সহোদর: বড়দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ (ডান দিকে)
বিভিন্ন ও বিচিত্র বিষয়ের প্রতি আগ্রহ জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির একটি চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিশেষ আগ্রহ ছিল জ্যোতির্বিজ্ঞান ও ভূতত্ত্ব চর্চায়। মহর্ষির পুত্রদের মধ্যে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ চর্চা করতেন ফ্রেনোলজি বা শিরোমিতিবিদ্যা। চিকিৎসাবিদ্যায় আগ্রহী হেমেন্দ্রনাথ কিছু দিন মেডিক্যাল কলেজে পড়াশোনা করেন। বীরেন্দ্রনাথ পছন্দ করতেন নিভৃতে গণিত চর্চা। সোমেন্দ্রনাথের ঝোঁক ছিল দর্শনে। দেবেন্দ্রনাথের ভূবিজ্ঞান বা জ্যোতির্বিদ্যার আগ্রহ প্রবাহিত হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের ন-দিদি স্বর্ণকুমারী দেবীর মধ্যে। বাড়িতে ব্রাহ্মধর্ম চর্চার পরিমণ্ডলে বড় হয়েও সত্যেন্দ্রনাথ আকৃষ্ট হয়েছিলেন বৌদ্ধ ধর্মে। রবীন্দ্রনাথ যেমন হোমিয়োপ্যাথি চর্চা করতে ভালবাসতেন, সে রকম তাঁর এক সময় বিশেষ আগ্রহ তৈরি হয়েছিল প্ল্যানচেটে। আর দেবেন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠ পুত্র দ্বিজেন্দ্রনাথের আগ্রহ ছিল আরও বিচিত্র ও বহুমাত্রিক। দর্শন ও সাহিত্য ছাড়াও জ্যামিতি ও বাক্সমিতি বা বক্সোমেট্রি-তে ছিল তাঁর বিশেষ দক্ষতা। পশুপাখির প্রতি ছিল গভীর প্রেম ও মমত্ববোধ। এ প্রসঙ্গে আরও উল্লেখ্য, বাংলায় শর্টহ্যান্ড বর্ণমালার অন্যতম উদ্ভাবক তিনিই। ব্রহ্মসঙ্গীতের স্বরলিপি প্রবর্তনও দ্বিজেন্দ্রনাথের হাত ধরেই। বিচিত্র প্রতিভাসম্পন্ন এই মানুষটির জন্মদিন ১৮৪০ সালের ১১ মার্চ। তাঁর পরের ভাই সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে তাঁর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠতা ছিল।
দ্বিজেন্দ্রনাথের এই অদ্ভুত বিষয়ের প্রতি আগ্রহ সম্বন্ধে প্রথমেই যে ভাবনাটা মনে আসে তা হল, কী ভাবে বাক্সমিতির মতো প্রায় অপ্রচলিত, অচর্চিত বিষয়ে তিনি এ ভাবে আত্মমগ্ন হয়ে পড়লেন! দ্বিজেন্দ্রনাথের ছোটবেলার দিকে তাকালে এই প্রশ্নের প্রচ্ছন্ন উত্তর আমরা পেতে পারি। সেন্ট পল’স স্কুল বা হিন্দু কলেজের প্রথাগত বিদ্যাচর্চা দ্বিজেন্দ্রনাথের মনে ধরেনি। তাই প্রিয় বিষয় অঙ্ক হলেও বাঁধা গতে অঙ্কের অনুশীলন দ্বিজেন্দ্রনাথ প্রত্যাখ্যানই করেছিলেন। তবে গণিতের বিশেষ শাখার প্রতি ঝোঁক কিন্তু সেই সময় থেকেই। “অঙ্ক আমার ভালো লাগিত। কিন্তু ক্লাসের বাঁধা ধরা নিয়মের মধ্যে অঙ্ক কষা ও গণিতশাস্ত্রের অধ্যয়ন করা আমার পক্ষে অসম্ভব। আমার ভালো লাগিত ট্রিগনোমেট্রি ও মেনসুরেশন; বাড়িতে ইচ্ছে মতো আমি তাহাই আলোচনা করিতাম।”
