ছবি কুনাল বর্মণ।
পূর্বানুবৃত্তি: অমরেন্দ্রনাথের ছেলের এক বার প্রবল জ্বর হয়। ডাক্তারের চিকিৎসায় সাড়া না মেলায় বাড়িতে কান্নার রোল ওঠে। শেষ প্রচেষ্টা হিসেবে জল-চিকিৎসা প্রয়োগ করেন অমরেন্দ্রনাথ। সুস্থ হয়ে ওঠে তাঁর ছেলে। ধীরে ধীরে খবর ছড়িয়ে পড়ে চার দিকে। সে সময় ঘরে ঘরে জ্বরের প্রাদুর্ভাব। অনেকে তাঁর জল-চিকিৎসায় আরোগ্যের মুখ দেখল। কিন্তু বাড়ির লোকের আপত্তিতে এই চিকিৎসা বন্ধ করে দিতে হল অমরেন্দ্রনাথকে। এমন সময় গোপালচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় নামে এক পরিচিত বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষ দেখা করতে আসেন তাঁর সঙ্গে। অমরেন্দ্রনাথের যাবতীয় অসুবিধের কথা শোনার পর গোপালবাবু তাঁর একটি দোতলা বাড়ি ছেড়ে দেওয়ার কথা বলেন জল-চিকিৎসা চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। সেই বাড়ি দেখে পছন্দ হয় অমরেন্দ্রনাথের। তিনি সেই বাড়িতে একটি বিদ্যালয় স্থাপন করারও পরিকল্পনা করেন। আরও ভেবে রাখেন, বিপ্লবীদের আত্মগোপনেরও উপযুক্ত জায়গা হয়ে উঠতে পারে এই বাড়িটি।
আজও রবীন্দ্রনাথের অনেক রাত হয়ে গেল একটি প্রবন্ধ শেষ করতে। লিখতে লিখতে তাঁর মনে হয়েছে, প্রবন্ধটি জনমানসে বিতর্কের সৃষ্টি করবে। পাঠ করলে কিছু মানুষ তাঁকে ভুল বুঝতে পারেন। কিন্তু এ বিষয়ে তাঁর কিছু করার নেই। বিদেশ থেকে কিছু দিন হল দেশে ফিরেছেন তিনি। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি তাঁকেও নাড়া দিয়েছে। মানুষ চাইছে, রবীন্দ্রনাথ কিছু লিখুন। তাই তিনি বাধ্য হয়ে লিখলেন এই প্রবন্ধটি। নাম দিলেন, ‘শিক্ষার মিলন’। আগামী কাল প্রবন্ধটি তিনি শান্তিনিকেতনে উত্তরায়ণ প্রাঙ্গণে পাঠ করে শোনাবেন উৎসাহী শ্রোতৃবৃন্দকে।
রবীন্দ্রনাথ জানালা দিয়ে অদূরে ছাতিম গাছের দিকে তাকালেন। ঝাঁকড়াচুলো এক রাক্ষস যেন দাঁড়িয়ে আছে। ওই ছাতিম গাছের নীচেই তিনি পাঠ করবেন ‘শিক্ষার মিলন’। তিনি জানেন, কংগ্রেসের একটা অংশ তাঁর উপর রুষ্ট হবে। জনসাধারণও তাঁর মতামত ভাল ভাবে নেবে না। তারা এখন একটা নেশায় বুঁদ হয়ে আছে— অসহযোগ আন্দোলনের নেশা। মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী নামে এক ব্যক্তির নামের মোহে তারা এখন অন্ধ। ভাল-মন্দ বিচার করার শক্তি তাদের হারিয়ে গেছে।
পরদিন প্রবন্ধটি পাঠে তেমন বিরূপ প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেল না। তার কারণ অবশ্য রবীন্দ্রনাথের জানা। উপস্থিত প্রায় সকলেই রবীন্দ্র-অনুরাগী। রবীন্দ্রনাথ প্রবন্ধ পাঠ করবেন, আর তারা সমালোচনা করবে, এমনটা ভাবা অসম্ভব। বিরূপ প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেল এর চার দিন পর, কলকাতায়। জাতীয় শিক্ষা