ছবি: কুনাল বর্মণ।
অভূতপূর্ব এক দৃশ্যের জন্ম হল গঙ্গার ঘাটে। দিকচক্রবাল জুড়ে সূর্যদেব ভাস্বর হয়ে উঠেছেন কিছু ক্ষণ মাত্র হল। উদ্ভাসিত সেই আলোর রং সর্বাঙ্গে মেখে শ্বেতাঙ্গ এক দীর্ঘদেহী সাহেব বাঁধানো ঘাটের সিঁড়ি বেয়ে নেমে যাচ্ছেন গঙ্গাবক্ষের দিকে। নগ্নপদ, পরনে কাছা দিয়ে পরা ধুতি, ঊর্ধ্বাঙ্গে আজানুলম্বিত উত্তরীয়, বুকে পরম যত্নে আঁকড়ে ধরা কষ্টিপাথরের তৈরি, গাঢ় কৃষ্ণ বর্ণের বালগোপাল। মেদহীন সুঠাম চেহারার গোরা সাহেবটি নেমে গেলেন পুণ্যসলিলার জলে, মূর্তি হাতে নিয়েই ডুব দিলেন, স্নান করালেন উপাস্য দেবমূর্তিকে, অবগাহন করলেন নিজেও। কপালে এঁকে নিলেন শ্বেতচন্দনের তিলক, তার পর আপাদমস্তক ওই ভিজে পোশাকেই উঠে আসতে শুরু করলেন সিঁড়ি ভেঙে। চোখে-মুখে প্রস্ফুটিত ভক্তিভাব, প্রশস্ত বুকের উপর ধরা সদ্যস্নাত গোপালবিগ্রহ দেখে ঘাটে উপস্থিত যে সব লোক দু’হাত জোড় করে প্রণাম করছেন, সাহেব তাদের প্রায় স্পষ্ট হিন্দুস্থানি উচ্চারণে বলছেন ‘জয় সীতারামজি’। দেখেশুনে আঠেরো শতকের শেষের দিকের সেই কলকাতার ঘাট-বাজার-রাস্তার লোকজনের তো চক্ষু চড়কগাছ। এ কী দেখছেন তাঁরা, দিবাস্বপ্ন নয় তো!
আশপাশে গুঞ্জন— কে এই লোকটা? যাঁরা কৌতূহলাক্রান্ত হয়ে অনুসরণ করলেন, তাঁরা দেখলেন সাহেব ধুলোভরা সারা পথ হেঁটে গিয়ে উঠলেন উড স্ট্রিট আর থিয়েটার রোডের ঠিক মাঝামাঝি বড়সড় একটা বাড়িতে। জানা গেল, ওই বাড়িতেই বাস করেন সাহেব। তিনি ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ফার্স্ট বেঙ্গল ইউরোপিয়ান রেজিমেন্টের কোয়ার্টার মাস্টার। লোকটার রকমসকম দেখে তো তাঁরা তাজ্জব, সাহেব নাকি ভীষণ কৃষ্ণভক্ত, সকাল-সন্ধে পুজোপাঠ না করে জলগ্রহণ করেন না, বেদ-উপনিষদ-পুরাণ-মহাকাব্য-সহ সব রকমের হিন্দুধর্ম সম্বন্ধীয় শাস্ত্রপুঁথি নাকি তাঁর নখদর্পণে। সাহবের এই বাড়িটিও নাকি ঠাসা নানা রকম হিন্দু দেবদেবীর মূর্তি আর হাজার রকম ভারতীয় প্রত্নসামগ্রীতে। সাহেবের নাম যদিও চার্লস স্টুয়ার্ট, কিন্তু তাঁকে তাঁর দেশীয় নাক-উঁচু সাহেবসুবোর দল কিছুটা যেন ব্যঙ্গ করেই ডাকে ‘হিন্দু স্টুয়ার্ট’।
কৃষ্ণপ্রেমে মাতোয়ারা হয়ে সৈয়দ আলাওল, সৈয়দ মুর্তজা, কবি মুসা, কমর আলি প্রমুখ বহু মুসলমান কবি কাব্য লিখেছেন। কালীপ্রেমে আপ্লুত হয়ে নওয়াজিস খান, আলি রজা, আকবর আলি, মির্জা হুসেন আলি আরও কত জনেই তো শ্যামাসঙ্গীত লিখেছেন। কিন্তু একেবারে বিশুদ্ধ গোরা সাহেবের হিন্দু দেবতা ভজনার কথা আগে কখনও শোনেনি সমসাময়িক নেটিভ জনগণ, দেখেনি ভারতীয় দেবদেবী নিয়ে কোনও ফিরিঙ্গি খ্রিস্টানের এত উৎসাহ। তাই ভারতীয়দের কাছে স্টুয়ার্টের এই সব কাণ্ডকারখানা যথেষ্ট সমীহযোগ্য হলেও তাঁর দেশোয়ালি বেরাদর আর সিস্টার, বিশেষ করে উচ্চপদস্থ আর্মি অফিসার ও শাসকবর্গের কাছে ব্যাপারটা হয়ে উঠল নিতান্তই অস্বস্তিকর। মাথা খারাপ হল না কি লোকটার! জাতে যদিও আইরিশ, পদে সাধারণ ক্যাডেট হলে কী হবে, নেহাতই বাপে খেদানো মায়ে তাড়ানো গোছের মানুষ তো নয় সে! বাবা আয়ারল্যান্ডের লিমেরিক শহরের সম্মানীয় এমপি, দাদুও তাই। সে নিয়ে কিছুটা আত্মাভিমান তো থাকবে! উন্নততর নরগোষ্ঠীর প্রতিনিধি, সাদা চামড়ার লোক হওয়ার জন্য কিছুটা বাড়তি মান-মর্যাদাবোধ না থাকলে চলবে কী করে! সে সবের বালাই নেই, কেমন বেহায়ায় মতো নেটিভদের সমতলে নেমে এসে সমানে সমানে মিশছে! নিজেকে এক জন ধর্মান্তরিত হিন্দু বলে পরিচয় দিচ্ছে, খবরের কাগজে হিন্দুধর্ম, দর্শন, নীতি-নৈতিকতার স্তুতি করে বেড়াচ্ছে, প্যামফ্লেটে লম্বা লম্বা প্রবন্ধ লিখছে খ্রিস্টান যাজকদের গণধর্মান্তরণের বিরুদ্ধে। লিখছে হিন্দু পৌত্তলিকতা, বিভিন্ন আচার-বিচার-সংস্কারের সমর্থনে। বলছে হিন্দু সভ্যতা উৎকর্ষ ও পরম্পরাগত ভাবে এতটাই নাকি স্বয়ংসম্পূর্ণ আর সমৃদ্ধ যে, তার খ্রিস্টধর্মের অভিভাবকত্ব বা পথপ্রদর্শনের কোনও প্রয়োজন নেই।
