সে দিনও ওই অঞ্চলে ছিল নাথ যোগীদের মঠ। কিন্তু জনমানসে তার চেয়েও বেশি প্রভাব ফেলেছিলেন মোহনদাস কর্মচন্দ গান্ধী। তাঁর অসহযোগ আন্দোলন তখন মানুষকে দেখিয়েছে স্বাধীনতার স্বপ্ন।
mahatma gandhi

Cauri Chaura: আর এক গোরক্ষপুর

মানুষের চোখে তিনি দেবতা। কিন্তু চৌরিচৌরা থানায় সত্যাগ্রহীদের হিংসার কারণে আন্দোলন তুলে নিলেন তিনি। আগামী শুক্রবার সেই ঘটনার শতবর্ষ।

Advertisement

অর্ণব সাহা

শেষ আপডেট: ৩০ জানুয়ারি ২০২২ ০৮:৫৩
Share:

আক্রমণ: চৌরিচৌরা থানার দিকে ধাবমান উন্মত্ত সত্যাগ্রহীরা। ৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯২২।

তারিখটি ছিল ১৯২২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি আর তার পরের দিন। তার ঠিক এক বছর আগে ১৯২১ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি মহাত্মা গান্ধী পূর্ব উত্তরপ্রদেশের গোরক্ষপুরে আসেন। তাঁর এই আগমন এক অভূতপূর্ব গণ-উন্মাদনার জন্ম দেয়। প্রায় আড়াই লক্ষ মানুষের বিশাল জনসভায় ভাষণ দিয়ে সেই রাতেই বারাণসী চলে যান গান্ধী। এই অঞ্চলে তিনি ছিলেন অতি সামান্য সময়, অথচ মহাত্মার কল্পরূপ পরবর্তী দিনের পর দিন জনমানসে এক বিরাট চেহারায় ঈশ্বরত্বের আকারে বেঁচে ছিল।

Advertisement

১৯২১-২২ এই সময়ে ভারতীয় জনগণের মধ্যে এক নজিরবিহীন রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনের জন্ম হয়েছিল। গান্ধীর ডাকা অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গে খিলাফত আন্দোলন যুক্ত হয়ে তা এক লাগামছাড়া গণ-বিস্ফোরণের চেহারা নেয়। এক বছরের মধ্যে গান্ধী ‘স্বরাজ’ আনবেন বলে ঘোষণা করেন। স্বরাজের মধ্যে রাজনৈতিক স্বাধীনতার সঙ্গে ছিল মানসিক উদ্বোধন, আত্মশুদ্ধি, দেশ গড়ার জন্য গঠনমূলক কাজ এবং স্বদেশি ক্রিয়াকলাপের বিস্তৃত কর্মসূচি। উত্তরপ্রদেশ ও বাংলায় হাজার হাজার কৃষক অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেন। অসহযোগ আন্দোলন সেই মুহূর্তে সত্যাগ্রহ স্বেচ্ছাসেবকদের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থনে ব্যাপক আকার লাভ করে। গোরক্ষপুরের ভূতপূর্ব রাজপরিবারের সদস্যেরা, স্কুলশিক্ষক, পোস্টমাস্টার, নায়েব, তহ্‌সিলদার, আহির এবং কুর্মি রায়তদের বিপুল অংশ এই আন্দোলনে জড়িয়ে গিয়েছিল।

১৯২১-এর নভেম্বরে কংগ্রেস সাপ্তাহিকী ‘স্বদেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত দশরথ দ্বিবেদীর লেখা সম্পাদকীয়তে গোরক্ষপুর জেলার নিম্নবর্গের মানুষজনের মনে গান্ধীজির সাধুসুলভ অতিলৌকিক চেহারাটি কী ভাবে গণচেতনায় ব্যাপক পরিবর্তন আনছে, সে সম্পর্কে বিস্তৃত আলোচনা করা হয়। বিবিধ হিন্দু আচার-অনুষ্ঠান পালন এবং আত্মশুদ্ধির প্রয়াস এই গণ-আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিল। উনিশ শতকে এই অঞ্চলের নিম্নবর্ণের মানুষেরা প্রায় সকলেই ছিলেন আমিষাশী এবং মদ্যপ। মহাত্মা গান্ধীর প্রভাবে তাঁরা অনেকেই মদ-মাংস খাওয়া ছেড়ে দেন।

Advertisement

গান্ধীর অতিপ্রাকৃত ক্ষমতা সম্পর্কে প্রথম লেখাটি বেরোয় ১৯২১ সালের জানুয়ারি মাসের ‘স্বদেশ’ পত্রিকায়। লেখাটির শিরোনাম— ‘স্বপ্নে মহাত্মা গান্ধী: উলঙ্গ ইংরেজদের পলায়ন’। সেখানে বলা হয়, রাত এগারোটা নাগাদ এক ইংরেজ দুঃস্বপ্ন দেখল, হাজার হাজার ভারতবাসীকে নিয়ে গান্ধী এগিয়ে আসছেন। তার আতঙ্কিত চিৎকারে ইংরেজরা বিছানা থেকে উঠে অর্ধ-উলঙ্গ অবস্থাতেই এলাকা ছেড়ে পালাতে শুরু করল। পরবর্তী এক-দেড় বছরে গান্ধীকে নিয়ে ছড়িয়ে পড়ে অসংখ্য অলৌকিক গুজব, যেখানে গান্ধীর অতিপ্রাকৃত ক্ষমতাবলে অবিশ্বাস্য সব ঘটনা ঘটতে শুরু করেছে বলে দাবি করা হয়। এখানে গুজবের রাজনৈতিক মাত্রা এবং তাৎপর্য অপরিসীম।

সমকালীন কাগজের রিপোর্টগুলিতে চোখ রাখলে দেখা যায়, গান্ধীর ট্রেন-যাত্রাপথে হাজার হাজার মানুষ স্টেশনে উপস্থিত হয়েছেন তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে। গান্ধীর প্রতাপ এবং ব্যক্তিত্বের সম্মোহন জনমানসকে কিছু দিনের জন্য হলেও আমূল পরিবর্তিত করতে সক্ষম হয়। ১৯২১-এর আগে সামাজিক বয়কট বা সত্যাগ্রহী স্বেচ্ছাসেবকদের স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভ ওই সব এলাকায় ছিল অপ্রচলিত ঘটনা। গান্ধী গোরক্ষপুরে আসার সঙ্গে সঙ্গেই মানুষ সম্পূর্ণ নিজের তাগিদে এক দিকে স্থানীয় পঞ্চায়েত বা সভা-সমিতির মাধ্যমে আত্মশুদ্ধির কাজে ব্যাপৃত হতে শুরু করেন এবং এক আসন্ন বারুদের স্তূপ জমে ওঠে, যা সামান্য আগুনের ইন্ধনের অপেক্ষায় ছিল।

১৯২১-এ গান্ধীকে স্বচক্ষে দেখার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে যাঁরা গোরক্ষপুরে এসেছিলেন, তাঁদের মধ্যে বহু কৃষকই ঠিক এক বছরের ব্যবধানে ১৯২২-এর ফেব্রুয়ারি মাসে চৌরিচৌরা রেলস্টেশনের পাশ দিয়ে মিছিল করে এগিয়ে গিয়েছিলেন সম্পূর্ণ অন্য ইতিহাস রচনা করবেন বলে। সেই ইতিহাসই ‘চৌরিচৌরা বিদ্রোহ’, যাকে দীর্ঘ দিন অবধি জাতীয়তাবাদী ইতিহাসের বয়ানে নিতান্ত পাদটীকা হিসাবেই গণ্য করা হয়েছে। অথচ ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে গণ-অংশগ্রহণের ইতিহাসে এর তাৎপর্য অপরিসীম।