পরবর্তী কালে অবসর যাপনের সময় গণিতের অনুশীলন এবং বাক্স নিয়ে খেলা থেকে মেতে উঠলেন বাক্সমিতি নিয়ে— “আঠা নাই, সুতা নাই, কাগজে কাগজে/ জোড়া লাগি গেল দেখ কেমন সহজে।” আঠা বা সুতো ব্যবহার না করে স্রেফ কাগজকে বিভিন্ন কৌশলে ভাঁজ করে বানাতেন বিভিন্ন খাপ, ব্যাগ, কলম-পেনসিল রাখার বিভিন্ন ধরনের পেটিকা। যাদের বিশেষ স্নেহ করতেন তাদের হাতে তুলে দিতেন এই সব অদ্ভুত উপহার। চিঠি পাঠানোর সময়েও খাম ব্যবহার না করে লিখিত পত্রটিকে বিভিন্ন উপায়ে ভাঁজ করে একটি সুন্দর আকার দিয়ে পাঠিয়ে দিতেন। রবীন্দ্রনাথের কথায় তাঁর এই বড় দাদা “কিঞ্চিৎ বিশ্রামের প্রয়োজন হইলে তিনি উচ্চাঙ্গের গণিতের অনুশীলন করিতেন।... একান্ত বিশ্রাম করিতে চাহিলে তিনি সুতা বা আঠার সাহায্য না লইয়া বিচিত্র কৌশলে কেবল ভাঁজিয়া ভাঁজিয়া কাগজের নানা-রকম খাতা, খাপ, ব্যাগ, পেটিকা প্রভৃতি তৈয়ার করিতেন।” তাঁর শর্টহ্যান্ড বর্ণমালা উদ্ভাবন এই অবসরকালীন প্রচেষ্টারই ফসল। তবে এই বিচিত্র ও বিভিন্ন ধরনের বাক্সের গড়নের পিছনে ছিল নিখুঁত গাণিতিক ফর্মুলা। স্বহস্তে লেখা পাণ্ডুলিপিতে সেই গাণিতিক কৌশলের সূত্র ও প্রয়োগকৌশল বিশদে লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন তিনি।
বাক্সমিতির উপর দ্বিজেন্দ্রনাথ রচনা করেন চারটি বৃহৎ পাণ্ডুলিপি। প্রথম দু’টি পাণ্ডুলিপি মলাটবিহীন অবস্থায় উদ্ধার হওয়ায় কোনও মুখবন্ধ পাওয়া যায়নি। কিন্তু শেষ দু’টি পাণ্ডুলিপির ক্ষেত্রে তা হয়নি। সেখানে তিনি তাঁর মৌলিক উদ্ভাবন সম্পর্কে যেমন স্থির দিক নির্দেশ করেছেন, তেমনই অঙ্কের বিভিন্ন দুরূহ সঙ্কেত ব্যবহারের কথা স্বীকার করলেও প্রকৃত রস্বাসাদনের জন্য একটু ধৈর্য ও নিষ্ঠার দাবি রেখেছেন। তাঁর ভাবনা প্রকৃতপক্ষেই অভিনব। পাণ্ডুলিপিতে যে তিনটি পর্ব বিভাজন আছে সেখানে প্রথম পর্বে চিহ্নগুলিকে আটটি পর্যায়ে বিভক্ত করেছেন। পর্যায়কে চিহ্নের পূর্বে যুক্তিপূর্ণ ভাবে স্থাপন করেছেন। দ্বিতীয় পর্বে রেখেছেন ১৬টি প্রতিজ্ঞা বা প্রোপোজ়িশন এবং প্রত্যেকটিকে উদাহরণ-সহ গাণিতিক ভাবে প্রমাণ করেছেন। তাঁর উদ্ভাবিত বিভিন্ন প্রতীকের গাণিতিক মান পূর্বে নির্ধারিত করে তবেই প্রয়োগকৌশলে সচেষ্ট হয়েছেন। সংজ্ঞা নিরূপণের ক্ষেত্রেও তিনি মৌলিক গাণিতিক ভাবনাকে যুক্তিপূর্ণ ভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। যেমন, ‘রেখা’-কে বলেছেন ‘প্রস্থবিহীন দৈর্ঘ্য’। ‘বিন্দু’-র সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে গিয়ে বলেছেন “যাহার স্থান মাত্র আছে কিন্তু আয়তন নাই, তাহাকেই বিন্দু কহে।” পরে পরিবর্ধিত আকারে বলেছেন “যে জড় বস্তুর আয়তন এত অল্প যে তদপেক্ষা অল্পায়ত্ত বস্তু ইন্দ্রিয় মনের গ্রহণযোগ্য নহে তাহাকে বিন্দু কহে।” এখানে ‘মনের’ শব্দটি নিশ্চয়ই আমাদের বাড়তি দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। প্লেটো বলেছিলেন, “অঙ্ক হইল আত্মার ঔষধ।” ‘আত্মা’ আর ‘মন’ শব্দ দু’টিকে অঙ্কের পাশাপাশি স্থান দিলে গণিতশাস্ত্র দর্শনে উন্নীত হয়। দ্বিজেন্দ্রনাথ এক জন প্রকৃত দার্শনিক ছিলেন বলেই উপলব্ধির এই স্তরে পৌঁছতে পেরেছিলেন। তিনি দু’টি দার্শনিক সংগঠন ‘দ্য ন্যাশনাল সোসাইটি’ এবং ‘বিদ্বজ্জন সমাগম’-এর সঙ্গে নিবিড় ভাবে যুক্ত ছিলেন। গীতার আধ্যাত্মিক দর্শনের প্রতিও তাঁর গভীর আগ্রহ ছিল।
দর্শন বিষয়ে তিনি তিন খণ্ডে একটি বই লিখেছিলেন, নাম ‘তত্ত্ববিদ্যা’। বাংলায় লেখা দর্শনশাস্ত্রের বই হিসেবে এটি ঐতিহাসিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর আরও দু’টি বিশেষ উল্লেখযোগ্য দর্শনগ্রন্থ হল ‘অদ্বৈত মতের সমালোচনা’ এবং ‘আর্যধর্ম ও বৌদ্ধধর্মের ঘাত-প্রতিঘাত’।
গণিতে দ্বিজেন্দ্রনাথের দখল সম্বন্ধে খ্যাতি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর তখন প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র। গণিতের দুঁদে অধ্যাপক রেস সাহেব ছিলেন বেশ নাকউঁচু। কোনও কঠিন সমাধান করে বলতেন এই সমাধান তাঁর উপরওয়ালা, অর্থাৎ প্রিন্সিপালও পারবেন না। এই রেস সাহেবই দ্বিজেন্দ্রনাথের জ্যামিতির বইটা উল্টেপাল্টে বলেছিলেন, “দ্য ম্যান হ্যাজ় ব্রেন।” রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর বড়দার গণিতে ব্যুৎপত্তি বিষয়ে অবহিত ও শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। বিদেশে এর স্বীকৃতির ব্যাপারেও সচেষ্ট হয়েছিলেন। বন্ধুবর বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুকে সেই পাণ্ডুলিপি বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ একটি চিঠিতে লিখেছেন, “বড় দাদা তাঁহার পাণ্ডুলিপি তোমাকে পাঠাইবার জন্য আমার হস্তে দিয়াছেন। কোনো গণিতওয়ালাকে দিয়া একবার যাচাই করিয়া লইতে চান— নিরুৎসাহজনক কথা হইলে বলিতে কুণ্ঠিত হইও না। তাঁহার মতে, ইহা কিছু জটিল ও বাহুল্যময় হইয়া থাকিতে পারে, কিন্তু ধৈর্য ধরিয়া দেখিলে ইহার মধ্যে নূতন পদার্থ অসম্ভব নহে।” জগদীশচন্দ্র সেই পাণ্ডুলিপি বিদেশের বিদগ্ধ মহলে পাঠিয়ে তাঁদের মতামত সম্বন্ধে কবিকে জানিয়েছিলেন : “তোমার দাদার পুস্তক এখানকার এক ম্যাথমেটিক্যাল সোসাইটি-কে দেখিতে দিয়াছিলাম। তিনি বিশেষ যত্ন করিয়া দেখিয়াছেন। তিনি ইনজেনুইটি-এর (বুদ্ধিমত্তার) বিশেষ প্রশংসা করিয়াছিলেন। তবে নূতন নোটেশন বলিয়া আপত্তি করিয়াছেন। তাঁহার চিঠি পাঠাই। এখানে কনজ়ারভেশন সব দিকেই বেশি। যদি একজন অনেককাল ধরিয়া নূতন সংজ্ঞা প্রচলিত করিতে না পারেন, তবে তাহা সর্বসাধারণে দেখিতে চাহে না। আমার বিবেচনায় যদি তোমার দাদা পুস্তকের লিথো কপি করিয়া বিভিন্ন লাইব্রেরিতে পাঠান তাহা হইলে ভালো হয়।” এমনকি সত্যেন্দ্রনাথ বিদেশে বসবাসকালে জনৈক আমেরিকান গণিতজ্ঞের কাছে দ্বিজেন্দ্রনাথের পাণ্ডুলিপি পাঠিয়েছিলেন।
বাংলা সাহিত্যে দ্বিজেন্দ্রনাথের প্রথম অবদান ছিল ধ্রুপদী সংস্কৃত ভাষায় রচিত কালিদাসের ‘মেঘদূত’ কাব্যের বঙ্গানুবাদ। ১৮৬০ সালে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মের ঠিক এক বছর আগে, এই গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছিল। তখন দ্বিজেন্দ্রনাথের বয়স ছিল মাত্র কুড়ি বছর। এই অনুবাদটিই ‘মেঘদূত’-এর প্রথম বাংলা অনুবাদ। দ্বিজেন্দ্রনাথ এই গ্রন্থ অনুবাদকালে দু’টি আলাদা ছন্দশৈলী ব্যবহার করেছিলেন। দ্বিজেন্দ্রনাথের দ্বিতীয় উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ ‘স্বপ্নপ্রয়াণ’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৭৫ সালে। এই গ্রন্থ প্রকাশকালে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন কিশোর বয়সি। এক যুবকের ভ্রমণকাহিনি নিয়ে রচিত হয়েছিল এই কাব্য। এই গ্রন্থে বিভিন্ন ছন্দশৈলী এবং তার প্রয়োগ নিয়ে দ্বিজেন্দ্রনাথের নানা পরীক্ষানিরীক্ষা মানুষজনকে বিস্মিত করেছিল।
দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন কাব্যচর্চায় পরিচিতি শুরু করেন, তখন মাইকেল মধুসূদন দত্ত খ্যাতির মধ্যগগনে। ১৮৫৬ সালে মাদ্রাজ থেকে কলকাতায় প্রত্যাবর্তন করার পর থেকে ইউরোপ যাত্রার আগে পর্যন্ত ছ’বছর মাইকেল মধুসূদন লিখেছেন ‘তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য’, ‘পদ্মাবতী’, ‘মেঘনাদবধ কাব্য’, ‘ব্রজাঙ্গনা কাব্য’, ‘কৃষ্ণকুমারী’, ‘বীরাঙ্গনা কাব্য’ ইত্যাদি কাব্য ও নাটক। সেই যুগে বাংলার প্রায় সব কবিই অল্পবিস্তর মধুসূদন দ্বারা প্রভাবিত হলেও, দ্বিজেন্দ্রনাথ ছিলেন স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। বরং কবি মধুসূদনই দ্বিজেন্দ্রনাথকে ‘ভবিষ্যতের কবি’ হিসেবে অভিহিত করে অকুণ্ঠ প্রশংসা করেছিলেন।
১৮৮৪ সাল থেকে টানা ২৫ বছর সময় ধরে তিনিই সম্পাদনা করেছিলেন ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকা। ‘হিতবাদী’ পত্রিকার প্রচলনও তাঁর হাতেই। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ প্রবর্তিত ‘ভারতী’ পত্রিকাও তিনি সম্পাদনা করেছেন দীর্ঘ দিন। বাংলা সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য ১৮৯৭ থেকে ১৯০০ সাল পর্যন্ত টানা তিন বছর তিনি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন।
গণিতশাস্ত্রেও দ্বিজেন্দ্রনাথের হাত ধরে সাহিত্যের অঙ্গীকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বাক্সমিতির গণিতচর্চায় মগ্ন দ্বিজেন্দ্রনাথ রাজনারায়ণ বসুকে লেখা এক চিঠিতে সেই অভিনব প্রণয়ন প্রকল্প বিষয়ে অবহিত করেছেন, “আমি এত ব্যস্ত যে আপনাকে পত্র দিব তাহা আর হইয়া উঠিল না।... আপনাকে বলি— কাগজের বাক্স বিরচনায় একটি শাস্ত্র প্রণয়ন করিতেছি পদ্যে। ‘রেখা-মুখা ধার দুটি মুড়িবে প্রথমে। / অবশিষ্ট দুটি ধার পরে যথাক্রমে॥/ সেজোর দুইটি ধার, ছোটো-বড়ো ভাগে/ কাটা আছে দেখিবে ত্যাড়চা এক দাগে॥/ ছোটো অংশখানি তার তৃতীয়াংশ করি পিঠাপিঠি, / দুই পার্শ্ব মোড়ো, যেন, মুড়িতেছ চিঠি॥/ কোণাকুণি-রেখার কর্তন-বিন্দু-`পরে, / অবশিষ্ট পার্শ্ব দুটি মোড়ো অকাতরে॥’”
এই ছড়ার ছন্দেই দ্বিজেন্দ্রনাথ তাঁর পশুপাখি প্রেমের কথা বলেছেন। শান্তিনিকেতনের নিচু বাংলোয় ভোর হওয়া মানেই আশ্রমবাসীরা দেখেছেন বনের যত কাক, শালিক, চড়ুই, কাঠবিড়ালি এমনকি ইঁদুরও তাঁকে নিয়ে আনন্দে মেতে উঠেছে। কাঠবিড়ালিরা নির্ভয়ে যেমন তাঁর গায়ে-হাতের উপর মনের আনন্দে ঘুরতে ফিরতে ছাতুর বড়ি মুখে তুলে নিয়েছে, সে রকম শালিক-শাবক গায়ে, মাথায় চড়ে যথেচ্ছ স্বাধীনতা উপভোগ করেছে। এক বার এক শালিক-শাবক মাত্রাতিরিক্ত আশকারা পেয়ে চোখে ঠোকর দিয়েছিল। চোখ ফুলে লাল হয়ে গিয়ে সেই যন্ত্রণায় বেশ কিছু দিন কাহিল হলেও প্রশ্রয়ে বিন্দুমাত্র খামতি হয়নি। ছড়ায় এ সমস্তই ছন্দবদ্ধ আছে— “আয় আয় কাক, ছাড়ি কা- কা ডাক,/ তোরে বড়ো বেশি ডাকতে হয় না॥ / তুই রে শালিক, বড়ো বে-রসিক, / খাবার দেখলে সবুর সয় না॥ / কাঠবেড়ালী কোথা পালালি, / আয় আয় আয় দৌড়ে আয়। / বড়ো তুই বোকা ! ছাতু খাবি তো খা! / কথা বুঝিস নে - এ বড়ো দায়॥ /শাবাশ শূর তুই কুকুর! / ভয়ে এগোয় না চোর ডাকাত।”
সত্যেন্দ্রনাথ তাঁর দাদার এই আশ্চর্য ক্ষমতার কথা বলেছেন। ভোরে দ্বিজেন্দ্রনাথ তাঁর এজলাসে বসলেই নাকি কোথা থেকে বনের চড়াই, শালিক, কাক, কাঠবিড়ালি, ইঁদুর ইত্যাদি বনের সমস্ত পশু-পাখি তাদের দাবি-দাওয়া নিয়ে সেখানে উপস্থিত হত। দ্বিজেন্দ্রনাথ তখন আদুরে গলায় ওদের ডাকছেন আর ওরা তাঁর গায়ে-মাথায়-হাতে প্রেমের পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে। সে এক ভারী আশ্চর্য দৃশ্য। গভীর, নির্মল, নিখাদ জীবনবোধ ছাড়া জীবনকে প্রকৃতির হাতে এ ভাবে সমর্পণ করা যায় না।
১৮৬৬ সাল থেকে ১৮৭১ সাল পর্যন্ত তিনি আদি ব্রাহ্মসমাজের আচার্যের পদ অলঙ্কৃত করেছিলেন। ঢাকায় ব্রজসুন্দর মিত্রের তত্ত্বাবধানে যখন ‘ঢাকা ব্রাহ্মসমাজ’ প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন তাঁর উদ্বোধন অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছিলেন মহর্ষি। সঙ্গে নিয়েছিলেন তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র দ্বিজেন্দ্রনাথকে। শুধু ব্রাহ্ম সমাজ নয়, ‘হিন্দু মেলা’র সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন দ্বিজেন্দ্রনাথ। ‘হিন্দু মেলা’র জনপ্রিয় দেশাত্মবোধক গান ‘মলিন মুখচন্দ্রমা ভারত তোমারি’ দ্বিজেন্দ্রনাথেরই লেখা। তাঁর রচিত ব্রহ্মসঙ্গীতগুলিও ব্রাহ্ম প্রার্থনাসভায় গাওয়া হয়। বিশেষ করে তাঁর লেখা ‘করো তাঁর নাম গান/ যত দিন রহে দেহে প্রাণ’ গানটি বহু বছর ধরে ৭ পৌষের প্রার্থনাসভায় গাওয়া হয়ে এসেছে।
দার্শনিক, গণিতজ্ঞ, সাহিত্যপ্রেমী, পশু-পাখিপ্রেমী মানুষটিকে নিয়ে এক কথায় কিছু বলা বেশ কঠিন। আবার শর্টহ্যান্ড লিপি ও স্বরলিপি উদ্ভাবনেও তিনি সৃষ্টিশীলতার ছাপ রেখে গেছেন। রবি বড়দাদার মধ্যে আবিষ্কার করেছেন সদা সৃষ্টিশীল এক বালককে। যিনি সামান্য উপকরণ নিয়ে খেলতে খেলতে সব অসামান্য কাণ্ড ঘটিয়েছেন। “শব্দ ও অর্থের রহস্য ভেদের আশ্চর্য অধ্যবসায়ে তিনি ছিলেন প্রবীণ, অন্যদিকে তিনি ছিলেন বালক, সামান্য উপকরণে অনাবশ্যক শিল্পনৈপুণ্য উদ্ভাবনায়।”
দ্বিজেন্দ্রনাথের যখন ৩৮ বছর বয়স, তখন তাঁর স্ত্রী সর্বসুন্দরী দেবী মারা যান। তিনি বাকি জীবন সন্ন্যাসীর মতোই কাটিয়েছিলেন। তাঁদের ন’টি সন্তানের মধ্যে দু’জন জন্মের পর পরই মারা যায়, বেঁচেছিলেন পাঁচ পুত্র এবং দুই কন্যা। এঁদের মধ্যে দ্বিপেন্দ্রনাথের পুত্র দিনেন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সমস্ত গানের স্বরলিপি করে সুর তুলে রাখতেন বলে, তাঁকে কবি তাঁর সকল গানের ‘ভাণ্ডারী’ বলে উল্লেখ করেছিলেন।
শেষ ২০ বছর শান্তিনিকেতনেই কাটান দ্বিজেন্দ্রনাথ। কবি তাঁকে ‘বড়দাদা’ বলে সম্বোধন করতেন। দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ফেরার পথে মহাত্মা গান্ধী এবং চার্লস অ্যান্ড্রুজ় যখন শান্তিনিকেতনে আসেন, কবির দেখাদেখি তাঁরাও দ্বিজেন্দ্রনাথকে ‘বড়দাদা’ বলেই সম্বোধন করতেন। দ্বিজেন্দ্রনাথের একটি চিঠির সঙ্কলনের ভূমিকায় মহাত্মা তাঁর সম্বন্ধে লিখেছিলেন, “ইউ নো দ্বিজেন্দ্রনাথ। হি ওয়াজ় দ্য এল্ডেস্ট ব্রাদার অব শ্রীরবীন্দ্রনাথ টেগোর অ্যান্ড হি লিভ্ড লাইফ অব আ মঙ্ক প্র্যাকটিকালি লাইক হিজ় ফাদার দেবেন্দ্রনাথ টেগোর।”
১৯২৬ সালের ১৯ জানুয়ারি শান্তিনিকেতনে দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রয়াত হন।
তথ্যঋণ: ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল/ চিত্রা দেব; ঠাকুরবাড়ির বাহিরমহল/ চিত্রা দেব; দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাক্সমিতি/ অরূপরতন ভট্টাচার্য; রবীন্দ্র-প্রসঙ্গ/ হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়; রবীন্দ্রবলয়/ করুণাময় মুখোপাধ্যায়