পরিষদ আয়োজিত, ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলে পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহে রবীন্দ্রনাথ দ্বিতীয় বার পাঠ করলেন ‘শিক্ষার মিলন’। গুঞ্জন, ফিসফাস শুরু হয়ে গেল। রবীন্দ্রনাথ কি তবে গান্ধীবিরোধী? যে অসহযোগ আন্দোলন ঘিরে জনসাধারণের মধ্যে এমন উন্মাদনা, রবীন্দ্রনাথ তা পছন্দ করেন না? রবীন্দ্রনাথ নিজেও কংগ্রেসের সমর্থক, তা হলে কি সবটাই লোক দেখানো? কবিকেও বোঝাতে হবে যে, তিনি নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন বলেই, যা বলবেন তা মানুষ মেনে নেবে না। এরও প্রতিবাদ করা দরকার।
বলতে হল না কাউকে। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এগিয়ে এলেন প্রতিবাদ করতে। হাওড়া জেলা কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট হিসেবে এ দায়িত্ব তিনি ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারলেন না। গৌড়ীয় সর্ববিদ্যা আয়তনে তিনি তাঁর সুললিত কণ্ঠে পাঠ করে শোনালেন স্বরচিত প্রবন্ধ, ‘শিক্ষার বিরোধ’।
কংগ্রেস সমর্থকরা ধন্য ধন্য করে উঠল। কারণ এ ভাষণ ছিল রবীন্দ্রনাথের ‘শিক্ষার মিলন’-এর উপযুক্ত জবাব। এখানেই থেমে থাকল না ব্যাপারটা। দু’দিন পর আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের সভাপতিত্বে কলকাতার আলফ্রেড থিয়েটার হলে রবীন্দ্রনাথকে আবার পাঠ করতে হল ‘শিক্ষার মিলন’। এত অল্প সময়ের ব্যবধানে আবার এই প্রবন্ধটি পাঠ করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ছিল না রবীন্দ্রনাথের। একই কথা বার বার বলতে তাঁর ভাল লাগে না। কিন্তু, তাও তিনি পাঠ করলেন, কারণ সভার উদ্দেশ্য ছিল স্বতন্ত্র। উদ্যোক্তারা তাঁকে জানিয়েছিল যে, এই অনুষ্ঠানের বিক্রীত টিকিটের অর্থ খুলনার দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের জন্য ব্যয় করা হবে।
প্রবন্ধ পাঠের পর রবীন্দ্রনাথ একটু গরম জল পান করছিলেন। উদ্যোক্তারা চা-পানের ব্যবস্থা রেখেছিল। কবিকে চা খাওয়ার অনুরোধ জানিয়েছিল। কিন্তু কবি সেই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে একটু গরম জল সেবনের ইচ্ছে পোষণ করেন। বলেন, এতে তাঁর গলার উপকার হবে। গরম জলের পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতেই টের পাচ্ছিলেন বাইরের আঁচ। মৃদু হাসছিলেন তিনি। মনে মনে এমনটাই আন্দাজ করেছিলেন।
গরম জল খাওয়ার পর গলায় খানিকটা আরাম বোধ করলেন রবীন্দ্রনাথ। তার পর দীর্ঘকায় মানুষটি উঠে দাঁড়ালেন চেয়ার থেকে। সমবয়সি প্রফুল্লচন্দ্র কাছেই ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তাকেই বললেন, “এ বার উঠি হে। বাকিটা তোমরা সামলাও।”
প্রফুল্লচন্দ্র বুঝলেন কবির ইঙ্গিত। একটু হাসলেন। তার পর কবিকে এগিয়ে দিলেন তার গাড়ি পর্যন্ত। রবীন্দ্রনাথ যখন তাঁর গাড়ির কাছাকাছি, দু’টি যুবক এসে রবীন্দ্রনাথের পা ছুঁয়ে প্রণাম করল। কবি একটু অবাক হলেন। অনেকেই দূর থেকে তাঁকে দেখে তির্যক মন্তব্য করছিল। সেখানে প্রণাম প্রাপ্তিটা তাঁর কাছে একটু বেমানান মনে হল। যুবক দু’টির দিকে চেয়ে রবীন্দ্রনাথ মৃদু হাসলেন, তার পর গাড়িতে উঠে পড়লেন।
রবীন্দ্রনাথের পা স্পর্শ করে এক অদ্ভুত শিহরণ অনুভব করল শশিকান্ত। এত সামনে থেকে রবীন্দ্রনাথকে দেখা এই প্রথম। ছেলেবেলায় মামা বলেছিলেন, রবীন্দ্রনাথের কাছে তাকে নিয়ে আসবেন। শশিকান্ত আসতে চায়নি। ভয় পেয়েছে। দাড়ি-গোঁফে ভরা ওই মুখটা দেখে তার কেমন যেন ভয় করত। আজও ভয়-ভয় করছিল। অত বড় মানুষ, আর সে কত সামান্য! যেন পাহাড়ের কাছে যেন এক মূষিকশাবক। সে আসতেই চায়নি এই অনুষ্ঠানে। রাজনৈতিক নেতাদের লম্বা-চওড়া ভাষণ শুনতে তার একদম ভাল লাগে না। এমন সব বক্তব্য রাখেন কেউ কেউ, যেন মনে হয় স্বাধীনতা এল বলে। শুধু হরপার্বতীর জন্য এখানে আসা। অনেক দিন পর সে দিন হরপার্বতীর সঙ্গে দেখা হয়েছিল ডালহৌসি স্কোয়ারে।
শশিকান্তকে দেখে অবাক হয়ে গেছিল হরপার্বতী। বলেছিল, “তুমি এখানে কী করছ?”
শশিকান্ত উত্তর দিয়েছিল, “সবাই যা করতে এখানে আসে।”
“তুমি চাকরি করো নাকি! কত দিন?” অবাক হয়ে প্রশ্ন করেছিল হরপার্বতী।
“হ্যাঁ, এই মাসদুয়েক।”
“কোথায়?”
“একটা মার্চেন্ট অফিসে। ব্রিটিশ ফার্ম।”
“কলেজ? পড়াশোনা?”
“ও সবে ইতি টেনেছি। সে অনেক কথা... তোমাকে পরে এক দিন বলব। কিন্তু এই দুপুরবেলা ছাত্র না পড়িয়ে ডালহৌসি স্কোয়ারে ঘুরে বেড়াচ্ছ যে... কী ব্যাপার?”
“আজকে কলেজ যাইনি। এখানে একটা বইয়ের দোকানে একটি বই খুঁজতে এসেছিলাম। পেলাম না। তা তুমি কি আবার অফিসে ফিরে যাবে?”
“হ্যাঁ, সে তো যেতেই হবে।”
“দেখো না একটু ম্যানেজ করতে পারো কি না, তা হলে এক জায়গায় নিয়ে যাব তোমায়।”
“কোথায় নিয়ে যাবে?”
“আলফ্রেড হলের একটা অনুষ্ঠানে। ওখানে এক জন বিখ্যাত মানুষ বক্তব্য রাখবেন।”
“তা আমি গিয়ে কী করব সেখানে। তা ছাড়া, আমার এই সব বক্তৃতা শুনতে ভাল লাগে না।”
“ভেবে দেখো শশী, এখানে বক্তব্য রাখবেন এমন এক জন, যাঁকে চোখের সামনে দেখাটা সৌভাগ্যের ব্যাপার।”
শশিকান্তর ভ্রুযুগল কুঞ্চিত হয়ে উঠল। হরপার্বতীর দিকে উদ্গ্রীব হয়ে তাকিয়ে রইল সে।
হরপার্বতী পকেট থেকে একটি টিকিট বার করে শশিকান্তকে দেখাল।
খুলনার দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের সাহায্যকল্পে একটি অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘শিক্ষার মিলন’ প্রবন্ধটি পাঠ করবেন, শশিকান্ত টিকিটটা দেখে ফিরিয়ে দিল হরপার্বতীকে। বলল, “এই প্রবন্ধটি নিয়ে খুব হইচই হচ্ছে না চার দিকে?”