গান্ধী বুঝতে পারছিলেন, তাঁকে ঘিরে এই তীব্র গণ-উন্মাদনা অতি শীঘ্রই হিংসাশ্রয়ী হয়ে উঠতে পারে। তিনি একটি কুড়ি দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন, যার মূল কথাই হল গণ-আন্দোলনে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা। যা তাঁর ভাষায় ‘মবোক্রেসি’কে ‘ডেমোক্রেসি’র চেহারা দেওয়া। এ ভাবেই আন্দোলনের ‘বিশৃঙ্খল’ নিম্নবর্গীয় চেহারাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য গান্ধী বললেন, স্বেচ্ছাসেবকদের কাজ হবে জনগণের ‘পুলিশ’ হিসেবে কাজ করা। তাঁর কথা চৌরিচৌরার সত্যাগ্রহীরাও অক্ষরে অক্ষরে পালনের চেষ্টা করেছিলেন। ১৯২১-এর নভেম্বরে তাঁরা একটি অঙ্গীকারপত্রে স্বাক্ষর করেন, যাতে স্পষ্ট ঘোষণা করা হয়, তাঁদের আন্দোলন অহিংস পথে চলবে, তাঁরা বিদেশি পণ্য বয়কট করবেন, ঈশ্বরের নামে শপথ নিয়ে খদ্দর পরবেন, মদ-মাংসকে অস্পৃশ্য হিসেবে মেনে নেবেন এবং এই সংগ্রামে শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত লড়বেন। যদি জেলেও যেতে হয়, তাও স্বেচ্ছায় মেনে নেবেন ও কারও কাছে মুক্তির জন্য আবেদন করবেন না বা টাকাপয়সা চাইবেন না।

১৯২২-এর জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি চৌরিচৌরা পুলিশ স্টেশনের এক মাইল পশ্চিমে ছোটকি ডুমরি গ্রামে একটি ‘মণ্ডল কমিটি’ গড়ে তোলা হয়েছিল। জনৈক লাল মহম্মদ সাঁইয়ের উদ্যোগে গোরক্ষপুর জেলা কমিটির কংগ্রেস এবং খিলাফত নেতাদের এই গ্রামে ডেকে আনা হয়। মহম্মদ আরিফ নামে এক জেলা স্তরের নেতা আসেন গ্রামীণ সত্যাগ্রহীদের সামনে গান্ধীবাদী আন্দোলনের স্বরূপ ব্যাখ্যা করার জন্য। এলাকার মানুষ তখন উৎসাহে ফুটছেন। তাঁরা নিকটবর্তী মুন্ডেরা বাজারে ধর্না শুরু করেন। মদ বিক্রি এবং খাদ্যশস্যের চড়া দামের বিরোধিতাই তাঁদের থানা অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু পুলিশের দিক থেকেও প্ররোচনা বা আইন সামলানোর ব্যর্থতা ছিল যথেষ্ট। বলা দরকার যে, নজর আলি নামের এক জন সত্যাগ্রহী নেতা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীকে শপথ করিয়েছিলেন যে, তারা কোনও মতেই হিংসায় জড়াবে না। ভগবান আহির নামের ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর এক অবসরপ্রাপ্ত সেনা এই ধর্নার নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন, পুলিশ তাঁকে বেদম প্রহার করে। উত্তেজিত সত্যাগ্রহীরা থানেদারের কাছে এই আচরণের ব্যাখ্যা চায় ও মুন্ডেরা বাজারে পিকেটিং শুরু করেন। থানেদার গুপ্তেশ্বর সিংহ অতিরিক্ত পুলিশ বাহিনী মোতায়েন করেন।

৪ ফেব্রুয়ারি থানা অভিমুখে তিন হাজার সত্যাগ্রহীর বিশাল মিছিল আটকাতে ব্যর্থ হন আট জন রাইফেলধারী পুলিশ-সহ স্থানীয় কনস্টেবল ও চৌকিদাররা। এই প্রাথমিক জয়ে আন্দোলনকারীরা বিপুল উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে শুরু করেন। এক জন পুলিশ অফিসার জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে শূন্যে গুলি চালান। তাতে কেউই আহত বা নিহত হয় না। অত্যুৎসাহী জনতা চিৎকার করে উঠে বলে—“ভগবান গান্ধীর আশীর্বাদে পুলিশের গুলি জলে পরিণত হয়েছে।” এ বার ক্ষুব্ধ জনতা রেলস্টেশনের দিক থেকে পুলিশের উদ্দেশে ইটপাটকেল ছুড়তে থাকে। পরিস্থিতি মুহূর্তে হয়ে ওঠে অগ্নিগর্ভ। পুলিশ গুলি চালাতে শুরু করে। তিন জন স্বেচ্ছাসেবক নিহত হন। আহত হন বেশ কিছু লোক। প্রবল আক্রোশে ক্ষিপ্ত জনতা এ বার থানা ঘিরে ফেলে। ভীত পুলিশকর্মীরা প্রাণ বাঁচাতে থানায় ঢুকে পড়েন। জনগণ থানার দরজায় বাইরে থেকে তালা আটকে দিয়ে নিকটবর্তী বাজার থেকে কেরোসিন এনে থানায় আগুন লাগিয়ে দেয়। স্টেশন অফিসার-সহ তেইশ জন পুলিশকে জ্যান্ত জ্বালিয়ে দেওয়া হয়।

