Bengalis then and Bengalis Now

আমাদের গেছে যে দিন...

তার সবই কি ছিল আগমার্কা এবং খাঁটি? এখন কি কিছুই ভাল নেই আর? আবার, এখন অনেকে বলছে, বহু আবর্জনার ভারমুক্ত হয়ে বাঙালি এখন প্রকৃত আধুনিক। তাঁরাও ঠিক জানেন তো? এখনকার সব কিছুই সত্যি সত্যি দুর্দান্ত ভাল? বাংলা বছরের শেষে এ কাল-সে কাল মাপজোকের চেষ্টা করলেন উল্লাস মল্লিক

উল্লাস মল্লিক

শেষ আপডেট: ১৩ এপ্রিল ২০২৫ ০৭:৪৫
Share:
ছবি: রৌদ্র মিত্র।

ছবি: রৌদ্র মিত্র।

যাই বলুন দাদা, বাঙালি বড় স্মৃতিকাতর প্রজাতির প্রাণী। বাঙালি শুধু স্মৃতিকাতর নয়, তদুপরি সিনিকও। বাঙালির বৈজ্ঞানিক নাম হওয়া উচিত ছিল ‘নস্টালজিকা সিনিকা’। মানে, ভুরু কুঁচকেই আছে। চার পাশে এত ভ্রুকুঞ্চন দেখে মনে হয় এদের বাড়িতে কি ইস্তিরি-টিস্তিরি নেই! মাঝে মাঝে হালকা গরম করে নিজের কপালের উপর দিয়ে চালিয়ে নিতে পারে তো! সর্বক্ষণ নাক সিঁটকানি— কিচ্ছু হচ্ছে না, কেউ কিচ্ছু পারছে না। তখন সব কিছুই ছিল আগমার্কা। সব কিছু চোখ মুখ নাক বুজে ভরসা করা যায়। তখনকার আমড়া এখনকার ল্যাংড়ার চেয়ে বেশি মিষ্টি। এখন গরম পড়ে বেশি, শীত কম। দরকারে বৃষ্টি নেই, অসময়ে বানভাসি। বসন্তে গ্রীষ্ম, গ্রীষ্মে লোডশেডিং! ঘাম ঘামাচি। খসখসে ত্বক। তখনকার দিনে সবার ত্বক যেন ল্যামিনেশন করা! আগে ফলে জলে দুধে কেমন স্বাদ ছিল! এখন ফলে বিষ, দুধে জল আর জলে আর্সেনিক। তখন ঘরে ঘরে সুবোধ বালক, পাড়ায় পাড়ায় মহাপুরুষ। সেটা ছিল বাঙালির গর্বের সময়। সেই বাঙালি আজ কোথায়! সব কিছু ছন্নছাড়া গামছাহারা রসাতল। আর বাঙালিত্ব! তার তো শেষকৃত্য সম্পন্ন। মড়াকান্না কন্টিনিউড। শ্রাদ্ধশান্তি চলছে।

বাঙালিত্ব জিনিসটা তা হলে কেমন! মানে, যে জিনিসটা আগে হিম্মতসে ছিল, কিন্তু অধুনা ন্যাদোস মাছের মতো বিলুপ্তপ্রায়, সেটার আকৃতি প্রকৃতি ইলেকট্রন প্রোটন কী প্রকার! সত্যি বলতে, আমার পক্ষে এক কথায় উত্তর দেওয়া কঠিন। তাই দু’-চার কথা। তাও আগে থেকে সাফাই গেয়ে রাখি, কলকাতার ওয়েদার অফিসের মতো দু’-একটা ফস্কেও যেতে পারে কিন্তু।

দাপটের দিকবদল

বাজখাঁই গলা। বাঙালি পুরুষ, বিশেষ করে গৃহকর্তা হলে তো কথাই নেই, সব সময় হাঁকডাক করে কথা বলবে। সব কিছুতেই হুকুমের সুর আর দাবড়ানি। বৌয়ের থেকে এমন ভাবে জল চাইবে, যেন ডাকাত সর্দার গৃহস্থকে বাড়ির খিল খুলে দিতে বলছে। ছেলে-মেয়ের সঙ্গে এমন করে কথা বলবে, যেন অফিসের বড়সাহেব বাক্যালাপ করছে পিওনের সঙ্গে। ছেলেমেয়েও এমন মাথা হেঁট করে শুনবে, যেন নিজের পায়ের বুড়ো আঙুলে নিজের মুখের ছবি দেখতে চাইছে। আর প্রতিবেশী একটু মিনমিনে হলে তাকে আক্রমণ করবে সেই নেকড়ের মতো। সেই যে নেকড়ে ওপর থেকে ঝরনার জল পান করতে করতে নীচের মেষশাবককে বলেছিল, “তুই ব্যাটা আমার খাবার জল ঘোলা করছিস। তাই তোকে খাব।”

তার পর মেষশাবকের কোনও অকাট্য যুক্তিতেই কান না দিয়ে, ‘তুই জল ঘোলা করিসনি, তোর বাবা তো করেছিল’— এই বলে, মেষশাবককে আর কথা বলতে না দিয়ে, দিয়েছিল তার ঘাড় মটকে।

কিন্তু এখন চিত্র কিঞ্চিৎ ভিন্ন। সন্ধেবেলা আপনি গিন্নিকে চায়ের হুকুম করলেন। গিন্নিও মেজাজ প্রকটিত করে বললেন, “আজ অনেক বার চা খেয়েছ, আর হবে না।” অথবা বলতে পারেন, “দাঁড়াও সিরিয়ালটা শেষ হোক, তার পর দেখছি।” অর্থাৎ গিন্নিও মেজাজে তাঁর মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করলেন, যেটা আগে অশ্বডিম্বর মতোই অসম্ভব ছিল। নিজের সিদ্ধান্ত একতরফা এখন ছেলেমেয়ের উপর চাপিয়ে দেওয়া অসম্ভব। তারাও প্রতিযুক্তি দেবে। কারণ তারা অনেক বেশি খবর রাখে এখন। আধুনিক প্রযুক্তি তাদের অনেক বেশি ক্ষুরধার, অনেক বেশি তথ্যসমৃদ্ধ, অনেক বেশি লজিক্যাল করেছে।

আর নেকড়ের গল্প এখন এডিটেড ভার্শনে। ধরা যাক, এই সময়ে, সেই নেকড়ে এক দিন এক পাহাড়ি ঝর্নার জল পান করছে। হঠাৎ নীচে দেখল এক নধর মেষশাবক। জল খাচ্ছে। জিভ লকলকিয়ে উঠল নেকড়ের। গর্জন করে বলে উঠল— অ্যাই!

মেষশাবক শুনতে পেলেও তাকাল না। একমনে চুক-চুক করে জল খেতে লাগল।

প্রচণ্ড রেগে নেকড়ে আবার গর্জন করল, “কী রে, শুনতে পাচ্ছিস না!”

মেষশাবক এ বার ধীরে ধীরে মুখ তুলে উপর দিকে তাকাল। তার পর মস্ত একটা হাই তুলে বলল, “খামোখা এত হল্লা করছেন কেন। কী সুন্দর চাঁদ উঠেছে! মিষ্টি হাওয়া দিচ্ছে। এনজয় করুন। ঝরনার মিষ্টি জল খান।”

নেকড়ে বলল, “জল খাব কী করে! তুই তো আমার জল ঘুলিয়ে দিচ্ছিস!”

মেষশাবক বলল, “আরে, দাঁড়ান, দাঁড়ান! আমি নীচে, আপনি উপরে। আমি আপনার জল ঘুলোব কী করে! স্বপ্ন দেখছেন নাকি!”

“মুখ সামলে কথা বলবি ছোঁড়া। না হলে…”

মেষশাবক বলল, “এই দাঁড়ান, দাঁড়ান; আপনাকে চিনিই না, কোনও দিন দেখিইনি। আমাকে আপনি তুইতোকারি করছেন কেন!”

নেকড়ে বলল, “কে বলেছে দেখিসনি! হ্যাঁ, হয়তো আলাপ-পরিচয় হয়নি, কিন্তু দেখা হয়েছিল।”

মেষশাবক একটু অবাক হয়ে বলল, “কোথায়, কবে দেখা হল!”

“এখানেই। ঠিক এক বছর আগে। এমনই এক চাঁদনি রাতে। তখন তুই ছিলি উপরে, আমি ছিলাম নীচে। আর তুই আমার জল ঘুলিয়ে দিয়েছিলি। সেই জল খেয়ে ভয়ঙ্কর পেট ব্যথা করেছিল।”

মেষশাবক আরও বলল, “এক বছর আগে! কী ভুলভাল বকছেন কাকা! এক বছর আগে তো আমার জন্মই হয়নি। আমার বয়স তো মাত্র ছ’মাস।”

এ বার একটু ভড়কে গিয়ে নেকড়ে বলল, “ছ’মাস! ঠিক বলছিস! কী প্রমাণ! তোর বার্থ সার্টিফিকেট আছে?”

মেষশাবক বুক ফুলিয়ে বলল, “আলবাত আছে। একশো বার আছে।”

“দেখা তা হলে!”

“চলুন, পার্টি অফিসে।”

নেকড়ে আরও ভড়কে গিয়ে বলল, “ক্-কেন! পার্টি অফিসে কেন!”

“কেন আবার, বাপিদা আছে। বাপিদাকে চেনেন তো; আমাদের পার্টির নেতা! সামনে ভোট। বাপিদাকে পার্টি টিকিট দেবে। বাপিদাই জিতবে। যখন আমার দেড় মাস বয়স, তখন থেকে বাপিদার হয়ে খাটছি। দেওয়াল লিখছি, পোস্টার মারছি। বাপিদাই আমাদের সব। বাপিদার কাছেই আমাদের বার্থ সার্টিফিকেট, আধার কার্ড জমা আছে। কখন কী দরকার হয়। চলুন পার্টি অফিসে, নাকি বাপিদাকে একটা ফোন লাগাব? এখনই দলবল নিয়ে চলে আসবে এখানে।”

নেকড়ে দেখল, হাওয়া অনুকূল নয়। সে সুড়সুড় করে কেটে পড়ল।

হ্যাঁ, এটাই আজকের চিত্র। তবে এখনও কি কোনও প্রভাবশালী দুর্বলের ওপর অন্যায় জুলুম করে না! করে, কারণ বাপিদারও বাপিদা থাকে। তখন সেই বড় বাপিদাকে প্রভাবশালীর দিকে থাকতে হয়। তবে সে সব ঘটনা সংখ্যায় অনেক কম। কারণ বাপিদারা জানে, খেলা কেঁচে গেলে কেস ঘুরে যেতে পারে। চার দিকে বাপিদা। কখন যে কোন বাপিদার পাল্লা ভারী হয়, আগে থেকে বলা খুব মুশকিল!

বন্ধুর মতো বাবা-মা

তবে একটা ব্যাপার দেখে ভাল লাগে, এখন বাবা-মার সঙ্গে সন্তানদের সম্পর্ক। আগে বাবা ছিলেন সাক্ষাৎ আতঙ্ক, মূর্তিমান ত্রাস। পিতা ধর্ম, পিতা কর্মের বদলে, পিতা খিঁচুনি, পিতা পিটুনি। প্রত্যেকে যেন এক-একটা উগ্রপন্থী-টাইপ। পান থেকে চুন খসলেই হাতে উঠে আসত কোমরের বেল্ট, কিংবা দরজার খিল, অথবা পায়ের চটি। তাঁরা জানতেন, বেল্ট শুধু প্যান্টকেই নয়, সন্তানকেও ঠিক জায়গায় রাখে। আর খিলের কাজ শুধু দরজা আটক করা নয়, সন্তানের কুপথে যাওয়া আটকানোও তার কাজ। কে বলেছে, চটি শুধু পায়ের সুরক্ষার জন্য? সন্তানের বখে যাওয়া থেকে সুরক্ষার জন্যও তা অপরিহার্য।

দেখা-সাক্ষাৎ কমই হত। একমাত্র ধোলাইয়ের প্রয়োজন পড়লে তলব করতেন। যুক্তি-প্রতিযুক্তির বালাই নেই। নাগালে পেলেই অকরুণ ধোলাই। নন-স্টপ। যত ক্ষণ না হাত ব্যথা হয়, তত ক্ষণ ছাড়ান নেই। ছাড়ার পর একটা অমোঘ রসিকতা— “যা,আজকের মতো ছেড়ে দিলাম। এর পর যদি আর কোনও দিন শুনেছি…” যেন সে দিন আর হাতব্যথা করবে না।

