ছবি: সুমন চৌধুরী
দি দিমাদের হাজরা রোডের বাড়ির ঠিক ওপরের তলায় এক সত্যিকারের পাগল থাকত, আসলে পাগলি। সে বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হিসি করত আর সেই জলোচ্ছ্বাস দিদিমাদের উঠোন ভিজিয়ে দিত। এক দিন আর না পেরে আমাদের ‘পাগল’ নেমে পড়ল, চিৎকার করে বলতে থাকল, ‘কোন দ্যাশের মাইয়ামানুষ রে তুই? দাড়াইয়া দাড়াইয়া মুতিস? চোখের আগল নাই?’ দোতলা থেকে গলা ভেসে এল, ‘সবাই বইস্যা বইস্যা মোতে, আমি দাড়াইয়া মুতি। তর কী? তর বাপের কী? তর ওই গোবরকুড়ানি বুড়ির কী?’ যত বারই হাজরা রোডের বাড়ি যেতাম, দুই পাগলের ঝগড়া লেগেই থাকত। এক দিন দিদিমার জ্বর, পাগল একাই এক সময় বালতি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। তত ক্ষণে আশেপাশের সব গোবর উধাও, হাজরা পার্কের পাশের খাটালগুলোতেও গোবর নেই। পাগল ফিরে আসছিল খালি বালতি নিয়ে, এমন সময়—
হাজরা মোড়ের কাছে একটা মুলতানি গরু ল্যাজ তুলেছে। দিগ্বিদিক হারিয়ে পাগল ছুটল ল্যাজ-তোলা গরুর একদম পেছনে। ধোঁয়া-ওঠা গোবর মাটিতে পড়ার আগেই পাগলের তুলে নেওয়া চাই, কিন্তু গরুটা হঠাৎ তার বাঁ ঠ্যাং তুলে মারল লাথি, পাগলকে। ব্যস। ফিমার বোন ভেঙে সেই যে পাগল বিছানা নিল, উঠে আর দাঁড়াতে পারেনি কোনও দিন! পালা করে পাগলকে খাইয়ে দিত দিদিমা বা মাসি, চাদর-তোশক ভিজিয়ে দিত পাগল, বড় কাজও বিছানাতেই করে ফেলত। মাসি, দিদিমা পাগলকে ধুয়ে আবার পরিষ্কার করে দিত বিছানা। পাগলের ডাঁট কিন্তু কমেনি কোনও দিনের জন্য একটুকুও। এক বছর যায়, দু’বছর যায়, তিন বছর যায়... পাগল দেহ রাখল। তার পর যে আতান্তর শুরু হল, সে আর এক গল্প। দিদিমা ছুটল পুরুতের বাড়ি, মেজমামা মসজিদে। কী করা যায়? পুরুত বলল, ‘হিন্দু মতে। হিন্দুদের সঙ্গে থাকতে থাকতে ও হিন্দুই হয়ে গেছে।’ মৌলবি দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, ‘মোছলমান মোছলমানই থাকে, হিঁদু হয় না। ওকে গোর দিতে হবে।’ তার পর কী হয়েছিল মনে নেই। মাসির ফোঁপানো কান্না শুনতে পেতাম মাঝরাত্রে আর সেই চোখের জলে ধর্মাধর্ম কোন চুলোয় ভেসে গিয়েছিল, কে তার খবর রাখে!