ঘটনা এখানেই শেষ হয় না। পর দিন হিংস্র জনতা নিপুণ ভাবে থানায় রাখা পুলিশের যাবতীয় সম্পত্তি ধ্বংস করতে থাকে। রাইফেলগুলো ভেঙে টুকরো টুকরো করা হয়। পুলিশের লাঠির মাথায় যে ধাতব অংশ লাগানো থাকে, সেই অংশগুলো খুলে নেওয়া হয়। প্রায় তিন ডজন গ্রামীণ চৌকিদার মাথার লাল পাগড়ি খুলে ফেলে জনতার ভিড়ে
মিশে পালিয়ে যেতে পারে। তাদের মাথার পাগড়িগুলো ছিঁড়ে ফেলে জনতা, জান্তব উল্লাসে। রাত্রি নামতেই থানা আক্রমণকারী জনতা পিছু হটে। কেউই ঘরে ফেরে না। দূরবর্তী আত্মীয়দের বাড়িতে আত্মগোপন করে।

অধিকাংশ স্বেচ্ছাসেবকের কাছে এই থানা ধ্বংস করে দেওয়া ‘গান্ধী-রাজের আগমন’ বলেই প্রতিভাত হয়। পুলিশ বিদ্রোহ দমন করতে এসে কাউকেই পায় না, কারণ ডুমরি-সহ পার্শ্ববর্তী সমস্ত গ্রাম তখন কার্যত পুরুষশূন্য। কিন্তু ঘরে ঘরে হানা দিয়ে পুলিশ বাজেয়াপ্ত করে সেই অঙ্গীকারপত্রগুলো, সত্যাগ্রহ শুরুর সময়ে যে শপথবাক্য-লেখা-কাগজে আন্দোলনকারীরা সই করেছিলেন। সেই অঙ্গীকারপত্র ধরে ধরে সে দিনের ঘটনায় জড়িত একের পর এক সত্যাগ্রহীকে খুঁজে বার করে গ্রেফতার করে পুলিশ। ২২৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা রুজু করা হয়। বিচার চলাকালীন ছয় জনের মৃত্যু ঘটে। ১৭২ জন ‘দাঙ্গাকারী’র কঠোর সাজা হয়। এদের মধ্যে ১৯ জনকে ফাঁসি দেওয়া হয়, বাকিদের দ্বীপান্তরে চালান করা হয়। কংগ্রেসের গোরক্ষপুর জেলা কমিটি অবশ্য দ্রুত অকুস্থলে পৌঁছেছিল। ৯ ফেব্রুয়ারি চৌরিচৌরায় একটি জরুরি মিটিং ডাকা হয়। এর পর সেখানে মহাত্মা গান্ধীর ছেলে, দেবদাস গান্ধী পৌঁছন এবং ১১ ফেব্রুয়ারি তিনি অবশিষ্ট স্বেচ্ছাসেবক-সহ সমস্ত জনগণের কাছে পৌঁছে দেন বার্তা— ‘অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করে নিয়েছেন গান্ধীজি।’ ১২ ফেব্রুয়ারি দেশ জুড়ে এই আন্দোলন তুলে নেওয়া হয়,
গান্ধী অত্যন্ত তৎপরতার সঙ্গে চৌরিচৌরার ঘটনাটিকে ‘নৃশংস অপরাধ’ বলে প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন এবং বারদৌলি কংগ্রেসের অধিবেশনে চৌরিচৌরায় কৃষক-বিক্ষোভকারীদের হাতে ঘটে যাওয়া এই ‘অমানুষিক’ কাজের তীব্র নিন্দা করেন। ওই বৈঠকেই ‘আইন-অমান্য’ আন্দোলনের ইতি টানা হয়। সমস্ত রকম শোভাযাত্রা, জনসভা একেবারে বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়। পরিবর্তে সুতো কাটা, মদ্যপান ত্যাগ ও চারিত্রিক শিক্ষা সম্পর্কিত ‘গঠনমূলক কাজ’-কেই একমাত্র অনুসরণের কথা বলা হয়। এ ভাবেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনকে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করা হয়। কংগ্রেসের মধ্যেও গান্ধীর সিদ্ধান্তের বিরোধিতা আসে। সুভাষচন্দ্র বসু একে ‘হিমালয়ান ব্লান্ডার’ বলে অভিহিত করেন। জেলবন্দি চিত্তরঞ্জন দাশ বলেন— “সারা জীবনের মতো সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেল।” লালা লাজপত রাই বলেন—“আমরা একেবারে ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলাম।” আর মোতিলাল নেহরু বলেছিলেন— “একটি স্থানের জনতার পাপের জন্য গান্ধীজি সমস্ত দেশবাসীকে শাস্তি দিলেন।”

