ছবি: অমিতাভ চন্দ্র
নিজের অফিসে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। আমার অপেক্ষায়! মাত্র কয়েকদিন আগে রাজ্যপালের দায়িত্ব নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে এসেছেন। তাঁর সাক্ষাৎকার নিতে চেয়ে আবেদন করতেই মঞ্জুর হয়েছে আর্জি। কিন্তু নির্দিষ্ট দিনে যাওয়ার একটু আগেই রাজভবন থেকে জানানো হল, বিশেষ কারণে সময় পিছিয়েছে।
পরিবর্তিত নির্ঘণ্টে রাজ্যপালের ঘরে ঢুকতেই দেখি, গোপালকৃষ্ণ গাঁধী স্বয়ং দাঁড়িয়ে। আমাকে হাত বাড়িয়ে স্বাগত জানিয়ে বলতে লাগলেন, ‘‘শেষ মুহূর্তে সময় বদলাতে হল। আমার জন্য আপনার কাজের অসুবিধে হল! খুব খারাপ লাগছে।’’
বিন্দুমাত্র অসুবিধে আমার হয়নি, হওয়ার কারণও নেই। সে কথা তাঁকে বোঝানোই দুষ্কর! আমাকে না বসিয়ে রাজ্যপাল নিজে বসতেও রাজি নন। বারবার বলছেন, ‘‘আপনি আমার অতিথি। এটা আপনার প্রাপ্য।’’
নিজের হাতে চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে কথা শুরু করলেন গোপালকৃষ্ণ। মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধীর পৌত্র, সুভদ্র, সুপণ্ডিত মানুষটির প্রতিটি বাক্যে মার্জিত রুচির ছাপ।
কেমন এই রাজ্যপাল পদ? কীভাবে কাজ করতে চান? ধীর শান্ত গলায় তিনি বললেন, ‘‘এক কথায় বলতে গেলে, আমার কাছে রাজ্যপাল হলেন বাড়ির পুরনো ডাক্তারবাবু। ঠিক বোঝাতে পারলাম?’’
জিজ্ঞাসু চোখে তাকাতেই গোপালকৃষ্ণ বোঝাতে লাগলেন, ‘‘বাড়ির পুরনো ডাক্তারবাবু শুধু রোগেরই চিকিৎসা করেন না। পরিবারের ভাল-মন্দ সব কিছুতে তাঁর ভূমিকা থাকে। তিনি পরামর্শ দেন। তাঁর কাছে মতামত চাওয়া হয়। তাঁর কথা মান্যতা পায়। বাড়ির ছেলেটির চাকরি না-পাওয়া বা মেয়েটির বিয়ের ব্যবস্থা করতে না-পারার মতো সমস্যা নিয়েও ডাক্তারবাবুর সঙ্গে মন খুলে কথা বলা যায়। তাঁকে বলা যায়, আপনি একটু সাহায্য করুন।’’
গোপালকৃষ্ণ বলছিলেন, ‘‘এই বিশ্বাস ও নির্ভরতার জায়গাটি একজন রাজ্যপালের ক্ষেত্রেও আবশ্যক। তিনি রাজ্য নামক পরিবারের পুরনো ডাক্তারবাবু হতে পারলে সেটাই সবচেয়ে ভাল। আমি চেষ্টা করব।’’
তাঁর পাঁচ বছরের কার্যকালে গোপালকৃষ্ণ যা করে গিয়েছেন, তাতে বিতর্কের উপাদান যথেষ্ট। কিন্তু ভেবে দেখলে বোঝা যায়, কোথাও একটা ‘ডাক্তারবাবু’ হয়ে ওঠার সচেতন প্রয়াস তার মধ্যে ছিল। নন্দীগ্রামে গণহত্যার পরে ‘হাড় হিম হয়ে যাচ্ছে’ বলে স্বতঃপ্রণোদিত বিবৃতি দেওয়া, সিঙ্গুর নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনশন মঞ্চে হাজির হওয়া বা সিঙ্গুরের জট খুলতে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এবং বিরোধী নেত্রী মমতাকে নিয়ে মধ্যস্থতা বৈঠক, সব তারই নানা প্রকাশ। সমালোচনা সত্ত্বেও গাঁধীর নাতি অনুচ্চকিত ভঙ্গিতে তাঁর বিবেচনা অনুযায়ী যা করার করেছেন।
রাজ্যপাল পদটি কার্যত আলঙ্কারিক। সবাই জানেন, রাজ্যে নির্বাচিত সরকার থাকলে রাজ্যপালের ভূমিকাও খুব সীমিত। তাঁরা ইচ্ছেমতো ছড়ি ঘোরাতে পারেন না। বরং রাজ্য মন্ত্রিসভার পরামর্শ মেনে তাঁদের চলতে হয়। প্রয়োজনে সরকারের কাছে তাঁরা কোনও কিছুর ব্যাখ্যা চাইতে পারেন। নিজের মতামত জানাতে পারেন। তার বেশি কিছু নয়। কিন্তু ফলিত স্তরে তা নিয়েই গোল বাধে অনেক সময়। সেটুকু বাদ দিলে আরাম-আয়েস, ঠাট-বাটে পাঁচ বছর কাটানোর পক্ষে রাজ্যপাল পদের হয়তো কোনও বিকল্প নেই!
অন্দরমহল: রাজভবনের গ্লেন রুম
স্বাধীনতার পরে প্রথম বিশ বছর রাজ্যপালদের নিয়ে বিশেষ ‘সমস্যা’ হয়নি। কারণ দেশে এবং রাজ্যগুলিতে কংগ্রেসের একদলীয় শাসন চলেছে। এই রাজ্যে তাল কাটে প্রথম যুক্তফ্রন্ট আমলে, রাজ্যপাল ধর্ম বীর দু’বছরের মধ্যে সেই সরকার ভেঙে দেওয়ায়। সেটা ১৯৬৯ সাল। সেই রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনা অনেক হয়েছে। পুনরাবৃত্তি নিষ্প্রয়োজন।
তবে তখন থেকে একটা বিষয় চোখে পড়ার মতো। বেশ কয়েকজন রাজ্যপাল এখানে পুরো মেয়াদ কাটিয়ে যাননি। কোনও না কোনও কারণে তাঁদের সরে যেতে হয়েছে। তার মধ্যে রাজ্যের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়ে নিজের অবস্থানকে বিতর্কিত করে তোলার মতো বিষয় যেমন রয়েছে, তেমনই কেন্দ্র-বিরোধী রাজ্য সরকারের সঙ্গে ‘সুসম্পর্ক’ গড়ে ওঠার মাসুলও দিতে হয়েছে কাউকে।
ধর্ম বীর থেকেই এই প্রবণতা স্পষ্ট। দায়িত্ব নেওয়ার বছরদুয়েক পরেই সরতে হয় তাঁকে। সরকার ভেঙে বিতর্ক তৈরি করা তার বড় কারণ। উত্তরসূরি হয়ে আসেন শান্তিস্বরূপ ধওয়ন। তাঁরও কার্যকাল ছিল দু’বছর। তারপরে আবার পুরো মেয়াদ এখানে রাজ্যপাল ছিলেন অ্যান্টনি ল্যান্সলট ডায়াস। তাঁর কাছে শপথ নিয়ে বামফ্রন্ট সরকারের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন জ্যোতি বসু। এর পরে ত্রিভুবন নারায়ণ সিংহ ছিলেন বছরচারেক। জ্যোতিবাবুরা তাঁকে মাথায় করে রেখেছিলেন। ভৈরব দত্ত পাণ্ডে (যাঁকে শাসক বামেরা ডাকতেন ‘বাংলা দমন পাণ্ডে’ বলে) থাকতে পেরেছিলেন দু’বছর। আর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্তোষ ভট্টাচার্যকে উপাচার্য নিয়োগ করে তুলকালাম বাধানো অনন্তপ্রসাদ শর্মার এই রাজ্যে মেয়াদ ছিল হাতে গোনা বারো মাস।
অবস্থা মোটামুটি স্থিতিশীল হয় বীরেন জে শাহের আমল থেকে। সেই থেকে পরপর গোপালকৃষ্ণ গাঁধী, এম কে নারায়ণন এবং কেশরীনাথ ত্রিপাঠী
তাঁদের পাঁচবছরের মেয়াদ পূর্ণ করেছেন। বিদগ্ধ ইতিহাসবিদ সৈয়দ নুরুল হাসান দু’বার রাজ্যপাল হয়ে এসেছিলেন কলকাতার রাজভবনে। কিন্তু টানা পাঁচবছর কোনও বারেই নয়। একইভাবে উমাশঙ্কর দীক্ষিত, টি ভি রাজেশ্বর, এ আর কিদোয়াইয়ের কার্যকালও ছিল এক-দেড় বছর করে। নুরুল হাসানের পরেই কে ভি রঘুনাথ রেড্ডি অবশ্য পাঁচ বছরের কার্যকাল পূর্ণ করেছিলেন। তাঁর সঙ্গে সিপিএমের সম্পর্কও ছিল মধুর।
রাজ্যপালেরা মিতবাক্ হবেন এবং ‘আপাত-নিরপেক্ষ’ ভাবমূর্তি নিয়ে চলবেন, এটাই প্রত্যাশিত। বহুক্ষেত্রে এই দুয়েরই ব্যতিক্রম হয়ে থাকে। বহির্জগৎ তা দেখতে, জানতে পারে। কিন্তু রাজভবনের অন্দরে এক একজন অধিনায়ক তাঁদের জমানায় নিজেদের ব্যক্তিত্ব, মানসিকতা, জীবনবোধ ইত্যাদির যে সব দৃষ্টান্ত রেখে গিয়েছেন, সেগুলিও কম আকর্ষক নয়।
অনন্তপ্রসাদ শর্মার কথাই ধরা যাক। ট্রেড ইউনিয়ন করে আসা লোকটির জীবনযাপনে বিলাস ছিল না। সোনার গদি ছেড়ে মাঠে হাওয়া খাওয়ার মেজাজে তিনি প্রায়ই বাবুঘাটের রাস্তায় ঘুরতে চলে যেতেন। স্ট্র্যান্ড রোড থেকে ফুচকাওয়ালা ডেকে আনা হত রাজভবনে। ঘনিষ্ঠদের নিয়ে ফুচকা খেতেন রাজ্যপাল! ভালবাসতেন ঝালমুড়ি, তেলেভাজাও। আর ফুরসত পেলেই গল্প জমাতেন রাজভবনের সাধারণ কর্মীদের সঙ্গে।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে সরকারের পাঠানো নামের তালিকা থেকে সন্তোষ ভট্টাচার্যকে বেছে নিয়ে আচার্য-রাজ্যপাল অনন্তপ্রসাদ সেদিন বিধিবহির্ভূত কিছু করেননি। কিন্তু সরকার ও শাসক সিপিএমের উগ্র প্রতিবাদের জেরে অচিরেই তাঁকে রাজভবন থেকে বিদায় নিতে হয়।
একদিন সন্ধ্যায় হঠাৎ দিল্লি তাঁকে পত্রপাঠ পদত্যাগের নির্দেশ দেয়। ওই রাতেই বিহারের ট্রেন ধরেন তিনি। তার আগে প্রথা মেনে ফোন করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুকে। বলেছিলেন, ‘‘চলে যাচ্ছি।’’ জ্যোতিবাবু একটু কটাক্ষের সুরে জবাব দেন, ‘‘আপনি কোথায় যাবেন, তা নিয়ে আমার করার কী আছে!’’ অনন্তপ্রসাদ ফের বলেন, ‘‘আমি রাজভবন ছেড়ে চলে যাচ্ছি।’’ এবার সরকারের টনক নড়ে। তাঁকে বিদায় জানাতে কে যাবেন? মন্ত্রীরা তো ‘বয়কট’ করেছেন তাঁকে! তড়িঘড়ি তৎকালীন মুখ্যসচিব এস ভি কৃষ্ণনকে পাঠানো হয়। তিনি ফুলের গুচ্ছ নিয়ে যান রাজ্যপালকে ট্রেনে তুলে দিতে।
ঠিক বিপরীত ছবি ছিল তাঁর পূর্বসুরী ত্রিভুবন নারায়ণ সিংহের বেলায়। তার আগে বলা দরকার, আদ্যন্ত গাঁধীবাদী ত্রিভুবন নারায়ণ রাজভবনে আসেন ডায়াসের পরে এবং ভৈরব দত্ত পাণ্ডের আগে। আইপিএস অফিসার ডায়াস ছিলেন পাক্কা সাহেব। আইসিএস পাণ্ডেও তাই। মাঝখানে ত্রিভুবন নারায়ণ সিংহ একেবারে বিপরীত। রাজভবনের রাজকীয় কেতায় তিনি অভ্যস্ত হতে পারেন নি। সরকারকে সেপাই-সান্ত্রী, প্রোটোকল তুলে নিতে রোজ পীড়াপীড়ি করতেন। নিজের থাকার জন্য রাজ্যপালের ঘর ছেড়ে তিনি রাজভবন চত্বরে একটি কুটির তৈরি করিয়ে নেন। তার মাথায় টিনের চাল। বাতানুকূল যন্ত্রও ছিল না। সেই কুটির আজও আছে। হয়তো অন্য কাজে, অন্য সাজে তা ব্যবহৃত হয়।
ছাগলের দুধ খেতেন ত্রিভুবন নারায়ণ। পোষা ছাগল ছিল তাঁর। ছাগল ‘চুরি’ যায়। রাজ্যপালের ছাগল চুরি বলে কথা! দারুণ শোরগোল। একেবারে লম্বকর্ণ পালা! লালবাজারের গোয়েন্দারা তদন্তে নামেন। দিন কয়েকের মধ্যেই ছাগল পাওয়া যায়। যদিও কানাঘুযো রটনা শুরু হয়, ওটা নাকি একইরকম দেখতে অন্য ছাগল। কিছুদিন পরে রাজভবন চত্বরের ঝোপঝাড় থেকে ছাগলের ছাল-চামড়াও মিলেছিল।
সে যা-ই হোক, গাঁধীবাদী ত্রিভুবন নারায়ণের সঙ্গে শাসক বামেদের একটা অদ্ভুত রসায়ন তৈরি হয়েছিল। এতটাই গভীর ছিল সেই সম্পর্ক যে, তাঁকে বিদায় জানাতে হাওড়া স্টেশনে গিয়েছিলেন জ্যোতিবাবু, প্রমোদ দাশগুপ্ত দু’জনেই। আর
ছিল লাল পতাকা নিয়ে অগণিত সিপিএম কর্মীর মিছিল, সঙ্গে ‘লাল সেলাম’ ধ্বনি।
অনেকের মতে, বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য হিসাবে ত্রিভুবন নারায়ণ বিতর্কিত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বিলে সম্মতি দিয়ে জ্যোতিবাবুদের ‘পছন্দের’ মানুষ হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু ভুললে চলবে না, এই রাজ্যপালই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালন কমিটির কোনও সিদ্ধান্তে একমত হতে না পেরে সমাবর্তন অনুষ্ঠান বর্জন করেছিলেন। রাজ্যের বিদ্যুৎ সঙ্কট নিয়েও কেন্দ্রে কড়া রিপোর্ট পাঠিয়েছিলেন।
অশীতিপর উমাশঙ্কর দীক্ষিত তাঁর বছরদুয়েকের কার্যকালে খুব একটা ছাপ ফেলতে পারেননি। রাজভবন ফের বর্ণময় হয় নুরুল হাসান আসার পরে। পাণ্ডিত্য ও আভিজাত্যের মিশেলে নুরুল হাসান নিজেকে আলাদা মান্যতায় প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। শান্ত, অমায়িক, নির্বিরোধ বলে তাঁকে নিয়ে বিশেষ কোনও সমস্যাও ছিল না। শুধু স্থূলকায় এই মানুষটির সুগার এবং উচ্চ রক্তচাপ সর্বদা চিন্তায় রাখত রাজভবনের পদস্থ অফিসারদের। কারণ তাঁর ভোজনবিলাস।
খাসির মাংস, মিষ্টি-সহ বিবিধ উপাদেয় ব্যঞ্জন পছন্দ করতেন নুরুল হাসান। চিকিৎসকদের নির্দেশ অন্যরকম। ফলে টানাপড়েন চলত সর্বদা। অনেকটা যেন লুকোচুরি খেলা। তাঁর কাছ থেকে যতটা সম্ভব ওইসব পদ সরিয়ে রাখার চেষ্টা চলত। তবে সবসময় সেটা করা যে সম্ভব হত, এমন নয়।
মনে আছে, একবার তাঁকে উত্তর কলকাতায় আমার জন্মস্থান রাজবল্লভপাড়ায় একটি কালীপুজোর উদ্বোধনে নিয়ে গিয়েছি। তিনি যাওয়ার আগে বললেন, ‘‘বাগবাজারের রসগোল্লা! আমি জানি।’’ গাড়িতে মিষ্টির হাঁড়ি তুলে দেওয়ার সময় তাঁর এডিসি-র কঠোর চাহনি ভুলিনি। আর একবার কলকাতা প্রেস ক্লাবের একটি অনুষ্ঠান হয়েছিল ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের হলে। সেখানেও অতিথি আপ্যায়নের সময় রাজভবনের আধিকারিকদের নির্দেশ মতো রাজ্যপাল হাসানকে সব পদ দেওয়া হয় নি। তিনি আমাকে ডেকে তাঁর প্লেটে প্রতিটি পদ দেওয়ার ব্যবস্থা করেন!
নিষ্পাপ শিশুর সারল্যে বিমানে ওঠার সময় হাইড্রলিক মইয়ের পাটাতনে চেয়ারের উপর বসে থাকতেন তিনি। মই তাঁকে নিয়ে বিমানের দরজায় পৌঁছত। পরপর দু’টি আসন একসঙ্গে রাখা থাকত তাঁর স্বচ্ছন্দে বসার জন্য।
সঙ্কীর্ণ ঘোরপ্যাঁচ নুরুল হাসানের ধাতে ছিল না। একবার বিধানসভা অধিবেশন শুরুর দিনে রাজ্যপালের ভাষণ নিয়ে তুমুল গোলযোগ হয়। তখনকার প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস রাজ্যপালের দিকে ধেয়ে গিয়ে তাঁর হাতে ধরা ভাষণের কপি ছিনিয়ে আনার চেষ্টা করে। রাজ্যপালের পেটে খোঁচা দেওয়া হয়।
প্রেস গ্যালারিতে বসে সব দেখে এসে রিপোর্ট লিখছি। আনন্দবাজারের নিউজ়রুমে রাজভবনের ফোন এল। রাজ্যপাল কথা বলতে চান। ফোন ধরতেই নুরুল হাসান বললেন, ‘‘আমার গায়ে কে খোঁচা দিয়েছিল, তুমি দেখেছ?’’ দেখেছিলাম অবশ্যই। কিন্তু রাজ্যপালকে কি তা বলা যায়? তাই বিনীতভাবে জানালাম, ‘‘স্যর, জটলার মধ্যে ঠিক বুঝিনি।’’ তিনি বললেন, ‘‘আমি কিন্তু তোমাকে দেখেছি। তুমি তখন দাঁড়িয়ে উঠে দেখছিলে।’’ তারপরেই হেসে জানালেন, ‘‘আমি কিন্তু কোনও ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নাম জানতে চাইছি না। আসলে ওই বিধায়ককে ডেকে একদিন ভাল করে খাওয়াব। তুমি নামটি বলতে পার।’’ সেদিন বলিনি। আজও বলব না। এটুকুই জানিয়ে রাখি, সেই বিধায়ক পরে তৃণমূলের সাংসদ হয়েছিলেন। আজ তিনিও প্রয়াত।
এই রাজ্যে রাজ্যপাল নুরুল হাসানের দ্বিতীয় দফার মেয়াদ ছিল সাড়ে তিন বছর। তাঁর পরেই রঘুনাথ রেড্ডি। অতি সাধারণ প্যান্ট, হাওয়াই শার্ট, পায়ে চটি। ফের সেই সাদামাটা জীবনযাপন। এ আর কিদোয়াইয়ের এক বছরও আলাদাভাবে বলার মতো কিছু নয়।
রাজভবন নতুনভাবে ‘জেগে’ ওঠে বীরেন জে শাহ আসার পরে। মুম্বইয়ের শিল্পপতি তথা বিজেপি নেতা ছিলেন শাহ। রাজভবনে পা দিয়ে একেবারে কর্পোরেট কালচার চালু করতে সচেষ্ট হন তিনি। ২৭ একরের বিস্তৃত রাজভবন চত্বরকে সাজিয়ে, গুছিয়ে পরিচ্ছন্ন করে তোলা ছিল তাঁর প্রথম কাজ। সেই আমলে ঝোপজঙ্গল সাফ করা হয়। ঘরদোর আরও ছিমছাম করে তোলা হয়। এবং সেই কাজ করতে গিয়ে অযত্নে, অবহেলায় পড়ে থাকা টিপু সুলতানের সিংহাসনটি ‘আবিষ্কৃত’ হয়! এখন যা উপরে হলঘরে সাজানো।
কর্পোরেট জীবনে অভ্যস্ত বীরেন জে শাহ কলকাতার বিভিন্ন অভিজাত ক্লাবে যেতেন। প্রায় নিয়মিত গল্ফ খেলতেন টালিগঞ্জের একটি ক্লাবে। তাঁর শিল্পপতি বন্ধুদের ডেকে প্রায়ই পার্টি দিতেন রাজভবনে। আর কোনও ঢাকঢোল না পিটিয়েই তাঁর স্ত্রী শীতের রাতে নীরবে রাজভবন থেকে বেরিয়ে কলকাতার ফুটপাতে কুঁকড়ে শুয়ে থাকা মানুষদের
গায়ে বিছিয়ে দিয়ে আসতেন কম্বল। শাহ তাঁকে প্রয়োজনীয় অর্থ এবং উৎসাহ জোগাতেন।
নিজেকে বেশি জাহির না করার এই মানসিকতা ছিল গোপালকৃষ্ণ গাঁধীরও। তিনিও অনেকসময় পরিচিতজনেদের বাড়ি যেতেন সামনে পাইলটের হুটার ছাড়াই। এমনকী, তাঁর স্ত্রী কোনও কাজে বাইরে বেরোলে যাতে সামনে পিছনে পুলিশের বহর না-থাকে, সেই নির্দেশও ছিল তাঁর। শরীরচর্চায় তাঁর খুব উৎসাহ ছিল। খাওয়াদাওয়া ছিল একেবারে ঘরোয়া। অকারণ, অহেতুক খরচ যাতে না হয়, সেদিকেও নজর থাকত তাঁর। ওই আমলে ব্যয়সঙ্কোচের জন্য একসময় সন্ধ্যার পরে এক ঘণ্টা রাজভবনে আলো জ্বালানো হত না।
এম কে নারায়ণন এবং কেশরীনাথ ত্রিপাঠী—পরপর দুই রাজ্যপাল একেবারেই বিপরীত মেরুর। নারায়ণন আইপিএস অফিসার হিসাবে দেশের নিরাপত্তা উপদেষ্টার দায়িত্বও সামলেছেন। কেশরীনাথ ওকালতি এবং আরএসএস-বিজেপি করেছেন পুরোদমে।
নারায়ণনের সহানুভূতিশীল ব্যবহারের কথা আজও রাজভবনের কর্মীদের মুখে মুখে ফেরে। তিনি অফিসার, কর্মীদের সঙ্গে কথা বলতেন পিঠে হাত রেখে। আজও কখনও কোনও কাজে তিনি কলকাতায় এসে রাজভবনে অতিথি হলে সেখানকার পুরনো কর্মীরা সেই স্নেহের পরশ পান।
কেশরীনাথ তুলনায় একটু চাপা। তবে ব্যবহারিক অমায়িকতা তাঁরও ছিল। নিজে কবিতা লিখতেন। ফলে অন্যতর একটি আড্ডার পরিসর তৈরি করে নিয়েছিলেন তিনি।
একটি বিষয়ে কিন্তু নারায়ণন এবং কেশরীনাথের বড্ড মিল। তাঁরা উভয়েই পুজোর সময় নিজেদের ব্যক্তিগত টাকা থেকে রাজভবনের প্রতিটি কর্মী এবং অফিসারকে ‘উপহার’ দিতেন। এটা সরকারি টাকার অনুদান নয়, শুধু নিজেদের মনের টানে উৎসবের আনন্দ ভাগ করে নেওয়া। রাজভবন স্মরণকালে এমন রাজ্যপালদের দেখেনি।