আমরা এক সঙ্গে বহু রথ দেখেছি। বিকেল পাঁচটায় শ্যামবাজারে আসত মিল্ক কলোনির যশোমাধবের রথ। ঘুরে যেত হাতিবাগানের দিকে। রথে থাকতেন শ্রীবিষ্ণু। রুপোর চালচিত্রে চতুর্ভুজ দারুমূর্তি। ছোট্ট ছেলের মতো বিস্ময়মাখানো আয়ত চোখ। শোভাযাত্রায় শ্রীখোল-খঞ্জনি-মন্দিরার সঙ্গে হরিধ্বনি। উদ্বাহু নৃত্য। ভিড়ের মাঝে মাথা গলিয়ে রথের দড়ি ধরে দৌড়তাম। বাতাসার হরির লুঠ। তার পর আর-একটা রথ আসত। সে রথে থাকতেন জগন্নাথ, বলভদ্র, সুভদ্রা। সামনে নাড়ু হাতে গোপালঠাকুর। দেশবন্ধু পার্কে সঙ্কীর্তন সমিতিতে সে রথ থাকত উল্টোরথ অবধি। আমরা ঘুরে ঘুরে দেখতাম। তার পর কখনও কখনও রথের মেলায়। জিলিপি, মালপো, পাঁপড়ভাজা। ভিড়ে হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে চেপে ধরে থাকতিস আমার হাত, মনে আছে, ঝিমলি?
রথের দিন বাড়িতে পুজো হত। আমাদের শাক্ত বাড়িতেও আছেন দেড়শো বছরের পুরনো নিমকাঠের জগন্নাথদেব। পুজো হয় এখনও। বিকেলে রথ টানা শেষ করে বাড়ি ঢুকে দেখতাম ম-ম করছে আম-কাঁঠালের গন্ধ। ঠাকুরের ফলনৈবেদ্য। আমার জন্মের আগে বাড়ি থেকে রথ বেরত। গল্প শুনেছি, রথের সামনে থাকত দু’দিকে ডানা ছড়ানো বিশাল তুলোর হাঁস। রথের সামনে রুপো-বাঁধানো ছড়ি নিয়ে হাঁটতেন বাবার ঠাকুরদাদা। সে সব বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর পুজোর সময় পুরোহিত মশাই জগন্নাথের সিংহাসন দু’হাতে ধরে একটু টানা-ঠেলা করতেন। প্রতীকে রথ চলা।
পুরীর সবচেয়ে বড় উৎসব রথযাত্রা। পুরীতে তিনটি আলাদা রথ। তিন ভাইবোন বরাবরই সোশ্যাল ডিসট্যান্স বজায় রাখেন। আষাঢ়ের শুক্লা দ্বিতীয়ায় সোজা রথ। ন’দিনের উৎসব। নবম দিনে, অর্থাৎ শুক্লা একাদশীতে উল্টোরথ। রথের দিন রাজার সোনার ঝাঁটা দিয়ে রাস্তা ঝাঁট, মন্দির থেকে পাণ্ডাপুরোহিত সহ জগবন্ধুর হেঁটে এসে রথে চাপা, রথে চেপে গুণ্ডিচা মন্দির... সে এক বিরাট ব্যাপার! বহু শতকের প্রাচীন এই প্রথার উদ্যাপনেও এ বছর প্রশ্নচিহ্ন লাগিয়েছে করোনা। এ বছর হয়তো মন্দির প্রাঙ্গণের মধ্যেই রথ টানা হবে। শোনা যাচ্ছিল, হয়তো হাতি, না হয় ইঞ্জিন দিয়েও হতে পারে রথচালনা। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট এ বারের রথযাত্রা স্থগিত রাখারই নির্দেশ দিয়েছেন। কথিত আছে, এক বার নাকি রাধার কুঞ্জে যেতে কৃষ্ণকে দেরি করিয়ে দিয়েছিলেন চন্দ্রাবলী। দুঃখিত রাধা অনুযোগ করেছিলেন— দেহরথে যদি না-ই এলে প্রভু, মনোরথে কেন এলে না? গুণ্ডিচা বাড়ি যেতে এ বার কি মনোরথই ভরসা জগন্নাথের?
কলকাতার রথে পুরীর গ্ল্যামার নেই, কিন্তু প্রাণের টান কোথাও কম নয়। রথ নিয়ে বাঙালির সংস্কারও অনেক। স্নানযাত্রার দিন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিণীর বিগ্রহ। রথের দিন এখনও দুর্গামণ্ডপের খুঁটিপুজোর রীতি আছে, রথের দিন শুরু হয় দুর্গাপ্রতিমার খড়ের কাঠামোয় মাটি লেপা। শোনা যায়, রানি রাসমণি ১৮৩৮ সালে এক লাখ বাইশ হাজার টাকা খরচ করে তৈরি করেছিলেন রুপোর রথ। এখন যেখানে শিয়ালদা স্টেশন, সেখানে বসত শেঠদের রথ, সঙ্গে মেলা। সেটিই এখন সরে এসেছে মৌলালি হয়ে রামলীলা ময়দানে, তবে আকারে অনেক ছোট হয়ে গিয়েছে। মৌলালির রথের মেলায় বিক্রি হত রংবেরঙের পাখি। গল্প শুনেছিলাম, কার যেন সেই মেলা থেকে কেনা লাল মুনিয়া বারান্দায় রাখা ছিল, বৃষ্টির জলে ধুয়ে চড়াই হয়ে গিয়েছে। এ ছাড়া ছিল পোস্তা, গরানহাটার রথ। সুরি লেনের মল্লিকবাড়ি, মার্বেল প্যালেস বা বেহালার বড়িশার রথও নাম করা। সে দিন আর নেই! কৃষ্ণনগরের মাটির পুতুল, তালপাতার সেপাই, চোরবাগানের লাট্টু, কাঠের নাগরদোলা, রঙিন মাছ কিংবা পাখি নিয়ে আর কারও উৎসাহ নেই।
বাংলার প্রাচীনতম মাহেশের রথ চলে আসছে সেই সুলতানি আমল, ইংরেজি ১৩৯৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে। শ্রীরামপুরের মাহেশে জগন্নাথদেবের মন্দির থেকে মাহেশ গুণ্ডিচা মন্দির বা মাসির বাড়ি জি টি রোড বেয়ে এক কিলোমিটার। মাহেশের রথ এবং জগন্নাথের মন্দির নিয়ে আছে কিংবদন্তিও। চতুর্দশ শতকে এক বাঙালি সাধু তীর্থ করতে গিয়েছিলেন শ্রীক্ষেত্রে। তাঁর নাম ধ্রুবানন্দ ব্রহ্মচারী। তাঁর ইচ্ছে হয়েছিল জগন্নাথদেবকে নিজে হাতে ভোগ রেঁধে খাওয়াতে। মন্দিরের পাণ্ডারা বাধ সাধে। দুঃখে ধ্রুবানন্দ নিজেও ত্যাগ করলেন অন্নজল। তিন দিন পরে জগন্নাথদেব তাঁকে দেখা দিয়ে বললেন— ধ্রুবানন্দ, বঙ্গদেশে ফিরে যাও। ভাগীরথী নদীর তীরে মাহেশ গ্রামে আমি একটি বিরাট নিম গাছের কাণ্ড পাঠিয়ে দেব। সেই কাঠে বলরাম, সুভদ্রা আর আমার মূর্তি গড়ে পুজো করো। আমি তোমার হাতে ভোগ খাওয়ার জন্য ব্যাকুল। এই স্বপ্ন দেখে ধ্রুবানন্দ মাহেশে এসে সাধনা শুরু করলেন। তার পর এক বর্ষার দিনে মাহেশের ঘাটে ভেসে এল এক বিরাট নিমগাছের গুঁড়ি। তিনি জল থেকে সেই কাঠ তুলে তিন দেবতার মূর্তি তৈরি করে মন্দির প্রতিষ্ঠা করলেন। ৫০ ফুট উঁচু মাহেশের রথে রয়েছে ১২টি লোহার চাকা এবং দু'টি তামার ঘোড়া। আগে রথে তেরোটি চূড়া ছিল। সংস্কারের পর নবরত্ন শৈলীতে তৈরি রথে চূড়ার সংখ্যা ন’টি। লোহার তৈরি এই রথের বয়স প্রায় ১৩৫ বছর। এ বছর মাহেশের রথযাত্রাও বন্ধ থাকবে।
মাহেশের কথায় মনে পড়ে গেল, নৈহাটির কাঁটালপাড়ায় বিখ্যাত চট্টোপাধ্যায় পরিবারের রাধাবল্লভের রথযাত্রার কথা। এক বার শোভাযাত্রার পুরোভাগে হাঁটছেন গৃহকর্তা রায়বাহাদুর যাদবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। কাঁসরঘণ্টা, বাজনাবাদ্যি, হরিনাম সঙ্কীর্তনের মধ্যে হঠাৎ বাড়ি থেকে খবর এল, যাদবচন্দ্রের সেজ ছেলে রথযাত্রা বন্ধ করার হুকুম দিয়েছেন। সকলে হতবাক। এ কেমন আদেশ! আবার অমান্য করাও যাচ্ছে না, কারণ সেজ ছেলেটি তো আর যে সে নয়, সে তখনই বারাসত মহকুমার ভারপ্রাপ্ত ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। খোঁজ নিয়ে দেখা গেল, রথের ন’টি চাকার মধ্যে একটি বেঁকে গিয়েছে, আরও দু’টি বাঁকার উপক্রম। রথের চাকার ঘর্ঘরধ্বনি যে স্বাভাবিক নয়, তা ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের কান এড়ায়নি। দুর্ঘটনার আশঙ্কা থেকেই এমন আদেশ। ১৮৭৫ সালে এই রথের মেলাতেই মারাত্মক ভিড়ে হারিয়ে গিয়েছিল এক কিশোরী। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব নাকি নিজেও মেয়েটিকে খোঁজার চেষ্টা করেছিলেন। সেই মেয়েটিকে সে দিন তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন কি না জানা যায় না, তবে তাকে উপন্যাসের নায়িকা করে জনসমক্ষে এনেছিলেন সে বছরেই, কার্তিক-অগ্রহায়ণ সংখ্যার ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায়। উপন্যাসের নাম ‘রাধারাণী’। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ভদ্রলোক, ঠিকই ধরেছেন, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। উপন্যাসে কাঁটালপাড়া হয়েছে শ্রীরামপুরের মাহেশ। বাঙালি পেয়েছে এক মিষ্টি প্রেমের উপন্যাস। ঝিমলি, তুই ক্লাস এইটে ওঠার পর পড়তে দিয়েছিলাম। তুই পড়তে পড়তে রাধারাণীর দুঃখে কেঁদেছিলি। এ বারও হয়তো রথের মেলা বসবে। কিন্তু তিন ফুট করে দূরত্ব রাখা মানুষজনের মাঝে আর কোনও রাধারাণী হারিয়ে যাবে না। রাধারাণীদের কমনীয় মুখচ্ছবি আর আলোড়ন তুলবে না বাঙালি যুবকের বুকে— করোনার ভয়ে অর্ধেক মুখই মাস্কে ঢাকা থাকবে যে!
সাহিত্যিকদের অন্তরমহলে বার বার হানা দিয়েছে রথের উৎসব। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথাই ধরা যাক। ছোট থেকেই আমরা পরিচিত তাঁর ‘রথযাত্রা লোকারণ্য মহাধুমধাম’ থেকে শুরু করে ‘বসেছে আজ রথের তলায় স্নানযাত্রার মেলা—/ সকাল থেকে বাদল হল, ফুরিয়ে এল বেলা।’-র মতো জনপ্রিয় পঙ্ক্তিগুলোর সঙ্গে। রথ তাঁর কাছে জীবনদেবতার চলমান সিংহাসন। সে কারণেই তাঁর করুণ আর্তি— ‘সমুখে ঐ হেরি পথ,/ তোমার কি রথ/ পৌঁছবে না মোর দুয়ারে?’ কখনও কি ভোলা যাবে ‘লিপিকা’-র ‘রথযাত্রা’ কবিতার সেই দুঃখীকে, যার কাজ ছিল রাজবাড়ির ঝাঁটার কাঠি কুড়িয়ে আনা! রাজা-রানি রথ দেখতে যাবেন। রাজার আদেশে মন্ত্রী সেই দুঃখীকেও সঙ্গী হতে ডেকেছিল। সে সভয়ে প্রত্যাখ্যান করেছিল এ সুযোগ। জানিয়েছিল, ঠাকুরের দুয়ারে যাবে সাধ্য কী তার! ঠাকুর নিজেই পুষ্পক রথে চেপে তার দুয়ারে আসেন। বিস্মিত মন্ত্রী জিজ্ঞেস করেছিলেন, কোথায় সেই পুষ্পক রথ! দুঃখী দেখিয়ে দিয়েছিল তার কুটিরদ্বারের দু’পাশে ফুটে থাকা দু’টি সূর্যমুখী ফুল।