“হ্যাঁ, গান্ধীবিরোধী লেখা। চলো শুনে আসি...” হরপার্বতী বলল।
শশিকান্ত রাজি হয়ে যায়।
এখন শশিকান্ত ভাবছে, ভাগ্যিস ও এসেছিল, না হলে এই রকম এক জন মহাপুরুষের সাক্ষাৎ লাভ হত না, বক্তব্য শোনা-ও হত না।
রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে গাড়িটি চলে যাওয়ার পর অনেক ক্ষণ দুই বন্ধু কোনও কথা বলেনি। প্রথম কথা শশিকান্ত বলল, “কী ব্যক্তিত্ব! তাই না?”
“হ্যাঁ, সত্যিই তাই। আমাদের গর্ব, উনি এই দেশে জন্মেছেন,” হরপার্বতী বলল।
“কিন্তু হর, প্রবন্ধপাঠের পর দর্শকদের প্রতিক্রিয়া দেখেছ? কেউ কেউ তো সরাসরি অত বড় মানুষটাকে গালাগাল করতেও ছাড়ছে না।”
“দেখেছি। তবে এরা প্রায় সকলেই কংগ্রেসি। ভাবছে, কবি বোধহয় তাদের নতুন নেতা মোহনদাস গান্ধীকে আক্রমণ করছে। তোমার কি তাই মনে হল?
“না, আমার মনে হল অসহযোগ আন্দোলনের কিছু বিষয় নিয়ে কবি সমালোচনা করলেন।”
“আমার মন বলছে, কবি আরও স্পষ্ট করে কিছু বলবেন। যাক, তুমি কি এখন বাড়ি ফিরে যাবে, না কি আমার সঙ্গে অন্য একটি জায়গায় যাবে?”
“কোথায় যাবে তুমি এখন?”
“চলোই না। কথা দিলাম, ঠকবে না।”
চৌরঙ্গী থেকে বৌবাজার। কথা বলতে বলতে হেঁটেই চলে এল দুই বন্ধু। বৌবাজারে ভীমচন্দ্র নাগের দোকানের সামনে দিয়ে যেতে যেতে শশিকান্ত প্রশ্ন করল, “কী ব্যাপার বলো তো, তুমি কি আমাকে ভীম নাগের সন্দেশ খাওয়াতে নিয়ে এলে?
“ভীম নাগের সন্দেশ পরে হবে’খন। এখন এসো আমার সঙ্গে...” বলে শশিকান্তর হাত ধরে একটা স্বল্পপরিসর পত্রিকা অফিসে এসে উপস্থিত হল হরপার্বতী। শশিকান্ত দেখল, ঘরে ঢোকার মুখে একটা সাইনবোর্ডে লেখা আছে ‘বিজলী’। বিজলীর অনেক সংখ্যাই শশিকান্ত পড়েছে। খুবই মনোগ্রাহী একটি পত্রিকা। একটি সংখ্যা পড়লে মনে হয়, পরেরটা পড়ি। বিশেষ করে ‘ঊনপঞ্চাশী’ পড়লে। সত্যি বলতে কি, এই ‘ঊনপঞ্চাশী’র টানেই সে ‘বিজলী’র অনেকগুলো সংখ্যা কিনেছে। মাঝে মাঝে শশিকান্তর মনে হয়েছে, এই ‘ঊনপঞ্চাশী’র লেখকের সঙ্গে যদি এক বার দেখা হয়! কিন্তু দেখা হলেই বা কী হবে? এই পত্রিকায় তো কেউ নিজের নামে লেখেন না। সকলেরই ছদ্মনাম। সুতরাং, শশিকান্ত জানবেই বা কী করে ‘ঊনপঞ্চাশী’র আসল লেখক কে।
টেবিলের উপর মাথা ঝুঁকিয়ে এক ভদ্রলোক কিছু লিখে চলেছিলেন। পায়ের শব্দে মাথা তুলে তাকালেন ও হরপার্বতীকে দেখে বললেন, “হর, কী মনে করে এ পথে?”