আমার ছোটমামু ছিলেন ব্যায়ামবীর। হাতের সামনে চেয়ার, টেবিল, সাইকেল যা পেতেন তুলে নিয়ে ডনবৈঠক দিতেন। আমিও বাদ পড়িনি। ইন্টার-কলেজ বডিবিল্ডিং চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন। অসামান্য গান গাইতেন আর ফিজিক্সের বইয়ের তলায় রাখতেন কবিতার খাতা, আশ্চর্য সব কবিতায় ভরা— তুমি ফোটো চতুর্দিকে, বৃক্ষমূলে আমি বসে থাকি। হাজরা রোডের বাড়িতে ক্লাস ফাইভের আমার সঙ্গে আস্তে আস্তে দেখা হতে লাগল অনেকের। তারাপদ রায় সকাল নেই বিকেল নেই, চলে আসতেন। দাঁত কিড়মিড় করে উঠতেন মেজমামা। ম্যাট্রিকে ফোর্থ হওয়া ভাইকে কবিতা ভাসিয়ে নিয়ে যাবে শেষ পর্যন্ত! বলতেন: আবার আসুক ‘তারা’, ওর ‘পদ’ কাইট্যা দিমু! আসতেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত, দীপক মজুমদারদের মতো ঝাঁ-চকচকে কবিরা। এঁরা চলে গেলে আসতেন মেজো-কবি, তার পর সেজো-কবি আর সবার শেষে কুট্টি-কবিদের দল। ম্যাট্রিক, ইন্টারমিডিয়েটে তুখড় রেজাল্ট করা ছোটমামু কোনও রকমে হামাগুড়ি দিয়ে বি এসসি পাশ করলেন। রেজাল্ট বেরনোর পর মেজমামা সাত দিন বাজার যাননি। দিনে, রাতে মুড়ি আর জল। আমি তখন ছোটমামুর খাটে শুই। খাট জুড়ে, ঘর জুড়ে, বালিশ জুড়ে খালি কবিতার গন্ধ। সেই গন্ধ আমার নাক দিয়ে ঢুকে পড়ছিল কোন গভীরে, বুঝতেই পারিনি। একই সময় সত্যজিৎ রায়, চিদানন্দ দাশগুপ্ত, রাধাপ্রসাদ গুপ্তরা মিলে শুরু করে দিলেন ‘ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটি’। মামু মেম্বার হয়ে গেলেন। রাত জেগে ‘ব্যাট্লশিপ পোটেমকিন’, ‘সিটিজেন কেন’, ‘ভার্জিন স্প্রিং’-এর গল্প বলতেন মামু।
কলকাতা শহরটা তখন একটা অন্য শহর ছিল। কিছু হতে হবে বলে কেউ কিছু করত না। কবিরা কবিতা লিখত তার পর ঘুমিয়ে পড়ত, ছবি-আঁকিয়েরা রঙের সঙ্গে রাজনীতি গুলত না, ধান্দাবাজেরা তখনও এই শহরটাকে মুঠোর ভেতর নিয়ে নেয়নি। প্রেম না পেয়ে দাড়ি রেখে হারিয়ে গেছে অনেক যুবক, অ্যাসিডের বোতল দোকানেই থেকে গেছে ঠিকঠাক কাজে ব্যবহারের জন্য। এত রাগ এই শহরটার গলা পর্যন্ত উঠে আসেনি তখনও। সদ্য কিশোর হয়ে-ওঠা ছেলেরা খিস্তির শব্দে বাতাস ভারী করে তোলেনি শহরটার। নবনীতা দেবসেনদের ‘ভালো বাসা’ বাড়ির জানলা দিয়ে উলটো দিকের ছাতে খালি-গায়ে লুঙ্গি পরে পায়চারি করতে দেখা যেত দাপুটে কমিউনিস্ট নেতা জ্যোতি বসুকে। আমার নিজের চোখে দেখা। ‘মন ডোলে মেরা তন ডোলে’তে সুর দিয়ে আর গেয়ে রাতারাতি দারুণ বিখ্যাত হেমন্ত মুখোপাধ্যায় লেক মার্কেট ঘুরে দরদাম করে সবজি কিনতেন! সুচিত্রা মিত্রর বাড়ি দুম করে চলে গিয়ে অজানা মানুষ আবদার করতে পারতেন— ‘তবু মনে রেখো’ গানটা এক বার শোনাবেন?
মামুদের পরিবারে নতুন সদস্য এল এক জন, এবং ক্রমশই সে বিশেষ জন হয়ে উঠল। মেজমামা এত দিন পরে এক জন কথা বলার, তাকিয়ে থাকার, ইঙ্গিত করার কাউকে পেলেন— টমি। টমির মা কুকুর, টমির বাবা কুকুর, ভাইবোনেরাও তাই, কিন্তু টমি মানুষ হয়ে গেল, নাম হল— টমীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত। দিদিমার সংসারে মেজমামা ছিলেন একা এক মানুষ। কোন কালে যেন টি.বি হয়েছিল মেজমামার, তার পর থেকে থালাবাটিগেলাস সব আলাদা। মেজমামা বাজার থেকে এক টাকায় ষোলোটা, ফাউ নিয়ে সতেরোটা রসগোল্লা নিয়ে এসে ফাঁকা ঘরে বসে একটা করে রসগোল্লা মুখে ফেলতেন আর বলতেন— ‘রসো, আমার মুখে বসো।’ দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আমি ভাবতাম, এই বার বোধহয় আমার পালা। কথা বলার, মুখের দিকে তাকিয়ে থাকার তেমন কেউ ছিল না মেজমামার। টমি চোখের পলক না ফেলে মেজমামার দিকে তাকিয়ে থাকত। আস্তে আস্তে ছবি হয়ে যাচ্ছিল অনেকেই। টমিও এক দিন ছবি হয়ে গেল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার দাদু, তাঁর পাশে দিদিমা আর তাঁদের পাশে আরও অনেক ছবি হয়ে ঝুলে থাকা মানুষদের মাঝখানে টমিও জায়গা করে নিল। এর পর মেজমামারও আর তর সইল না। দেওয়ালের একটা ফাঁকা জায়গায়, পেরেক থেকে ঝুলে পড়লেন তিনিও।
হঠাৎ দেখলাম আমিও বড় হয়ে গিয়েছি। মামুর সঙ্গে বসে মদ খাচ্ছি। দুঃখ জমতে শুরু করেছে মনের ভেতর। তার পর আরও আরও আরও সময় কেটে গেছে, আমি আর মামু বন্ধু হয়ে গিয়েছি, বয়েস ভুলে। মামুর শরীর থেকে গান, কবিতা, সিনেমা ছোঁয়াচে রোগের মতো আমাকে জড়িয়ে ধরল। যেটা সবচেয়ে আশ্চর্য করত আমাকে সেটা হল, এ রকম শক্তপোক্ত মানুষটার ভেতরটা ছিল তুলতুলে। কেউ কিছু চেয়েছে, কারও কোনও দরকার পড়েছে অথচ মামু তাকে দেননি বা পাশে দাঁড়াননি, এমন কখনও হয়নি। সব সময় নিজের দিকে তাকিয়ে থাকা কবিদের ভিড়ে, সেই অর্থে মামু এক জন অ-কবি।
এর মধ্যে আমারও এক দিন খুব দরকার পড়ল মামুকে। সকাল থেকেই মন ভাল নেই মন ভাল নেই মন ভাল নেই। নিজের কোনও কাজ ভাল্লাগছে না, কবিতা ভাল্লাগছে না। পুরস্কার-ফুরস্কার, কবিতার বই লাথি মেরে ফেলে দিতে ইচ্ছে করছে। মাঝরাত্তিরে গাড়ি নিয়ে ভূতের মতো মামুর বাড়ির রাস্তায় বার বার চক্কর খাচ্ছি, হঠাৎ দেখি, মামু দাঁড়িয়ে আছে গেটের সামনে: ‘আবার পাগলামি করত্যাসিস, কী হইসে তর? বাড়ি যা।’ আর এক বার দেখব বলে আবার ঘুরে এসে বাড়িটার সামনে দাঁড়ালাম। মামু, মানে কবি সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত, গেটের কাছে নেই, থাকার কথাও না। কয়েক বছর আগেই তো সব চুকেবুকে গেছে। মাঝে মাঝেই বন্ধু ফাল্গুনী রায়ের একটা লাইন কোনও এক ভেতর থেকে উঠে আসে— ‘মানুষ বেঁচে থাকে মানুষ মরে যায়/ কাহার তাতে ক্ষতি? কিই বা ক্ষতি হয়?/ আমার শুধু বুকে গোপনে জ্বর বাড়ে/ মানুষ বেঁচে থাকে মানুষ মরে যায়।’