মাসখানেকের মতো আগে, শনিবার চড়কের বিকেল। কলেজ স্ট্রিটে প্রায় সব ক’টি ধর্মীয় প্রকাশনায় ঢুঁ মেরে মেরে ক্লান্ত হয়ে গেলাম, কোত্থাও মিলল না পয়ার ছন্দে লেখা, তারকচন্দ্র সরকারের ‘শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত’। বাংলা ১৩২৩ সালে বাংলাদেশের ওড়াকান্দি থেকে মতুয়া মিশন বার করেছিল এই বই। সেতু প্রকাশনা থেকে একদা প্রকাশিত মনোশান্ত বিশ্বাসের ‘বাংলার মতুয়া আন্দোলন: সমাজ সংস্কৃতি রাজনীতি’ বইটিও আউট অব প্রিন্ট। ইতিহাসের অধ্যাপক মনোশান্তবাবুর এটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাপত্র। নমশূদ্র আন্দোলনের ইতিহাসকার শেখর বন্দ্যোপাধ্যায় সেই বইয়ের চমৎকার একটি ভূমিকাও লিখেছিলেন।
সবই দুষ্প্রাপ্য। পাওয়া গেল না মনোহরমৌলি বিশ্বাসের আত্মজীবনী ‘আমার ভুবনে আমি বেঁচে থাকি’। ফোনে ধরা গেল বলাগড়ের তৃণমূল বিধায়ক, দলিত সাহিত্য অকাদেমির মনোরঞ্জন ব্যাপারীকে। তাঁরও ‘মতুয়া এক মুক্তিসেনার নাম’ বলে একটি বই ছিল। একদা ‘আমার চণ্ডাল জীবন’ নামে একটি বই লিখে বাংলা সাহিত্যে নজর কেড়েছিলেন। চণ্ডালই তো নমশূদ্র বা মতুয়া। তিনিও ফোনে আক্ষেপ করলেন, “সে বই কী আর পাবেন দাদা!”
টিভি-কাগজে রোজ মতুয়া-লড়ালড়ি। বনগাঁ ঠাকুরনগরে মতুয়া ধর্মের স্রষ্টা হরিচাঁদ ও গুরুচাঁদ ঠাকুরের উত্তরসূরিরা কেউ বিজেপি, কেউ তৃণমূল। রাজনীতিতে প্রভাব থাকলেও, বই-বাজারের সংস্কৃতিক্ষেত্রে কোনও মতুয়া-প্রভাব কি নেই?
“নেই,” মনোরঞ্জন সটান বললেন, “ঠাকুরনগরের ঠাকুরবাড়ি তো দেশভাগের পরের ঘটনা। তত দিনে হরিচাঁদ, গুরুচাঁদ কেউ নেই। জায়গাটা গুরুচাঁদের নাতি প্রমথরঞ্জন ঠাকুরের জমিদারি। তিনি কংগ্রেস করতেন, ওখানে তাঁর জমিদারিতে মতুয়াদের থাকতে দেন, ঠাকুরবাড়ি তৈরি করেন। ওর সঙ্গে হরিচাঁদ, গুরুচাঁদের সম্পর্ক নেই।” পি আর ঠাকুরের স্ত্রী-ই ২০১৯ সালে প্রয়াত বীণাপাণি দেবী, তাঁকে সকলে বড়মা বলতেন। তাঁরই নাতি শান্তনু ঠাকুর আজকের বিজেপি সাংসদ, বিধবা জ্যেষ্ঠ পুত্রবধূ মমতাবালা ঠাকুর তৃণমূলের টিকিটে রাজ্যসভার সাংসদ। মমতাবালাই মতুয়া সমাজের প্রথম নারী সাংসদ।
এটাই মতুয়া ধর্মের উত্তরাধিকার। নিম্নবর্গের নমশূদ্রের আশা-আকাঙ্ক্ষার পরিচায়ক। ‘আইনসভায় যাও, আমি বলি রাজা হও/ দূর কর এ জাতির ব্যথা,’ সেই কবে উপদেশ দিয়েছিলেন গুরুচাঁদ ঠাকুর। আইন প্রণয়নের জায়গায় না পৌঁছলে সেই তিরিশের দশকে ব্রিটিশ শাসনে তো উচ্চবর্গের বামুন, কায়েতরাই তাদের সমর্থনে সব আইন বানিয়ে নেবে, শিক্ষিত নমশূদ্র পড়ে থাকবে চাকরি, বেসাতিহীন অন্ধকারে।
গুরুচাঁদ ঠাকুরের আইনসভায় যাওয়ার উপদেশই তা হলে আপনাদের ঠাকুরবাড়ির বিভাজন ঘটাল? মনোরঞ্জন এ বার আরও স্পষ্ট, “না, সব মতুয়াই ওখানে যান না। অনেক জায়গাতেই হরিচাঁদ, গুরুচাঁদের মন্দির আছে।”