রথের মেলার আকর্ষণ এড়াতে পারেননি হুতোমও। তখনকার শহুরে রথ, মেলার ভিড় নিয়ে কালীপ্রসন্ন সিংহ লিখেছেন, ‘রথের দিন চিৎপুর রোড লোকারণ্য হয়ে উঠলো। ছোট ছোট ছেলেরা বার্নীস করা জুতো ও সেপাইপেড়ে ঢাকাই ধুতি পোরে, কোমরে রুমাল বেঁধে চুল ফিরিয়ে, চাকর-চাকরাণীদের হাত ধরে, পয়নালার ওপর, পোদ্দারের দোকানে ও বাজারের বারাণ্ডায় রথ দেখতে দাঁড়িয়েছে। আদবইসি মাগিরা খাতায় খাতায় কোরা ও কলপ দেওয়া কাপড় পোরে, রাস্তা জুড়ে চলেচে; মাটীর জগন্নাথ, কাঁটাল, তালপাতের ভেঁপু, পাখা ও শোলার পাখি বেধড়ক বিক্রী হচ্চে; ছেলেদের দ্যাখাদেখি বুড়ো বুড়ো মিন্ষেরাও তালপাতের ভেঁপু নিয়ে বাজাচ্চেন, রাস্তায় ভোঁ পোঁ ভোঁ পোঁ শব্দের তুফান উঠেছে। ক্রমে ঘণ্টা, হরিবোল, খোল-কত্তাল ও লোকের গোলের সঙ্গে একখানা রথ এলো। রথের প্রথমে পেটা ঘড়ি, নিশান খুন্তী, ভোড়ং ও নেড়ির কবি, তারপর বৈরাগীদের দু-তিন দল নিমখাসা কেত্তন, তার পেছনে সখের সঙ্কীর্ত্তন পাওনা।... পেচোনে চোতাদারেরা চেঁচিয়ে হাত নেড়ে গান বলে দিচ্ছেন; দোহারেরা কি গাচ্ছেন, তা তাঁরা ভিন্ন আর কেউ বুঝতে পাচ্ছেন না।...’ এমন বিবরণ আর হবে না... ভাইরাসের ভয়ে সবই এখন স্যানিটাইজ়ড।
বাড়ি ফিরে আসি। বছর দশেক আগেও পুজোর শেষে সবাই মিলে বসে গাওয়া হত রথের গান। ‘শ্যামল-অঙ্গ, শ্যাম ত্রিভঙ্গ, কুঞ্জকাননচারী/ জয় জগন্নাথ, করি প্রণিপাত’ কিংবা ‘রথে নারায়ণ, করো দরশন’ ইত্যাদি। তার পর সবই শেষ হয়ে এল। পুরনো বাড়ির সব শরিক ছড়িয়ে পড়লাম সারা কলকাতায়। রথের পুজো হয় এখনও, যেতে পারি না। পুজোর পর হয় না গান। প্রসাদ খাওয়ার পর হাতে হাতে ঘোরে না পাঁপড়ভাজা। ঝিমলি, এ রকমই এক রথের বিকেলে পড়েছিল তোর পাকা দেখা। এমনটা হওয়ারই ছিল। তখন থেকেই আমার মাথায় লেখালিখির ভূত। সরকারি চাকরির জন্য বহু উৎসাহ দিয়েছিলি। আমারই গা ঘামেনি। সময় মতোই বসেছিলি কানাডা-প্রবাসী ইঞ্জিনিয়ারের সামনে। প্র্যাকটিকাল সিদ্ধান্ত। তবু শেষ দেখা হওয়ার দিন তুই কেন যেন আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলি। কাঁদো কাঁদো গলায় বলেছিলি, ‘এ জন্মে তো হল না, পরের জন্ম বলে যদি কিছু থাকে...’ কোনও গল্পের বইয়ে কি পেয়েছিলি কথাটা? কে জানে!
ঠাকুরমশাইয়ের মুখে শুনেছিলাম কঠোপনিষদে আছে, রথে তু বামনং দৃষ্ট্বা পুনর্জন্ম ন বিদ্যতে... রথারূঢ় জগন্নাথদেবকে দর্শন করলে জন্ম-মৃত্যুর বন্ধন থেকে মুক্তিলাভ হয়। আমরা এক সঙ্গে রথে বসা জগন্নাথ দর্শন করেছি বহু বার... পরজন্মের ভরসা কোথায়, ঝিমলি? রথ যে পথে যায়, সে পথেই ফিরে আসে। জীবন তো সে রকম নয়, তাই না?