কাজটা যে কী ভীষণ কঠিন আর বিপজ্জনক ছিল, ভাবলে হাঁ হয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। সালটা ১৭৬৪, পলাশির যুদ্ধের পর বাংলায় সবে জাঁকিয়ে বসছে ইংরেজ শাসন। কবির কল্পনায় স্নিগ্ধ মেদুর নদীমাতৃক এই বঙ্গদেশের শ্যামলবরন কোমল মূর্তি আমাদের মর্মে যে ভাবেই গাঁথা হয়ে থাক না কেন, সেই সময়ের গ্রামবাংলার বাস্তবটি মোটেও কাব্যময় ছিল না। সে ছিল এক জলা-জঙ্গলে ভরা, সাপ-বাঘ-ঠ্যাঙাড়ে-ডাকাত অধ্যুষিত, প্রায় আদিম পরিবহন ব্যবস্থার দেশ। তার উপরে শুরু হয়েছে লালমুখো সাহেবদের বিরুদ্ধে সন্ন্যাসী-ফকিরদের বিদ্রোহ, চারিদিকে ছড়িয়ে থাকা ঘন অরণ্যে যাঁদের গোপন আস্তানা।
সেই জটিল আবর্তে জলঙ্গি নদীর মুখ থেকে গঙ্গা ও মেঘনার সংযোগস্থল অবধি গঙ্গার (এ ক্ষেত্রে গঙ্গা বলতে আসলে পদ্মা) দক্ষিণ তটভূমি জরিপের দুঃসাহসিক অভিযানে রওনা দিলেন একুশ বছরের এক ইংরেজ যুবক— জেমস রেনেল। হাতে তৎকালীন ফোর্ট উইলিয়মের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির গভর্নর জেনারেল হেনরি ভ্যান্সিটার্ট-এর আদেশনামা। সদ্য কব্জায় আসা এই গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের উপর শাসনব্যবস্থার ভিত মজবুত করার অন্যতম শর্ত, এই তাবৎ অঞ্চলের সমস্ত জমি ও নদী জরিপ করে যত দ্রুত সম্ভব একটি পূর্ণাঙ্গ ম্যাপ এঁকে ফেলা। যে ম্যাপে ধরা পড়বে ভিনদেশে এসে মুঠোর মধ্যে নেওয়া রাজত্বটার পরিষ্কার একটা ছবি। খাজনা আদায়, উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, ব্যবসাবাণিজ্য, বহিঃশত্রুর আক্রমণ মোকাবিলা ইত্যাদি নানান প্রয়োজন মেটাতে এই ম্যাপই হবে কোম্পানির অব্যর্থ হাতিয়ার।
সম্পূর্ণ অচেনা অজানা দেশ, পদে পদে ওত পেতে আছে বিপদ। মাথার উপর ক্রান্তীয় সূর্যের ক্রূর মুখ, মে মাসের তীব্র দাবদাহ। ম্যালেরিয়া, ওলাওঠার দাপট। এরই মধ্যে অল্প ক’জন সঙ্গী নিয়ে সার্ভের কাজে নামাটা জীবন নিয়ে বাজি ছাড়া আর কী! কিন্তু ভয় বলে কোনও বস্তু নেই যুবার রক্তে। বাবা ছিলেন ব্রিটিশ রয়্যাল আর্মির গোলন্দাজ বাহিনীর সেনাপতি। ছেলে যখন নিতান্তই নাবালক, তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে মারা গেলেন এক লড়াইয়ে। মা দ্বিতীয় বিয়ে করার পর ছেলের বড় হয়ে ওঠা এলাকার ভিকার রেভারেন্ড গিলবার্ট বারিংটনের বাড়িতে। ছোটবেলা থেকেই ভূগোল চর্চার দিকে ঝোঁক, মাত্র বারো বছর বয়সেই ছেলেটি এঁকে ফেলল নিজের ছোট শহর চাডলের অসামান্য একটি মানচিত্র। আর চোদ্দো বছর বয়সেই নৌযাত্রার অদম্য নেশায় ক্যাপ্টেন হাইড পার্কারের অধীনে ‘ব্রিলিয়ান্ট’ নামের এক রণতরীতে চেপে ভেসে পড়ল অজানার উদ্দেশে।
দীর্ঘ যাত্রাপথে সমুদ্রস্রোত আর সমুদ্র জরিপের বিচিত্র অভিজ্ঞতা ও পাঠ নিয়ে উনিশ বছর বয়সে ‘আমেরিকা’ নামের এক জাহাজে রেনেল এসে পৌঁছলেন মাদ্রাজ। সেখান থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নেভি সার্ভিসে যোগ দিয়ে ফিলিপিন্সে সার্ভের কাজে রওনা দিতে হল। ফিরে যে জাহাজের দায়িত্ব নিয়ে কাজ শুরু করলেন, ভয়ানক সমুদ্রঝড়ে সেটা গেল হারিয়ে। ভাগ্যক্রমে সে দিন সেই জাহাজে ছিলেন না রেনেল। তার পর ঘটনাচক্রে এসে পৌঁছনো কলকাতায়, পুরনো বন্ধু টপহ্যামের সুপারিশে ফোর্ট উইলিয়ামে প্রবেশনারি ইঞ্জিনিয়ারের চাকরি, বিরল অভিজ্ঞতা আর যোগ্যতাবলে মাত্র চব্বিশ বছর বয়সেই বাংলার সার্ভেয়ার জেনারেল পদে নিযুক্ত হওয়া।
মানচিত্র: লর্ড ক্লাইভকে উৎসর্গ করা ‘ম্যাপ অব দ্য কাশিমবাজার আইল্যান্ড’। রেনেলের ‘আ বেঙ্গল অ্যাটলাস’
পদ যাই হোক, কাজ তো সেই করতে হবে খোলা আকাশের নীচে, মাটি কামড়ে পড়ে থেকে। রোদ, বৃষ্টি, ঝড়, প্রকৃতির খামখেয়ালিপনা উপেক্ষা করে দিনের পর দিন, মাইলের পর মাইল জমি-নদী-খালবিল খুঁটিনাটি পর্যবেক্ষণ করে বিস্তারিত বিবরণ তৈরি করা, আর ম্যাপ এঁকে চলা। এমন নয় যে রেনেল স্রেফ সাহেবি দুঃসাহসে ভর দিয়ে একটা সাদা পাতায় অজস্র অনুমানের আঁকিবুঁকি কাটছিলেন। ভারতের তৎকালীন শাসকরা আসলে সেই সময় বুঝতে চাইছিলেন, যে মুলুকগুলো তাঁরা শাসন করেন, এই বিপুল ভূখণ্ডের ঠিক কোথায় তাদের অবস্থান, তাদের আকার-আয়তনই বা কেমন, সম্ভাব্য বিপদ-বিদ্রোহের মুখে পড়লে তাদের ভৌগোলিক অবস্থান তাদের বাঁচাতে পারবে কি না— এই সব। কাজ শুরু করার জন্য রেনেলের হাতে কিছু গেজেটিয়ার, চার্ট, টলেমির মানচিত্র, পূর্বসূরি পর্তুগিজ ও ডাচ সাহেবদের আঁকা কিছু ম্যাপের নমুনা ছিল বটে। তবে তার সীমাবদ্ধতাও ছিল প্রচুর। যন্ত্রপাতি