সে যুগে অভিভাবকদের সঙ্গে মনের কথা বলা আর সুন্দরবনের বাঘের সামনে গিয়ে দাঁড়ানো একই ব্যাপার। বক্তব্য সব সময় গতে বাঁধা— “দানাপানি পাচ্ছ, পরনের জামাকাপড়ও, আর তো তোমার সমস্যা থাকতে পারে না। খোঁজ নিয়ে দেখো, কত ছেলেমেয়ে এটুকুও পায় না।”

এখন অভিভাবক অনেক কাছের। সন্তান অনেক অকপট। ফলে অনেক সমস্যার সমাধানও হয়ে যাচ্ছে সহজে।

অন্তঃপুর হেরো, পর্দা দুয়ো

ধরুন, কিছু কাল আগের কথা। মানে যে সময়ে আকাশ বাতাস চাঁদের আলো কোলাব্যাঙ সব কিছুই পিওর আর কী। সেই সময়ে এক দরিদ্র ব্যক্তির এক কন্যা ছিল। তার প্রথম অপরাধ, সে কন্যাসন্তান। তার দ্বিতীয় অপরাধ, সে পৃথিবীর বার্ষিক গতিকে থামিয়ে দিতে পারেনি। বয়স বাড়তে বাড়তে কখন যেন সে বারো-তেরো হয়ে গেছে। তৃতীয় অপরাধ, বাবা গরিব। পণের অর্থ জোগাড় করে তাকে পাত্রস্থ করতে পারেনি। ফলে সমাজে গুনগুন। গ্রামের চণ্ডীমণ্ডপে মিটিং। চণ্ডীমণ্ডপ কী বস্তু জানেন নিশ্চয়ই। আপনাদের ওই সোনাযুগের সুপ্রিম কোর্ট। রায় দিয়ে দিলে আর রেহাই নেই। তা সেই চণ্ডীমণ্ডপে সওয়াল হল। সমাজ তো উচ্ছন্নে গেল হে! এ অনাচার যে সহ্য হয় না আর! রায় বেরোল— ওই পরিবারটিকে একঘরে করে দাও। ধোপা নাপিত পুরুত সব বন্ধ। ব্যাটারা মরুক পচে।

তার পর ধরুন, এক ব্যক্তি বিপুল কষ্টে পণের টাকা জোগাড় করে মেয়েকে পাত্রস্থ করেছে। অতি সুপাত্র। নিজ বাড়ি। জমি-জমা, খেত-খামারি। বয়স সামান্য বেশি— ওই সত্তরের আশপাশে। কিন্তু সোনার আংটি আবার বাঁকা! অতএব, দাও ঝুলিয়ে, দাও ঝুলিয়ে। ভবিতব্য, ছোট্ট মেয়েটির অশেষ দুর্গতির জীবন।

আর এখনকার বাঙালি দেখুন। কালচার বলে কিছু আছে! সব বিচিত্র পোশাক পরে লারেলাপ্পা। রবীন্দ্রনাথ নজরুল সুকান্ত বিসর্জন দিয়ে বিজাতীয় চিৎকার! ছিঃ ছিঃ! বাঙালি বলে পরিচয় দিতে লজ্জা করে! লজ্জা তো করবেই। আগের বা তার আগের জেনারেশন তো বুক ফুলিয়ে বলে এসেছে, “আজ একটা বাচ্চা মেয়েকে সতী করে এলুম। খুব কাঁদছিল, পালানোর চেষ্টা করছিল, কিন্তু তা বললে হবে! শাস্ত্র, ধর্ম, সমাজ সবার আগে।”

সত্যিই বুক ফুলিয়ে বলার মতো। স্মার্টফোনের যুগ হলে হয়তো সামাজিক মাধ্যমে পোস্টই দিয়ে দিতেন। দেদার লাইক-লাভ-কমেন্ট।

যাই হোক, সতীদাহ থেকে যে সব মেয়েদের নিষ্কৃতি দিলেন রাজা রামমোহন রায়, তাদের কী হত? যে বয়সে মেয়েটার এক্কা-দোক্কা খেলার কথা, রাতে মায়ের কোল ঘেঁষে শোওয়ার কথা, বাবার গলা জড়িয়ে আদর খাওয়ার কথা, সেই মেয়ের গায়ে সাদা থান চড়িয়ে দেওয়া হল। যেন হিমশীতল বরফে ঢেকে দেওয়া হল তাকে। তার শখেরলম্বা চুলে কেটে দেওয়া হল মুড়িয়ে। তার পর এই করবে না, ও দিকে তাকাবে না, সেই খাবে না— মনে হবে, সাইবেরিয়ান জেলে নিক্ষেপ করা হয়েছে তাকে। আমৃত্যু।

আর এখন, মেয়ের বয়েস তেরো হোক বা তেতাল্লিশ-তিপ্পান্ন, সে নিজেই পার্লারে ছেঁটে আসছে চুল। চুল আমার। সেটা রাপুনজেলের মতো হবে, না মালিঙ্গা-মার্কা— সে সিদ্ধান্তও আমার। হাতের চুড়ি লাল হবে, না নীল, সেটাও। আবার, হাত খালি রাখতেও পারি। একটু রসিকতা করে বলা যায়, হাত খালি তো কী, পকেটে ক্রেডিট কার্ড তো আছে।

মেয়েরা নিজেদেরটা বুঝে নিতে পারে, তারা সেটা নিয়েছে, নিচ্ছে। তাতে অতীতের সোনাযুগের নামে দু’গ্লাস বেশি জল খাওয়া আপনার যদি বদহজম হয়, তা হলে জোয়ানের আরক খান, মশাই। চোঁয়াঢেকুরে বাতাস দূষিত করবেন না।

রোগী ঘিরে গোলটেবিল

আপনাদের সময়, ধরুন কেউ অসুস্থ হল। বাগনান থেকে বনগাঁ, হলদিয়া থেকে হালিসহর— কী ভাবে যেন রটে গেল বার্তা। যেখানে যত আত্মীয়-বন্ধু সবার মন উচাটন। সবাই ছুটে এল রোগী-দর্শনে। রোগীর বাড়ি নয় তো, যেন কুম্ভমেলা। শুধু কি বন্ধু, কিছু শত্তুরও আসত। অসুস্থ লোকটির মরার চান্স কতটা দেখার জন্যে। যারা টাকা ধার নিয়েছে, তারাও আসত— পাওনাদার পটল তুললে ধারের টাকাটা ঝেঁপে দেওয়া যায় কি না খতিয়ে দেখতে। এখন এদের নিয়ে আপনি কী করবেন! কোথায় বসাবেন, কী খেতে দেবেন! দেখা গেল, রোগী সেরে উঠল, কিন্তু বিছানা নিল সেবায়েত।

এখন হাতে হাতে টেকনোলজি। তার ওপর ব্যস্তসমস্ত জীবন। তাই ফোনেই খোঁজ খবর, কুশল সংবাদ। অবশ্য ব্যাপারটা কখনও আরও সহজ করে দেয় রোগীপক্ষ। কেমন করে? কেন, ফেসবুকে নিত্য স্টেটাস দিয়ে।

‘আজ বাবার জ্বর একটু কমেছে। ক’দিন চারের নীচে নামছিল না, আজ আড়াই।’

আপনি শুধু একটা লাইক মেরে দিন।

কেউ হয়তো পোস্ট করল, ‘দাদু এমনিতে ঠিক আছে, কিন্তু কোষ্ঠকাঠিন্য। পেট ভার।’

এটাতে লাইক দেওয়ার আগে দু’বার ভেবে দেখবেন। একটা বিষণ্ণ মুখের ইমোজি দিতে পারেন। তবে উপদেশ দেওয়া যেতেই পারে। পেয়ারা থেকে পেঁপে, ইসবগুলের ভুসি থেকে বেলের শরবত, পাকা কলা থেকে সেদ্ধ ঢেঁড়স। কেউ আবার নানারকম আসন, ব্যায়াম, প্রাণায়ামের পরামর্শ দিতে পারে। কোনটা বেশি ভাল, তা নিয়ে তর্কও চলতে পারে। তবে সবই ফেসবুকে। রোগীর বাড়িতে বসে কয়েক রাউন্ড চা-সহ আড্ডাবাজিতে নয়।

ছবি: রৌদ্র মিত্র।

কানে তুলো, পিঠে কুলো

বিনয়বাবু সেকেলে মানুষ। একটা ব্রিটিশ আমলের সুইচ-টেপা ফোন আছে তাঁর। স্মার্টফোনে সুবিধে করতে পারেননি। যাই হোক, সেই ফোনেই বন্ধুবান্ধব আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ। সেই ফোনেই তিনি মত প্রকাশ করেন,আইন করে মোবাইল ফোন বন্ধ করে দেওয়া হোক। মোবাইল ফোনই নাকি যুবসমাজকে শেষ করে দিচ্ছে। অর্থাৎ, একটা টেকনোলজি ব্যবহার করে সেই টেকনোলজিরই গুষ্টির তুষ্টি করছেন।

এখানে একটা কথা। মোবাইলকে কি এ কাল ঠিকমতো বাগে রাখতে পারছে? বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বলা যায়— না। মোবাইল এখন অপরিহার্য ঠিকই। যোগাযোগ রাখতে, পড়াশোনা করতে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের খবর রাখতে এই যন্ত্রটির নো বিকল্প। কিন্তু এখন জনে জনে মোবাইলকে মাদুলি বানিয়ে ফেলছে, সমস্যা সেখানেই। মোবাইল স্বর্গ, মোবাইল ধর্ম, মোবাইল প্রাণের সুর। দিনরাত্র স্ক্রিনে দৃষ্টি। যেন অর্জুন মাছের চোখ দেখছে। ফস্কালেই গেরো। তার ওপর কানে ঠুলি। একটা কথা মিনিমাম চার বার না বললে হুঁশ ফেরে না। ধরুন, বাসস্ট্যান্ডে এক ছোকরা কানে ঠুলি গুঁজে বুঁদ হয়ে আছে। ঘাড়ও নাড়ছে তালে তালে। আশপাশে কেউ নেই দেখে আপনি তাকেই জিগাইলেন, “ভাই, ফর্টিফোর বি রুটের বাস কি এখান দিয়ে যায়?”

বার চারেক বলার পর সে তার কানকে ছিপিমুক্ত করবে। ভুরু কুঁচকে তাকাবে আপনার দিকে। আপনাকে ফের বুঝিয়ে বলতে হবে। ছোকরা এমন ভাবে ঘাড় নাড়বে যার অর্থ ‘হ্যাঁ’ কিংবা ‘না’ দুটোই হতে পারে। বলতে বলতে, দেখলেন একখানি সিটখালি ফর্টিফোর বি আপনার নাকের ডগা দিয়ে বেরিয়ে গেল। ছোকরার থেকে উত্তর আদায়ে ব্যস্ত আপনি খেয়াল করেননি। হাত দেখাননি, তাই বাসটা দাঁড়ায়নি। এ রকম তারা হামেশাই করে থাকে। মর্জি না হলে তো হাত দেখালেও দাঁড়ায় না। যাক সে কথা, ফিরে আসি ছোকরার কথায়। সে আবার ছিপি আঁটল কানে। তখন আপনার কি অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত ভাবেই মনে হবে না যে, ওই ছিপি কান থেকে খুলে ব্যাটাকে দমাদ্দুম দু’-চার ঘা...!

আর ‘কানে তুলো’র কথা যখন উঠলই, তখন ‘পিঠে কুলো’টাই বা বাদ রাখি কেন!

বাসে-মেট্রোয় প্রায় সকলের পিঠেই ঢাউস ব্যাকপ্যাক। পিছনে আর একটি লোকের জায়গা বেদখল। ভিড় মেট্রোয়, দরজা বন্ধ হওয়ার ঠিক আগে এক যুবক দৌড়ে উঠল। তার পিছনে এক বয়স্ক লোকও ছিলেন। কিন্তু তিনি ওই যুবকের পিছু পিছু মেট্রোয় উঠতে যেতেই ব্যাকপ্যাকের গুঁতো খেয়ে প্ল্যাটফর্মে কুমড়ো-গড়াগড়ি। চার দিকে হায়-হায় ধ্বনি। সেই বয়স্ক মানুষটি অসহায় ভাবে দেখলেন মেট্রোর দরজা বন্ধ হয়ে গেল। কিন্তু মেট্রোয় ঢুকে যাওয়া যুবকটি টের পেল না। তার কানে যে হেডফোনের ছিপি!

অনেক সময় কানে ছিপি আটকেই তারা রাস্তা টপকাতে চায়। কখনও অল্পের জন্যে বেঁচে যায়। আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়ে ওঠে ড্রাইভারের নানা রকমের গালাগালিতে।

তবে মন্দভাগ্য হলে, ড্রাইভারও বাঁচাতে পারে না। একেবারে ভবসিন্ধু পার। এখানেই শেষ নয়, বাই-প্রোডাক্ট আছে। কারণ সব দোষ তো গাড়িওয়ালাদের। ব্যাটারা পয়সা করে ধরাকে সরা জ্ঞান করছে। মুহূর্তের মধ্যে অলিগলি থেকে বেরিয়ে আসবে সমব্যথীরা। হাতে লাঠি, ওয়ান শটার বা ক্ষুরও থাকতে পারে। গাড়িতে আগুন, দোকান ভাঙচুর। দেদার লুঠ। শেষে পথ অবরোধ। হাজার হাজার লোক নাকাল। এ যেন আজ নিত্যদিনের ঘটনা। আপনি বলবেন, “আরে দাদা, আগে জনসংখ্যা কম ছিল, গাড়িঘোড়াও এত ছিল না, অ্যাক্সিডেন্ট হত কম। তাই তেমন চোখে পড়ত না।” সত্যিই কি তা-ই! এতটা হিংস্র ছিল মানুষ আগে! এত খুন-জখম-হামলা হত সে কালে? কিংবা এত নির্বিকার জিঘাংসা? এত নিরাসক্ত হনন? এত নিরুদ্বেগ অপরাধ? কই, মনে পড়ে না তো!

নিরাসক্ত, অমায়িক

এখন মানুষের মায়া বড় কম। সে খুব নিরাসক্ত। কিছুতেই যেন তার আর কিছু আসে যায় না। সেই কারণেই বোধহয় তলানিতে এসে ঠেকেছে গুরুজনদের প্রতি শ্রদ্ধা-সম্মান! শুধু বয়সে বড় হলেই কি প্রণাম করতে হবে? গুরুজন মানেই কি প্রণম্য? এই প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারিনি আমরাও। ফলে প্রণাম প্রথাটাই এখন ডায়নোসর কিংবা ডোডোপাখি হয়ে উঠেছে। আবার পিছু ফিরে নিজের ছোটবেলা যখন দেখি, তখন মনে পড়ে, কত গা-জ্বালানে গুরুজনের পায়ের পাতা খিমচে ছাল তুলে নেওয়ার ইচ্ছে থাকলেও, তা মনে চেপে রেখে সুবোধ বালকের মতো প্রণাম করেছি— শুধু করতে হয় বলে। তা হলে কি এখনকার ছেলেমেয়েদের প্রণাম না-করার সটান প্রতিবাদটাই ভাল? সবটা বুঝতে পারি না। বাস্তবের সাদা-কালো মিশে যখন ধূসর রং নেয়, তখন সাদা-কালো আলাদা করতে মস্তিকের ধূসর বস্তুও সম্ভবত হাল ছেড়ে দেয়।

আমরা শক্তি, আমরা বল

এই না হলে ছাত্রদল! ছাত্র মানেই, যা ইচ্ছে তা-ই করব। আমি স্টুডেন্ট, তাই আমার জন্যে কোনও আইন নেই। শিক্ষক পেটাব, ভাংচুর করব, বাসে-ট্রেনে টিকিট কাটব না, ফেল করেও পাশ করানোর দাবিতে পথ অবরোধ করব। আমি নিশ্চিত, পরীক্ষা বানান জিজ্ঞেস করলে এরা কেউই পারবে না। পরীক্ষা শেষে উন্মত্তের মতো নাচব। পাঠ্যবইয়ের পাতা কুচিকুচি করে ছিঁড়ে রাস্তায় ছড়িয়ে পালন করব জয়োৎসব। কার জয়! সহজ উত্তর, সভ্যতার কান রগড়ে দিয়ে অসভ্যতার। পরীক্ষায় পাশ তাদের জন্মগত অধিকার, তার জন্যে পড়াশোনা করে সময় নষ্ট করে কোন বোকা! কী হবে লেখাপড়া করে! চাকরি-বাকরি আছে নাকি কোথাও! লেখাপড়া করতে বলে সেকেলে লোকেরা, বুড়ো-হাবড়ারা। তাদের কথা কে কবে শুনেছে! লেখাপড়া করার ধারণাটা যে তাদের আগেই ঘাটে চলে গেছে, তাও ব্যাটারা জানে না, এত ব্যাকডেটেড!

হিন্দির বর্গি হানা

হিন্দু-হিন্দি-হিন্দুস্থান— এর চক্করে তো এর পর প্রকাশ্যে মুখ খুলতেই বুক ধুকপুক করবে! বাপরে বাপ! ব্যাপার যা দেখছি, হিন্দি না জানলে, কিছু দিনের মধ্যেই হয়তো ভোটাধিকার চলে যাবে। কিংবা মাথা নেড়া করে ঘোল ঢেলে রাস্তায় রাস্তায় ঘোরাবে। দোকানের সেলসম্যান, বাসের কন্ডাক্টর, ট্যাক্সির ড্রাইভার, কম্পাউন্ডার, মাছওলা, দুধওলা, ফলওলা— সব হিন্দিমে বাত। ব্যাপারটা যে দিকে এগোচ্ছে, কিছু দিন পরই হয়তো শুনতে হবে— বাঙালি হয়ে তুমি হিন্দি জানো না, তা হলে বাংলা থেকে দূর হটো! বাংলা ভাষা নাকি কিছু দিন আগেই ধ্রুপদী ভাষার মর্যাদা পেল। মানে কী দাদা-দিদিরা? এই ভাষায় আর রোজকার কথোপকথন চলবে না? লেবেল এঁটে মিউজ়িয়মে সাজিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা হবে? আচ্ছা, সেই জন্যই কি আজকাল লোকজনের কথ্য বাংলা এত বেঁকেচুরে যাচ্ছে? সে দিন শহরের রাজপথে দু’টি মেয়ের কথোপকথন শুনে আমি আর একটু হলে ভিরমি খেয়ে পড়ে যাচ্ছিলাম।

একটি মেয়ে বলছে, “তোর মতো একটা মেয়েকে আমি বলে এত দিন ধরে ঝেলছি, অন্য মেয়ে হলে কবে হাত ধুয়ে ফেলত!”

অন্য মেয়েটি উত্তরে বলছে, “আর আমি তোর জীবনে কম বড় ভূমিকা নিভিয়েছি! এখন আমার এক্স বয়ফ্রেন্ড তোর ওপর ডোরি ডালছে বলে, আমি হয়ে গেছি দুধ মে মক্ষি, রাইট?”

সেখানে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারিনি। বাংলা ভাষার এ রকম শ্লীলতাহানি এর আগে কানে আসেনি। এ যদি এখনকার ধরন হয়, তা হলে আর বাংলার জন্য শোক করা বৃথা! হিন্দি, মৈথিলি, কন্নড়, সোয়াহিলি, এসপেরান্তো— কাউকেই আর আটকানো যাবে না হয়তো।

শেষে একটা গোপন কথা। কিছু দিন আগে, আমাকে এক ‘সেকেলে’ মুখ ফসকে বলে ফেলেছিলেন, তাঁদেরও নাকি বাপ-জেঠাদের কাছে ‘এ কাল-সে কাল’ শুনতে হত। এবং বিশ্বস্ত সূত্রের খবর, তাঁদের বাপ-জেঠারাও নাকি এই একই ভর্ৎসনা শুনেছে যৌবনকালে। তা হলে কি বুঝতে হবে বাঙালির সরল মন, অতীতের ভালগুলোকেই শুধু মনে রাখে, আর খারাপ জিনিসগুলো মনে করতেই চায় না? হতেও পারে!

কী আর করা যাবে, শুধু দেখে যাওয়া ছাড়া।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন

এটি একটি প্রিমিয়াম খবর…

  • প্রতিদিন ২০০’রও বেশি এমন প্রিমিয়াম খবর

  • সঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকার ই -পেপার পড়ার সুযোগ

  • সময়মতো পড়ুন, ‘সেভ আর্টিকল-এ ক্লিক করে

সাবস্ক্রাইব করুন