গর্বোদ্ধত উপনিবেশবাদী সাহেব-সম্প্রদায়ের কাছে সে তখন এক আজব চিড়িয়া। কলকাতার সব নামী খবরের কাগজ অকপটে লিখছে, এই রকম উষ্ণ ক্রান্তীয় দেশের পক্ষে নেটিভদের পোশাক-আশাক কত বেশি উপযোগী, বিশেষ করে প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠছে হিন্দু নারীর শাড়ি পরার বিষয়টি নিয়ে। এমনকি এও বলছে মহিলাদের পক্ষে শাড়ির চেয়ে দৃষ্টিনন্দন, আকর্ষক ও যৌন আবেদনময় পোশাক নাকি আর হতে পারে না, পরিচ্ছদ হিসেবে এটি ইউরোপীয় মহিলাদের হাল-ফ্যাশনের পোশাকের চেয়ে অনেক সুন্দর, ইউরোপীয় মহিলাদেরও শাড়ি পরা উচিত। ভারতীয় নারীদের সৌন্দর্যের বিষয়ে সে নাকি এমনই অনুরক্ত যে পষ্টাপষ্টি লিখছে, বেশির ভাগ হিন্দু মহিলা উচ্চতায় কিছুটা খাটো বটে, কিন্তু রূপের দিক থেকে ইউরোপীয় নারীদের তুলনায় অনেক বেশি রূপসী ও ইন্দ্রিয়সংবেদ্য। গড়ন বা আকৃতির দিক থেকে তাঁদের দেহবল্লরি অতি অনুপম। অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কমনীয় বাঁক-বিভঙ্গ, চোখের নিবিড় কটাক্ষে পাশ্চাত্যের সেরা সুন্দরীদের চেয়ে তাঁরা কোনও অংশে কম নন। ইউরোপীয় মহিলাদের ওই রকম ফ্যাকাশে রক্তাল্পতা ধরনের ফর্সা গায়ের রঙের চেয়ে এই সব হিন্দু মেয়ের উজ্জ্বল তাম্রবর্ণ মুখশোভা অনেক বেশি চিত্তাকর্ষক।
এই সব দেখে-পড়ে বিরক্ত হল মিশনারিরা, বিরোধিতা এল ক্ষমতাশালী সাহেবদের দিক থেকে। বিধর্মী, পেগান কত কিছুই না বলা হল, কিন্তু কিছুতেই দমানো গেল না স্টুয়ার্টকে। তিনি আগের মতোই চালিয়ে যেতে লাগলেন তাঁর হিন্দু জীবনযাপন। রাজপুতদের মতো চিবুক অবধি নেমে আসা গোঁফ রাখলেন, পরনে চিরাচরিত হিন্দুস্থানি পোশাক, পায়ে নাগরা জুতো, মাথায় পাগড়ি, হাতে পানের পিকদানি, হুঁকো। খাওয়াদাওয়ায় ব্যবহার করলেন এ দেশীয় বাসনকোসন— ছোট-বড় নানা রকম পানপাত্র, মোগলদেশীয় জলপাত্র। বিবাহিত হয়েও প্রেমে পড়লেন এক ভারতীয় নারীর, কাজের ফাঁকে সারা ভারত জুড়ে বেড়ালেন সেই ভারতীয় স্ত্রীকে নিয়ে। এক দল ব্রাহ্মণ নিযুক্ত করলেন গৃহস্থালির সনাতনী রীতি-রেওয়াজ ছাড়াও হিন্দু খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে বিশুদ্ধতা রক্ষার জন্য।
সাহেবসুবোরা হিন্দু স্টুয়ার্টের প্রতি যে মনোভাবই পোষণ করুক, কখনও ব্যক্তিস্বাধীনতায় হাত দেয়নি। স্টুয়ার্ট কাজকর্মে মনোযোগী ছিলেন, তাই পদোন্নতিও আটকায়নি, শেষ পর্যন্ত তিনি উন্নীত হয়েছিলেন মেজর জেনারেল পদে। তিনি যখন উত্তর ভারতের অন্যতম বৃহত্তম এক রেজিমেন্টের কম্যান্ডার হিসেবে কর্মরত, তখন তাঁর অধীনে যোগ দেন উইলিয়াম লিনিয়াস গার্ডেনার নামে এক সাহেব। তাঁর বিবরণ থেকে জানা যায়, এক বার স্টুয়ার্ট তাঁর অশ্বারোহী বাহিনীর ডিউটি থেকে ছুটি নিয়ে কুম্ভমেলায় পুণ্যস্নানে গিয়েছিলেন। সেখানে ওই বিপুল জনসমুদ্রের মধ্যে গার্ডেনার তাঁকে খুঁজে পান দশ-বারো জন নগ্ন নাগা-সন্ন্যাসীদের মধ্যে। সাধুরা সম্মিলিত ভাবে তাঁর মাথায় হাত দিয়ে নাকি তাঁকে আশীর্বাদ করছিলেন। স্টুয়ার্ট নাকি গঙ্গার ধারে একটি মন্দির তৈরি করতে চেয়েছিলেন, সে ইচ্ছে বাস্তবায়িত হয়নি। তবে গঙ্গাসাগর দ্বীপে তিনি এক মন্দিরও স্থাপন করেছিলেন।
গার্ডেনার তাঁকে ‘জেনারেল পণ্ডিত’ বা ‘পণ্ডিত স্টুয়ার্ট’ বলে উল্লেখ করতেন, তার প্রধান কারণ ভারতীয় ধর্মশাস্ত্র, ইতিহাস, পুরাণ, প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ে স্টুয়ার্টের প্রগাঢ় আগ্রহ, জ্ঞান ও পাঠচর্চা। সেনাবাহিনীতে চাকরি করতে করতেই তিনি নিযুক্ত হয়েছিলেন ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের ফার্সি ভাষার অধ্যাপক হিসেবে। যে সময় তিনি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে ভারতে প্রশাসক হয়ে আসা ইংরেজদের উর্দু ফার্সি পড়াচ্ছেন, তখন সহকর্মী হিসাবে পেয়েছেন জন গিলক্রিস্ট, উইলিয়াম কেরি, মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার, ম্যাথু লাম্সডেন প্রমুখ দিকপালদের। ইংল্যান্ডে গিয়েও অধ্যাপনা করেছেন ইস্ট ইন্ডিয়া কলেজে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভাষাসমূহের অধ্যাপক হিসেবে। শেষ জীবনে তিনি ভারতে ফিরে আসেন ও এখানেই তাঁর প্রয়াণ ঘটে।
যাই হোক, সাহেবের ভারতবাসের, বিশেষ করে কলকাতায় থাকার দিনগুলো শুধু ঘটনাবহুল নয়, নাটকীয়ও। দিন দিন তাঁর চৌরঙ্গিস্থিত ওই অট্টালিকা ভরে উঠছিল অসংখ্য প্রাচীন হিন্দু ও বৌদ্ধ-জৈন মূর্তি, দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ পুঁথিপত্র, নানা এ দেশীয় অস্ত্র, বিচিত্র রংবাহারি পোশাক, হাতে-আঁকা ছবি, ঐতিহাসিক সামগ্রীতে। স্যর জর্জ বেল নামে এক ব্রিটিশ অফিসার তাঁর মিউজ়িয়াম দেখে এসে নিজের ডায়েরিতে লিখেছিলেন যে, স্টুয়ার্টের বাড়িতে তিনি তেত্রিশ কোটি দেবদেবীর মূর্তি দেখেছেন, যা কোনও এক জায়গায় তাঁর দেখা সর্ববৃহৎ সংগ্রহ। তবে এই বর্ণনায় কিছুটা অতিরঞ্জন আছে।
হিন্দু স্টুয়ার্টকে ঘিরে জন্ম হয়েছিল খুচরো বিতর্কেরও। বাড়ি-ঠাসা অত ভারতীয় মূর্তি দেখে ক্রমশ অভিযোগ উঠতে লাগল তাঁর এই বিপুল সংগ্রহ ও লাইব্রেরির বেশির ভাগ সামগ্রীই নাকি চুরি করা, মোটা টাকার লোভ দেখিয়ে কেনা বা জোরজবরদস্তি করে কেড়েকুড়ে আনা। ওড়িশার খণ্ডগিরির কাছে এক দল পুরোহিত তাঁর বিরুদ্ধে নালিশ জানিয়েছিলেন, এই কর্নেল সাহেব নাকি তাঁদের মন্দিরের শিলালিপি চুরি করে নিয়ে পালিয়েছেন! অনেকে অভিযোগ করেছেন, তাঁর সংগ্রহে থাকা বেলেপাথরের অসামান্য সুন্দর হরিহর (বিষ্ণু ও শিবের যুগল বিগ্রহ) মূর্তিটি নাকি মধ্যপ্রদেশের খাজুরাহোর মন্দির থেকে উপড়ে আনা। সে যা-ই হোক, ৩১ মার্চ ১৮২৮, স্টুয়ার্টের মৃত্যুর পরে তাঁর মিউজ়িয়ামের ভারতীয় প্রত্নমূর্তির ওই বিরাট সংগ্রহ লন্ডনের ক্রিস্টি-র নিলামে উঠে অবশেষে স্থান পায় ব্রিটিশ মিউজ়িয়ামে। তাঁর বিশাল ওই সংগ্রহ আজ সমস্ত পৃথিবীর পর্যটক, উৎসাহী ও গবেষকদের কাছে শুধু দর্শনীয়ই নয়, বিস্ময়ের বস্তুও। সে দিন সমালোচিত হলেও বিশ্বখ্যাত ওই মিউজ়িয়ামের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বিভাগে এই বৃহত্তম অবদানের জন্য মেজর জেনারেল চার্লস স্টুয়ার্ট নামটি আজও সন্ধানী ভারততত্ত্ববিদ ও ভারতীয় সভ্যতাপ্রেমী মানুষদের কাছে অমর হয়ে আছে।
জনপ্রিয় হিন্দুধর্ম-অনুরাগী ও হিন্দু সভ্যতাপ্রেমী সাহেব-মেমদের মধ্যে আমরা হেন্সম্যান অ্যান্টনি (অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি) বা মার্গারেট এলিজ়াবেথ নোবল (ভগিনী নিবেদিতা)-কে পেয়েছি পরবর্তী কালে, কিন্তু বাঙালি সে ভাবে চার্লস স্টুয়ার্টকে মনে রাখেনি। সম্পূর্ণ বিদেশি হয়েও যাঁরা ভারতকে অত্যন্ত গভীর ও আন্তরিক ভাবে ভালবেসেছিলেন, তাঁদের মধ্যে হিন্দু স্টুয়ার্ট অন্যতম প্রধান, সন্দেহ নেই। প্রাচ্যবিদ, ভারততত্ত্ববিদ, ইন্ডোফাইল ইত্যাদি যে অভিধাতেই তাঁকে ভূষিত করা হোক না কেন, লেখক হিসেবে তাঁর অবদানকে খাটো করলে ঘোর অন্যায় হবে। তাঁর লেখা বাংলার ইতিহাস তো বিখ্যাতই, তা ছাড়াও তাঁর জীবন ও লেখালিখি নিয়ে বিশদে পড়তে গেলে জর্গ ফিচ-এর রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটির (খণ্ড ১১৭, সংখ্যা ১, জানুয়ারি ১৯৮৫) জার্নালে লেখা ‘আ সলিটারি ভিন্ডিকেটর অব দ্য হিন্দুজ়: দ্য লাইফ অ্যান্ড রাইটিংস অব জেনারেল চার্লস স্টুয়ার্ট (১৭৫৭/৫৮-১৮২৮)’ একটি উল্লেখযোগ্য সঙ্কলন সন্দেহাতীত ভাবেই।
যে মানুষটি এত কিছু করলেন বাংলা ও ভারতের জন্য, এত ভালবাসলেন এই দেশের সভ্যতা-সংস্কৃতিকে, দুঃখের বিষয়, সেই মানুষটিকে নিয়ে বিশেষ কোনও উৎসাহ দেখা যায় না মূল ধারার বাংলা লেখালিখিতে। তাঁর জীবন নিয়ে লেখা হয়নি কোনও উপন্যাস, তৈরি হয়নি কোনও চলচ্চিত্রও। কয়েক বছর আগে একটা খবর হয়তো আমাদের অনেকেরই নজর এড়িয়ে গেছে, কলকাতার সাউথ পার্ক স্ট্রিট সেমেটরির একটি গুরুত্বপূর্ণ সমাধিসৌধের গা থেকে শেষ অক্ষত হেরিটেজ পদ্মচিহ্ন বা লোটাস-প্লাকটিও চুরি হয়ে গেছে। সমাধিসৌধটি ওই খ্রিস্টান সমাধিক্ষেত্রের মধ্যে একটি পুরোদস্তুর হিন্দু মন্দিরের ক্ষুদ্র সংস্করণ, তার নীচেই চিরঘুমে শায়িত আছেন প্রবাদপ্রতিম সেই হিন্দু স্টুয়ার্ট।
সাহেবের মরদেহের সঙ্গে ওই একই স্থানে একই সঙ্গেই সমাধিস্থ করা হয়েছিল তাঁর প্রিয় উপাস্য কষ্টিপাথরের দেববিগ্রহগুলিও।
সাউথ পার্ক স্ট্রিট সেমেটরি আজ একটি শ্যাওলা-ধরা অবহেলিত জায়গা হলেও সেখানে শুয়ে আছেন সেই সময়ের কলকাতার বহু বিখ্যাত ব্যক্তি— ভাষাতত্ত্ববিদ ও এশিয়াটিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা উইলিয়াম জোনস, কবি হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজ়িয়ো, বিশ্বখ্যাত ঔপন্যাসিক চার্লস ডিকেন্সের ছেলে ওয়াল্টার ল্যান্ডর ডিকেন্স, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাংলা প্রদেশের সুপ্রিম কোর্টের প্রথম বিচারপতি ইলাইজ়া ইম্পে, প্রথম সার্ভেয়ার জেনারেল কলিন ম্যাকেঞ্জি প্রমুখ আরও অনেকে। সাহেবদের এই ঐতিহাসিক সমাধিস্থলে কত ধরনেরই না স্মৃতিসৌধ আছে, কত না তাদের আকার ও বৈশিষ্ট্য, কিন্তু তার মধ্যে সবচেয়ে ব্যতিক্রমী অবধারিত ভাবেই স্টুয়ার্টের এই হিন্দু পঞ্চরত্ন দেউলাকৃতি সৌধটি। ছায়াশীতল, গম্ভীর এই সংরক্ষিত এলাকার মধ্যে আপনমনে হাঁটতে হাঁটতে ওড়িশার মন্দির-ঘরানাতে তৈরি এই স্মৃতিসৌধের কঙ্কালটির সামনে সহসা থমকে দাঁড়িয়ে পড়া ছাড়া আজ যেন আমাদের কোনও উপায় নেই। এই সাহেব-হিন্দুর সামগ্রিক প্রেক্ষাপটটি জানা থাকলে সে ক্ষেত্রে উপায় জানা না-ও থাকতে পারে অজান্তেই চোখ ভিজে আসা আটকানোর।
তথ্যঋণ: হোয়াইট মুঘলস, উইলিয়াম ডালরিম্পল (পেঙ্গুইন বুকস); আ সলিটারি ভিন্ডিকেটর অব দ্য হিন্দুজ়: দ্য লাইফ অ্যান্ড রাইটিংস অব জেনারেল চার্লস স্টুয়ার্ট (১৭৫৭/৫৮- ১৮২৮),
(জার্নাল অব দ্য রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটি, কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস); মেজর জেনারেল চার্লস স্টুয়ার্ট, দ্য ব্রিটিশ মিউজ়িয়াম ও অন্যান্য প্রাসঙ্গিক গ্রন্থ
অভূতপূর্ব এক দৃশ্যের জন্ম হল গঙ্গার ঘাটে। দিকচক্রবাল জুড়ে সূর্যদেব ভাস্বর হয়ে উঠেছেন কিছু ক্ষণ মাত্র হল। উদ্ভাসিত সেই আলোর রং সর্বাঙ্গে মেখে শ্বেতাঙ্গ এক দীর্ঘদেহী সাহেব বাঁধানো ঘাটের সিঁড়ি বেয়ে নেমে যাচ্ছেন গঙ্গাবক্ষের দিকে। নগ্নপদ, পরনে কাছা দিয়ে পরা ধুতি, ঊর্ধ্বাঙ্গে আজানুলম্বিত উত্তরীয়, বুকে পরম যত্নে আঁকড়ে ধরা কষ্টিপাথরের তৈরি, গাঢ় কৃষ্ণ বর্ণের বালগোপাল। মেদহীন সুঠাম চেহারার গোরা সাহেবটি নেমে গেলেন পুণ্যসলিলার জলে, মূর্তি হাতে নিয়েই ডুব দিলেন, স্নান করালেন উপাস্য দেবমূর্তিকে, অবগাহন করলেন নিজেও। কপালে এঁকে নিলেন শ্বেতচন্দনের তিলক, তার পর আপাদমস্তক ওই ভিজে পোশাকেই উঠে আসতে শুরু করলেন সিঁড়ি ভেঙে। চোখে-মুখে প্রস্ফুটিত ভক্তিভাব, প্রশস্ত বুকের উপর ধরা সদ্যস্নাত গোপালবিগ্রহ দেখে ঘাটে উপস্থিত যে সব লোক দু’হাত জোড় করে প্রণাম করছেন, সাহেব তাদের প্রায় স্পষ্ট হিন্দুস্থানি উচ্চারণে বলছেন ‘জয় সীতারামজি’। দেখেশুনে আঠেরো শতকের শেষের দিকের সেই কলকাতার ঘাট-বাজার-রাস্তার লোকজনের তো চক্ষু চড়কগাছ। এ কী দেখছেন তাঁরা, দিবাস্বপ্ন নয় তো!
আশপাশে গুঞ্জন— কে এই লোকটা? যাঁরা কৌতূহলাক্রান্ত হয়ে অনুসরণ করলেন, তাঁরা দেখলেন সাহেব ধুলোভরা সারা পথ হেঁটে গিয়ে উঠলেন উড স্ট্রিট আর থিয়েটার রোডের ঠিক মাঝামাঝি বড়সড় একটা বাড়িতে। জানা গেল, ওই বাড়িতেই বাস করেন সাহেব। তিনি ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ফার্স্ট বেঙ্গল ইউরোপিয়ান রেজিমেন্টের কোয়ার্টার মাস্টার। লোকটার রকমসকম দেখে তো তাঁরা তাজ্জব, সাহেব নাকি ভীষণ কৃষ্ণভক্ত, সকাল-সন্ধে পুজোপাঠ না করে জলগ্রহণ করেন না, বেদ-উপনিষদ-পুরাণ-মহাকাব্য-সহ সব রকমের হিন্দুধর্ম সম্বন্ধীয় শাস্ত্রপুঁথি নাকি তাঁর নখদর্পণে। সাহবের এই বাড়িটিও নাকি ঠাসা নানা রকম হিন্দু দেবদেবীর মূর্তি আর হাজার রকম ভারতীয় প্রত্নসামগ্রীতে। সাহেবের নাম যদিও চার্লস স্টুয়ার্ট, কিন্তু তাঁকে তাঁর দেশীয় নাক-উঁচু সাহেবসুবোর দল কিছুটা যেন ব্যঙ্গ করেই ডাকে ‘হিন্দু স্টুয়ার্ট’।
কৃষ্ণপ্রেমে মাতোয়ারা হয়ে সৈয়দ আলাওল, সৈয়দ মুর্তজা, কবি মুসা, কমর আলি প্রমুখ বহু মুসলমান কবি কাব্য লিখেছেন। কালীপ্রেমে আপ্লুত হয়ে নওয়াজিস খান, আলি রজা, আকবর আলি, মির্জা হুসেন আলি আরও কত জনেই তো শ্যামাসঙ্গীত লিখেছেন। কিন্তু একেবারে বিশুদ্ধ গোরা সাহেবের হিন্দু দেবতা ভজনার কথা আগে কখনও শোনেনি সমসাময়িক নেটিভ জনগণ, দেখেনি ভারতীয় দেবদেবী নিয়ে কোনও ফিরিঙ্গি খ্রিস্টানের এত উৎসাহ। তাই ভারতীয়দের কাছে স্টুয়ার্টের এই সব কাণ্ডকারখানা যথেষ্ট সমীহযোগ্য হলেও তাঁর দেশোয়ালি বেরাদর আর সিস্টার, বিশেষ করে উচ্চপদস্থ আর্মি অফিসার ও শাসকবর্গের কাছে ব্যাপারটা হয়ে উঠল নিতান্তই অস্বস্তিকর। মাথা খারাপ হল না কি লোকটার! জাতে যদিও আইরিশ, পদে সাধারণ ক্যাডেট হলে কী হবে, নেহাতই বাপে খেদানো মায়ে তাড়ানো গোছের মানুষ তো নয় সে! বাবা আয়ারল্যান্ডের লিমেরিক শহরের সম্মানীয় এমপি, দাদুও তাই। সে নিয়ে কিছুটা আত্মাভিমান তো থাকবে! উন্নততর নরগোষ্ঠীর প্রতিনিধি, সাদা চামড়ার লোক হওয়ার জন্য কিছুটা বাড়তি মান-মর্যাদাবোধ না থাকলে চলবে কী করে! সে সবের বালাই নেই, কেমন বেহায়ায় মতো নেটিভদের সমতলে নেমে এসে সমানে সমানে মিশছে! নিজেকে এক জন ধর্মান্তরিত হিন্দু বলে পরিচয় দিচ্ছে, খবরের কাগজে হিন্দুধর্ম, দর্শন, নীতি-নৈতিকতার স্তুতি করে বেড়াচ্ছে, প্যামফ্লেটে লম্বা লম্বা প্রবন্ধ লিখছে খ্রিস্টান যাজকদের গণধর্মান্তরণের বিরুদ্ধে। লিখছে হিন্দু পৌত্তলিকতা, বিভিন্ন আচার-বিচার-সংস্কারের সমর্থনে। বলছে হিন্দু সভ্যতা উৎকর্ষ ও পরম্পরাগত ভাবে এতটাই নাকি স্বয়ংসম্পূর্ণ আর সমৃদ্ধ যে, তার খ্রিস্টধর্মের অভিভাবকত্ব বা পথপ্রদর্শনের কোনও প্রয়োজন নেই।
গর্বোদ্ধত উপনিবেশবাদী সাহেব-সম্প্রদায়ের কাছে সে তখন এক আজব চিড়িয়া। কলকাতার সব নামী খবরের কাগজ অকপটে লিখছে, এই রকম উষ্ণ ক্রান্তীয় দেশের পক্ষে নেটিভদের পোশাক-আশাক কত বেশি উপযোগী, বিশেষ করে প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠছে হিন্দু নারীর শাড়ি পরার বিষয়টি নিয়ে। এমনকি এও বলছে মহিলাদের পক্ষে শাড়ির চেয়ে দৃষ্টিনন্দন, আকর্ষক ও যৌন আবেদনময় পোশাক নাকি আর হতে পারে না, পরিচ্ছদ হিসেবে এটি ইউরোপীয় মহিলাদের হাল-ফ্যাশনের পোশাকের চেয়ে অনেক সুন্দর, ইউরোপীয় মহিলাদেরও শাড়ি পরা উচিত। ভারতীয় নারীদের সৌন্দর্যের বিষয়ে সে নাকি এমনই অনুরক্ত যে পষ্টাপষ্টি লিখছে, বেশির ভাগ হিন্দু মহিলা উচ্চতায় কিছুটা খাটো বটে, কিন্তু রূপের দিক থেকে ইউরোপীয় নারীদের তুলনায় অনেক বেশি রূপসী ও ইন্দ্রিয়সংবেদ্য। গড়ন বা আকৃতির দিক থেকে তাঁদের দেহবল্লরি অতি অনুপম। অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কমনীয় বাঁক-বিভঙ্গ, চোখের নিবিড় কটাক্ষে পাশ্চাত্যের সেরা সুন্দরীদের চেয়ে তাঁরা কোনও অংশে কম নন। ইউরোপীয় মহিলাদের ওই রকম ফ্যাকাশে রক্তাল্পতা ধরনের ফর্সা গায়ের রঙের চেয়ে এই সব হিন্দু মেয়ের উজ্জ্বল তাম্রবর্ণ মুখশোভা অনেক বেশি চিত্তাকর্ষক।
এই সব দেখে-পড়ে বিরক্ত হল মিশনারিরা, বিরোধিতা এল ক্ষমতাশালী সাহেবদের দিক থেকে। বিধর্মী, পেগান কত কিছুই না বলা হল, কিন্তু কিছুতেই দমানো গেল না স্টুয়ার্টকে। তিনি আগের মতোই চালিয়ে যেতে লাগলেন তাঁর হিন্দু জীবনযাপন। রাজপুতদের মতো চিবুক অবধি নেমে আসা গোঁফ রাখলেন, পরনে চিরাচরিত হিন্দুস্থানি পোশাক, পায়ে নাগরা জুতো, মাথায় পাগড়ি, হাতে পানের পিকদানি, হুঁকো। খাওয়াদাওয়ায় ব্যবহার করলেন এ দেশীয় বাসনকোসন— ছোট-বড় নানা রকম পানপাত্র, মোগলদেশীয় জলপাত্র। বিবাহিত হয়েও প্রেমে পড়লেন এক ভারতীয় নারীর, কাজের ফাঁকে সারা ভারত জুড়ে বেড়ালেন সেই ভারতীয় স্ত্রীকে নিয়ে। এক দল ব্রাহ্মণ নিযুক্ত করলেন গৃহস্থালির সনাতনী রীতি-রেওয়াজ ছাড়াও হিন্দু খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে বিশুদ্ধতা রক্ষার জন্য।
সাহেবসুবোরা হিন্দু স্টুয়ার্টের প্রতি যে মনোভাবই পোষণ করুক, কখনও ব্যক্তিস্বাধীনতায় হাত দেয়নি। স্টুয়ার্ট কাজকর্মে মনোযোগী ছিলেন, তাই পদোন্নতিও আটকায়নি, শেষ পর্যন্ত তিনি উন্নীত হয়েছিলেন মেজর জেনারেল পদে। তিনি যখন উত্তর ভারতের অন্যতম বৃহত্তম এক রেজিমেন্টের কম্যান্ডার হিসেবে কর্মরত, তখন তাঁর অধীনে যোগ দেন উইলিয়াম লিনিয়াস গার্ডেনার নামে এক সাহেব। তাঁর বিবরণ থেকে জানা যায়, এক বার স্টুয়ার্ট তাঁর অশ্বারোহী বাহিনীর ডিউটি থেকে ছুটি নিয়ে কুম্ভমেলায় পুণ্যস্নানে গিয়েছিলেন। সেখানে ওই বিপুল জনসমুদ্রের মধ্যে গার্ডেনার তাঁকে খুঁজে পান দশ-বারো জন নগ্ন নাগা-সন্ন্যাসীদের মধ্যে। সাধুরা সম্মিলিত ভাবে তাঁর মাথায় হাত দিয়ে নাকি তাঁকে আশীর্বাদ করছিলেন। স্টুয়ার্ট নাকি গঙ্গার ধারে একটি মন্দির তৈরি করতে চেয়েছিলেন, সে ইচ্ছে বাস্তবায়িত হয়নি। তবে গঙ্গাসাগর দ্বীপে তিনি এক মন্দিরও স্থাপন করেছিলেন।
গার্ডেনার তাঁকে ‘জেনারেল পণ্ডিত’ বা ‘পণ্ডিত স্টুয়ার্ট’ বলে উল্লেখ করতেন, তার প্রধান কারণ ভারতীয় ধর্মশাস্ত্র, ইতিহাস, পুরাণ, প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ে স্টুয়ার্টের প্রগাঢ় আগ্রহ, জ্ঞান ও পাঠচর্চা। সেনাবাহিনীতে চাকরি করতে করতেই তিনি নিযুক্ত হয়েছিলেন ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের ফার্সি ভাষার অধ্যাপক হিসেবে। যে সময় তিনি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে ভারতে প্রশাসক হয়ে আসা ইংরেজদের উর্দু ফার্সি পড়াচ্ছেন, তখন সহকর্মী হিসাবে পেয়েছেন জন গিলক্রিস্ট, উইলিয়াম কেরি, মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার, ম্যাথু লাম্সডেন প্রমুখ দিকপালদের। ইংল্যান্ডে গিয়েও অধ্যাপনা করেছেন ইস্ট ইন্ডিয়া কলেজে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভাষাসমূহের অধ্যাপক হিসেবে। শেষ জীবনে তিনি ভারতে ফিরে আসেন ও এখানেই তাঁর প্রয়াণ ঘটে।
যাই হোক, সাহেবের ভারতবাসের, বিশেষ করে কলকাতায় থাকার দিনগুলো শুধু ঘটনাবহুল নয়, নাটকীয়ও। দিন দিন তাঁর চৌরঙ্গিস্থিত ওই অট্টালিকা ভরে উঠছিল অসংখ্য প্রাচীন হিন্দু ও বৌদ্ধ-জৈন মূর্তি, দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ পুঁথিপত্র, নানা এ দেশীয় অস্ত্র, বিচিত্র রংবাহারি পোশাক, হাতে-আঁকা ছবি, ঐতিহাসিক সামগ্রীতে। স্যর জর্জ বেল নামে এক ব্রিটিশ অফিসার তাঁর মিউজ়িয়াম দেখে এসে নিজের ডায়েরিতে লিখেছিলেন যে, স্টুয়ার্টের বাড়িতে তিনি তেত্রিশ কোটি দেবদেবীর মূর্তি দেখেছেন, যা কোনও এক জায়গায় তাঁর দেখা সর্ববৃহৎ সংগ্রহ। তবে এই বর্ণনায় কিছুটা অতিরঞ্জন আছে।
হিন্দু স্টুয়ার্টকে ঘিরে জন্ম হয়েছিল খুচরো বিতর্কেরও। বাড়ি-ঠাসা অত ভারতীয় মূর্তি দেখে ক্রমশ অভিযোগ উঠতে লাগল তাঁর এই বিপুল সংগ্রহ ও লাইব্রেরির বেশির ভাগ সামগ্রীই নাকি চুরি করা, মোটা টাকার লোভ দেখিয়ে কেনা বা জোরজবরদস্তি করে কেড়েকুড়ে আনা। ওড়িশার খণ্ডগিরির কাছে এক দল পুরোহিত তাঁর বিরুদ্ধে নালিশ জানিয়েছিলেন, এই কর্নেল সাহেব নাকি তাঁদের মন্দিরের শিলালিপি চুরি করে নিয়ে পালিয়েছেন! অনেকে অভিযোগ করেছেন, তাঁর সংগ্রহে থাকা বেলেপাথরের অসামান্য সুন্দর হরিহর (বিষ্ণু ও শিবের যুগল বিগ্রহ) মূর্তিটি নাকি মধ্যপ্রদেশের খাজুরাহোর মন্দির থেকে উপড়ে আনা। সে যা-ই হোক, ৩১ মার্চ ১৮২৮, স্টুয়ার্টের মৃত্যুর পরে তাঁর মিউজ়িয়ামের ভারতীয় প্রত্নমূর্তির ওই বিরাট সংগ্রহ লন্ডনের ক্রিস্টি-র নিলামে উঠে অবশেষে স্থান পায় ব্রিটিশ মিউজ়িয়ামে। তাঁর বিশাল ওই সংগ্রহ আজ সমস্ত পৃথিবীর পর্যটক, উৎসাহী ও গবেষকদের কাছে শুধু দর্শনীয়ই নয়, বিস্ময়ের বস্তুও। সে দিন সমালোচিত হলেও বিশ্বখ্যাত ওই মিউজ়িয়ামের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বিভাগে এই বৃহত্তম অবদানের জন্য মেজর জেনারেল চার্লস স্টুয়ার্ট নামটি আজও সন্ধানী ভারততত্ত্ববিদ ও ভারতীয় সভ্যতাপ্রেমী মানুষদের কাছে অমর হয়ে আছে।
জনপ্রিয় হিন্দুধর্ম-অনুরাগী ও হিন্দু সভ্যতাপ্রেমী সাহেব-মেমদের মধ্যে আমরা হেন্সম্যান অ্যান্টনি (অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি) বা মার্গারেট এলিজ়াবেথ নোবল (ভগিনী নিবেদিতা)-কে পেয়েছি পরবর্তী কালে, কিন্তু বাঙালি সে ভাবে চার্লস স্টুয়ার্টকে মনে রাখেনি। সম্পূর্ণ বিদেশি হয়েও যাঁরা ভারতকে অত্যন্ত গভীর ও আন্তরিক ভাবে ভালবেসেছিলেন, তাঁদের মধ্যে হিন্দু স্টুয়ার্ট অন্যতম প্রধান, সন্দেহ নেই। প্রাচ্যবিদ, ভারততত্ত্ববিদ, ইন্ডোফাইল ইত্যাদি যে অভিধাতেই তাঁকে ভূষিত করা হোক না কেন, লেখক হিসেবে তাঁর অবদানকে খাটো করলে ঘোর অন্যায় হবে। তাঁর লেখা বাংলার ইতিহাস তো বিখ্যাতই, তা ছাড়াও তাঁর জীবন ও লেখালিখি নিয়ে বিশদে পড়তে গেলে জর্গ ফিচ-এর রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটির (খণ্ড ১১৭, সংখ্যা ১, জানুয়ারি ১৯৮৫) জার্নালে লেখা ‘আ সলিটারি ভিন্ডিকেটর অব দ্য হিন্দুজ়: দ্য লাইফ অ্যান্ড রাইটিংস অব জেনারেল চার্লস স্টুয়ার্ট (১৭৫৭/৫৮-১৮২৮)’ একটি উল্লেখযোগ্য সঙ্কলন সন্দেহাতীত ভাবেই।
যে মানুষটি এত কিছু করলেন বাংলা ও ভারতের জন্য, এত ভালবাসলেন এই দেশের সভ্যতা-সংস্কৃতিকে, দুঃখের বিষয়, সেই মানুষটিকে নিয়ে বিশেষ কোনও উৎসাহ দেখা যায় না মূল ধারার বাংলা লেখালিখিতে। তাঁর জীবন নিয়ে লেখা হয়নি কোনও উপন্যাস, তৈরি হয়নি কোনও চলচ্চিত্রও। কয়েক বছর আগে একটা খবর হয়তো আমাদের অনেকেরই নজর এড়িয়ে গেছে, কলকাতার সাউথ পার্ক স্ট্রিট সেমেটরির একটি গুরুত্বপূর্ণ সমাধিসৌধের গা থেকে শেষ অক্ষত হেরিটেজ পদ্মচিহ্ন বা লোটাস-প্লাকটিও চুরি হয়ে গেছে। সমাধিসৌধটি ওই খ্রিস্টান সমাধিক্ষেত্রের মধ্যে একটি পুরোদস্তুর হিন্দু মন্দিরের ক্ষুদ্র সংস্করণ, তার নীচেই চিরঘুমে শায়িত আছেন প্রবাদপ্রতিম সেই হিন্দু স্টুয়ার্ট।
সাহেবের মরদেহের সঙ্গে ওই একই স্থানে একই সঙ্গেই সমাধিস্থ করা হয়েছিল তাঁর প্রিয় উপাস্য কষ্টিপাথরের দেববিগ্রহগুলিও।
সাউথ পার্ক স্ট্রিট সেমেটরি আজ একটি শ্যাওলা-ধরা অবহেলিত জায়গা হলেও সেখানে শুয়ে আছেন সেই সময়ের কলকাতার বহু বিখ্যাত ব্যক্তি— ভাষাতত্ত্ববিদ ও এশিয়াটিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা উইলিয়াম জোনস, কবি হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজ়িয়ো, বিশ্বখ্যাত ঔপন্যাসিক চার্লস ডিকেন্সের ছেলে ওয়াল্টার ল্যান্ডর ডিকেন্স, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাংলা প্রদেশের সুপ্রিম কোর্টের প্রথম বিচারপতি ইলাইজ়া ইম্পে, প্রথম সার্ভেয়ার জেনারেল কলিন ম্যাকেঞ্জি প্রমুখ আরও অনেকে। সাহেবদের এই ঐতিহাসিক সমাধিস্থলে কত ধরনেরই না স্মৃতিসৌধ আছে, কত না তাদের আকার ও বৈশিষ্ট্য, কিন্তু তার মধ্যে সবচেয়ে ব্যতিক্রমী অবধারিত ভাবেই স্টুয়ার্টের এই হিন্দু পঞ্চরত্ন দেউলাকৃতি সৌধটি। ছায়াশীতল, গম্ভীর এই সংরক্ষিত এলাকার মধ্যে আপনমনে হাঁটতে হাঁটতে ওড়িশার মন্দির-ঘরানাতে তৈরি এই স্মৃতিসৌধের কঙ্কালটির সামনে সহসা থমকে দাঁড়িয়ে পড়া ছাড়া আজ যেন আমাদের কোনও উপায় নেই। এই সাহেব-হিন্দুর সামগ্রিক প্রেক্ষাপটটি জানা থাকলে সে ক্ষেত্রে উপায় জানা না-ও থাকতে পারে অজান্তেই চোখ ভিজে আসা আটকানোর।
তথ্যঋণ: হোয়াইট মুঘলস, উইলিয়াম ডালরিম্পল (পেঙ্গুইন বুকস); আ সলিটারি ভিন্ডিকেটর অব দ্য হিন্দুজ়: দ্য লাইফ অ্যান্ড রাইটিংস অব জেনারেল চার্লস স্টুয়ার্ট (১৭৫৭/৫৮- ১৮২৮),
(জার্নাল অব দ্য রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটি, কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস); মেজর জেনারেল চার্লস স্টুয়ার্ট, দ্য ব্রিটিশ মিউজ়িয়াম ও অন্যান্য প্রাসঙ্গিক গ্রন্থ