আশ্রিতা: হোমে একমনে কাপড়ে ব্লক প্রিন্টের কাজ করছে সাফি আখতার
তেরো বছরের কিশোরীর দু’চোখের পাতা বন্ধ, কোলের কাছে জড়িয়ে ধরা ছোট গিটারের মতো একটা বাজনা। বাজনার তারগুলোর উপর আঙুলের ওঠানামায় মন ঠান্ডা করা রিনরিনে একটা আওয়াজ ছড়িয়ে পড়ছে।
ক্যালিফোর্নিয়া থেকে কলকাতায় আসা লরি আন্টির কাছে সন্ধেবেলার ক্লাসে এই ‘উখুলেলে’ বাজাতে শিখেছে সে। প্রথমে ‘টুইঙ্কেল টুইঙ্কেল,’ তার পর এই সুরটা। সাফি যখনই চোখ বন্ধ করে সুরটা বাজায়, তখনই নানির গায়ের গন্ধ পায়! পান-জরদা মেশানো আদর-আদর গন্ধ।
সাফি কাঁদছে। বাজনা থেমে গিয়েছে। দু’হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠছে। লরি আন্টি, মানবী আন্টি মাথায়-পিঠে হাত বুলিয়েও থামাতে পারছেন না। কিচ্ছু ভাল লাগছে না সাফির। ছুটে চলে যেতে ইচ্ছে করছে মায়ানমারে তাদের হারিফারা গ্রামে। সেখানে নানি শুনশুন্নার বেগম আছে, ছোটমামু আছে, বড়মামুর মেয়ে জাইদা আছে, পাশের বাড়িতে তার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু আশিয়া আছে। বড় পুকুরটায় আবার দাপিয়ে সাঁতার কাটবে, খেলনাবাটি খেলবে, আশিয়ার সঙ্গে সকাল-বিকেল মাদ্রাসায় যাবে।
কোরান শরিফ শেষ করতে আর একটু বাকি ছিল তার। তার আগেই পালাতে হল। বার্মিজরা এসে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিল। গুলি করে, লাঠি দিয়ে পিটিয়ে মানুষগুলোকে মেরে ফেলতে লাগল। বাচ্চাগুলোকেও রেহাই দিল না। টেনে নিয়ে যেতে লাগল মেয়েদের। নানি আর তাকে রাখার সাহস পেলেন না। বাবা ছিলেন বাংলাদেশের কক্সবাজারে। নানি রাতের অন্ধকারে নৌকো করে সাফিকে নিয়ে বাংলাদেশ বর্ডার পার করে দিয়ে এল বাবার কাছে। পরের গন্তব্য ছিল ইন্ডিয়া।
মায়ানমারের পশ্চিম দিকে বাংলাদেশ সীমান্তের রাখাইন প্রদেশের রোহিঙ্গা কিশোরী সাফি আখতার। এক কালে এই অঞ্চলেরই নাম ছিল আরাকান। ‘রোহিঙ্গা’ অর্থাৎ মায়ানমারের সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়। ২০১২ থেকে গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত মায়ানমারের রাখাইন প্রদেশ থেকে প্রাণ বাঁচাতে দলে–দলে তাঁরা ছড়িয়ে পড়ছেন গোটা বিশ্বে। পালাতে গিয়ে কখনও সমুদ্রে নৌকাডুবি হয়ে মরছেন, কখনও আবার বিদেশের মাটি থেকে কুকুরের মতো তাড়া খাচ্ছেন। তাঁরা স্টেটলেস! সিরিয়ার উদ্বাস্তুদের মতো এই রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের নিয়েও বিশ্ব উত্তাল। খোদ ইউনিসেফ এঁদের ‘ওয়ার্ল্ড’স মোস্ট পার্সিকিউটেড মাইনরিটিজ’ ঘোষণা করেছে। শান্তির নোবেল পাওয়া আউং সান সু চি’র দেশ থেকে সেখানকার সেনাবাহিনী ও সংখ্যাগুরু বৌদ্ধদের হামলায় ভিটেমাটি হারানো রোহিঙ্গাদের একাংশ বাংলাদেশ সীমান্ত পেরিয়ে ঢুকে পড়ছে ভারতেও।
তেমনই একটা দলের সঙ্গে ঢুকেছিল সাফি। ধরা পড়েছিল বিএসএফ-এর হাতে। সেটা ২০১৫, সঙ্গে ছিলেন বাবা এনায়েতউল্লাহ। বাবাকে নিয়ে গেল জেলে, আর সাফি এসে পড়ল কলকাতা-লাগোয়া বেসরকারি মেয়েদের হোমে। দফায়-দফায় এই হোমে প্রায় ২২-২৩ জন রোহিঙ্গা শিশু ও কিশোরী এসেছিল। প্রত্যেকেই আগে-পরে নিজেদের পরিবারের কাছে ফিরে গিয়েছে। আস্তানা নিয়েছে এই ভারতেরই কোনও প্রান্তে। হোমে আপাতত রোহিঙ্গা বলতে রয়ে গিয়েছে একলা সাফি।
বাবা এখনও দমদম জেলে, আর মা নুনতাজ বেগম আরও চার ছেলেমেয়ে নিয়ে হায়দরাবাদের বাবানগরের উদ্বাস্তু বস্তিতে। তাঁরা বাংলাদেশ বর্ডার পেরিয়েছিলেন সাফিদের কয়েক মাস আগে। ধরা পড়েননি। সাফির থেকে দেড় বছরের বড় দাদা এনামুল বাবানগরের একটা হোটেলে কাজ করে সংসার চালায়। সপ্তাহে দু-এক বার মা আর দাদা ফোন করে সাফিকে। কথা যত না হয়, তার থেকে বেশি হয় কান্না।
সাফিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য দরকারি কাগজপত্র এখনও জোগাড় করে উঠতে পারেননি নুনতাজ। কলকাতা সম্পর্কেও বিন্দুবিসর্গ জানা নেই তাঁর। এ দেশের ভাষাও প্রায় কিছুই বুঝতে পারেন না। বুঝতে পারেন না, কী ভাবে পৌঁছতে পারবেন মেয়ের কাছে। সাফি অবশ্য স্বপ্ন দেখে, এক দিন কোনও একটা দেশ তার নিজের হবে। সেই স্বপ্নের পিছনে হেঁটেই তো ইন্ডিয়ায় আসছিল ওরা। ইন্ডিয়ার বর্ডারে একটা বাড়িতে লুকিয়ে থাকতে হয়েছিল দিনভর। রাত আটটা নাগাদ সবাইকে বার করে একটা জলার ভিতর দিয়ে গুঁড়ি মেরে হেঁটে ইন্ডিয়ার মধ্যে ঢুকতে বলা হল। চোখেমুখে জল ঢুকে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল সাফির। এমন সময় চিৎকার শোনা গেল—‘এই রুখ, রুখ!’ ইন্ডিয়ার পুলিশের কাছে ধরা পড়ে গেল সাফিরা।
হোমে যে রোহিঙ্গা মেয়েদের সঙ্গে তার আলাপ হয়েছিল, তারাও কেউ মাইলের পর মাইল হেঁটে, কেউ আবার নদীপথে ঢুকেছিল এ দেশে। গন্তব্য মূলত জম্মু-কাশ্মীর, এ ছাড়া অন্ধ্র, কেরল, দিল্লি, উত্তরপ্রদেশ আর অসম। জম্মুর নারওয়ালের রাজীবনগর, কাশিমনগরের মতো একাধিক জায়গায় রোহিঙ্গাদের বড়-বড় উদ্বাস্তু বস্তি আছে। একাধিক আন্তর্জাতিক সংগঠনের হিসাবে, ভারতে প্রায় ৩৬ হাজার রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু রয়েছেন, যাঁদের মধ্যে সরকারি ভাবে নথিভুক্ত মেরেকেটে ৯ হাজার। নথিভুক্ত নয় এমন অনেকেই বিভিন্ন ভাবে ভোটার কার্ড, রেশন কার্ডও পেয়ে যাচ্ছেন। মিশে যাচ্ছেন ভারতীয়দের মূল স্রোতে।
সাফি অবশ্য ফিরে যেতে চায় হারিফারা গ্রামের সেই বাড়িটায়। তার স্বপ্ন কোনও দিন সত্যি হবে কি না জানা নেই, কিন্তু সে ইতিমধ্যে চমৎকার বাংলা শিখেছে। দারুণ ব্লক প্রিন্টের কাজ করে, আর উখুলেলে বাজায়। একটা স্কুল তৈরি করতে চায় এই রোহিঙ্গা কিশোরী। যেখানে তার কাছে বাজনা শিখতে আসবে ছোট্ট ছোট্ট ছেলেমেয়েরা। ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ-মায়ানমার, আরও কত দেশের বর্ডার পার করে, কাঁটাতারের নিষেধ এড়িয়ে ছড়িয়ে পড়বে তাদের বাজনার সুর। কেউ আটকাতে পারবে না।