নোবেলজয়ী: বিজ্ঞানী রোনাল্ড রস। ছবি সৌজন্য: উইকিমিডিয়া কমন্স।
লাবক। একটি চা-বাগানের নাম। দক্ষিণ অসমের প্রধান শহর শিলচরের গা ঘেঁষে এর অবস্থান। শহর থেকে চা-বাগানটির দূরত্ব ত্রিশ কিলোমিটার। এই লাবক বাগানে রয়েছে একটি বড় হাসপাতাল। বিশাল এলাকা জুড়ে তৈরি। সেই হাসপাতাল চত্বরে রয়েছে একটি সাইনবোর্ড। সেই সাইনবোর্ডে একবার চোখ পড়লে থমকে দাঁড়াতে হবে। কারণ, তাতে লেখা, এই হাসপাতাল এক সময় এক নোবেল পুরস্কার বিজয়ীর কর্মক্ষেত্র ছিল। এক বছর সেখানে ছিলেন তিনি। এই বিজ্ঞানীর নাম রোনাল্ড রস। হ্যাঁ, সেই রোনাল্ড রস, যিনি এক বিশেষ প্রজাতির মশা-ই যে ম্যালেরিয়ার জীবাণু-বাহক, সেটা আবিষ্কার করে হুলস্থুল ফেলে দিয়েছিলেন। সেই আবিষ্কার তাঁকে দিয়েছিল নোবেল বিজয়ীর সম্মান। একই সঙ্গে এই আবিষ্কার রক্ষা করেছিল লক্ষ-কোটি প্রাণও।
ম্যালেরিয়ার ভয় নেই, এমন জায়গা ভারতে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। আর ‘রোনাল্ড রস এখানে ম্যালেরিয়ার সূত্র খুঁজে পেয়েছিলেন’, এমন দাবি জানানোর মতো জায়গারও অভাব নেই। এর একটি কারণ হল তিনি বিভিন্ন জায়গায় কাজ করেছিলেন। শুধু একটি বিশেষ গবেষণাগারে বসে নয়, গবেষণার ক্ষেত্র বিস্তৃত বলে তর্কের সুযোগও প্রশস্ত। কলকাতা না সেকেন্দ্রাবাদ, রোনাল্ড রস কোথায় গবেষণা করে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন, এমন একটি প্রশ্ন ছিল পশ্চিমবঙ্গ প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ পরিচালিত টেট পরীক্ষায়। ২০১৪ সালে। সেই নিয়ে তর্কবিতর্ক একেবারে উচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছিল।
অসমের শিলচর শহরের কাছে এই লাবক চা-বাগানেও রস-এর কাজ করার কথা শোনা যায়। হাসপাতালের ইতিহাস বলে যে, লাবকে কাজ করার সময়ই রস আবিষ্কার করেন ম্যালেরিয়ার জীবাণু এবং অ্যানোফিলিস স্ত্রী-মশার মারাত্মক সম্পর্ক। সেখান থেকেই নোবেল পুরস্কার।
একটি মাইক্রোস্কোপও রাখা আছে হাসপাতালে। বলা হয়, সেটি রস-এর ব্যবহৃত। আর আছে বেশ কিছু ছবি। অ্যানোফিলিস মশার। জিজ্ঞেস করলে শোনা যাবে, এখানকার চিফ মেডিক্যাল অফিসার গ্রাহাম কোলভিল র্যামসি-র আমন্ত্রণে রস এখানে এসেছিলেন ১৮৯৮-৯৯ নাগাদ। এই অঞ্চলে ম্যালেরিয়া এবং কালাজ্বরের প্রকোপ নিয়ে গবেষণা করার জন্য। সেটা ওঁর ১৯০২ সালে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার আগেকার কথা। উইকিপিডিয়াতেও রয়েছে এই তথ্য। চা-বাগানের হাসপাতালের তরফ থেকে এও বলা হয় যে, রস-এর নামাঙ্কিত দলিলপত্রগুলো এক সময় ছিল, কিন্তু এখন হারিয়ে গেছে কালের গহ্বরে।
কিন্তু একটু খতিয়ে দেখলেই ধাঁধায় পড়তে হয়। রোনাল্ড রস-এর নিজের কোনও লেখায় লাবকে এসে বছরখানেক থাকার উল্লেখ নেই। ১৮৯৮ সালে তিনি অসমে এসেছিলেন, এটা ঠিক। কিন্তু তিনি গুয়াহাটি হয়ে নওগাঁ, তেজপুর এবং ওই অঞ্চলের কয়েকটি চা-বাগানে ছিলেন। তাও মাত্র ছ’সপ্তাহ। তখন অসমে কালাজ্বরের প্রকোপ দেখা দিয়েছিল। ব্রিটিশ সরকার রস-কে সেখানে পাঠান, সরেজমিনে তদন্ত করে দেখতে। সংক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য কী করা দরকার, পরামর্শ দেওয়ার জন্য। তখনকার ডাক্তাররা ভেবেছিলেন কালাজ্বর আসলে ম্যালেরিয়ার মতোই একটি অসুখ। সেই জন্যই রস-এর তলব। রস সাহেবের নিজস্ব ধারণাও এমনই ছিল। পরে অবশ্য এই ভুল ভাঙে।
অসম থেকে ফিরে গিয়ে তিনি একটি রিপোর্ট লিখেছিলেন। সেখানে শিলচর অথবা লাবক চাবাগানে যাওয়ার কথা নেই। তাঁর রিপোর্ট অনুযায়ী, ১৮৯৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর তিনি গুয়াহাটি পৌঁছান। অসমে ছিলেন দেড় মাস। আর ১৮৯৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি তিনি কলকাতা থেকে লন্ডন রওনা হয়েছিলেন। তাই লাবক চা-বাগানে এক বছর থাকা অসম্ভব। তবে এমন কি হতে পারে যে এক বছর নয়, কয়েক মাস ছিলেন সেখানে? আর, যেভাবে বলা হয়, তিনি হয়তো সেখানে বন্ধুর আমন্ত্রণে গিয়েছিলেন, তাই সরকারি রিপোর্টে সেটার কথা নাও লিখে থাকতে পারেন!
কিন্তু এখানেই আরও একটা খটকা। যার আমন্ত্রণে রস সেখানে গিয়েছিলেন বলে দাবি করা হয়, সেই র্যামসি সাহেবের বয়স তখন মাত্র দশ! এবং তিনি সেখানে ছিলেনই না। দশ বছরের ছেলে কেমন করে রস-কে বেড়াতে আসতে বলতে পারে! আসল কথা, র্যামসি-র কথা কেউ তলিয়ে দেখেনি। তা হলেই তাঁর জন্মপঞ্জিকা বেরিয়ে পড়ত। পরবর্তী কালে র্যামসি নিজে ম্যালেরিয়া নিয়ে প্রচুর গবেষণা করেছিলেন, যার জন্য তাঁকে একসময় ‘কাইজ়ার-ই-হিন্দ’ পুরস্কার দেওয়া হয়। অর্থাৎ, তিনি নিজেও কম খ্যাতনামা ডাক্তার ছিলেন না। একটু খুঁজলেই তাঁর জীবনী বেরিয়ে আসে। তাঁর মৃত্যুর পর ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নালে যে খবর বেরিয়েছিল, সেখানে লেখা আছে যে, র্যামসির জন্ম হয়েছিল ১৮৮৮ সালে। স্কটল্যান্ডে। এবং তিনি ১৯১২ সালে শিলচরে-র লাবক হাসপাতালে এসেছিলেন। এক বছর থেকে তিনি চলে যান মধ্যপ্রাচ্যে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যোগ দিতে। মিশরে গিয়ে ‘লরেন্স অফ অ্যারাবিয়া’ নামে খ্যাত, কর্নেল টমাস লরেন্সের দলে ডাক্তার হিসেবে কাজ করার সুযোগ পান। যুদ্ধ শেষে ১৯১৯ সালে আবার ফিরে আসেন লাবকে।
সেই সময় র্যামসি চা-বাগানের কুলিদের মধ্যে নানা রোগ নিয়ে কাজ করেছিলেন। লিখেছিলেন বেশ কিছু গবেষণামূলক প্রবন্ধ। চা-বাগানে কুলিদের বস্তিতে শূকর পালনের সঙ্গে ফিতাকৃমির সংক্রমণের সম্পর্ক নিয়ে। একটি ছোঁয়াচে রোগ, নাম ‘ইয়স’, যা থেকে গায়ে লাল ফোস্কা পড়ে, সেটা নিয়েও। ১৯২৪ সালে এই রোগের ওপর একটি প্রবন্ধ লেখার জন্য তাঁকে এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম ডি ডিগ্রি দেওয়া হয়। চা-বাগানে জল জমে যাতে মশার উপদ্রব না বাড়ে, সেই দিকেও নজর ছিল র্যামসির। স্বাভাবিক ভাবেই রস-এর গবেষণা নিয়ে তাঁর আগ্রহ ছিল প্রচুর। এক বার সুযোগও এসেছিল তাঁর সঙ্গে দেখা করার।
তবে সেটা ১৮৯৮ সালে নয়। অনেক পরে, ১৯২৭ সালে। রোনাল্ড রস লন্ডন থেকে অসমে এসেছিলেন সেই বছর। ম্যালেরিয়া প্রতিরোধের কাজ কেমন চলছে, স্বচক্ষে দেখার জন্য। ব্রিটিশ সরকার লন্ডনে রস ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করার কয়েক মাস পরে। মালয়-এ স্যর ম্যালকম ওয়াটসন আর কলকাতার কর্নেল মেগো-ও তাঁকে অনুরোধ করেছিলেন এই অঞ্চলের কাজকর্ম দেখে যাওয়ার জন্য। কর্নেল মেগো ছিলেন কলকাতা ‘স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিন’-এর তদানীন্তন অধিকর্তা। তাঁরা বলেছিলেন রস-এর গবেষণাগারের কাছে একটি তোরণ তৈরি করা হয়েছে—সেটার উদ্বোধনের দিন রস স্বয়ং উপস্থিত থাকলে তাঁরা খুশি হবেন।
এক বার ভারত ঘুরে আসার ইচ্ছে হয়তো রস-এরও ছিল। কারণ সেই সময় রস-এর মনের অবস্থা যে খুব একটা ভাল ছিল তা নয়। ব্রিটিশ সরকার তখনও তাঁর পেনশনের ব্যবস্থা করেনি, নোবেল পুরস্কার পাওয়া সত্ত্বেও। সেই বছর লন্ডনে ফিরে গিয়ে রস তাঁর নিজস্ব গবেষণাগারের কাগজপত্র নিলামে বিক্রি করতে বাধ্য হন। ভারতে আসার আরও একটা সম্ভাব্য কারণ থাকতে পারে। তাঁর ছোট ভাই হ্যালফোর্ড রস তখন ছিলেন অসমে। ১৯২৭ সালের সেপ্টেম্বর অবধি। হ্যালফোর্ড এর আগে পানামা খাল তৈরির সময় সেখানে যাতে জল জমে মশার উপদ্রব না হয়, তার তত্ত্বাবধানে ছিলেন। অসমের জলাভূমিতেও একই পদ্ধতিতে জল নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করার জন্য তাঁকে পাঠানো হয়। লন্ডনের টাইমস পত্রিকায় এই খবর বেরিয়েছিল। কিন্তু ছোটভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়েছিল কি না, তার কথা রোনাল্ড রস কোথাও উল্লেখ করেননি।
জাহাজে করে ভারতে আসার সময় রোনাল্ড রস জিব্রাল্টর এবং তার পর মালয়-এ কিছু দিন থাকেন। সেখান থেকে ইন্দোনেশিয়ার পেনাং হয়ে কলকাতা পৌঁছন ১৯২৭ সালের ৩ জানুয়ারি। কর্নেল মেগোর বাড়িতেই থেকেছিলেন সেবার। ৫ তারিখ বড়লাট লর্ড লিটনের সঙ্গে ডিনার। সাত তারিখ কলকাতা জেনারেল হাসপাতালে তিনি যেখানে বসে এক সময় কাজ করেছিলেন, সেই জায়গার কাছে তোরণ উদ্বোধন করা হল। লর্ড লিটন মজুত ছিলেন সেই সভায়। রসের বক্তৃতা শুনতে এসেছিলেন এক বিশাল শ্রোতৃমণ্ডলী। ১১ তারিখ আর এক বিশাল জনসমাবেশে রস-এর হাতে তুলে দেওয়া হয় সাড়ে পাঁচশো টাকার চাঁদা। যাতে রস ইনস্টিটিউটের কাজে লাগে। সেদিন সন্ধ্যেবেলায় তিনি রওনা দেন কার্শিয়ং-দার্জিলিং-শিলিগুড়ি হয়ে অসমের দিকে। ডুয়ার্স-এর অনেকগুলো চাবাগানের মালিক এবং ডাক্তারদের আমন্ত্রণে। এগুলোর কোথাও ম্যালেরিয়া রোধ করার কাজ সফল হয়েছে, আবার অনেক জায়গায় হয়নি। ১৮ জানুয়ারি জলপাইগুড়িতে তিনি বেশ কয়েকটি চা-বাগানের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে এই নিয়ে আলোচনা করেন।
তার পর আমিনগাঁও স্টেশনে পৌঁছে সেখান থেকে ব্রহ্মপুত্রের বুকে স্টিমারে করে উত্তর অসমের জোড়হাট চলে যান তিনি। সেখানেও চা-বাগানের মালিক এবং ডাক্তারদের সঙ্গে আলোচনাচক্র বসে। ২৫ জানুয়ারি ট্রেনে চড়েন দক্ষিণে শিলচরের উদ্দেশে। পরের দিন সন্ধ্যেবেলা শিলচর স্টেশনে দেখা হয় র্যামসির সঙ্গে। র্যামসি তাঁকে নিয়ে যান লাবক-এ। তাঁর বাড়িতেই থাকেন রস। র্যামসি-পত্নীর আপ্যায়নের কথাও জানা যায়। এর পরের দিন আশেপাশের চা-বাগান গুলোতে র্যামসির কাজকর্মের নমুনা দেখার সুযোগ হয়। রিপোর্ট-এ রস লিখেছিলেন যে, র্যামসির কাজ দেখে তিনি মুগ্ধ। শুধু মুগ্ধ বললে বোধহয় কম বলা হয়। প্রায় পঞ্চাশ হাজার মশা পরীক্ষা করে র্যামসি খুঁজেছিলেন কোন বিশেষ প্রজাতির অ্যানোফিলিস মশা ম্যালেরিয়ার জীবাণু বয়ে বেড়ায়। তখনকার দিনের রেকর্ড এটা। অসমের চা-বাগানগুলোর পরিবেশে এই মশার সংখ্যা কীভাবে বাড়ে সেই নিয়েও তাঁর গবেষণা সকলকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। স্বাভাবিক ভাবেই, পরবর্তী কালে রস ইনস্টিটিউটের অসম শাখার অধিকর্তা হিসেবে র্যামসির কথা ভাবা হয়েছিল। এখানে বলে রাখা উচিত, রস-কে খুশি করা খুব একটা সহজ কাজ ছিল না, সেটা তাঁর সহকর্মীরা বলে গিয়েছেন। র্যামসির কাজ খুব উঁচুদরের ছিল বলেই তিনি প্রশংসা করেছিলেন।
২৬ জানুয়ারি সন্ধেবেলা শিলচর শহরে ক্লাবে এসে বক্তৃতা দিয়েছিলেন রস। ২৫০ জন শ্রোতা মজুত ছিলেন সেখানে। আজ অবশ্য সেই ক্লাবের পুরনো চেহারা দেখার উপায় নেই। শিলচর শহরের মধ্যিখানে, সেন্ট্রাল রোডের পাশে সেই ব্রিটিশ আমলের বাড়িটি ভেঙে নতুন করে বানানো হয়েছে। তবে প্রচুর গাছগাছালির ছায়াঘেরা সেই চত্বরটি রয়ে গেছে এখনও।
বক্তৃতা শেষে ক্লাবের কাছেই সুরমা ভ্যালি লাইট হর্স মেস-এ ডিনারের আয়োজন ছিল। সেই কথাও লিখেছেন রস। পরের দিন শিলচর থেকে
ট্রেনে করে চাঁদপুর হয়ে গোয়ালন্দে স্টিমারে চড়েন তিনি। এই সফরের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ তিনি লিখে গেছেন তাঁর ‘ম্যালেরিয়া-কন্ট্রোল ইন মালয় এন্ড আসাম’ প্রবন্ধে।
এই হল আসল ইতিহাস। অর্থাৎ, রস এক রাত্তিরের জন্যই ছিলেন লাবক চা-বাগানে। কিন্তু সেই গল্প মুখে মুখে প্রচলিত হয়ে তাঁর এক বছরের থাকার কথায় পরিণত হয়েছে। তিনি শুধু ম্যালেরিয়া প্রতিরোধের ক্ষেত্রে এখানকার চা-বাগানগুলোতে কী করা হচ্ছে সেটা জানতে এসেছিলেন। কিন্তু তার বদলে চলে এসেছে অ্যানোফেলিস নিয়ে তাঁর গবেষণার গল্প। সঙ্গে নোবেল পুরস্কারের প্রসঙ্গও চলে এসেছে। তিনি নিশ্চয়ই ২৬ জানুয়ারি সকালে লাবক হাসপাতালে র্যামসির গবেষণাগারে মাইক্রোস্কোপ দিয়ে র্যামসির কাজের নমুনা দেখেছিলেন। রস-এর স্পর্শলাঞ্ছিত সেই অণুবীক্ষণ যন্ত্রটি হয়তো হয়ে গেছে রস-এর নিজস্ব মাইক্রোস্কোপ। একটুকু ছোঁয়া লাগে, একটুকু কথা শুনি, তাই দিয়ে আমরা রঙে-রসে জাল বুনি। আর রূপকথায় ধরা দেন বিজ্ঞানী।
স্থানপরিচিতি: এই সাইনবোর্ডটিই তুলে ধরছে লাবক চা-বাগানে রোনাল্ড রসের গবেষণার ইতিবৃত্ত। বাঁ দিকে, বিজ্ঞানীর ব্যবহৃত সেই অণুবীক্ষণ যন্ত্র। ছবি সৌজন্য: কৃষ্ণেন্দু রায়।
বিজ্ঞানের ইতিহাসে এমন ‘মিথ’-এর উদাহরণ প্রচুর পাওয়া যায়। বিশেষ করে বিখ্যাত গবেষণার ক্ষেত্রে এমন অনেক গল্প শোনা যায় যেগুলো পরে দেখা গেছে ভিত্তিহীন। যেমন, গ্যালিলিওর সেই পিসার হেলানো টাওয়ারে উঠে দুটো বল ফেলে দেওয়ার গল্প। একটি ভারী এবং একটি হালকা বল ছিল তাঁর হাতে। দুটো বলই একসঙ্গে এসে মাটিতে পড়েছিল। প্রমাণিত হয়েছিল যে পৃথিবীর মহাকর্ষীয় বল সব বস্তুকে সমানভাবে টানে। ইতিহাসবিদরা পরে লক্ষ করেছিলেন যে, গ্যালিলিও নিজে কখনো এই ঘটনার উল্লেখ করেননি। সমসাময়িক অন্য কারও জবানবন্দিতেও পাওয়া যায় না। তাঁর মৃত্যুর বহু পরে এই গল্প চালু হয়। গ্যালিলিও যখন প্রায় অন্ধ এবং গৃহবন্দি অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন, তখন তাঁর সেক্রেটারির কাজ করে দিত একটি ছেলে। নাম, ভিভিয়ানি। সে যখন ১৭১৭ সালে গ্যালিলিওর জীবনী লিখে প্রকাশ করে তখন এই ঘটনার প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়। অর্থাৎ, গ্যালিলিওর মৃত্যুর পঁচাত্তর বছর পরে। অথচ এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এর আগে পর্যন্ত কেউ লিখবেন না, এটা ভাবাই যায় না। বিজ্ঞানের ইতিহাসবিদরা এই ঘটনা কতটুকু সত্যি সেই নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ প্রকাশ করেন।
বিজ্ঞানের ইতিহাসে গল্পের গরু যে প্রায়ই গাছে চড়ে সেটা হয়তো স্বাভাবিক। আর যেখানে রস-এর মতো গবেষণার সঙ্গে নোবেলের প্রসঙ্গ যুক্ত, সেখানে ‘মিথ’ বজায় রাখলেই যেন সবাই আশ্বস্ত হয়। এমনিতে বিজ্ঞানীদের একটা ভাবমূর্তি থাকে, তাঁরা সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে। এই ধরনের গল্প বিজ্ঞানীদের যেন নাগালের মধ্যে নিয়ে আসে। রূপকথা তৈরি হয়। তাই ‘মিথ’ খুঁজি আমরা। নিউটন-এর মাথায় আপেল পড়ার গল্প শেখাই স্কুলের ছেলেমেয়েদের। এই গল্পগুলো ভিত্তিহীন বললে মানতে চায় না মন। ভাল স্বপ্ন ভেঙে গেলে যেমন মন খারাপ হয়, তেমনি ‘মিথ’-কে মিথ্যে বলতেও বাধে।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার : সোমাভা বিশ্বাস