একমাত্র জওহরলাল নেহরু বারদৌলি কংগ্রেসের সিদ্ধান্তের সমর্থনে বলেছিলেন— “অন্যথায় তা আয়ত্তের বাইরে গিয়ে সরকারের সঙ্গে সহিংস ও রক্তস্রাবী সংগ্রামে পরিচালিত হত,” অবিকল আত্মপক্ষ সমর্থনে যে যুক্তি গান্ধী দিয়েছিলেন ১৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯২২, ‘ইয়ং ইন্ডিয়া’ পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর দীর্ঘ প্রবন্ধে, যার ছত্রে ছত্রে হিংসা ও বিশৃঙ্খলার তীব্র বিরোধিতা করেন তিনি। সবচেয়ে বড় কথা, চৌরিচৌরার আন্দোলনকারীদের শাস্তিদানের পর মূলধারার জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বের তরফ থেকে কোনও প্রতিবাদই হয়নি। একমাত্র নথিবদ্ধ প্রতিবাদ মানবেন্দ্রনাথ রায়ের প্রবাসী পত্রিকা ‘ভ্যানগার্ড’ আর কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের কার্যনির্বাহী সমিতির প্রস্তাব। এমনকি চৌরিচৌরায় মৃত পুলিশদের জন্য স্মৃতিস্তম্ভ গড়ে উঠলেও শহিদ কৃষকদের স্মৃতিতে কোনও স্তম্ভ গড়ে তোলার কথা কেউই ভাবেননি। যদিও সম্প্রতি সেই চেষ্টা চলছে।

