ঐতিহ্য নয় জাল্লিকাট্টু

আধুনিক সাহিত্য ও সিনেমাই তাকে তামিল স্বাভিমানের প্রতীক হিসাবে তৈরি করেছে। অশোকামিত্রনপ্রথম লাফ; দ্বিতীয় লাফ, অতঃপর ষাঁড়ের তৃতীয় বার ধেয়ে আসা লাফানোটাও এড়িয়ে গেল সে। এ বারেই ষাঁড়টা তাকে নির্ঘাত ছুড়ে ফেলে, পায়ের চাপে মাড়িয়ে তছনছ করে চলে যাবে। …এই ষাঁড় শুধু তার বাবার স্বপ্নকে শেষ করেনি, বাবার জীবনটাও শেষ করে দিয়েছিল।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৯ জানুয়ারি ২০১৭ ০০:০০
Share:

১৯৮০ সালের ‘মুরাত্তু কালাই’ ছবিতে জাল্লিকাট্টু লড়ছেন রজনীকান্ত

প্রথম লাফ; দ্বিতীয় লাফ, অতঃপর ষাঁড়ের তৃতীয় বার ধেয়ে আসা লাফানোটাও এড়িয়ে গেল সে। এ বারেই ষাঁড়টা তাকে নির্ঘাত ছুড়ে ফেলে, পায়ের চাপে মাড়িয়ে তছনছ করে চলে যাবে। …এই ষাঁড় শুধু তার বাবার স্বপ্নকে শেষ করেনি, বাবার জীবনটাও শেষ করে দিয়েছিল। লড়বার সিদ্ধান্ত এখনই নিতে হবে।…

Advertisement

এই রকমই ছিল ১৯৪৯ সালে লেখা চেল্লাপ্পার উপন্যাস ‘বড়িভাসাল’। চেল্লাপ্পা তামিল সাহিত্যে বাস্তবতার অন্যতম পথিকৃৎ, গত এক মাস ধরে এখানে জাল্লিকাট্টু বিতর্কে বারংবার ফিরে আসছে তাঁর সেই উপন্যাসের কথা। ষাঁড়ের সঙ্গে লড়াই বা জাল্লিকাট্টু সহসা আজ তামিল স্বাভিমান ও সংস্কৃতির অন্যতম ঐতিহ্যে পর্যবসিত। কেউই খেয়াল করছে না, সংস্কৃতি কথাটা আপেক্ষিক, বিভিন্ন দিক থেকে বিভিন্ন ব্যাখ্যা করা যায়। চেল্লাপ্পা ওই উপন্যাসের প্রথম সংস্করণের ভূমিকায় সে কথাই লিখেছিলেন, ‘শেষ করার পরেও ষাঁড়, মানুষ আর বড়িভাসাল পাঠকের স্মৃতিতে থেকে যাবে। এক নতুন দুনিয়ার সঙ্গে তাঁদের পরিচয় করিয়ে দিতে চাই আমি।’ তামিল ঐতিহ্য-টৈতিহ্যের কথা উল্লেখই করেননি লেখক।

করার কথা ছিলও না। বড়িভাসাল মানে ছোট্ট এক দরজা, যেখান দিয়ে ষাঁড়েরা লাফিয়ে রণভূমিতে প্রবেশ করে। উপন্যাসটি বহু দিন আগেই অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে ‘অ্যারিনা’ নামে ইংরেজি ভাষায় অনূদিত, আগ্রহী পাঠকেরা পড়ে ফেলতে পারেন। চেল্লাপ্পার সেই উপন্যাসে জমিদারের পোষা ষাঁড় একটি মানুষকে শিং দিয়ে গুঁতিয়ে শেষ করে দেয়। মৃত লোকটির ছেলে এর প্রতিশোধ নিতে প্রতিজ্ঞা করে এবং কয়েক বছর পরে সেই ষাঁড়টির সঙ্গেই লড়াইতে নামে। ষাঁড়টি এ বার পরাস্ত হয়। জমিদারের আর সহ্য হয় না, ষাঁড়টিকে সে গুলি করে মেরে ফেলে। চেল্লাপ্পার এই উপন্যাস তাই কখনওই স্থানীয় কোনও তামিল স্বাভিমান ও ঐতিহ্যের কথা বলে না, জমিদারের শোষণ, মানুষের প্রতিবাদী ইচ্ছা, পশুতে-মানুষে সম্পর্ক— অনেক কিছুই সেখানে রয়েছে।