এখানেই আজকের প্রবল প্রতাপশালী হিন্দুত্বের হার, ধর্মের জিত। হিন্দুধর্মে কোনও একমেবাদ্বিতীয়ম্ ভ্যাটিক্যান বা পোপ নেই। অযোধ্যার রামমন্দিরও সেখানে একমাত্র শক্তি নয়। হরিচাঁদ, গুরুচাঁদরাও সেই আদর্শে স্থিত। কোনও এক এবং একমাত্র ঠাকুরবাড়ির বিধান তাঁরা দিয়ে যাননি।
তা হলে হরিচাঁদ প্রবর্তিত মতুয়া ধর্মের বৈশিষ্ট্য কোথায়? “নেড়ানেড়ি, সাহেবধুনি, কর্তাভজা, আউল বাউল বলাহাড়ি… বৈষ্ণব ধর্মে এ রকম দুশোর বেশি ভাগ আছে। মতুয়াও সে রকম এক ধরনের বৈষ্ণব, নমশূদ্রদের অন্ত্যজ, জল-অচল বলে মন্দিরে ঢুকতে দেওয়া হত না। সেই নমশূদ্রদের জন্যই হরিচাঁদ ঠাকুর এই ধর্মমত চালু করেন,” বললেন বিধায়ক।
মানে, হিন্দুধর্মে থেকেই অন্ত্যজদের এক সংস্কার আন্দোলন। কী রকম সংস্কার? কোনও বেদমন্ত্র বা বৈদিক সংস্কার দরকার নেই। দরকার নেই দণ্ডী, কমণ্ডলু নিয়ে গেরুয়া বসনে সন্ন্যাসী হওয়ার। ‘করিবে গৃহধর্ম লয়ে নিজ নারী/ গৃহে থেকে ন্যাসী বানপ্রস্থী ব্রহ্মচারী।’ ‘হরিলীলামৃত’-এ হরিচাঁদ ঠাকুরের উক্তি এই রকমই। এই যে সন্ন্যাস বা প্রব্রজ্যাকে অস্বীকার, এটি মহাভারতের বৈশিষ্ট্য। গার্হস্থকেই ওই মহাকাব্য শ্রেষ্ঠ আশ্রম বলেছে। ফরিদপুরের ওড়াকান্দি গ্রামের নমশূদ্র সন্তান হরিচাঁদ কতটা রামায়ণ, মহাভারত পড়েছিলেন, সে অন্য গল্প। তবে তখনকার গ্রামজীবনে কীর্তন, পালাগান, ভাগবত ও কথকতা ছিল। রাজনীতি এক ব্যাপার, শাস্ত্রবিচার আর এক।
নমশূদ্র আর মতুয়া তা হলে এক? বিধায়ক হাসলেন, “একেবারেই নয়। কোনও নমশূদ্র তো খ্রিস্টানও হতে পারেন। সব মতুয়াই নমশূদ্র, কিন্তু সব নমশূদ্র মতুয়া নন।”
নমশূদ্র কারা
নমশূদ্র মানেই চণ্ডাল। মনু্স্মৃতির বিধানে, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র এই চার বর্ণেরও নীচে তার অবস্থান। গ্রামের সীমান্তে থাকবে, মৃত পশুর মাংস ভক্ষণ করবে। মধ্যযুগের স্মার্ত বাঙালিও এই নিয়মের ব্যতিক্রম নয়। একমাত্র শ্রীচৈতন্যই বলেন, ‘চণ্ডাল চণ্ডাল নহে যদি কৃষ্ণ বলে’। যবন হরিদাসকেও বুকে টেনে নেন, তাঁর নির্দেশেই নিত্যানন্দ সংসারে ফিরে এলেন, খড়দহে দুই স্ত্রীকে নিয়ে সংসার করলেন, সকলকে নিয়ে হরিনামে জগৎ মাতালেন।
ভক্তদের বিশ্বাস, শ্রীচৈতন্যই ১৮১২ সালে ফরিদপুরের সাফলডাঙা গ্রামে নমশূদ্র পরিবারে যশোমন্ত বিশ্বাসের পুত্র হিসাবে জন্মান। ‘হরিলীলামৃত’-এর বয়ান, ‘নীচ হয়ে করিব যে নীচের উদ্ধার/ অতি নিম্নে না নামিলে কিসের অবতার?’ মনুষ্যজন্ম নিয়ে ঈশ্বরের বারংবার পৃথিবীতে ফিরে আসা বা ‘অবতারবাদ’ হিন্দু ধর্মবিশ্বাসের অন্যতম লক্ষণ। ‘হরিলীলামৃত’-এর মতো ধর্মীয় আকরগ্রন্থ সেই তরিকাতেই নিজেকে প্রকাশ করেছে। বার বার ফিরে এসেছে জাতপাতের ভেদ ঘোচানো বুদ্ধ অবতারের কথা। সেই চর্যাপদের যুগ থেকে নিম্নবর্গের বাঙালি বার বার বুদ্ধ-শরণ নিয়েছে, প্রতিষ্ঠিত সত্য। আজকাল ‘আমরা বাঙালি, সেকুলার, আমাদের রামমোহন আছেন, রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ আছেন’ গোছের জনগর্জন শোনা যায়। ভোট-বাজারের এ সব কথায় যতটা রাজনীতি আছে, ততটা সত্য নেই। কলকাতা শহরেও সব বাঙালি গেরস্ত ব্রাহ্ম হয়নি, বেলুড় মঠে বিবেকানন্দদেরও আশপাশের লোকজন ব্যঙ্গ করত, ‘দূর! চা খায়, এরা আবার কিসের সন্ন্যাসী!’ কলকাতার ছেলে, ইংল্যান্ড, আমেরিকা-ফেরত বিবেকানন্দ তাঁর গুরুকে অবতারবরিষ্ঠ বলে প্রণাম করছেন, আবার ফরিদপুরের অন্ত্যজ গ্রাম্য জীবনেও সেই অবতারবাদ। এখানেই হিন্দুর বিশিষ্টতা, কোনও উচ্চাকাঙ্ক্ষী রাজনৈতিক লব্জে নয়।
বস্তুত বাঙালির জাতিবিভাজনে মনুবাদী চণ্ডালের পরিবর্তে নমশূদ্র শব্দটি একেবারেই হাল আমলের ঔপনিবেশিক অবদান। ১৮৮৫ সালের পর থেকেই বাংলায় সৎচাষী, সদ্গোপ, নবশাখ ইত্যাদি নতুন জাতি-পরিচয় তৈরি হতে থাকে। নমশূদ্র শব্দটিও সেই সময়ে তৈরি। কিন্তু সাফলডাঙা গ্রামের হরিচাঁদ ঠাকুর তার আগেই ‘মতুয়া’ শব্দটি চালু করে দিয়েছেন। ভেকধারী বৈষ্ণবদের অর্থলোভ ও সাধনসঙ্গিনীর লাম্পট্য দেখে দেখে তিনি তিতিবিরক্ত। অতএব সকলে মিলে হরিনামের বিধান, ‘হরি ধ্যান হরি জ্ঞান হরি নাম সার/ প্রেমেতে মাতোয়ারা মতুয়া নাম যার।’ মতুয়া মানে শুধু তৃণমূল বনাম বিজেপি নয়। আজও বেলেঘাটা থেকে বিজয়গড়, কুঁদঘাট থেকে বৈষ্ণবঘাটা সব উদ্বাস্তু এলাকার বাজারে যে মাঝে মাঝে অষ্টপ্রহর সঙ্কীর্তনের আসর বসে, সেখানেও রয়েছে মতুয়া সংস্কৃতির প্রভাব।
ফরিদপুর, বাখরগঞ্জ এলাকার গায়ে-গতরে খাটা এই সব নিম্নবর্গের চাষিরা উচ্চবর্গের জমিদারদের অত্যাচার সহ্য করতে করতে প্রথম থেকেই তীব্র প্রতিবাদী। ১৮৭৩ সালের ৮ এপ্রিল ফরিদপুরের ইংরেজ জেলাশাসক কেলি ঢাকার ডিভিশনাল কমিশনারকে এক চিঠিতে জানাচ্ছেন, ‘উচ্চবর্ণের হয়ে গতর খাটানোয় নারাজ চণ্ডালরা এখানে টানা চার-পাঁচ মাস ধর্মঘট করেছে। বরিশাল, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ সর্বত্র এক অবস্থা।’
এই চাওয়ায় কোনও অন্যায় নেই। ১৮৭১ সালের জনগণনায় ফরিদপুরের চণ্ডাল জনসংখ্যা ১ লক্ষ ৫৬ হাজার, তাদের মধ্যে স্কুলে যায় মাত্র দুশো জন। বামুন, কায়েতদের স্কুল বা পাঠশালার ছায়া মাড়ানো তাদের পক্ষে নিষিদ্ধ। হরিচাঁদ, গুরুচাঁদরা তাই ওড়াকান্দি গ্রামে নিজেদের বসতবাড়িতে ইংরেজ সাহেবের সহায়তায় প্রতিষ্ঠা করলেন স্কুল। হরিচাঁদ যেমন শ্রীকৃষ্ণের অবতার, তার পুত্র গুরুচাঁদ সে রকম শিবের অবতার। গুরুচাঁদের বাণী, ‘প্রয়োজন হলে করবে ভিক্ষা/ ছেলেমেয়েকে দেবে শিক্ষা।’ ঠাকুরনগরের মতুয়া মেলায় এক বার ‘মতুয়া ধর্মমতে ক্রিয়াকর্মের বিধান’ নামে একটি চটি বই পেয়েছিলাম। সেখানে নির্দেশ, বিয়ের সময়েও দেখতে হবে পাত্রপাত্রীর ‘এডুকেশন’। নিম্নবর্গের আর কোনও ধর্ম শিক্ষায় এতটা গুরুত্ব দিয়েছে কি? নাগরিক বাঙালিও শিক্ষাবিস্তারের কথা বলতে গিয়ে বিদ্যাসাগর, হেয়ার স্কুল ও বেথুন সাহেবে আটকে থাকেন। এই কারণেই স্বাধীনতার পর পূর্ববঙ্গের নমশূদ্র উদ্বাস্তু এ পারে এসে বগুলা, মাজদিয়া, বিজয়গড়, অশোকনগর যেখানেই বাসা বাঁধতেন, চাঁদা তুলে স্কুল, কলেজ গড়ার চেষ্টা করতেন। ওটি ধর্মের বিধান। আর যুযুধান যে দুই দল আজ লড়তে লড়তে গরিবের সরকারি শিক্ষাব্যবস্থাকে কার্যত শিকেয় তুলে দিয়েছে, তারাই মতুয়াপ্রেমের প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। এটি রাজনীতির বিধান।