আমাদের জাতীয়তাবাদী বয়ানে তাই চৌরিচৌরার কৃষকদের এই লড়াই দীর্ঘ দিন পর্যন্ত গান্ধীবাদী পথে এগিয়েও হিংসাশ্রয়ী পরিণতির দিকে এগিয়ে যাওয়া একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা হিসেবেই বর্ণিত হয়েছে। যেন এটি মূল জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের একটি মূল্যহীন পাদটীকা, মোতিলাল নেহরুর ভাষায় যা— ‘কৃষকদের পাপ’। স্বয়ং গান্ধী তাঁর নিজের জবানিতে এক বারও এই কৃষকদের পক্ষ সমর্থন করেননি। তিনি ঘটনার পরেই পাঁচ দিনের জন্য অনশন করেন। ‘দ্য ক্রাইম অব চৌরিচৌরা’ নামক লেখায় তিনি বলেন— ‘এই ঘটনা আমার কাছে প্রায়শ্চিত্ত এবং ওই অপরাধী কৃষকদের ক্ষেত্রে শাস্তিই যথার্থ।’ ঘটনার ঠিক পরেই, ৬ মার্চ ১৯২২, উত্তরপ্রদেশের অখ্যাত ‘প্রতাপ’ পত্রিকায় চৌরিচৌরা নিয়ে জনৈক কবি সুরেন্দ্র শর্মার লেখা একটি হিন্দি কবিতা ছাপা হয়। কবিতাটির নাম ‘প্রায়শ্চিত্ত’। কবি ছিলেন প্রবল গান্ধীভক্ত। শুরুতেই কবি বলছেন, অসহযোগ আন্দোলন ‘কর্মবীর’ গান্ধীর নেতৃত্বে প্রবল আশা জাগিয়ে শুরু হয়েছিল, এই আন্দোলন চিরকালের জন্য ভারতীয় জাতিকে মুক্তি দিত তার যাবতীয় দুর্ভাগ্য এবং কষ্ট থেকে। কিন্তু ঈশ্বরের দুর্জ্ঞেয় ইচ্ছা একে বিপথে নিয়ে গেল। কবিতায় কৃষক অভ্যুত্থানকে ‘ভয়ঙ্কর কাণ্ড’, তাঁদের অগ্নিসংযোগকে ‘উৎপাত’, এমনকি কৃষকদের ‘দুষ্ট’ অবধি বলা হয়েছে। কবিতাটি শেষ হচ্ছে এই ভাবে— চিরকালীন শান্তির পথিক গান্ধী ঠিক ভাবেই এই লড়াইয়ের সূচনা করেছিলেন, কিন্তু শেষ অবধি নিষ্ঠুরহৃদয় দাঙ্গাকারীদের এই ভয়ানক পাপ তাঁর মতো মহাত্মার আত্মাকেও বিষণ্ণ করে তুলল। ঘটনার ঠিক পরেই ৯ ফেব্রুয়ারি, ১৯২২
তারিখে উত্তরপ্রদেশের ‘আজ’ পত্রিকায় চৌরিচৌরার ঘটনা নিয়ে সম্পাদকীয় লেখা হয়, যার শিরোনাম— ‘ভীষণ উপদ্রব’।

মোটের উপর সে দিন এই ঘটনাকে মূলধারার জাতীয় আন্দোলনের একটি ব্যতিক্রম হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, যদিও চৌরিচৌরায় যা ঘটেছিল তা ছিল গান্ধীকে সম্পূর্ণ মান্যতা দিয়ে শুরু হওয়া একটি রাজনৈতিক লড়াইয়ের স্বাভাবিক পরিণতি। এটা বোঝা যাবে ঘটনার পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে, ১৯৭২ সালে, সূচনা বিভাগ, লখনউ থেকে প্রকাশিত একটি হিন্দি পুস্তিকায় চৌরিচৌরার ঘটনার বিবরণ পড়লে। পুস্তিকাটির নাম ‘স্বতন্ত্রতা সংগ্রাম কে সৈনিক’ (সংক্ষিপ্ত পরিচিতি)। এই পুস্তিকায় যে অনুপুঙ্খ বিবরণ দেওয়া হয়েছে চৌরিচৌরার ঘটনার, তা শিউরে ওঠার মতো। অসহযোগ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ার পর গোটা উত্তরপ্রদেশে একমাত্র গোরক্ষপুরের কংগ্রেস জেলা কমিটিই একটি সুসংবদ্ধ, সুশৃঙ্খল স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গড়ে তুলেছিল। তাদের নেতৃত্ব এবং নির্দেশ মেনেই চৌরিচৌরার অন্তর্গত মুন্ডেরা বাজারে প্রায় দু’মাস ব্যাপী দেশি মদ ‘তাড়ি’ ও বিদেশি কাপড়ের দোকানের সামনে পিকেটিং চলছিল। এই অবরোধ প্রথম থেকেই হিংস্র বিরোধিতার মুখে পড়ে ব্রিটিশ পুলিশ এবং স্থানীয় জমিদারের বাহিনীর সামনে। কিন্তু এর পরেও তাঁরা তাঁদের পিকেটিং চালিয়ে যেতে থাকেন। সিদ্ধান্ত হয়, ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে তাঁরা মিছিল নিয়ে এগিয়ে যাবেন এবং এই বিশেষ কর্মসূচি পালিত হবে প্রত্যেক শনিবার।

