আমার প্রথম শুট করা ছবি ‘পাতালঘর’। কিন্তু ‘পাতালঘর’ রিলিজ হয় চার বছর পর। তত দিনে আমি হরনাথ চক্রবর্তীর নির্দেশনায় ‘সাথী’-তে অভিনয় করে ফেলেছি। সে দিক থেকে, ওটাই আমার প্রথম ছবি। তবে, আমি প্রথম সিনেমার জন্য ক্যামেরার সামনে দাঁড়াই ‘পাতালঘর’-এর শুটিংয়ের সময়। তখন আমি থিয়েটারে পুরোদস্তুর কাজ করি। পাশাপাশি চাকরি করি, আমাকে তখন সংসার চালাতে হয়। থিয়েটারে আমাকে দেখে শিবপ্রসাদ আর নন্দিতা এক রকম জোর করেই ‘জনতা এক্সপ্রেস’ অ্যাঙ্করিং-এর জন্য রাজি করায়। টিভির কাজ করছি অবশ্য তার আগে থেকেই। কিন্তু ‘জনতা এক্সপ্রেস’-এর সময় থেকে লোকজন আমাকে হালকা ভাবে চিনতে শুরু করে।
এর পরেই ‘পাতালঘর’। ডিরেক্টর ছিলেন অভিজিৎদা। সেখানে গিয়ে দেখি এক বিরাট রাজসূয় যজ্ঞ চলছে। বোলপুরে শুটিং। অবিনাশপুরের রাজবাড়িতে। চোখধাঁধানো কাস্টিং। আমার চরিত্রটা এক ভীষণ তোতলা মানুষের। দুটো মোটে সংলাপ। একটা হচ্ছে, ‘আমি কি পারব?’, আর একটা জায়গায় আমি অ্যানাউন্সমেন্ট-এর জন্য উঠি, কিন্তু বলতে গিয়ে আটকে যাই। বাকি সব জায়গায় আমার প্রেজেন্স আছে। কিন্তু সংলাপ নেই। ফলে মনটা কেমন-কেমন লাগছে। এমন সময় হঠাৎ অভিজিৎদা ডাকলেন। আমি যেতে উনি বললেন, ‘কাঞ্চন, জানো তো আমি বিজ্ঞাপন বানাই।’ আমি তো অবাক। উনি বললেন, ‘বিজ্ঞাপন বানাই তো। তাই আমার চোখে পড়ল, তুমি পেছনে দাঁড়িয়ে রয়েছ। কিছু করছ না। তোমার কি মনখারাপ হচ্ছে? দেখো, ডায়লগটা কিন্তু বড় কথা নয়। আর আমার যদি তোমার প্রতি অ্যাটেনশন না থাকত, তা তোমাকে ডেকে এ ভাবে কথা বলতাম না। বুঝতে পারছ তো, আমার সব দিকে চোখ আছে।’ এই কথাটা আমায় চাঙ্গা করে দেয়।
আমার মনে আছে, ছবিতে একটা গান ছিল খরাজদার লিপে, ‘যে কোনও ভূমিকায় সমানে লড়ে যাই।’ সেই গানের কোনও ডান্স কোরিয়োগ্রাফার ছিল না। এটা খরাজদা কম্পোজ করেছিল পুরোটা। হিসেবমত আমি খরাজদাকে অ্যাসিস্ট করেছিলাম। তখন আমি জানতামই না, জিরো আওয়ার কী, হাই স্পিড শট কাকে বলে। সেগুলো তখন শিখলাম।
তার পর ‘সাথী’। সে আর এক বিশাল ব্যাপার। আসলে ‘পাতালঘর’ তো সময়ের অনেকটা আগে হয়ে গিয়েছিল, তাই আমরা তখন বুঝতে পারিনি এটা কী করছি, এটা ঠিক কী তৈরি হচ্ছে। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের একটা কল্পবিজ্ঞান অবধি জানতাম। কিন্তু ঘটনার সঙ্গে আমরা পুরোটা জড়িয়ে ছিলাম না। এ বার যখন ‘সাথী’ করতে আসি, তখন হরনাথ চক্রবর্তী মধ্যগগনে। ‘সাথী’র সেটটা ছিল বিশাল। তৈরি হয়েছিল এন.টি. ওয়ান-এর পিছন দিকটা পুরো জুড়ে। তাতে রাস্তা, ফুটব্রিজ, লোকজন, অটো, রিকশা, গাড়ি, রোজ প্রায় দেড়শো করে জুনিয়র আর্টিস্ট। আমার তো তখন একেবারেই মানসিক ভারসাম্যহীন, ড্রাগ অ্যাডিক্ট-এর মতো চেহারা। কোথায় যে বসে আছি, নিজেকেই খুঁজে পাচ্ছি না! হিরো নতুন, আমিও নতুন। দুজনেই কালীঘাট পাড়ায় থাকতাম। প্রায়ই দুজনে একসঙ্গে শুটিংয়ে যেতাম। কারওরই গাড়ি নেই। হিরোকে অবশ্য ট্যাক্সিভাড়া দেওয়া হত। আর আমি ওর ট্যাক্সিতেই ফিরতাম মাঝে মাঝে। পয়সাটাও বাঁচত। সেটেও খুব ভয়ে ভয়ে থাকতাম। তখন বলতেও পারতাম না, ‘এ ভাই, ছাতা দাও, চেয়ার দাও।’