Advertisement

কথামঙ্গলম সুব্বুর কথাও ধরতে পারেন। আর এক তামিল কবি, আমাদের সঙ্গে জেমিনি স্টুডিয়োতে একদা চাকরি করতেন। ‘থিলানা মোহনাম্বল’ উপন্যাসের লেখক হিসেবে সুব্বু আজও জনপ্রিয়, গাঁধীর জীবন নিয়ে একদা লৌকিক সাহিত্যের ধাঁচে ‘গাঁধী মহান কথা’ লিখেছিলেন। ১৯৩০-এর দশকে ‘মঞ্জু বিরাট্টু’ নামে এক ছোটগল্প লিখে তামিল সাহিত্য-দুনিয়ায় সুব্বুর প্রবেশ।

মঞ্জু বিরাট্টু দক্ষিণ তামিলনাড়ু অঞ্চলের আর এক রকম জাল্লিকাট্টু। গল্পের পটভূমি সেই উৎসবে মুখর, মেয়েরা আদর করে তাদের প্রিয় ষাঁড়ের কী ভাবে বিভিন্ন নাম দিচ্ছে, সেটিও রয়েছে গল্পে। তার পরই সেই জাল্লিকাট্টুকে কেন্দ্র করে দুই জাতির মধ্যে শুরু হয় রক্তাক্ত সংঘর্ষ, উৎসব স্থগিত হয়ে যায়। অতঃপর গাঁধীর অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়, গ্রামে ফের নতুন করে জাল্লিকাট্টু শুরু হয়। কিন্তু জাতপাত, বিভিন্ন গোষ্ঠীর সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ গাঁধীর প্রভাবে তত দিনে থেমে গিয়েছে। জাল্লিকাট্টুকে বীরত্বব্যঞ্জক তামিল খেলা হিসেবে এই গল্পটিই প্রথম তুলে ধরে, কিন্তু সেখানেও ছিল অন্য মাত্রা। তামিল স্বাভিমান সেখানে গাঁধীর আন্দোলনের সহযোগী।

তারও আগে ১৮৯৩ সালে রাজম আয়ার ‘কমলাম্বল চারিত্রম’ নামে এক উপন্যাসে জাল্লিকাট্টুর কথা লিখেছিলেন। এই উপন্যাসটিও ‘ফেটাল রিউমার’ নামে ইংরেজিতে অনূদিত। এখানেও তামিল স্বাভিমান নয়, খেলাটারই প্রাধান্য। খেলা দেখতে মাঠে দর্শকদের ভিড়। রাজম আয়ার স্বামী বিবেকানন্দের শিষ্য, উনিশ শতকে তাঁর কাছে জাল্লিকাট্টু পরাধীন দেশের শরীরচর্চার প্রতীক।

সংস্কৃতির চিহ্ন এ ভাবেই বদলে যায়। বড়িভাসাল উপন্যাসে ষাঁড়গুলির দৌড়নোর মাঠ বা ‘অ্যারিনা’র কথা ছিল, দর্শকের জন্য কোনও ব্যারিকেডের উল্লেখ ছিল না। অজস্র তরুণ ষাঁড়ের কুঁজটা শক্ত করে ধরে ঝুলে যুদ্ধজয়ের চেষ্টায় রত। শিং ধরলে গুঁতিয়ে ফেলে দেবে, তাই কুঁজ ধরা।

সবাই কুঁজ ধরে, শিং ধরার সাহস কেউ পায় না। গত এক মাস ধরে এখানে জাল্লিকাট্টু-বিতর্কও সেই পর্যায়ে। এত পশুপ্রেম, তামিল সংস্কৃতির কথা বলেও জাল্লিকাট্টুর সমর্থক বা বিরোধীরা কেউই ষাঁড়ের শিং ধরার সাহস পাচ্ছেন না, জোর গলায় বলে উঠতে পারছেন না, জাল্লিকাট্টুর তামিল সংস্কৃতি একেবারেই আধুনিক। সুব্বু, চেল্লাপ্পা সকলে এই যুগেরই লেখক। সাহিত্য, সিনেমা, সব কিছু মিলেই তৈরি হয়েছে জাল্লিকাট্টুর বীরগাথা। দেব আনন্দ বহু কাল আগে ১৯৫৫ সালে ‘ইনসানিয়ত’ ছবিতে এক খ্যাপা ষাঁড়ের সঙ্গে লড়াই করে নায়িকা বীণা রাইকে বাঁচিয়েছিলেন।

‘ইনসানিয়ত’ অবশ্যই তামিল ছবি ছিল না। প্রয়াত এমজিআরকেও আমরা বিভিন্ন ছবিতে বিভিন্ন পশুর সঙ্গে লড়তে দেখেছি। গোড়ার দিকে ডিএমকে বা দ্রাবিড় মুন্নেত্রা কাঝাঘাম দলের মুখপত্রে ষাঁড়ে-মানুষে লড়াইয়ের একটি স্কেচ থাকত। পরে করুণানিধি আর এমজিআর আলাদা হয়ে গেলেন, স্কেচটির ষণ্ডজয়ী পুরুষকে আর চেনা গেল না। এমজিআর, করুণানিধি যে কেউ হতে পারেন!

এই সিনেমা-ঐতিহ্য বেয়েই আশির দশকে রজনীকান্তের ছবি ‘মুরাত্তু কালাই।’ গ্রামের প্রতিবাদী নায়ক ষাঁড়ের সঙ্গে লড়ে জিতে নিল নায়িকাকে। বছর আটেক আগে কমল হাসানের হিট ছবি ‘বীরুমান্ডি’-ই বা কম কী? সেই ছবিতেই প্রথম খ্যাপা ষাঁড় ও নিরস্ত্র মানুষের লাইভ জাল্লিকাট্টু শুট করা হয়েছিল। সেটে ৫০টি তাগড়া ষাঁড় ও তাদের প্রশিক্ষকদের নিয়ে আসা হয়, ক্যামেরার সামনে জাল্লিকাট্টু প্রেমিকদের ধরার জন্য মাদুরাই থেকে নিয়ে আসা হয় হাজার জনকে। মাদুরাইয়ের কানেগ্যম প্রজাতির ষাঁড় লড়াই-খ্যাপা হিসেবে পরিচিত, সেখানকার দুই ষাঁড়কে নিয়ে এসে চেন্নাইয়ের শিবাজি গার্ডেন-এ রাখা হয়। শুটিং-এর আগে নায়ক কমল হাসান ও নায়িকা অভিরামি মাঝে মাঝেই সেই দুই ষাঁড়ের সঙ্গে সময় কাটিয়ে যেতেন। পরিচয় না থাকলেই তো ক্যামেরার সামনে সাড়ে সর্বনাশ! কমল হাসান, রজনীকান্তদের জাল্লিকাট্টু তাই যতটা তামিল সংস্কৃতি, তার চেয়েও বেশি ‘মাচোগিরি।’

এটাই নিয়ম। সাহিত্য, সিনেমা, খবরের কাগজ, টিভি চ্যানেলই আধুনিক যুগে সংস্কৃতি তৈরি করে। উত্তর ভারতে সন্তোষী মা’র মিথ কিন্তু সিনেমার হাত ধরেই ছড়িয়েছিল।

ঐতিহ্যের কথা বলতে গিয়ে অনেকে আবার চোল রাজাদের আমলে প্রাচীন সঙ্গম সাহিত্যের কথাও টানছেন। প্রথমত, খ্রিস্টপূর্ব যুগের সাধক তিরুভাল্লুভার তাঁর ‘তিরুক্কুরাল’-এর কবিতায় ষাঁড়ের কথা লেখেননি, হাল চাষের বলদের কথা লিখেছিলেন। সেই প্রাচীন তামিলে ‘মাড়ু’ বলে একটি শব্দ ছিল। মাড়ু মানে ষাঁড় বা গবাদি পশু, সম্পদ দুটোই হতে পারে। কিন্তু ঐতিহ্যবাদীরা কেউই বলছেন না, তিরুক্কুরাল-এ ছিল, শিক্ষাই প্রকৃত মাড়ু বা সম্পদ। সঙ্গম সাহিত্যে এক মহিলার কাস্তে নিয়ে বাঘের সঙ্গে লড়াইয়ের বর্ণনাও ছিল। সে জন্য তামিল মহিলাদের এখন বাঘের খাঁচায় ঠেলে ফেলা হবে না কি?

জাল্লিকাট্টু-সংস্কৃতি এই রকমই। সবাই ষাঁড়ের কুঁজ ধরে, কিন্তু শিং ধরার সাহস পায় না। সাহস করে জানতে হবে, চিরন্তন ঐতিহ্য বলে কিছু নেই। তা নির্মিত হয় প্রতিদিন।

প্রখ্যাত তামিল লেখক

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement