বাবরের বাইসন শিকার

তিনি শুধুই মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা নন। রোজনামচা লিখেছেন, সেই সঙ্গে দিয়েছেন এ দেশের পশুপাখি, ফুলের অসাধারণ বর্ণনা।তিনি শুধুই মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা নন। রোজনামচা লিখেছেন, সেই সঙ্গে দিয়েছেন এ দেশের পশুপাখি, ফুলের অসাধারণ বর্ণনা।

Advertisement

অশোককুমার দাস

শেষ আপডেট: ২৯ অক্টোবর ২০১৭ ০৮:২০
Share:

সম্রাট বাবর

আমেরিকার ওয়াশিংটন ডিসি-র ফ্রিয়ার গ্যালারি অব আর্ট-এ ১৯৫০ সালে সংগৃহীত এক জোড়া বাইসন বা বুনো মোষের ছবি দেখে শিল্পমহলে সাড়া পড়ে যায়। খুঁটিয়ে দেখে ও ছবির সঙ্গে লেখার পাঠোদ্ধার করে জানা যায়, এই বিক্ষিপ্ত পৃষ্ঠাটি সম্রাট জহিরুদ্দিন বাবরের আত্মজীবনী ‘তকিয়ৎ-ই-বাবুরী’-র (ফারসিতে ‘বাবরনামা’) একটি হারিয়ে যাওয়া কপির অংশ। ছবির নীচে লেখা, আকবরের দরবারের এক নামী শিল্পী কান্‌হা ছবির রূপরেখা এঁকেছিলেন, আর ছবি সম্পূর্ণ করেছিলেন মনসুর, পরে সম্রাট জাহাঙ্গিরের রাজত্বকালে যিনি খ্যাতির শিখরে উঠেছিলেন।

Advertisement

মুঘল চিত্রশিল্পের একটা বড় অংশে প্রকৃতি, জীবজন্তু, পাখি, ফুলফল, গাছগাছালির মনোগ্রাহী প্রতিরূপ দেখা যায়। এর কারণ খুঁজতে গেলে আমাদের কিছুটা পিছনে তাকাতে হবে, জানতে হবে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবরের ঘটনাবহুল জীবনের কথা, তাঁর পুত্র হুমায়ুন ও পৌত্র আকবরের প্রকৃতিপ্রেম ও চিত্রশিল্পে অনুরাগের কথা।

আজকের উজবেকিস্তানের পূর্ব প্রান্তে পর্বতসংকুল মনোরম ছোট উপত্যকা অঞ্চল ফরঘনায় ১৪৮৩ খ্রিস্টাব্দে বারলাস তুর্কি পরিবারে বাবরের জন্ম। মাত্র এগারো বছর বয়সে পিতা ওমর শেখ মির্জার আকস্মিক মৃত্যুর পর ফরঘনার সিংহাসনে বসলেও তাঁর রাজ্যারোহণ আদপেই নিষ্কণ্টক ছিল না। আত্মীয়-বিরোধ, আমির-ওমরাহদের ষড়যন্ত্র ও ক্রমবর্ধমান উজবেক শক্তির সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার মতো ক্ষমতা, সুযোগ, লোকবল— তাঁর কোনওটাই ছিল না। অল্প দিনের মধ্যে তাঁকে ফরঘনার গদি হারিয়ে আন্দিজান, কুন্দুজ বা তাসখন্দে আশ্রয় নিতে হয়েছে। অভাবনীয় সুযোগ পেয়ে দু’বার তিনি তৈমুর-সাম্রাজ্যের রাজধানী সমরখন্দের সিংহাসনেও বসেছিলেন। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে ফের পথে নামতে হয়েছে। ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম দিকে আফগানিস্তানের কাবুলে তাঁর স্থিতি হয়। কিন্তু তাঁর কাবুল-প্রবাসও সুখের ছিল না। গজনী, কান্দাহার, হেরাত-এ ছুটতে হয়েছে, উজবেকদের চাপে পড়ে দিশাহারা হয়ে নজর পড়েছে হিন্দুস্তানের উপর। নানা প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে শেষমেশ হিন্দুস্তান জয়ের সুযোগ আসে ১৫২৫ সালের শেষে— যখন তিনি সুসজ্জিত সৈন্যবাহিনী নিয়ে দিল্লির পাঠান সুলতান ইব্রাহিম লোদিকে পরাজিত করে ১৫২৬ সালে হিন্দুস্তানে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন।

Advertisement

বাবরের কাহিনি শুধু যুদ্ধবিগ্রহ, জয়-পরাজয়ে সীমাবদ্ধ থাকলে তাঁর নাম এতটা পরিচিতি পেত না। চরিত্রের আরও নানা গুণ তাঁকে অমর করেছে। তিনি সুশিক্ষিত ছিলেন। মাতৃভাষা চাঘতাই তুর্কিতে লেখালিখি করতেন, কবিতা লিখতেন, হাতের লেখা মকসো করে নতুন এক লিপি ‘খত-ই-বাবুরী’ উদ্ভাবন করেছেন। আর নিয়মিত রোজনামচা লিখেছেন, যার উপর ভিত্তি করে তাঁর আত্মজীবনী ‘তকিয়ৎ-ই-বাবুরী’ রচিত। যাযাবর জীবনযাত্রার জন্য তার বেশ কিছু অংশ হারিয়ে গিয়েছে। তা সত্ত্বেও এই লেখার ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম, এতে তাঁর বংশপরিচয়, ইতিহাসচেতনা, তাঁর বারলাস-তুর্কি শাখার ঘরানার রীতি-রেওয়াজের একটা সুন্দর ছবি পাওয়া যায়। তাঁর ঘটনাবহুল জীবনের খুঁটিনাটি, অকপট স্বীকারোক্তি, সুচিন্তিত মতামত পড়ে বোঝা যায়, এই আত্মজীবনী আর পাঁচটা লেখার মতো নয়।

আত্মজীবনীর একটা বড় অংশ জুড়ে তাঁর প্রকৃতিপ্রেম, পশুপাখি, ফুল-ফল, গাছগাছালির তথ্যনিষ্ঠ বিবরণ, আর যে মানুষদের সংস্পর্শে এসেছেন তাঁদের প্রসঙ্গ। যেখানেই গিয়েছেন, সেখানকার মানুষজন, বাগ-বাগিচা, স্থাপত্য, কিছুই তাঁর নজর এড়ায়নি। ১৫৩০ সালের ডিসেম্বরে অকালমৃত্যুর জন্য তাঁর এ দেশে বসবাস পাঁচ বছরেরও কম। এই স্বল্প সময়ের মধ্যেও তাঁকে নবস্থাপিত সাম্রাজ্যের ভিত্তি সুদৃঢ় করার জন্য পাঠান ও রাজপুতদের বিরুদ্ধে বহু বার যুদ্ধ করতে হয়েছে।

হিন্দুস্তানকে যে তাঁর খুব ভাল লেগেছিল তা নয়। তিনি দিল্লি, আগ্রা, ধৌলপুরের প্রখর গ্রীষ্মে বরফে-ঢাকা ফরঘনার জন্য কাতর হয়ে ফোয়ারা ও জলধারায় ঠান্ডা হওয়ার জন্য বিভিন্ন জায়গায় নতুন ফোয়ারা ও ‘ল্যান্ডস্কেপ’ বাগান তৈরি করিয়েছেন। বুঝেছিলেন যে তাঁর মাতৃভূমিতে ফিরে যাওয়ার কোনও সুযোগ নেই, তাই হিন্দুস্তানকে তাঁর একমাত্র আশ্রয়স্থল বলে মেনে নিয়েছিলেন। এখানকার বিশাল পর্বতমালা, নদী-উপনদী, জনাকীর্ণ শহর, সমৃদ্ধ বাণিজ্যকেন্দ্র, এখানকার শস্যশ্যামল প্রকৃতি, গহন অরণ্য— সব কিছু দেখেছেন। তাঁর আত্মজীবনীর একটি পরিচ্ছেদে এ দেশে প্রথম দেখা পশুপাখি, ফুলফল, গাছগাছালির তালিকা ও বিশদ বর্ণনা লিখেছেন। সেগুলি এত প্রাঞ্জল ও নিখুঁত যে সেলিম আলির মতো বিশ্ববরেণ্য জীববিজ্ঞানী ও পক্ষিবিশারদ তাঁর লেখাকে এ দেশের পশুপাখির প্রথম বিজ্ঞানসম্মত তালিকা বলে মেনে নিয়েছেন।

স্মৃতিচিত্র: জাহাঙ্গিরের আমলে ‘বাবরনামা’-য় মনসুরের আঁকা ছবি। প্রকৃতির মধ্যে দুই বাইসন বা বন্য মহিষ। ওয়াশিংটন ডিসি-র ফ্রিয়ার গ্যালারি অব আর্ট-এ সংরক্ষিত।

মাতৃভাষা চাঘতাই তুর্কিতে লেখা ‘তকিয়ৎ-ই-বাবুরী’-র সম্যক পরিচিতি ও প্রচারের জন্য বাবরের পৌত্র সম্রাট জালালুদ্দিন আকবর তা ফারসিতে অনুবাদের সিদ্ধান্ত নেন। দু-তিন জন পণ্ডিতের করা অনুবাদ তাঁর পছন্দ না হওয়ায় তিনি বহুভাষাবিদ ও বিদ্যোৎসাহী পারিষদ আবদুর রহিম খান-এ-খানানের উপর অনুবাদের ভার দেন। ১৫৮৯ সালের নভেম্বরে আবদুর রহিমের অনূদিত বই আকবরের হাতে আসে। আকবর তাঁর নিজস্ব ব্যবহারের জন্য তাঁকে কিতাবখানার সুলেখক ও তসবিরখানার নামী শিল্পীদের উপর একটি সুলিখিত ও সুচিত্রিত গ্রন্থনির্মাণের ভার দেন। সে কাজ সম্পূর্ণ হওয়ার পর রাজপুত্রদের জন্য অনুলিপি তৈরির নির্দেশ দেন। দুঃখের বিষয়, সম্রাটের জন্য নির্মিত সচিত্র পুঁথিটি অখণ্ড অবস্থায় পাওয়া যায়নি। স্বল্প সংখ্যক পৃষ্ঠা ও মোট ৩৮টি ছবির সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। সেগুলি ছড়িয়ে আছে ইউরোপ, আমেরিকা, ইরান, কাতারের বিভিন্ন সংগ্রহে। প্রথমে উল্লেখ করা জোড়া বুনো মোষের অনবদ্য ছবিটি এরই অংশ। এই বিক্ষিপ্ত পৃষ্ঠার অপর দিকে আরও দুটি সুদৃশ্য ছবি— নীলগাই ও চিতল হরিণের।

বাবর বন্য মহিষের যে সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিয়েছেন, শিল্পী দু’জন তা নিখুঁত রূপায়িত করেছেন। বাবর লিখেছেন, ‘বন্য মহিষ আমাদের দেশের ষাঁড়ের চেয়ে আকারে অনেক বড়। ষাঁড়ের মতোই এদের শিং পিছন দিকে বাঁকানো, তবে পিঠ-ছোঁওয়া নয়। এরা অসম্ভব হিংস্র ও বিপজ্জনক।’ কান্‌হা-মনসুরের ছবির সামনের দিকে ঘন কৃষ্ণবর্ণের পুরুষ মহিষ, যার বিশাল শিং দু’টি অর্ধচন্দ্রাকারে উঠেছে। কপালে ছোট সাদা ছোপ, চোখের দৃষ্টি আদপেই স্নিগ্ধ নয়। পিছনে একটু হালকা রঙের একই আকারের মাদি মহিষ, কপালের অনেকটা জুড়ে সাদা লোমের ছোপ, চোখের দৃষ্টি যথেষ্ট ভয়ানক। পাহাড়ি এলাকায় কোনও জলাশয়ের সামনে তারা দাঁড়িয়ে আছে। বাবরের সময় তাদের যত্রতত্র দেখা গেলেও এখন তারা দুর্লভ— অসমের কাজিরাঙায় অনেক ও ওডিশা, ছত্তীসগঢ় ও মধ্যপ্রদেশে খুব অল্প কয়েকটি বন্য মহিষের দলের সন্ধান পাওয়া যায়।

আকবরের জন্য বিশেষ যত্নে তৈরি সচিত্র পুঁথির চারটি অনুলিপি-গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। প্রথমটি ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে (যা উনিশ শতকে কলকাতা থেকে সংগৃহীত হয়েছিল), দ্বিতীয়টি দু’ভাগে ভাগ হয়ে মস্কোর স্টেট মিউজিয়াম অব ইস্টার্ন কালচার ও আমেরিকার বাল্টিমোর শহরের ওয়াল্টার্স আর্ট মিউজিয়ামে; তৃতীয়টি প্রায়-সম্পূর্ণ অবস্থায় দিল্লির ন্যাশনাল মিউজিয়ামে (১৯৫০ সালে আগ্রার মিশনারি কলেজ থেকে সংগৃহীত); চতুর্থ কপিটি আলওয়ার মিউজিয়ামে, লেখার অংশটি প্রায়-সম্পূর্ণ হলেও ছবির সংখ্যা খুব কম। এগুলি ছাড়া তুরস্কের এক লাইব্রেরিতে একটি মোরক্কায় (অ্যালবাম) ‘বাবরনামা’-র বেশ কয়েকটি ছবি আবিষ্কার হয়েছে, গুণগত মানে যা যথেষ্ট উন্নত। ন্যাশনাল মিউজিয়ামের কপিতে কোনও তারিখ দেওয়া পুস্তিকা না থাকলেও দু’টি ছবি ১৫৯৮ ও ১৫৯৯-এ আঁকা হয়েছে, জানা যায়।

আকবরের নিজস্ব পুঁথির আর একটি ছবি জুরিখের রিটবার্গ মিউজিয়ামে সম্প্রতি সংগৃহীত হয়েছে। ছবির বিষয়বস্তু বাবরের গন্ডার শিকার। বাবর গন্ডার দেখে বিশেষ ভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। তাঁর বর্ণনাও নিখুঁত: এটিও একটি বড় আকারের জন্তু, তিনটি মহিষের সমান। এর নাকের উপর প্রায় ন’ইঞ্চি লম্বা একটি খড়্গ আছে। ...গন্ডারের চামড়া ভীষণ মোটা, যদি একটি বড় ধনুকে ধারালো তির লাগিয়ে পূর্ণশক্তিতে ছাড়া যায়, তা হলে ভাগ্য সহায় হলে পায়ের উপরের দিকের সন্ধির ভাঁজের চামড়ার বড়জোর চার ইঞ্চি গভীরে পৌঁছতে পারে। এর পিঠে, পিছনের দিকে ও পায়ের চামড়া দেখলে মনে হয় যে বর্ম পরে আছে। এর সঙ্গে ঘোড়ার অনেক মিল আছে। ...এর স্বভাব কিন্তু হাতির মতো নয়, অনেক বেশি হিংস্র, হাতির মতো একে পোষ মানানো যায় না।’ বাবরের সময় সিন্ধুর পশ্চিম পাড়ে পেশওয়ারের কাছে পঞ্জাবের ভেরা অঞ্চলে সিন্ধু-অববাহিকায় ও গঙ্গার উত্তর দিকে সরযূ নদীর আশেপাশে গন্ডার দেখা যেত। ‘বাবরনামা’য় এ রকম আরও অনেক বর্ণনা আছে, যা আজও প্রাসঙ্গিকতা হারায়নি।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement