাঙালির আদরের, শ্রদ্ধার ও গৌরবের বস্তু।’ তাই পরিষদের জন্য উদার হস্তে দান করতে কখনও সঙ্কোচ করেননি। অনেকটা এই কারণেই তাঁকে শেষ জীবনে নিদারুণ অর্থকষ্টের সম্মুখীন হতে হয়েছিল।
শেষ বয়সে মদন চ্যাটার্জি লেনের পৈতৃক বাড়ি বিক্রয় করে তিনি চন্দননগরে থাকতে শুরু করেন, জীবনসায়াহ্নে তাঁর ভাগনে মাধব ঘোষালের অর্থানুকূল্যে মাধববাবুরই পরিচালিত জয়শ্রী প্রকাশনা তাঁর জীবনের অভিজ্ঞতা-লব্ধ ‘রবীন্দ্র কথা’ (১৯৪১) প্রকাশ করে, রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণবর্ষেই। বইয়ের ভূমিকা লেখেন হীরেন্দ্রনাথ দত্ত। ইচ্ছে ছিল একটি পরিশিষ্ট তিনি রচনা করবেন, সেখানে রবীন্দ্র-জীবনের আরও উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটনার মাধ্যমে কবিজীবনকে দেখার প্রয়াস থাকবে। কিন্তু কলেবর বৃদ্ধির জন্য ‘রবীন্দ্র কথা’ গ্রন্থের সঙ্গে পরিশিষ্ট প্রকাশিত হয়নি। এই বই প্রকাশের অব্যবহিত পরেই খগেন্দ্রনাথের প্রয়াণ তাঁর ইচ্ছেকে বাস্তবেও পরিণত করতে পারেনি। পরে তাঁর পৌত্রীর স্বামী করঞ্জাক্ষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সৌজন্যে পরিশিষ্টের অংশগুলি মাসিক বসুমতীতে ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয় ‘রবীন্দ্রায়ণ’ শিরোনামে।
তাঁর অ্যাটর্নি পেশার কথা আগেই উল্লিখিত হয়েছে। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে উত্তীর্ণ হয়ে পিতৃব্যের উইলসন-চ্যাটার্জি আইন প্রতিষ্ঠানে যোগ দেন, পরে নিজে খগেন্দ্রনাথ চ্যাটার্জি ল ফার্ম-এর প্রতিষ্ঠা করে স্বাধীন আইন ব্যবসায় খ্যাতি পান। তিনি রবীন্দ্রনাথ ও ঠাকুরবাড়ির, বিশেষ করে পাথুরিয়াঘাটার কালীকৃষ্ণ ঠাকুরের মামলা-মকদ্দমার দেখভাল করতেন। কালীকৃষ্ণ ঠাকুরের দৌহিত্রী সরযূবালার সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল তাঁর। সরযূবালার অকালপ্রয়াণের পর দ্বিতীয় বার বিয়ে করেন বাসুদেবপুরের দেবেন্দ্রনাথ রায়ের মধ্যম কন্যা আনন্দময়ীকে।
জোড়াসাঁকোর ১২ নং মদন চ্যাটার্জি লেনে তাঁর পৈতৃক বাটী।
পারিবারিক অস্মিতা তাঁর চরিত্রের আর এক বৈশিষ্ট্য। ১৯০৮ সালে ‘পারিবারিক হিতকরী সভা’-র প্রতিষ্ঠা তাঁর অন্যতম কীর্তি। ঠাকুর পরিবারের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড আয়োজনের উদ্দেশ্যে গঠিত এই সংগঠনের তিনি প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক, পরে আজীবন সহ-সভাপতি। তাঁর বিশিষ্ট কীর্তি অবশ্যই মদনমোহন-কুলপঞ্জির নির্মাণ। প্রপিতামহের নামাঙ্কিত এই কুলপঞ্জিতে পাঁচ প্রজন্মের— মদনমোহন চট্টোপাধ্যায়, চন্দ্রমোহন চট্টোপাধ্যায় থেকে শুরু করে একমাত্র পুত্র, প্রখ্যাত মঞ্চ-নির্দেশক রমেন্দ্রনাথ ও পুত্রবধূর ছবি আঁকিয়ে বা তুলে সংযুক্ত করেছিলেন তিনি। এ ছাড়া ভদ্রাসনের ঠাকুরদালান, কুলদেবতা গোপালজিউ, কুলগুরু, পরিবারভুক্ত ভৃত্যের ছবিও ঠাঁই পেয়েছিল তাতে। যা থেকে আজকের প্রজন্ম পারিবারিক ইতিহাস রক্ষার পাঠ নিতে পারে।
পাথুরিয়াঘাটা ঠাকুরবাড়ি সম্বন্ধে বিস্তর দুষ্প্রাপ্য নথি ও তথ্য উদ্ধার করেছিলেন, যার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছিলেন নগেন্দ্রনাথ বসু ‘বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস, ব্রাহ্মণ কাণ্ড’-র অন্তর্গত ‘পিরালী ব্রাহ্মণ বিবরণ’ রচনার সময়ে। তবু তাঁর কর্মকৃতিত্ব আজ বিস্মৃতপ্রায়। ১২ জুলাই চলে গেল তাঁর জন্মের ১৪৯তম বর্ষ। জন্মের মাইলফলককে কেন্দ্র করে অতীত-উদ্ধারের রেওয়াজ ইদানীং চালু। আশা করা যায়, খগেন্দ্রনাথ তাঁর ব্যতিক্রম হবেন না।
তথ্যঋণ: কবিকণ্ঠ ও কলের গান: সন্তোষকুমার দে; সাহিত্য কল্পদ্রুম (১২৯৮-৯৯): সম্পা: ব্যোমকেশ মুস্তাফি; বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের বিভিন্ন বছরের কার্যবিবরণী