এই রাজনীতি আসলে বদলে যাওয়া অর্থনীতির ফসল। ১৮৮০-৮৫’তে বাংলাদেশের ফরিদপুর, বরিশালের চাষি পেয়ে যায় পাটের ঠিকানা। জমিদারের অত্যাচারে আধপেটা খেয়েও গোলাঘরে ধান তুলে দিতে হত, কিন্তু পাট অন্য ব্যাপার। কলকাতার চটকলে না পৌঁছলে তা মূল্যহীন। “পাট চাষ শুরু হওয়ার পর ও পাটের বাজার যতদিন চড়া ছিল, ১৯২৫ সাল পর্যন্ত নমশূদ্ররা একটু ভাল ছিল। কোনো কোনো বাড়িতে পড়াশোনা ঢোকে। কারো কারো একটু সামাজিক সম্মান জোটে। এই চল্লিশ বছরে নমশূদ্রদের ভাবসাব বেশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। নতুন তৈরি আসাম ও পূর্ববঙ্গ প্রদেশের লেফটেন্যান্ট গভর্নর নমশূদ্র নেতাদের একটু খাতিরও দেন। গুরুচাঁদ ঠাকুরের মতুয়া ধর্ম আন্দোলন বেশ ছড়ায়-গুছোয়,” ‘বরিশালের যোগেন মণ্ডল’ উপন্যাসে লিখে গিয়েছেন দেবেশ রায়।
শিক্ষাবিস্তারের কারণেই ইংরেজ আমলে ওকালতি, শিক্ষকতা ইত্যাদি নানাবিধ পেশায় ঢুকে পড়েন নমশূদ্ররা। কিন্তু পেতে হবে সরকারি চাকরি। তখনই দর কষাকষি, রাজনীতির পাঞ্জা। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের উত্তাল সময়ে গুরুচাঁদ পূর্ববঙ্গ ও অসমের ছোটলাটকে এক অভিনন্দনপত্র দেন। গুরুচাঁদের পৌত্র প্রমথরঞ্জন ঠাকুর তাঁর আত্মজীবনীতে জানিয়েছেন, “ইহাই অনুন্নত জাতির মধ্য হইতে গভর্নমেন্টকে সর্বপ্রথম অভিনন্দনপত্র। ইহার ফলে বাঙ্গালার নমশূদ্র ও অন্যান্য অনুন্নত জাতির রাজনৈতিক অধিকারের দাবি এবং শিক্ষিত হইলে গভর্নমেন্টের অধীনে চাকুরি পাইবার উপযুক্ততা গভর্নমেন্ট কর্তৃক স্বীকৃত হইয়াছিল।”
এখানেই ইতিহাসের উচ্চাবচতা। কলকাতার রাখিবন্ধন আর ‘বাংলার মাটি, বাংলার জল’-এ গা না ভাসিয়ে পূর্ববঙ্গের মতুয়ারা তাঁদের রাজনীতির বয়ান তৈরি করেছিলেন। বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করেননি, ১৯২১-এ গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলনও সমর্থন করেননি। গুরুচাঁদের সাফ বক্তব্য ছিল, “অসহযোগে ভদ্রলোকদের কী আর আসে যায়! এক ভাই উকিল, এক ভাই মাস্টার, আর এক ভাইয়ের ব্যবসা। উকিল গেল অসহযোগ করে জেলে, মাস্টার নিল সংসারের দায় আর ব্যবসায়ী খদ্দর বেচে করল লাভ। এগুলো তাদের সাজে। নমশূদ্ররা চাষ ছেড়ে অসহযোগে গেলে দফা রফা।” তখনও ছিল জাতীয়তাবাদী মেনস্ট্রিম রাজনীতির প্রতিস্পর্ধা।
সেই স্পর্ধাই আজ লুপ্ত। ১৯৩৭ সালে গুরুচাঁদের স্মরণসভায় নেতাজি সুভাষচন্দ্র জানালেন, “শ্রীগুরুচাঁদ ঠাকুর একজন মহাপুরুষ। তিনি দুই লক্ষ শিষ্যকে নিয়ে আন্দোলন শুরু করেছিলেন, যা তাঁদের তফসিলিভুক্ত জাতির মর্যাদায় ভূষিত করেছিল। তাঁরা বর্ণহিন্দুদের সঙ্গে সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে সমকক্ষ হতে সম্ভব হয়েছিলেন।” যেন বর্ণহিন্দুর সমকক্ষ হওয়াই নমশূদ্র জীবনে এক এবং একমাত্র লক্ষ্য। উচ্চবর্গের জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতেই অনেক ফাঁকফোকর আছে, আমাদের খেয়াল থাকে না।
কলকাতার যোগেন মণ্ডল
দেবেশ রায় তাঁর ‘বরিশালের যোগেন মণ্ডল’ উপন্যাসের শেষ লাইনে দেশভাগের পর যোগেনকে পাকিস্তানের ট্রেনে তুলে দিলেন, “যোগেন নিজেকে দেখতে চায়, ভারতবর্ষ নামে হাজার হাজার বছরের ধ্যানের একমাত্র প্রতিনিধি সে, এক শূদ্র। চলেছে পাকিস্তানে। সেই ধ্যানের স্বদেশকে সত্য রাখতে।” গুরুচাঁদ ১৯৩৫ সালের প্রাদেশিক আইনসভার নির্বাচন মেনে নিয়েছিলেন, তফসিলি জাতির জন্য সে বার ৩০টি আসন সংরক্ষিত। একটি আসনে জিতে এলেন তাঁর নাতি প্রমথরঞ্জন ঠাকুর। নমশূদ্রদের মধ্যে প্রথম বিলেতফেরত ব্যারিস্টার। সাধারণ আসনে কংগ্রেস প্রার্থীকে হারিয়ে জিতে এলেন মতুয়া পরিবারের ‘যোগেন মণ্ডল’।
হরিচাঁদ, গুরুচাঁদদের থেকে যোগেনের রাজনীতি অন্য রকম ছিল। ওড়াকান্দির ঠাকুরবাড়িতে নমশূদ্র বিজয় পালা হত, হিন্দু নমশূদ্ররা কী ভাবে ফরাজি মুসলমানদের দাঙ্গায় মেরে পাট পাট করেছিল, তার গান। বাস্তবে পদ্মবিলের সেই কাজিয়ায় গরুচুরি নিয়ে দু’-একটি মৃত্যু ঘটেছিল, পুলিশ যথাসময়ে হস্তক্ষেপ করে। যোগেন মণ্ডল বলতেন, নমশূদ্র এবং মুসলমান দুই তরফই পাশাপাশি, প্রায় স্বগোত্রের। দু’পক্ষই উচ্চবর্ণের হিন্দু জমিদারের হাতে শোষিত।
যোগেন দেশভাগ ও দাঙ্গা আটকানোর বহু চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। কিন্তু নিম্নবর্গ-চর্চায় আজও তিনি স্মরণীয়। ১৯৪৬-এ আইনসভার নির্বাচনে আম্বেডকর হেরে যান, কিন্তু যোগেন তাঁকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে জিতিয়ে আনেন। স্বাধীনতার পর পাকিস্তানে গিয়ে লিয়াকত আলি খানের মন্ত্রিসভায় যোগ দেন, ১৯৫০ সালে ভারতে চলে আসেন। পাক প্রধানমন্ত্রী তাঁর সহকর্মী প্রসঙ্গে বলেন, তিনি চোরের মতো অন্য দেশে পালিয়েছেন, এ দিকে পূর্ব পাকিস্তান ও ভারতের নমশূদ্ররা তাঁকে বিশ্বাসঘাতক অভিধা দানে ব্যস্ত।
১৯৫০ সালের ২৪ অক্টোবর আনন্দবাজার পত্রিকা প্রতিবাদে লিখছে, “শ্রীযুত মণ্ডলের করাচী হইতে ভারতে আসিতে ছদ্মনাম বা ছদ্মবেশের প্রয়োজন হয় নাই। সরকারী কর্মচারীদের সহিত যোগসাজসে বেনামে এবং বিনা ফটোগ্রাফে পাসপোর্টেরও প্রয়োজন হয় নাই, সাধারণ যাত্রী হিসাবেই তিনি আসিয়াছেন।”
করোনা-পূর্ব পৃথিবীতে এক দিন বিশ্বস্ত সূত্রে আচমকা জানা গেল, সেই যোগেন মণ্ডলের একমাত্র ছেলে জগদীশ মণ্ডল এখনও বেঁচে। চার দিকে এত মতুয়া-মতুয়া রব, আর ভারত-ইতিহাসের ব্যতিক্রমী চরিত্রটিকে খতিয়ে দেখব না?
কোনও ‘অ্যাসাইনমেন্ট’ নেই, পূর্বপরিকল্পনা নেই। রটনা আদো কতটা ঘটনা, সেটা জানতে এক সকালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের চলচ্চিত্রবিদ্যার অধ্যাপক মৈনাক বিশ্বাস, তাঁর বন্ধু সুদীপ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গী হলাম। গড়িয়া স্টেশন থেকে আরও দূরে, কলকাতা শহর যেখানে আচমকা শেষ হয়ে গিয়েছে, কাঁচা ড্রেন আর সিমেন্টের রাস্তা, সেই পাঁচপোতা অঞ্চলে বৃদ্ধ জগদীশ মণ্ডলের নিবাস। পাকা বাড়ি, সামনে গাছগাছালি-সহ পুকুর। জগদীশবাবু রেলে চাকরি করতেন, দীর্ঘকাল প্রায় একক চেষ্টায় খোঁজাখুঁজি করে সংবাদপত্রের বিভিন্ন ছবি ও ক্লিপিং, সরকারি ও বেসরকারি হরেক নথিপত্র নিয়ে সাত খণ্ডে ‘মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ’ নামে বই লিখেছেন। বাংলা সাহিত্যে এ রকম পরিশ্রমী পিতৃস্মৃতি বিশেষ নেই।
বৃদ্ধ জগদীশবাবু তখনও কথা বলেন, কিন্ত মাঝে মাঝে খেই হারিয়ে ফেলেন। সাত খণ্ডের বইটি কেনা গেল। পার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো পণ্ডিতরাও সেই বইয়ের কিছু তথ্যকে মান্যতা দেন। পার্থ চট্টোপাধ্যায় তাঁর এক নিবন্ধে প্রশ্ন তুলেছিলেন, “রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভর না করে তত্ত্বনির্ভর রাজনীতির সন্ধানেই কি যোগেন্দ্রনাথ পথ হারালেন? এর বদলে অন্য পদ্ধতিটি যদি তিনি গ্রহণ করতেন, তা হলে তিনি ভাবতেন না লাখ লাখ কোটি কোটি মানুষের কোনটা করা উচিত। বরং অনুমান করার চেষ্টা করতেন, তারা কোনটা করতে পারে অথবা করতে চলেছে, সেই মতো নিজের কর্তব্য স্থির করতেন।” সমাজবিজ্ঞানীর সিদ্ধান্ত, “এই দ্বিতীয় পদ্ধতিটা তত্ত্বনির্ভর নয়, তা হলো স্ট্র্যাটেজি, হালের বাংলায় যাকে বলা হয় কৌশল।” তাঁর কথার রেশ টেনে বলা যায়, আজকের মতুয়া রাজনীতিতে হরিচাঁদ, গুরুচাঁদ কেউই নেই। আছে শুধু কৌশল।
জগদীশবাবু সে দিন বলছিলেন, শুধু কি হিন্দু নমশূদ্ররাই মতুয়া? বাংলাদেশে কিছু মুসলমান মতুয়াও আছেন। তাঁরা এখনও হরিচাঁদের জন্মতিথিতে বারুণী স্নানের মেলায় যান।
প্রসঙ্গত, মতুয়া ধর্মে মাছ-মাংস খাওয়া নিয়ে বাঁধাবাঁধি নেই। শুধু বুধবার, হরিচাঁদের জন্মদিনে নিরামিষ খেলেই হল। সামাজিক প্রেক্ষাপটটি ভুললে চলবে না। মাছ-ভাত যার প্রধান খাদ্য, কায়িক পরিশ্রমের পর সেই নমশূদ্র চাষিকে স্রেফ নিরামিষ খেয়ে থাকতে বলা যায় না।
আর বাংলা ভাগ? সে নিয়ে আজকাল স্বকপোলকল্পিত অনেক কাহিনি শোনা যায়। কিন্তু ইতিহাস অন্য। পার্থবাবু লিখছেন, “১৯৪৭-এ বাংলার পার্টিশন চেয়েছিল হিন্দুরা। যখন জানা গেল ধর্মের ভিত্তিতে ভারত-পাকিস্তান ভাগ হতে চলেছে, তখন বাংলার হিন্দু ভদ্রলোকেরা এই ভেবে ত্রস্ত হয়ে পড়লেন যে মুসলিমগরিষ্ঠ প্রদেশ হিসাবে বাংলা অন্তর্ভুক্ত হবে পাকিস্তানে। একই রকম আশঙ্কায় পঞ্জাবের শিখরাও পঞ্জাব ভাগের দাবি তুলেছিল। বাংলায় সে দাবি প্রথম তোলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়।” ইতিহাসের নথি, ৭ মে ১৯৪৭ সালে বিলেতে সেক্রেটারি অব স্টেটকে কিছু কৃতবিদ্য বাঙালি, এ কালের ভাষায় বুদ্ধিজীবী বাংলা ভাগের দাবি জানান। সকলেই হিন্দু। নাম যদুনাথ সরকার, রমেশচন্দ্র মজুমদার, মেঘনাদ সাহা, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়।
যোগেন মণ্ডল ও তাঁর রাজনৈতিক গুরু শরৎচন্দ্র বসুই তখন বাংলা ভাগের বিপক্ষে, কংগ্রেস নীরব। হিন্দু মহাসভা ভাগের পক্ষে। অতঃপর ১৯৪৯ সালে খুলনার দাঙ্গায় কমিউনিস্টদের গ্রেফতার করতে গিয়ে নমশূদ্রদের উপর নির্মম অত্যাচার। পাকিস্তানের তৎকালীন আইনমন্ত্রী যোগেন মণ্ডলেরও তখন প্রাণসংশয়। যে কোনও মুহূর্তে আক্রান্ত হতে পারেন। প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খানকে চিঠিতে ক্যাবিনেট মিনিস্টার যোগেন জানালেন, নেতা আজ ব্যর্থ। মুসলিম লিগের প্রবক্তা জিন্না ‘সেকুলার’ দেশের কথা বলেছিলেন, লিয়াকত সেই প্রতিজ্ঞার দাম রাখেননি।
‘আইডেন্টিটি পলিটিক্স’ যে কী ভয়াবহ, যোগেনবাবুর শেষ দিনগুলিই তার প্রমাণ। জগদীশবাবু বলছিলেন, তখন ওঁরা টালিগঞ্জের সুলতান আলম রোডে থাকতেন। ১৯৫২ সালের পর তাঁর বাবা প্রায় সব নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন ও হেরেছেন। ১৯৬৭ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকারের পতনের পর আম্বেডকরের রিপাবলিকান পার্টির হয়ে ১৯৬৮ সালে ভোটে দাঁড়ান, সেই ভোটপ্রচারেই তাঁর মৃত্যু। যোগেন মণ্ডল তখন কুপার্স ক্যাম্প, বাগজোলার উদ্বাস্তু শিবিরে আর নমশূদ্র আইডেন্টিটির কথা বলেন না, বামপন্থীদের সঙ্গে জোটের কারণে সেখানে স্লোগান তোলেন, ‘আমরা কারা? বাস্তুহারা’।
এ ভাবেই শেষ হয়ে গিয়েছিল নমশূদ্র রাজনীতির সেই ব্যাতিক্রমী ঝলকানি। খবর পেয়েছি, করোনা-পর্বের শেষে ২০২২ সালে জগদীশবাবুও এই পৃথিবী ছেড়ে গিয়েছেন।
বই বনাম উইকি
গোটা ঘটনাটা তা হলে কী দাঁড়াল? গুরুচাঁদ বিশের দশকেও মতুয়াদের সরকারি চাকরি ও শিক্ষার জন্য দর কষাকষি করছেন, প্রমথরঞ্জন ঠাকুর স্বাধীনতার পর এ পারে ঠাকুরনগরে তাঁদের ওড়াকান্দির বাড়ির এক অতীত প্রতিচ্ছবি তৈরিতে সচেষ্ট। ঠাকুরনগরের মতুয়ামেলায় শুনেছিলাম গান, ‘মতুয়ারা দলে দলে ওড়াকান্দি যায় রে।’ ফরিদপুরে ওড়াকান্দির আশ্রম এতই বিখ্যাত যে, উইকিপিডিয়া-সহ বেশ কয়েকটি সাইট সেটিকেই হরিচাঁদের জন্মস্থান বলে জানিয়েছে। অথচ ‘হরিলীলামৃত’ পরিষ্কার জানাচ্ছে, সাফলডাঙাই হরিচাঁদদের পাঁচ ভাইয়ের জন্মস্থান। ‘ফরিদপুর জিলা গ্রাম সফলাডাঙ্গায়/ পঞ্চ ভ্রাতা জন্মিলেন এসে এ ধরায়।’ পারিবারিক অবস্থা ভাল ছিল, জমিদারকে কর্জ দিতেন। পরে সেই জমিদার ও নায়েবের চক্রান্তে ভিটেছাড়া হন। ওড়াকান্দিতে এসে বসত করেন।
এই তথ্যগুলি নিছক ছাপা বই বনাম সোশ্যাল মিডিয়া নয়। কিন্তু বইয়ের অলভ্যতা, আকর গ্রন্থে এক, উইকিতে আর এক, এ সব একটা কথাই জানায়। মতুয়াদের রাজনৈতিক পুঁজি বেড়েছে নিশ্চয়ই, কিন্তু সাংস্কৃতিক পুঁজি সেই তিমিরেই।
ছাপাখানার গল্প
‘হরিলীলামৃত’ বাড়িতেই বইয়ের তাকের এক কোণে আত্মগোপন করেছিল। অবশেষে তাকে খুঁজে পাওয়া গেল। বইটা কেন খুঁজছিলাম? পয়ারে লেখা বইটিতে অম্বররাজ মানসিংহের ছেলের পুর্নজীবন প্রাপ্তি, কৃষ্ণ-সুদামার গল্পের মতো মৃত বন্ধুকে বালক হরিচাঁদের ফের বাঁচিয়ে দেওয়া, পুরীতে জগন্নাথের স্নানযাত্রা, হরিচাঁদের জন্মের আগে তাঁর মায়ের যশোদা-আবেশ ইত্যাদি হরেক গল্প আছে। সব গল্পই যে বাস্তব কার্যকারণ বোধের, এমন নয়।
হওয়ার কথাও নয়। যে কোনও ধর্ম প্রথমাবস্থায় এক রকম জাদুকাহিনি, কৃষ্ণদাস কবিরাজের ঢের আগে বৃন্দাবনদাসের ‘চৈতন্যভাগবত’ মনে করে দেখতে পারেন। সেখানে ছোট্ট নিমাই হাঁটেন, তাঁর বাবা নূপুরের শব্দ শুনতে পান। শ্রীচৈতন্য আমের আঁটি পুঁতে দিলে সঙ্গে সঙ্গে গাছ হয়ে যায়, ভক্তেরা সেই গাছের আম কাড়াকাড়ি করে খান। মতুয়াদের ‘হরিলীলামৃত’-র অলৌকিকত্ব আসলে মধ্যযুগের চৈতন্যজীবনী থেকে আসা ঐতিহ্য।
ঐতিহ্যটি আসলে ইলাস্টিকের মতো স্থিতিস্থাপক, মধ্যযুগ ছাড়া আধুনিক যুগেরও আবেশ আছে। মৃত্যুর আগে হরিচাঁদ পুত্র গুরুচাঁদকে বলেন, “আমি নশ্বর দেহ ছেড়ে গেলেও তোমাতেই অবস্থান করব। যখনই ডাকবে, সাড়া পাবে।” শুরু হল বংশগত গুরুগিরির নতুন তরিকা। হরিচাঁদ, গুরুচাঁদই একমাত্র আরাধ্য। এই সঙ্কীর্ণতাকেই ঠাকুর রামকৃষ্ণ ‘মতুয়ার বুদ্ধি’ বলেছিলেন। আমার নিজের গুরুই একমাত্র আরাধ্য, অন্যরা তাঁর থেকে নিচু থাকের, আদৌ শ্রদ্ধার্হ নন!
কিন্তু আরও কিছু চমকপ্রদ বিষয় আছে। সব ঠাকুর এক নন। বিহার, উত্তরপ্রদেশে ঠাকুর মাত্রেই উঁচু জাত, জমিদার। পূর্ববঙ্গে নিচু জাত। ব্রাহ্মণ জগন্নাথ কুশারী নিচু জাতে বিয়ে করেছিলেন, ফলে তাঁকে একঘরে হতে হয়। নিচু জাতের, ম্লেচ্ছসংশ্লিষ্ট পিরালি ব্রাহ্মণ হওয়াই তাঁর ভবিতব্য। ইনিই দেবেন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথদের পূর্বপুরুষ।
হরিচাঁদের বাবা সাফলডাঙার যশোমন্ত বিশ্বাসের ভাগ্য সে রকম নয়। তিনি নমশূদ্র, আশপাশের চাষি, জেলেদের মধ্যেই যজমানি করেন। তাই তাঁকে সকলে ঠাকুর বলেন।
জাতের নামে বজ্জাতি শুধু সে আমলের মফস্সলে নয়, কলকাতাও কম যেত না। ১৯৪৩ সালে প্রকাশিত মহানন্দ হালদারের ‘গুরুচাঁদ চরিত’ ‘হরিলীলামৃত’ ছাপার প্রথম কাহিনি বলে। গুরুর আদেশে বই ছাপতে তাঁরা কলকাতায় আসেন। সেখানে কোনও কোনও প্রেসওয়ালা এই বই ছাপতে অস্বীকার করেন। ‘নমশূদ্র ঘরে এল স্বয়ং ভগবান/ এই কথা ছাপিবারে নাহি বলে প্রাণ’।
অতঃপর ‘ছিদাম মুদির লেনে ছিল এক প্রেস/ “শাস্ত্র প্রচার প্রেস” নাম বলি কয়... তের’শ তেইশ সালে গ্রন্থ ছাপা হ’ল/ প্রতিখণ্ড তিনটাকা মূল্য রেখে দিল।’ রামমোহন, বিদ্যাসাগরের স্মৃতিধন্য নবজাগরণের শহর যে আদতে সেকুলার নয়, ছাপাখানাও এক সময় বইয়ের বিষয়বস্তুতে মানুষী জাতিভেদ করত, এখানেই তার প্রমাণ। বইয়ের অধুনা অলভ্যতার পাশাপাশি ছাপার ইতিহাসও তাই স্মরণীয়।
শেষ কথা
হরিচাঁদের পর বংশগত দু’টি ধারা। একটি গুরুচাঁদের, অন্যটি তান্ত্রিক উমাচরণ ঠাকুরের। গুরুচাঁদের পর পি আর ঠাকুরের একটি শাখা, সুধন্য ঠাকুরের আর একটি। বংশবর্হিভূত প্রধান শাখা তারকচন্দ্র সরকারের। সত্যজিতের সিনেমার বাইরে মতুয়া ধর্মেও যে কত শাখাপ্রশাখা! পারিবারিক গুরুগিরিতে, বিভাজনক্লিষ্ট সেই দুনিয়াতেই কি নিহিত আছে রাজনীতি-বিজয় ও সাংস্কৃতিক পরাজয়?
আর সেই রাজনীতিই কি নয় পারিবারিক ‘ব্লাইন্ড স্পট’? রাজনীতিতে ধ্রুব বলে কিছু নেই, সময়ের সঙ্গেই বদলায় সে। গুরুচাঁদ, প্রমথরঞ্জন ঠাকুর বা যোগেন মণ্ডল তাঁদের সময়ে, তাঁদের মতো করে মতুয়াদের উন্নয়নকল্পে রাজনৈতিক দর কষাকষি করেছেন। অথচ প্রমথ ঠাকুরের বিধবা স্ত্রী বীণাপাণি দেবী ২০১০ সালে কী করলেন? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে প্রধান পৃষ্ঠপোষক ঘোষণা করলেন। তখনও মমতা মুখ্যমন্ত্রী হননি। ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে যে ধর্মের উত্থান, ব্রাহ্মণকন্যাকে সে করল পৃষ্ঠপোষক। তার পর তো ২০১৯ সালে বড়মার মৃত্যু। রাজ্য সরকার দিল রাষ্ট্রীয় মর্যাদা, দিল্লি থেকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী পাঠালেন শোকবার্তা। হরিচাঁদ, গুরুচাঁদের প্রবর্তিত ধর্ম এখন আর প্রতিবাদী নিম্নবর্গের আশ্রয় নয়, নিছক ভোটব্যাঙ্ক মাত্র!