সরঞ্জাম প্রাথমিক স্তরের, সহকারীরাও প্রশিক্ষিত ছিলেন না। তবু পিছপা হওয়ার প্রশ্ন নেই। রেনেল জানতেন, সমুদ্রে নৌকো নিয়ে দিন-মাস-বছর কাটায় ‘নেটিভ’ মাঝিরা, তারাও কিন্তু জল আর ডাঙাকে চেনে হাতের তালুর মতো। স্রোতের মেজাজমর্জি বুঝে কখন কোন দিকে নৌকোটি নিয়ে যেতে হবে, যুগ যুগ ধরে সেই শিক্ষা তাদের প্রকৃতিগত ভাবে আয়ত্ত। তরুণ সাহেব বুঝেছিলেন, এই ‘শিক্ষা’কেই তাকে হাতে-কলমে লিপিবদ্ধ করে যেতে হবে। কাজের ক্ষেত্র ক্রমশ বেড়েই চলেছে, ভাগীরথী (রেনেলের কথায় ‘কাশিমবাজার রিভার’) পদ্মা মেঘনা পেরিয়ে এ বার এগোতে হবে ব্রহ্মপুত্র অববাহিকা অর্থাৎ অসম, ভুটান সীমান্তের দিকে। মানুষটার কাজের পরিধি ভাবলে আশ্চর্য হতে হয়। ভারতবর্ষে তাঁর কর্মজীবনের তেরো বছরের ভেতরে উত্তরে হিমালয় থেকে শুরু করে দক্ষিণে ছোটনাগপুর মালভূমি, পূর্বে অবিভক্ত বাংলাদেশের নিম্নসীমা থেকে শুরু করে পশ্চিমে আগরা, এত বর্গকিলোমিটার জুড়ে থাকা এই বিশাল ভূখণ্ডের সার্ভে করে তার প্রায় নিখুঁত মানচিত্র এঁকে ফেলাকে হারকিউলিস-সম কাজ ছাড়া আর কী-ই বা বলা যেতে পারে?
সঙ্গে চলতে লাগল ডায়রি লেখা। সার্ভের কাজে বেরোনোর দিনক্ষণ উল্লেখ করে পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিয়ে কড়চা তৈরি করা, যে বিবরণী পরে বিখ্যাত হয়েছে রেনেলের ডায়রি বা জার্নাল নামে। সেই ডায়রি থেকেই জানা যায় সেই সব দিনের রোমাঞ্চকর নানান অভিযানের কথাও। জার্নালের ছিয়াত্তর পাতার একটা ঘটনা পড়লে হাড় হিম হয়ে যায়। সার্ভের প্রয়োজনে সাহেব তখন কাজ করছেন ব্রহ্মপুত্রের তীরবর্তী এলাকায়, ভুটান সীমান্তের গহন অরণ্যে। হঠাৎ বিদ্রোহী সশস্ত্র সন্ন্যাসীরা চারদিক থেকে ঘিরে ফেলল তাঁদের দল। সঙ্গীরা সবাই সৈনিক, তাই প্রচণ্ড লড়াই হল। কিন্তু তাঁরা সংখ্যায় অনেক কম। কিছু ক্ষণ প্রতিরোধ করা গেলেও শেষে ঘটে গেল এক ভয়ঙ্কর বিপর্যয়। সন্ন্যাসীদের তলোয়ারের ঘা এসে পড়ল সাহেবের কাঁধে। হাঁ হয়ে গেল মাংস, কোপ পড়ল ডান ঘাড়ের হাড়ে, কেটে গেল পিঠের দিকের বেশ কয়েকটা পাঁজর। পালকিতে কোনও মতে পালিয়ে প্রাণে বাঁচা গেল ঠিকই, কিন্তু কয়েক মুহূর্তের জন্য যেন শিয়রে এসে দাঁড়িয়েছিল সাক্ষাৎ মৃত্যু!
১৭৬৬ সালের জানুয়ারির শেষ দিকে ঘটে যাওয়া ওই দুর্ঘটনার পর স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে কেটে গেল অনেক সময়। পরের বছর মার্চ নাগাদ জার্নাল লেখার কাজ শেষ হল, হঠাৎ এক মারাত্মক জ্বরে আক্রান্ত হয়ে গুটিয়ে আনতে হল গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ অঞ্চলের নদী-জরিপের কাজ। বাংলায় থাকাকালীন জ্বরটা আসছিল মাঝেমধ্যেই, স্বাস্থ্যের অবনতি হচ্ছিল। তবে রেনেল দমবার পাত্র নন কিছুতেই। পুরনো শত্রু সন্ন্যাসী-ফকিরদের বিরুদ্ধে অভিযানের সুযোগ হাতে আসতেই এ বার ঝাঁপালেন ব্রিটিশ বাহিনীর কমান্ডার হয়ে। বিদ্রোহ দমনে সাফল্যও পেলেন। এ বার থিতু হয়ে বিয়ে করলেন জেন থ্যাকারে নামের একটি মেয়েকে। বিখ্যাত ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক উইলিয়ম মেকপিস থ্যাকারের পিসি-ঠাকুমা ছিলেন এই মেয়েই।
১৭৭৬ সালে মেজর পদে উন্নীত হলেন রেনেল। ওয়ারেন হেস্টিংস-এর কাছ থেকে বড় অঙ্কের পেনশনের সঙ্গে চাকরি থেকে অবসর নিয়ে নিজের দেশ ইংল্যান্ডে ফিরে গেলেন। অক্লান্ত পরিশ্রম আর গভীর নিষ্ঠায় বাংলার সমস্ত নদী ও সড়ক পথের যে পর্যালোচনা তিনি করে গিয়েছেন তার জন্য তাঁর কাছে আমাদের ঋণ কি কখনও ফুরোবে? আর আঠেরো শতকের বাংলার নিসর্গ বুঝতে গেলে রেনেলের ডায়রি ছাড়া গতি নেই। পড়তে পড়তে চোখে ভেসে ওঠে কত হারিয়ে যাওয়া নদী, জনপদ। মাইলের পর মাইল ধানখেত, পানের বরজ, বাঁশবন, বট-পিপুল শাল-তাল-নারকেল-সুপারির সারি। ঘনঘোর বর্ষা, রোদেলা শরৎ, কুয়াশা জড়ানো শীতের দিনের ছবি, এমনকী বাঘের আসা যাওয়ার পথও। দেশজ শব্দগুলো তাঁর উচ্চারণে অদ্ভুত শোনায়: বনগাঁ হয়ে যায় বোনগঙ্গ, বারাসত ব্যারাসেট, কৃষ্ণনগর কিসটানাঘুর, কুষ্টিয়া কাস্টি, সুন্দরবন সান্ডারবাউন্ড, ইছামতী নদী রিভার ইসামোট, ব্রহ্মপুত্র বারামপুটরে, খেজুরগাছ কাজিরগাছ। নামে কী এসে যায়, আসল কথা হল দেশের ভূগোলটাকে হাতের তালুর মতো চেনার নিবিড় চেষ্টা। আর সেই চেষ্টার জন্যেই হয়তো, তাঁর জীবনীকার ক্লেমেন্ট মার্কহ্যাম রেনেলকে বলেছিলেন ঊনবিংশ শতকের গ্রেট ব্রিটেনের শ্রেষ্ঠ ভূগোলবিদ।
রেনেল তো শুধু ভারতেরই না, তাঁর কাজ বিশ্বজোড়া। দুনিয়াসুদ্ধু ভূগোলবিদরা এক কথায় মেনে নিয়েছেন, সর্বকালের সেরা বিশেষজ্ঞদের মধ্যে জেমস রেনেল অন্যতম। জীবনভর কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ প্রশান্ত মহাসাগরের একটি দ্বীপ আর সিসিলি দ্বীপপুঞ্জের দক্ষিণ দিকের একটি সমুদ্রস্রোতের নামকরণ হয়েছে তাঁর নামে। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার, যে বাংলার মাটি তাঁর প্রতিভা বিকাশের ভিত্তিভূমি, যে নরম নদীর সবুজ দেশে মানুষটি নিজেকে নতুন ভাবে আবিষ্কার করেছিলেন, সেই দেশের মানুষ এই ‘ম্যাপ সাহেব’কে ভুলে গিয়েছে। কিন্তু বাংলার নদী, মাঠঘাট, পথপ্রান্তর কি কখনও তাঁকে ভুলতে পারবে? নদীর কি হৃদয় থাকে? থাকলে নিশ্চয়ই সেখানে চিরকালের জন্য লেখা থাকবে প্রিয় নামটি— মেজর জেমস রেনেল।