সেই সময় হরদা ভীষণ হেল্প করেছিলেন। তখন নতুন ক্যারেক্টার আর্টিস্টদের অবস্থা একেবারে চতুর্থ পংক্তিতে খেতে বসার মতো। কিন্তু হরদা এই বিভেদটা কখনও করতেন না। এক দিন রোদ্দুরে আমরা ক’জন ক্যারেক্টার আর্টিস্ট দাঁড়িয়ে আছি, হরদা হঠাৎ এসে বললেন, ‘রোদ্দুরে দাঁড়িয়ে কেন? এই ওকে ছাতা দাও।’ আর আমি নতুন আসা ক্যারেক্টার আর্টিস্টের নিম্ন মধ্যবিত্ত মন নিয়ে ‘না না’ করে যাচ্ছি। তার পর হরদা বললেন, ‘শোনো ভাই, আমি কিন্তু ছাতাটা তোমার জন্য দিতে বলছি না। আমার জন্য বলছি। কারণ, তোমার মেক-আপটা রোদ্দুরে গলে যাবে।’ এই হরদাই আমাকে একটা খুব সুন্দর কথা বলেছিলেন, ‘কাঞ্চন, আমাদের এই ইন্ডাস্ট্রিতে নতুন এসে কোনও দিন চেয়ার আর ছাতাটা খুঁজো না। কাজটা মন দিয়ে করো। চেয়ার আর ছাতা তোমায় ঠিক খুঁজে নেবে।’ এটা আমার কাছে বেদবাক্য। এটা সত্যি কথা, আমার মতো থিয়েটারের ছেলেমেয়েদের হরদা তখন বিরাট চান্স দিয়েছিলেন।
আর একটা জিনিস বুঝেছিলাম। এটা অবশ্য বুম্বাদার ক্রেডিট। বুম্বাদার সঙ্গে শঙ্কর রায়, স্বপন সাহার কমার্শিয়াল ছবি করছি, আমরা নতুন এসেছি, এমন সময়ও হয়েছে যে বুম্বাদা বলেছে, ‘কী করছিস এই সিনটা দেখা তো মনিটরে।’ দেখালাম হয়তো। বুম্বাদা বলল, ‘বাহ্! ঠিক আছে।’ এ বার শটটা শেষ হওয়ার পর হয়তো ডিরেক্টরকে বলেছে, ‘ওর এই সিনটা ক্লোজ নাও। ভাল করেছে।’ তখনকার সময় একটা ক্লোজ পাওয়া মানে, একেবারে ডিস্টিংশন পাওয়া। বুম্বাদা কিন্তু এই স্পেসটাও আমাদের দিয়েছে। আসলে, ফিল্মে যখন একটা ছোট ক্লোজ যায়, আর তার জন্য প্রেক্ষাগৃহে যখন পরদায় প্রায় আঠেরো বাই বারো হয়ে ওঠে আমার মুখটা, তখন কোথাও এর একটা মানে দাঁড়ায়। এটা এমন এক ম্যাজিক, যার আঁচ খানিকটা পাওয়া যায় কোনও প্রিমিয়ার শো-তে না, সাধারণ মানুষদের সঙ্গে বসে দেখলে। ওই হইহই, চিৎকার, ওটা অসাধারণ। কারও হয়তো আমাকে সেই সিন-এ দেখে পছন্দ হল, সে একটা সিটি মেরে দিল। এটা আমার কাছে অস্কার-এর চেয়ে কিছু কম পাওয়া নয়। আর এই জন্যই আমি প্রিমিয়ার শো-তে ছবি দেখায় বিশ্বাস করি না। তা ছাড়া, আমি তো বাংলা ছবির এক জন কর্মী। তাই আমি টিকিট কেটে ছবি দেখি। তাতে বাংলা সিনেমার লাভ হয়।
তবে, স্বীকার করতে অসুবিধে নেই, আমার পরিচিতি কিন্তু তৈরি হয়েছে, ওই ‘জনতা এক্সপ্রেস’-এর হাত ধরে। ‘জনতা এক্সপ্রেস’ আর আমার প্রথম ছবিজীবন শুরুর সময়টা প্রায় এক। আর, কমার্শিয়াল ছবিতে আমার হাঁটি হাঁটি পা পা ‘সাথী’র হাত ধরেই। শুটিংয়ের ওই দিনগুলো সত্যিই ভোলা যায় না।
kanchan.mullick@gmail.com