দূরদর্শনে ‘নববর্ষের বৈঠক’ কখনও স্টুডিয়োতে, আবার কখনও, বাইরে নানা জায়গায় আয়োজন করা হয়েছে। ১৪০০ সনের ‘নববর্ষের বৈঠক’ হয়েছিল জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে। ১৩০০ সনের পয়লা বৈশাখে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে নববর্ষের এক উৎসব হয়েছিল, একশো বছর পরে আমরা যেন সেটাই ফিরিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। ঠাকুরবাড়ির উৎসবে পূর্ব বাংলা থেকে অতিথিরা এসেছিলেন, আমাদের অনুষ্ঠানেও পূর্ব বাংলা থেকে এলেন বেগম সুফিয়া কামাল এবং ফিরোজা বেগম। সেই বৈঠকে যোগ দিলেন দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, গৌরী ঘোষ প্রমুখ। বহুরূপী ‘নবান্ন’ নাটকের অংশ পরিবেশন করল। আর একটা আশ্চর্য ব্যাপার করেছিলাম— অনুষ্ঠানে মাঝে মাঝেই ফেরিওয়ালারা নানান পসরা নিয়ে সে কালের মতো হাঁক দিয়ে গেল, যেমন: ‘বেলফুলের মালা নেবে’, ‘কুয়োর ঘটি তোলা’, ইত্যাদি। চারিদিক থেকে শোভাযাত্রা এসে মিলল জোড়াসাঁকোর অঙ্গনে।
যে বার গ্রামে ‘নববর্ষের বৈঠক’ হয়েছিল, গ্রামীণ মানুষরা নিজেরাই শোভাযাত্রা বের করেছিলেন। তাঁরাই সেট সাজিয়েছিলেন, ভাস্কর জনক ঝংকারের তত্ত্বাবধানে। প্রতি বারই দূরদর্শনের ‘সিনিক সেকশন’-এর শিল্পী-কর্মীরা অনুষ্ঠানের বিষয়ভাবনার সঙ্গে মিলিয়ে সুন্দর সুন্দর সেট বানাতেন। শান্তিনিকেতনে উত্তরায়ণ-এ যে বার ‘নববর্ষের বৈঠক’ হল, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে গান গাইলেন। শিল্পীদের নাচগানের সঙ্গে ছবি আঁকলেন যোগেন চৌধুরী, ইলিনা বণিক ও কলাভবনের অন্য ছাত্রছাত্রীরা। বাংলাদেশের ছাত্রছাত্রীরা সুন্দর সুন্দর ট্যাবলো নিয়ে অনুষ্ঠানের জন্য শোভাযাত্রা করেছিল।
নিউ থিয়েটার্সে নববর্ষের বৈঠক। পঙ্কজ সাহা, স্বাগতালক্ষ্মী, বুদ্ধদেব, রাজলক্ষ্মী দেবী, তারা ভট্টাচার্য
ঢাকায় নববর্ষ উদ্যাপনের কভারেজ আমরা বাংলাদেশ থেকে আনিয়ে অনুষ্ঠানের মধ্যে দেখাতাম। বাংলাদেশের বিখ্যাত সব শিল্পী নিয়মিত এসে যোগ দিতেন। ‘নববর্ষের বৈঠক’ এই ভাবে হয়ে উঠেছিল দুই বাংলার মিলনের অনুষ্ঠান। বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন বছরে কত অসামান্য শিল্পী এসেছেন! ওয়াহিদুল হক, শাহীন সামাদ, নীলুফার ইয়াসমিন, আবিদা, রফিকুল, মিতা হক, রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা এবং আরও অনেক শিল্পী ও শিল্পীগোষ্ঠী। আর এক বার, বিভিন্ন জেলের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত নারীপুরুষ কয়েদিদের একসঙ্গে গান শিখিয়ে, বৈঠকে গাইয়েছিলাম ‘মুক্তির মন্দির সোপানতলে’। সেই প্রথম মনে হয় কয়েদিদের বাইরের কোনও অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ।
চলচ্চিত্রের শতবর্ষে, নিউ থিয়েটার্স স্টুডিয়োতে আয়োজিত নববর্ষের বৈঠকে, চলচ্চিত্রের বিভিন্ন গুণিজন তো এসেছিলেনই, কিন্তু সবচেয়ে উজ্জ্বল অঙ্গ ছিল অন্য, দেখানো হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের করা ফিল্ম ‘নটীর পূজা’র অংশবিশেষ। বাঙালি জীবনে বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি নিয়ে বৈঠক হয়েছিল সায়েন্স সিটিতে। বিভিন্ন বিজ্ঞান জাদুঘরের নির্মাতা সরোজ ঘোষ সেখানে দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞানের নানা দিক তুলে ধরলেন। নবনীতা দেবসেন বললেন এশিয়ার নানা দেশের নববর্ষের উৎসব নিয়ে। গান গাইলেন অজয় চক্রবর্তী, অনুপ ঘোষাল, লোপামুদ্রা, কবীর সুমন, সাবিনা ইয়াসমিন, কিশোর-শিল্পী আরশাদ আলি। আর হল গৌড়ীয় নৃত্য, যা এই প্রথম কোনও প্রচারমাধ্যমে এল।
এক বার পুরনো লাহাবাড়িতে, ঊনবিংশ শতাব্দী নিয়ে বৈঠকে, মাইকেলের ভূমিকায় ছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, ডিরোজিয়োর ভূমিকায় নিশীথরঞ্জন রায়, বিনোদিনী দাসী কেতকী দত্ত, আমি জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভূমিকায়, এই রকম অনেকে। সে বারের প্রযোজক অভিজিৎ দাশগুপ্ত। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের শতবর্ষে বৈঠকে কত গান হল, রবীন্দ্রনাথ, ডি.এল.রায়, মুকুন্দদাসের লেখা, হল লোকসংগীতও, আর অভিনীত হল ডি. এল. রায়ের নাটক, এগুলির মধ্যে দিয়ে আমরা জানতে পারলাম এই আন্দোলনের কথা।
এক বারের বিষয় ছিল ‘বাঙালি আন্তর্জাতিক এবং অবাঙালি হয়েও বাঙালি’। রামমোহন, বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, নেতাজি, সত্যজিৎ রায়ের আন্তর্জাতিক অবদানের পরিক্রমা সেরে আমরা আসি তপন রায়চৌধুরী, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তর কাছে। দ্বিতীয় পর্বে মার্টিন কেম্পশেন, মেরিঅ্যান দাশগুপ্ত, মারিয়া চট্টোপাধ্যায়, প্রতিভা অগ্রবালরা তুমুল আড্ডা জমালেন বাংলা ভাষাতেই। মোহন সিংহ, রশিদ খান, হৈমন্তী শুক্লা, মনোজ ও মনীষা মুরলী, প্রীতি পটেলরা বাংলা গান গেয়ে নেচে মাত করলেন। সস্ত্রীক শিল্পপতি বিড়লা অনুষ্ঠানে ঔজ্জ্বল্য আনলেন।
এই অনুষ্ঠান আয়োজনে জড়িয়েছিলেন যে সহকর্মীরা: মধুশ্রী, তহমিনা, ধ্রুব, গৌতম, অপর্ণা, সীমা, শম্ভু, জলি, বীথি, নিবেদিতা, কৃষ্ণপদ, নন্দিনী, আরও অনেকে। তথ্য অনুসন্ধানে থাকতেন জ্যোতিভূষণ চাকী, শুভেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রণব বিশ্বাস। পয়লা বৈশাখ নববর্ষের বৈঠক অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়েই শুরু হত বাঙালির নববর্ষ।
pankajsaha.kolkata@gmail.com