প্রথম দুই শনিবার প্রবল পুলিশি বিরোধিতার সামনেও থমকে যাননি সত্যাগ্রহীরা। অবশেষে তৃতীয় শনিবার আসল ঘটনাটি ঘটে। পুলিশি গুলিচালনায় কয়েকশো সহকর্মীর জখম হওয়া এবং কয়েক জনের মৃত্যু তাঁদের সহ্যের বাঁধ ভেঙে দেয় এবং ওই হিংস্র ঘটনাটি ঘটে। উল্লিখিত পুস্তিকায় বলা হয়, যে প্রবল পুলিশি নিপীড়ন ঘটেছিল তা এক জন সন্ত যোগীর মাথাতেও আগুন জ্বালিয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। কিন্তু এত দিনের অবহেলিত চৌরিচৌরার বিদ্রোহীদের এই পুস্তিকায় স্বাধীনতা সংগ্রামের গৌরবোজ্জ্বল শহিদের তকমা দেওয়া থেকেই স্পষ্ট, কী ভাবে আঞ্চলিক ও নিম্নবর্গের বিদ্রোহও এ বার সরকারি জাতীয়তাবাদী ভাষ্যের অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে।

প্রশ্ন হল, নিম্নবর্গের চৈতন্যের যে আলোড়ন এ রকম একটি বৈপ্লবিক উত্থানের জন্ম দিয়েছিল, কোনও ঐতিহাসিক বয়ানেই কি তার যথার্থ চেহারা ধরা সম্ভব? ইতিহাস তো লেখেন শিক্ষিত এলিটবর্গ, যাঁদের কাছে সমস্ত তথ্যই আসলে নিজেদের দৃষ্টিকোণ থেকে সাজিয়ে নেওয়ার উপাদান। তাই ১৯৩৮ সালে চৌরিচৌরা বিদ্রোহের এক সাধারণ কারাবন্দি সদস্য দ্বারকা গোঁসাই যখন আগরা জেল থেকে আংশিক স্বায়ত্তশাসনের অধিকার পাওয়া কংগ্রেসি নেতাদের চিঠি লেখেন, সেই চিঠি বিস্মিত করে আমাদের। প্রথম চিঠিটি ইংরেজিতে। তাতে চৌরা গ্রামের পুরোহিত দ্বারকা, নিজেদের ‘রাজনৈতিক বন্দি’ হিসেবে গণ্য করার দাবি জানান এবং সমকালীন কাকোরি ষড়যন্ত্র মামলায় ছাড়া-পাওয়া বিপ্লবীদের সঙ্গে নিজেদের তুলনা করে বলেন, পথ অহিংস বা সশস্ত্র যা-ই হোক না কেন, তাঁরা সকলেই দেশমাতৃকার সৈনিক। সকলকে একই চোখে দেখে মুক্তি দেওয়া উচিত সরকার বাহাদুরের। হিন্দিতে লেখা চিঠিতে তিনি তার মতো হতভাগ্য বন্দিদের ছাড়া না হলে আত্মহত্যার হুমকিও দিয়েছিলেন। দ্বারকা
ছাড়া পান ১৯৪৪ সালে, তার আগে তিনি জেল থেকেই মহাত্মার ডাকে ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন। পূর্বে উল্লিখিত পুস্তিকায় দ্বারকা অবশ্য স্বাধীনতা সংগ্রামীর সম্মান পেয়েছেন।

ইতিহাস কোনও একটি বিশেষ মতাদর্শের একক সম্পত্তি নয়। ইতিহাস আসলে লুকিয়ে রয়েছে দ্বারকা গোঁসাই-এর মতো হাজার হাজার অতিসাধারণ মানুষের মননে, চেতনায় যে সময়প্রবাহ বয়ে চলে, তার ইশারায়। এই বিদ্রোহ ওই অঞ্চলের মানুষের স্মৃতিতে কী ভাবে বেঁচে আছে, সে সম্পর্কে গভীর অনুসন্ধানের মধ্য দিয়েই জানা যেতে পারে একশো বছর আগের ইতিহাস।

তথ্যঋণ: ইভেন্ট, মেটাফর, মেমোরি, চৌরিচৌরা ১৯২২-১৯৯২, শাহিদ আমিন; গান্ধী যখন মহাত্মা, শাহিদ আমিন; নিম্নবর্গের ইতিহাস, সম্পাদনা: গৌতম ভদ্র ও পার্থ চট্টোপাধ্যায়; আধুনিক ভারতের ইতিহাস, বিপান চন্দ্র

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement