তৎকালীন আর জিকর হাসপাতালের জরুরী বিভাগের প্রবেশপথ। তখন নাম ছিল কারমাইকেল মেডিক্যল কলেজ।
বহুমুখী প্রতিভা শব্দবন্ধটি অতিব্যবহারে আজ প্রায় অর্থ হারাতে বসেছে। তবু ইতিহাসে এমন কয়েক জন আমাদের সমাজজীবনকে ছুঁয়ে গেছেন, যাঁদের প্রতিভা আক্ষরিক অর্থেই বহুমুখী। ডাক্তার রাধাগোবিন্দ কর তেমনই এক জন। নামের আগে যে হেতু ডাক্তার শব্দটি যুক্ত আছে এবং তাঁর নামাঙ্কিত, অধুনা কলঙ্কিত হাসপাতালটির বিষয়েও যে হেতু সকলেই অবগত, তাই সে বিষয়ে আপাতত কিছু বলার নেই। রাধাগোবিন্দ করের অভিনেতা, জিমন্যাস্ট, লেখক, ব্যবসায়ী এবং সমাজ-সংস্কারক সত্তা নিয়ে আলোচনাই এখানে উপজীব্য।
অভিনেতা যে রকম
বাংলা রঙ্গালয়ের ইতিহাসে অন্যতম উল্লেখযোগ্য দিন ২৯ মার্চ ১৮৭৩। সেই দিনই সাবেক ন্যাশনাল থিয়েটার দ্বিখণ্ডিত হয়। বাংলা রঙ্গালয়ের সার্বিক ভবিষ্যৎ তখন অনিশ্চয়তায় আচ্ছন্ন। সেই অনিশ্চয়তার মাঝেই টাউন হলে সে দিন অভিনীত হল দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’। সেই ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানটির পরিকল্পনার পিছনে ছিলেন এক ইংরেজ ডাক্তার, চার্লস ম্যাকনামারা। তিনি ছিলেন তৎকালীন কলকাতার বিশিষ্ট চক্ষুবিশারদ এবং তাঁর স্বপ্ন ছিল কলকাতায় একটি ভাল চক্ষু-হাসপাতাল তৈরির। সেই সাধু উদ্যোগের জন্য অর্থ জোগাড় করতেই তিনি ন্যাশনাল থিয়েটারের কিছু সদস্যকে ধরেন যে, একটি নাটকের উপস্থাপনা করে যেন তাঁরা হাসপাতালের প্রয়োজনীয় খরচাপাতি তুলে দেন। সেই কারণেই ‘নীলদর্পণ’ মঞ্চস্থ হয়। টিকিটের দামও ছিল বেশ চড়া, পুরো দু’টাকা। মনে রাখতে হবে, সে সময় এক মণ সর্বোৎকৃষ্ট চালের দাম এক টাকা ১০ সিকে।
নাটকটি ব্যাপক জনপ্রিয় হয় এবং ডা. ম্যাকনামারা তাঁর কাঙ্ক্ষিত হাসপাতালটি তৈরি করতে সক্ষম হন। মেয়ো হাসপাতাল নামে এই চিকিৎসালয়ের স্বপ্ন থেকেই বাংলা রঙ্গমঞ্চের স্বর্ণযুগের ভিত্তি স্থাপিত হয়। সেই ঐতিহাসিক নাটকে অভিনয় করেছিলেন দুই ভাই। তাদের ডাকনাম ছিল মাধু ও গোবি। গোবি বয়সে বছর দেড়েকের বড়। ভাল নাম রাধাগোবিন্দ কর। ছোট ভাই রাধামাধব কর পরে ‘নাট্যাচার্য’ উপাধি পান। তবে নাট্যকৌশলের দিক থেকে রাধাগোবিন্দও যে কম যেতেন না, তার অন্যতম প্রমাণ, রসরাজ অমৃতলাল বসুর প্রশংসা। তিনি নগদ দু’টাকা দিয়ে টিকিট কেটে সে দিন টাউন হলে নাটক দেখতে গিয়েছিলেন। সেই অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে তিনি লেখেন যে, “সৈরিন্ধ্রীর বেশে গোবিকে আমি ঈর্ষাকষায়িত লোচনে দেখিয়া ছিলাম। কিন্তু তাহার সুন্দর অভিনয় দেখিয়া আমি বিস্মিত ও পুলকিত হইলাম।”আ
প্রতিষ্ঠাতা রাধাগোবিন্দ কর।
শুধু অভিনয় নয়, রাধাগেবিন্দের চরিত্রের ঔদার্যের কথাও স্মরণ করেছেন স্টার থিয়েটারের মধ্যমণি বিনোদিনী দাসী। বিনোদিনী যখন প্রথম ন্যাশনাল থিয়েটারে যোগ দেন, তখন তিনি সাত-আট বছর বয়সি বালিকা। উৎসাহ দিতে রাধাগোবিন্দ তাঁকে দুটি খেলনা কিনে দেন। একটি ঢাকায় তৈরি রুপোর ফুল আর অপরটি একটি কাচের ফুল। এই ফুল দু’টি বিনোদিনীর বালিকা হৃদয় স্পর্শ করেছিল এবং তিনি আজীবন রাধাগোবিন্দের সেই স্নেহের উপহার কাছে রেখেছিলেন। বিনোদিনীর আত্মকথায় পাওয়া যায়, “এই বহু সম্মানিত ডাক্তারবাবু মহাশয় এই অভাগিনীর চির ভক্তির পাত্র।”
রাধাগোবিন্দ নাট্যরচনাও করেছেন। রসরাজ অমৃতলাল তাঁর স্মৃতিচারণে উল্লেখ করেছেন, যে প্রহসন লেখার জন্য তিনি জনপ্রিয় হয়েছিলেন, সর্বপ্রথম সেই প্রহসন রচনায় অমৃতলালের সঙ্গী ছিলেন আরও ছ’জন— অর্ধেন্দু মুস্তাফি, গোপাল দাস, মতিলাল সুর, নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, বেলবাবু এবং রাধাগোবিন্দ। অমৃতলালের স্মৃতি অনুসারে, বাংলা রঙ্গমঞ্চে অভিনয়ের জন্য রচিত এই প্রহসনটির মূল উপাদান ছিল ডাক্তার নেলার সাহেবের ডিসপেনসারি। সে কালে এই ধরনের ডিসপেনসারিগুলির অন্যতম দুর্নীতি ছিল ওষুধের নামে বড়লোকের ছেলেদের মদ বিক্রি করা। সেই প্রসঙ্গ এবং নেলার সাহেবের সাজপোশাক, কথাবার্তা নকল করেই তৈরি হয় প্রহসনটি।
ব্যায়ামবীর বটে
উনিশ শতকের কলকাতায় দুর্গাপুজোর সময়, বড় বড় রাজা বা জমিদারদের পুজোয় নানা বিলিতি জিনিসের প্রদর্শন হত। রাজনারায়ণ বসুর কথায়, “দালানে পূজা হইতেছে, বৈঠকখানায় মদ্যপান ও উইলসনের দোকানের খানা চলিতেছে।” এই ধারারই বশবর্তী হয়ে ১৮৬৮-৬৯ নাগাদ এক বার শোভাবাজারের রাজারা তাঁদের পুজোয় বিলিতি জিমন্যাস্টিক্স প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেন। ট্রাপিজ়, হরাইজ়ন্টাল বার, রিংয়ের খেলা দেখে বাঙালির তাক লেগে যায়।
তবে নামে বিলিতি হলেও, সেই প্রদর্শনীর তারকারা ঠিক ইংরেজ ছিলেন না। ছিলেন অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান বা সে কালের ভাষায়, ফিরিঙ্গি। দলের অধিকারী এবং মধ্যমণির নাম ছিল পিটার। এই পিটারের খেলা দেখে বঙ্গসমাজ এতটাই প্রভাবিত হল যে, নবগোপাল মিত্র চোরবাগানে একটি জিমন্যাস্টিক্স স্কুলই খুলে বসলেন। প্রশিক্ষক হিসেবে মাসে ৪০ টাকা বেতনে বহাল করা হল এই পিটারকেই। এই নবগোপাল মিত্রই, যাঁকে লোকে ‘ন্যাশনাল নবগোপাল’ বলে জানত, আধুনিক বাঙালির ভাষায় এবং ভাবনায় ‘ন্যাশনাল’ শব্দটি ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। ন্যাশনাল থিয়েটারের নামটির মূলেও তাঁরই অনুপ্রেরণা।
যাঁরা সে দিন শোভাবাজার রাজবাড়িতে পিটারকে দেখে উদ্বুদ্ধ হলেন, এঁদের মধ্যে বাগবাজারের শ্যামাচরণ ঘোষ ও রাধাগোবিন্দ মিলে ঠিক করলেন যে, তাঁরাও জিমন্যাস্টিক্সের একটি আখড়া খুলবেন। রাধাগোবিন্দর বাবা ডা. দুর্গাদাস করকে রাজি করিয়ে দুর্গাদাসবাবুর গৃহেই সেই আখড়া খোলা হল। দুর্গাদাসবাবু নিজেও এ বিষয়ে উৎসাহী ছিলেন। শ্যামাচরণ ঘোষকে পরে স্যর জর্জ ক্যাম্পবেল চুঁচুড়া কলেজের জিমন্যাস্টিক্স প্রশিক্ষক রূপে চাকরি দেন। ক্যাম্পবেলের আদেশে অন্যান্য স্কুল কলেজেও জিমন্যাস্টিক্স শিক্ষা শুরু হয়।
এই জিমন্যাস্টিকসে সঙ্গতের প্রয়োজনেই গড়ে ওঠে একটি কনসার্ট দল। এই সঙ্গীতবৃন্দেরই কয়েক জন পরে ন্যাশনাল থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত হন এবং এর মাধ্যমেই কর-ভ্রাতৃদ্বয় গিরিশ ঘোষ এবং অন্যান্য নাট্যরসিকের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন। শরীরচর্চা, সঙ্গীতচর্চা আর রঙ্গালয়ে ক্রমশ কর-দের জীবনের অঙ্গ হয়ে ওঠে।
তবে চিকিৎসা থেকে তাঁরা কখনও দূরে সরেননি। তাঁদের নানা খেলাধুলো, শরীরচর্চা, নাটক সব কিছুর পিছনেই ছিল তাঁদের পিতৃপ্রশ্রয়। অমৃতলাল জানিয়েছেন যে, উনিশ শতকের মধ্যবর্তী সময়ে পিতা-পুত্রের এমন সাবলীল ও নিবিড় সম্পর্ক ছিল বিরল। সেই প্রশ্রয় সম্ভব হয়েছিল তাঁদের পিতার আর্থিক সচ্ছলতার দ্বারা। সেই সচ্ছলতার ভিত্তি ছিল চিকিৎসাব্যবসা।
পিতা-পুত্র
১৮৩৫ সালে যখন মেকলে সাহেব পূর্ববর্তী নেটিভ মেডিক্যাল ইনস্টিটিউশন তুলে দিয়ে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ সৃষ্টি করলেন, তাঁর উদ্দেশ্য ছিল বাঙালিদের হাবভাবে সাহেব বানিয়ে তোলা। তবে কলেজ শুরু হওয়ার কয়েক বছরের মধ্যেই বোঝা গেল, সেই উদ্দেশ্য সাধন করতে গেলে দেশে ডাক্তারের চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে না। কারণ ইংরেজিতে আগাগোড়া ডাক্তারি পড়তে পারবে এমন বাঙালি সে সময়ে প্রায় নেই। এ দিকে ইংরেজ সাম্রাজ্য তত দিনে ফুলে ফেঁপে জাঁকিয়ে বসেছে। জনগণের জন্য না হলেও, স্রেফ সেনাবাহিনী আর রাজকর্মচারীদের চিকিৎসার জন্যই দরকার প্রচুর ডাক্তার। অত ডাক্তার বিলেত থেকে আমদানি করতে গেলে কোম্পানি লাটে উঠবে।
১৮৪৫ সালে তাই ইংরেজির পাশাপাশি একটি হিন্দুস্থানি ক্লাসও মেডিক্যাল কলেজে শুরু করা হয়। তাতেও ডাক্তারের চাহিদা না মেটায় ১৮৫২ সালে একটি বাংলা ক্লাস যুক্ত করা হল। কিন্তু ক্লাস চালু করলেই তো হল না। চাই শিক্ষক। চাই পাঠ্যপুস্তক। ছাত্ররা ভাঙা-ভাঙা সাহেবি বাংলা লেকচার শুনে যেটুকু শিখতে পারছে, শিখছে। তখন মেধাবী ছাত্রদের বেছে নিয়ে সহকারী অধ্যাপক রূপে নিযুক্ত করা হল। রাধাগোবিন্দের পিতা দুর্গাদাস কর ছিলেন তাঁদেরই এক জন। দুর্গাদাস ব্যতীত আর তিন জন মাত্র বাঙালি শিক্ষক তৎকালীন মেডিক্যাল কলেজে নিযুক্ত হন— অ্যানাটমিতে জগবন্ধু বসু, অ্যানাটমির প্র্যাকটিকালে নীলমাধব মুখোপাধ্যায় এবং রসায়নে কানাইলাল দে। দুর্গাদাসের উপর ভার পড়ল মেটিরিয়া মেডিকা, অর্থাৎ ওষুধতত্ত্ব বা ভেষজ তত্ত্ব পড়ানোর। চার বছর শিক্ষকতার পর তিনি তাঁর বিষয়টির উপর একটি বাংলা গ্রন্থ প্রকাশ করলেন, নাম ‘ভৈষজ্য রত্নাবলী’। নামটি তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ এই একই নামে একটি বিখ্যাত আয়ুর্বেদিক গ্রন্থ আছে এবং সেটি উনিশ শতকের গোড়া পর্যন্তও বাংলাদেশে বহুলপ্রচলিত ছিল। দুর্গাদাস সেই একই নামে ডাক্তারি বিষয়ক গ্রন্থ প্রণয়নের মাধ্যমে বিষয়টিকে দেশীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত করলেন। এ প্রসঙ্গে তিনি লেখেন, “মেডিকেল কলেজস্থ বাংলা শ্রেণির পাঠোপযোগী প্রায় কোনো গ্রন্থ এ পর্যন্ত উৎকৃষ্ট ও ফলদায়করূপে বিরচিত বা অনুবাদিত হয় নাই।” ফলে তাঁর বইটিই সর্বপ্রথম। তিনি জানিয়েছেন, বইটির পাণ্ডুলিপি তৈরি হয়ে গেলেও সাহসের অভাবে তিনি কয়েক বছর তা ছাপেননি। পরে এই পাণ্ডুলিপি অনুসরণ করে শিক্ষকতায় সুফল মেলায় বই প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেন।
একটি নতুন বিষয়ে বই লেখা সহজ নয়। প্রতিটি শব্দের নির্ভুল প্রতিশব্দ নির্ধারণ করা, সেই সব শব্দকে মোটামুটি বোধগম্য রেখে মূল প্রতিপাদ্য বিষয়টি ছাত্রদের বোঝানো— তবে সেই সব মুশকিল অতিক্রম করলে রয়েছে সুবৃহৎ ব্যবসার সুযোগ। এমন একটি বিষয়, যাতে প্রতি বছর বহু ছাত্র পাঠরত, অথচ যাতে আর কোনও পাঠোপযোগী গ্রন্থ নেই, সেখানে একটি পাঠ্যপুস্তক রচনা করতে পারলে যে তার কী ব্যাপক চাহিদা হবে, বলাই বাহুল্য। তার উপর আবার লেখক স্বয়ং যদি সেই ছাত্রদের অধ্যাপক হন, তা হলে তো কথাই নেই! আর সেই চাহিদার ফলই হল দুর্গাদাসের আর্থিক উন্নতি এবং তাঁর পুত্রদের স্বাধীন শখ-শৌখিনতা।
বাংলায় ডাক্তারি বই
রাধাগোবিন্দ পিতার পথই অবলম্বন করেন। শুরু থেকেই তিনি ডাক্তারি শিক্ষার পাশাপাশি বাংলায় ডাক্তারি পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন এবং প্রকাশনার দিকে ঝোঁকেন। ছাত্রাবস্থায়ই ১৮৮২ সালে রাধাগোবিন্দ তাঁর প্রথম পাঠ্যপুস্তক প্রস্তুত করেন। বিষয় ছিল তাঁর পিতার মতোই, আধুনিক ভেষজতত্ত্ব। গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি জানান, এই বইটি ছাত্রদের পরীক্ষা প্রস্তুতি এবং ব্যস্ত ডাক্তারবাবুদের দৈনিক ব্যবহারের উদ্দেশ্যে লিখিত। বইটির পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করতে তাঁকে সাহায্য করেন তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু, ডা. আশুতোষ মিত্র। বইটি রাধাগোবিন্দ উৎসর্গ করেন তাঁর পিতার সহকর্মী রায়বাহাদুর কানাইলাল দে-কে।
পরে রাধাগোবিন্দ আরও বই লেখেন। এর মধ্যে ছিল ‘ভিষক-সুহৃদ’, ‘এনাটমি’, ‘কর-সংহিতা’, ‘সংক্ষিপ্ত ভেষজতত্ত্ব’, ‘সংক্ষিপ্ত শিশু ও বালক চিকিৎসা’, ‘রোগী-পরিচর্যা’, ‘নতুন ভেষজতত্ত্ব’, ‘প্লেগ’, ‘স্ত্রীরোগচিকিৎসা’, ‘গাইনোকোলোজি’ এবং ধাত্রীসহায় (ডা. সুরত বসুর সহিত)। বেশ কয়েকটি বই একাধিক সংস্করণে ছাপা হয়েছিল।
একই বছরে, অর্থাৎ ১৮৮২, ডা. আশুতোষ মিত্র নিজেও একটি বাংলা বই প্রণয়ন করেন। ‘নর-শারীর বিধান’ নামক ছোট্ট বইটির প্রকাশক ছিলেন তাঁর বন্ধু রাধাগোবিন্দ কর। বইটির প্রথম পাতায় সেটিকে ‘সরল বিজ্ঞান বোধ, ১ম খণ্ড’ বলে আখ্যায়িত হয়েছিল। তবে এই সারিতে সম্ভবত অন্য কোনও বই আর প্রকাশিত হয়নি। কারণ এর পরের বছরই আশুতোষ এবং রাধাগোবিন্দ, দুই বন্ধুই, একত্রে উচ্চশিক্ষার জন্য বিলেত চলে যান। তাঁরা ভর্তি হন এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিক্যাল কলেজে।
১৮৮৩ সালে রাধাগোবিন্দ বিলেত যাওয়ার আগেই ‘কর প্রেস’ নামক একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠা করেন। এই প্রেসটি থেকে ডাক্তারি বই ছাড়াও, নানা সাহিত্যকর্ম প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে তারকনাথ বিশ্বাস রচিত উপন্যাস ‘সুহাসিনী’ বা মাসিক পত্রিকা ‘আর্য্যদর্শন’-এর নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য।
অথচ এ কালেও অনেকের ভ্রান্ত ধারণা, উনিশ শতকে ডাক্তারি পেশায় নামডাক করার মূল পথ ছিল গবেষণা-কেন্দ্রিক। তাই এমন প্রচেষ্টাও দেখা যায় যে, রাধাগোবিন্দের মতো সে কালের বাঙালি ডাক্তারদের গবেষক এবং আবিষ্কারক রূপে প্রতিপন্ন করতে অনেকেই সচেষ্ট হয় পড়েন এবং ভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে আবিষ্কারের আখ্যান সাজান। যেমন ধরুন, রাধাগোবিন্দের দ্বারা জলের মাধ্যমে কলেরা জীবাণু সংক্রমণ আবিষ্কার। আসলে ১৮৫৪ সালে এই তথ্য আবিষ্কার করেন ইংরেজ ডাক্তার জন স্নো, তখন রাধাগোবিন্দ মাতৃক্রোড়ে ক্রীড়ারত। অথচ আশ্চর্যের বিষয় যে দুর্গাদাস বা রাধাগোবিন্দের মৃত্যুর পর তাঁদের যে সব স্মরণিকা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়, তাতে তাঁদের পরিচিতরা কিন্তু তাঁদের গবেষক বা আবিষ্কারক বলে সম্মান জানাননি। বরং প্রত্যক্ষদর্শীরা পিতা-পুত্র দু’জনকেই, চিকিৎসা-বিষয়ক পাঠ্যপুস্তকের লেখক এবং প্রকাশক হিসেবেই চিহ্নিত করেছেন। আসলে দুর্গাদাস-রাধাগোবিন্দরা বুঝেছিলেন যে, নব্য চিকিৎসা বিদ্যাকে এ দেশে প্রতিষ্ঠিত করতে গেলে গবেষণার চেয়ে অনেক বেশি জরুরি পাঠ্য গ্রন্থ রচনা এবং প্রকাশনা। বিদেশি ডাক্তাররা যখন নিত্যনতুন আবিষ্কার করে নাম-যশ পাচ্ছেন, বাঙালি ডাক্তাররা সুচিন্তিত ভাবেই অনুবাদের উপর জোর দেন।
এই অনুবাদের কাজকে গবেষণার থেকে কম মনে করার কোনও কারণ নেই। পরিভাষা নির্বাচন বা নামকরণের মতো আপাত-সরল বিষয়ও আসলে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাজশেখর বসু থেকে মোহাম্মদ কুদরত-ই-খুদার মতো মেধাবী গবেষকরা গবেষণার থেকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন এই কাজের উপর, কারণ এর মাধ্যমেই জনগণের মধ্যে বিজ্ঞান প্রচার সম্ভব হয়। সফল ভাবে সেই প্রচার করতে গেলে বিজ্ঞানের তত্ত্বগুলিকে দেশীয় প্রকৃতি, পরিবেশ, সমাজ এবং ইতিহাসের সঙ্গে সংযুক্ত করা অত্যন্ত জরুরি। বিশেষ করে ডাক্তারির মতো সামাজিক এবং প্রয়োগধর্মী একটি বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তো বটেই।
দেশীয় অভিজ্ঞতা
১৮২২ সালে যখন রাধাগোবিন্দ প্রথম গ্রন্থ রচনা করেন, তখন তাঁর বিষয়বস্তু মূলত আহরিত হয়েছিল ব্রিটিশ ফার্মাকোপিয়া থেকে। তাঁর কথায়, তাঁর উদ্যোগের মূল উদ্দেশ্য ছিল ছাত্রদের পরীক্ষা পাশে সহায়তা। কিন্তু পনেরো বছর পরে, ১৮৯৭ এ, যখন তিনি ‘রোগী পরিচর্যা’ নামক গ্রন্থ প্রকাশ করছেন, তখন তাঁর মত অনেক বদলে গেছে। তিনি লিখছেন, “চিকিৎসক মাত্রেই স্বীকার করবেন যে এ দেশে অধিকাংশ স্থলে রোগীর উপযুক্ত শুশ্রূষার অভাবে চিকিৎসার আশানুরূপ ফললাভ হয় না।” তাঁর মতে, ইংরেজি ওষুধের থেকে তখন বেশি জরুরি রোগীর সুপরিচর্যা। ‘অঙ্গ-মর্দন ও অঙ্গ-চালনা’— এই দু’টির উপর তিনি জোর দেন। লেখেন, মাসাজের মাধ্যমে অনেক দুরারোগ্য ব্যাধিই সারানো সম্ভব।
পরের বছর, ১৮৯৮-এ, যখন কলকাতায় প্লেগের আতঙ্ক দেখা দেয়, তিনি একটি ছোট গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। তাতে সরাসরি জানান যে তিনি গ্রন্থটি রচনা করেছেন সাধারণ মানুষ কী ভাবে প্লেগের হাত থেকে বাঁচতে পারে, তার কিছু উপদেশ দেওয়ার জন্য। সরকারি সমস্ত উদ্যোগ সমর্থন করেও তিনি জানান যে, “বিমুক্ত বায়ুসঞ্চালন, সুখকর শীতল গৃহ, যথেষ্ট পরিমাণে শীতল ও উষ্ণ জল, বরফ, যথেষ্ট সংখ্যক পরিচারক এবং চিকিৎসার উপযোগী যন্ত্রপাতি নিতান্ত আবশ্যক।” আরও বললেন, “বাড়ি বা আবাস স্থানের ও তৎচতুর্দিকের অস্বাস্থ্যকর অবস্থা, জনাকীর্ণতা, উপযুক্ত বায়ুসঞ্চালনের অভাব, দারিদ্র্য, দৌর্বল্য প্রভৃতি রোগ উৎপত্তির অনুকূল অবস্থা।” এখানে দারিদ্রকেও তিনি বিধ্বংসী রোগের প্রত্যক্ষ কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেন।
পুরোধাবৃন্দ: আর জি কর হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিত্বরা। উপরের সারির বা দিক থেকে ঘড়ির কাঁটার চনল অনুসারে, লেফটেন্যান্ট কর্নেল সুরেশপ্রসাদ সর্বাধিকারী, স্যর কৈলাশ চন্দ্র বসু, স্যার নীলরতন সরকার, ডা. কেদারনাথ দাস, রাধাগোবিন্দ কর, ডা. মহেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্য়ায়
১৮৯৮ সালে, বিশেষ করে জীবাণু-তত্ত্বের রমরমার কালে, রাধাগোবিন্দের দ্বারা দারিদ্রকে রোগের কারণ হিসেবে সরাসরি চিহ্নিতকরণ খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। জীবাণু তত্ত্ব মেনে নিয়েও তিনি একটি বৃহত্তর পটভূমিকায় রোগের কারণ সন্ধান করেন।
ডাক্তারির নতুন কলেজ
স্বাস্থ্যক্ষেত্রে রাষ্ট্রশক্তি এবং নাগরিক সমাজের যে যৌথ দায়বদ্ধতার ভাবনা, সেটিই আবার আমরা দেখতে পাই তাঁর সব থেকে স্মরণীয় সৃষ্টি, ‘ক্যালকাটা স্কুল অব মেডিসিন’-এ। ১৮৮৬ সালে, বিলেত থেকে ফেরার পর-পরই মহেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, অক্ষয়কুমার দত্ত, বিপিন মৈত্র, কুমুদ ভট্টাচার্য প্রমুখের সঙ্গে মিলিত হয়ে তিনি একটি নতুন বেসরকারি মেডিক্যাল স্কুল গঠনে প্রবৃত্ত হন। বৈঠকখানা রোডের ভাড়া বাড়িতে স্থিত স্কুলটির নাম হয় ‘ক্যালকাটা স্কুল অব মেডিসিন’। স্কুলের নিজস্ব হাসপাতাল না থাকায়, মেয়ো হাসপাতালের রোগীদের দেখিয়ে ছাত্রদের শিক্ষা দেওয়া হত।
তাঁর স্কুলের সব কাজ হত বাংলায়। স্কুলটি সরকারি আওতাভুক্ত ছিল না বলে এর সব কর্মচারীই ছিলেন বাঙালি। ১৯০২ সালে রাধাগোবিন্দের স্কুলটি উঠে যায় তাঁদের নিজস্ব গৃহে এবং স্কুলের সঙ্গে যুক্ত হয় নিজস্ব হাসপাতাল। শুরুতে মাত্র ৩০টি বেড ছিল সেখানে। দু’বছর বাদে, এই স্কুলটি মিলিত হয় নীলরতন সরকারের তৈরি ‘কলেজ অব ফিজ়িশিয়ানস অ্যান্ড সার্জেনস’-এর সঙ্গে। এই মিলিত স্কুলটি ১৯১৬ অবধি চলার পর সরকারি ভাবে স্বীকৃত হয় ‘বেলগাছিয়া মেডিক্যাল কলেজ’ নামে। আরও তিন বছর বাদে স্কুলটিকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় স্বীকৃতি দেয় এবং এম বি ডিগ্রি দেওয়ার ক্ষমতা প্রদান করে। তখনই কলেজের নাম পরিবর্তিত হয়ে, বাংলার ছোট লাটের নামানুসারে, ‘কারমাইকেল কলেজ’ রাখা হয়। এর কয়েক মাস আগেই রাধাগোবিন্দ ইহজগৎ ত্যাগ করেছেন।
১৯০৪ থেকে বেলগাছিয়া কলেজে পর পর তিন জন অধ্যক্ষ হন, লেফটেন্যান্ট কর্নেল ডা. সুরেশপ্রসাদ সর্বাধিকারী, ডা. কৈলাসচন্দ্র বসু এবং স্যর নীলরতন সরকার। কারমাইকেল কলেজ নাম হওয়ার পর প্রথম অধ্যক্ষ পদে বসেন ডা. মহেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। পরে সেই পদে অভিষিক্ত হন, ডা. কেদারনাথ দাস। এঁরা সকলে প্রথম থেকেই এই কলেজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কিন্তু রাধাগোবিন্দ নিজে কোনও দিন অধ্যক্ষ হননি। হাসপাতালের সর্বজনীন পরিচালনার দায়িত্বে ছিল ‘মেডিক্যাল এডুকেশন সোসাইটি অব বেঙ্গল’ নামে এক সংগঠন। ১৯২১ অবধি কলেজের অধ্যক্ষই সাধারণত সোসাইটির সভাপতি পদে থাকতেন। ১৯২১ থেকেই এই দু’টি পদ আলাদা হয় যায়। সভাপতি পদে সেই সময় থেকে টানা ১৯৪১ অবধি আসীন ছিলেন নীলরতন সরকার। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর, ১৯৪৮ সালে, পশ্চিমবঙ্গ সরকার কলেজটি অধিগ্রহণ করেন এবং এর নাম রাখা হয় ‘আর জি কর হাসপাতাল’।
ক্রমশ মলিন
তবে এই আনুষ্ঠানিকতার বাইরে রাধাগোবিন্দের স্মৃতি বেশ ম্লান হয়ে আসছিল। ১৯২৯ সালে যখন বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ-এর গৃহে রাধাগোবিন্দের তৈলচিত্র উন্মোচন উপলক্ষে একটি স্মরণসভার আয়োজন করা হয়, রসায়নাচার্য রায় বাহাদুর চুনিলাল বসু আক্ষেপ করে বলেন যে, রাধাগোবিন্দের নানা কর্মকাণ্ড ও উদারতা সত্ত্বেও সে দিন সভায় তাঁর সহকর্মীদের মধ্যে মাত্র তিন জন উপস্থিত ছিলেন। এই দ্রুত বিস্মৃতির মধ্যেই হয়তো প্রকট হচ্ছিল পরিবর্তিত সময়ের ইঙ্গিত।
সে যুগের অনেকেই মনে করতেন যে ১৯২০-৩০’এর দশকে যে পরিবর্তন চিকিৎসা-জগৎকে উদ্বেলিত করছিল, তা হল অত্যধিক বাণিজ্যিকীকরণ জনিত নানা অনৈতিক ও অবৈধ কার্যকলাপ। ১৯৩৭-এ প্রকাশিত কামাখ্যাপ্রসাদ রায়ের ‘মায়াপুরী’ নাটক কিংবা ১৯৪০-এ শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের লেখা ‘নার্সিং হোম’ নাটকের মূল প্রতিপাদ্য এমনই ছিল। ১৯৫৯ সালে বনফুল রচিত ‘অগ্নীশ্বর’-এর মধ্যেও খানিকটা একই মনোভাব— ডাক্তারি চিকিৎসায় বাণিজ্যিকীকরণের জেরে সেবার মনোভাব হারিয়ে যাচ্ছে। কামাখ্যাপ্রসাদ বা শচীন্দ্রনাথের নাটক আবার এই অবক্ষয়ের সঙ্গে সরাসরি বেসরকারি হাসপাতাল বা নার্সিং হোমের যোগ স্থাপন করে। ফলে নানা দুর্নীতির অকুস্থল হিসেবে এই বেসরকারি হাসপাতালগুলোর যে দুর্নাম জুটতে আরম্ভ করেছিল তা সপ্রমাণ।
তবে নাট্যকারদের এই মূল্যায়ন পুরোপুরি অভ্রান্ত নয়। পরিবর্তন যদি কেবল বাণিজ্যিকীকরণজনিত হত, তা হলে তা রাধাগোবিন্দের যুগেও যথেষ্ট ছিল। আমরা দেখেছি দুর্গাদাস ও রাধাগোবিন্দ দু’জনেই চিকিৎসা বিষয়ক বই লিখে, প্রকাশ করে এবং সর্বোপরি হাসপাতাল তৈরি করে প্রভূত সম্পত্তির মালিক হয়েছিলেন। তবু সেই বাণিজ্যিক বুদ্ধি কোনও দিন তাঁদের চিকিৎসা-কর্তব্য থেকে বিচ্যুত করেনি। বরং রোগীরা তাঁদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন। পরিবর্তনটি আসলে অন্যত্র।
চিকিৎসার ইতিহাস লক্ষ করলে দেখা যায়, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর চিকিৎসা অনেক বেশি প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে পড়ে। তাই ডাক্তারবাবুর পক্ষে বাড়ি গিয়ে রোগীর পাশে বসে চিকিৎসা করার অবকাশও কমে। চিকিৎসায় জরুরি নানা যন্ত্রপাতির সম্ভার, যেমন নতুন আবিষ্কৃত এক্স-রে মেশিন হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য অপরিহার্য হয়ে ওঠে।
চিকিৎসায় সহৃদয়তা নিয়ে উনিশ শতকের বহু চিকিৎসক চিন্তিত ছিলেন। সেই চিন্তার একটি বিশেষ কারণও ছিল। আসলে চিকিৎসা এমন একটি বিষয়, যেখানে অত্যধিক সহৃদয়তা থাকলে বেশি দূর এগোনো যায় না। তারাশঙ্করের ‘আরোগ্য নিকেতন’-এ যুবক জীবনমশাই তাঁর গুরু রঙ্গলাল ডাক্তারের সঙ্গে লাশ-কাটা ঘরে শব ব্যবচ্ছেদ করতে গিয়ে একটি বাচ্চা মেয়ের মৃতদেহ দেখে কেঁদে আকুল হন। বলেন, এই দেহ তিনি ব্যবচ্ছেদ করতে পারবেন না। রঙ্গলাল এতে প্রথমে রেগে যান। জানান, এ ভাবে ডাক্তারি শেখা যাবে না। পরে শান্ত হয়ে তিনি জীবন মশাইকে বলেন, তাঁর পক্ষে তাঁর কবিরাজিই ভাল। ডাক্তারি আর শিখে কাজ নেই।
আসলে ডাক্তারি শিক্ষা এবং প্রয়োগে অনেক সময়ই ডাক্তারকে সহৃদয়তাজনিত মমতা অতিক্রম করে রোগীর স্বার্থে কঠোর হতে হয়। আবার স্বাভাবিক ভাবেই, সম্পূর্ণ সহৃদয়তা বর্জন করলে সেই ডাক্তার হয়ে উঠতে পারেন নেহাতই নিষ্ঠুর ও অত্যাচারী। মানুষের শরীরকে এক দিকে একটি কলকব্জা চালিত যন্ত্ররূপে দেখতে শেখা, আবার সঙ্গে সঙ্গে রোগীটিকে স্রেফ যন্ত্রবৎ না ভেবে আর একটি মানুষ হিসেবে ভাবার মধ্যে যে অন্তর্দ্বন্দ্ব, তা নির্বাহ করাই ডাক্তারি শিক্ষার অন্যতম পাঠ।
বিশিষ্ট মার্কিন চিকিৎসক সিলাস উইয়ার মিচেল ১৮৯০-এর দশকে এ বিষয়ে বেশ হৃদয়গ্রাহী আলোচনা করেছিলেন। তাঁর মতে ডাক্তারের পক্ষে সহৃদয়তা বা সিমপ্যাথি একটি ‘দৈব উপহার’। তবে ভগবানদত্ত এই ক্ষমতাকে ‘যৌবনে চর্চা করতে হয় এবং বয়সকালে আগলে রাখতে হয়।’ মিচেলের মতে, এটি থাকলে ডাক্তারের বিবেক পাপমুক্ত থাকে, আবার চিকিৎসাকার্যেও নানা সাহায্য মেলে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে চিকিৎসা যখন দ্রুত প্রযুক্তিকেন্দ্রিক হয়ে পড়ল, ধীরে ধীরে ডাক্তারি শিক্ষায় সহৃদয়তা চর্চার অবকাশও কমে এল। ও দিকে পাঠ্য বিষয় যত বাড়তে থাকল, ডাক্তারি ছাত্রদের অবসরও কমতে শুরু করল। ছাত্র হিসেবে লেখাপড়ায় এগিয়ে থেকেও পাশাপাশি নাটক, জিমন্যাস্টিক্স, কনসার্ট সঙ্গীত, বই লেখা এবং প্রকাশনা কোম্পানি চালানো ১৯২০-৩০’এর দশকে আর সম্ভব ছিল না। এবং এখানেই রাধাগোবিন্দের যুগের সঙ্গে পরবর্তী যুগের ডাক্তারদের মূল পার্থক্য।
মিচেল সাহেবের কথায় ফিরে গেলে মনে রাখতে হবে যে, হবু ডাক্তারের পক্ষে যৌবন ছিল সহৃদয়তা গড়ে তোলার সময়। তা অবশ্যই পাঠ্যপুস্তকের দ্বারা সম্ভব নয়। সেই সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলি গড়ে উঠত সাহিত্য, সঙ্গীত, নাটক ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে। সে সব শৌখিনতার অবকাশ যত কমল, সহৃদয়তা চর্চার অবকাশও বিলীন হয়ে গেল। এই সরল সত্য অনুধাবনের জন্যই আজ আমেরিকার নানা মেডিক্যাল কলেজে ‘মেডিকেল হিউম্যানিটিজ়’ নামক একটি নতুন বিষয় শিক্ষার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
সহৃদয় যাপন
হয়তো রাধাগোবিন্দের সহৃদয়তার মূলে ছিল তাঁর যৌবনের নাট্যচর্চা। ভাই রাধামাধবের কথায়, এক বার গিরিশ ঘোষ বলেছিলেন, যে নিজের জীবনে কাঁদেনি সে স্টেজে কাঁদতে জানে না। নাটক যে সহৃদয়তা চর্চার আখড়া, তা আমাদের দেশে অনেক কাল ধরেই মেনে নেওয়া হয়েছে। রাধাগোবিন্দের মৃত্যুর কয়েক বছর পরই দীনেশচন্দ্র সেন তাঁর লেখায় ‘চৈতন্য ভাগবত’-এর একটি ঘটনার আলোচনা করেন। মধ্যযুগীয় এক বাঙালি অভিনেতা নাকি রঙ্গমঞ্চে দশরথের ভূমিকায় অভিনয় করতে গিয়ে পুত্রশোকে এতই আকুল হয়ে পড়েন যে, তিনি মঞ্চেই প্রাণত্যাগ করেন। ঘটনাটি সত্য হোক আর না হোক, তাঁর আলোচনা প্রমাণ করে যে, রাধাগোবিন্দের জীবদ্দশায় এই ধরনের আখ্যানের মাধ্যমে বাঙালি নাট্যাভিনয়কে সহৃদয়তার চর্চার আঙিনা হিসেবে দেখত। তাই রাধাগোবিন্দের শখের অভিনয়কে তাঁর জীবনের একটি অবান্তর খেয়াল হিসেবে না দেখে, সেটিকে তাঁর বৃহত্তর জীবনযাপনের একটি মৌলিক অঙ্গ হিসেবে দেখা উচিত। তাঁর শখের অভিনয়ের মধ্যেই লুকিয়ে ছিল সহৃদয়তার বীজ।
চিকিৎসাক্ষেত্রে বিজ্ঞান ও ব্যবসার মধ্যে মৌলিক বিরোধ নেই। তবে এই দুইয়ের সম্পর্কটিকে সুষ্ঠু ভাবে চালনা করতে গেলে হৃদয়ধর্মের চর্চা অপরিহার্য। সেই চর্চা ছাড়া বিজ্ঞান ও ব্যবসার মিতালি হয়ে ওঠে ভয়ঙ্কর অত্যাচারের উৎস। সহৃদয়তার অবক্ষয় যে কী ভয়ানক ও পৈশাচিক হতে পারে, আমরা আজ চোখের সামনে দেখছি। তবে যে কলঙ্কিত হাসপাতালটি আমাদের আজ এই পৈশাচিকতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে, তারই বিস্মৃত ইতিহাসে রয়েছে এই বীভৎসতা অতিক্রম করার চাবিকাঠি।