হরপার্বতী শশিকান্তর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল ভদ্রলোকের। বলল, “আমার বন্ধু, শশিকান্ত। আমরা দু’জনে একটু আলফ্রেড থিয়েটারে এসেছিলাম।”
“রবি ঠাকুরের ‘শিক্ষার মিলন’ শুনতে? আমারও যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এমন একটা কাজে আটকে গেলাম... যাক, তোমাদের কেমন লাগল প্রবন্ধ পাঠ?” ভদ্রলোক বললেন।
শশিকান্ত বলল, “আমার তো খুবই ভাল লেগেছে। প্রত্যেকটি কথাই খুবই যুক্তিপূর্ণ। রবীন্দ্রনাথের যুক্তিগুলোর সঙ্গে আপনাদের ‘ঊনপঞ্চাশী’র মিল পেলাম।”
“তাই নাকি?” বলে ভদ্রলোক সোজা হয়ে বসলেন। শশিকান্তর দিকে খানিক ক্ষণ চেয়ে থেকে বললেন, “তুমি ‘বিজলী’ পড়ো নাকি?”
“নিশ্চয়ই!” শশিকান্ত উত্তর দেয়, “ওই ‘ঊনপঞ্চাশী’র জন্যই পড়ি।”
“বেশ, শুনে খুব ভাল লাগল যে, তুমি আমাদের পত্রিকার নিয়মিত পাঠক। তবে ভাই, তুমি রবিঠাকুরের যুক্তির মধ্যে আমাদের সঙ্গে মিল যেমন পেয়েছ, অমিলও আছে। রবীন্দ্রনাথ অহিংস নীতিকে সমর্থন করেছেন। আমরা করিনি। আমরা একটু-আধটু হিংসার সমর্থক। আরে বাবা, ওয়াশিংটন যদি কাঁদুনি গেয়ে বলতেন যে, আমেরিকাকে স্বাধীন না করে দিলে তিনি মনের দুঃখে সাত রাত্রি উপোস করে মারা যাবেন, না হয় গলায় কাপড় বেঁধে সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়বেন, তা হলে আজ আমেরিকার দুঃখে শেয়াল-কুকুর কাঁদত।” বলে ভদ্রলোক হো-হো করে হেসে উঠলেন।
শশিকান্ত বলে উঠল, “‘ঊনপঞ্চাশী’ থেকে বললেন, না?”
“‘উনপঞ্চাশী’র লেখক অন্যের কথা ধার করবেন কেন?” হরপার্বতী হাসতে হাসতে বলল।
“আপনি... মানে, আপনার হাত দিয়েই...”
শশিকান্তকে কথা শেষ করতে না দিয়ে হরপার্বতী বলে উঠল, “হ্যাঁ শশী, তুমি যাঁর সঙ্গে কথা বলছ, তিনি ‘বিজলী’তে ‘ঊনপঞ্চাশী’র লেখক উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, যিনি দ্বীপান্তরের কারাগারে বারো বছর কাটিয়ে এসে কলম ধরেছেন।”
শশিকান্তর উত্তেজনা তখনও কাটেনি। কিছু বলতে যাচ্ছিল সে। কিন্তু বলতে পারল না। ঘরের মধ্যে আরও এক ভদ্রলোকের আগমন ঘটেছে। ভদ্রলোককে দেখে উঠে দাঁড়ালেন উপেন্দ্রনাথ। বললেন, “আপনিই কি...”
“সুভাষচন্দ্র বসু। হেমন্ত নিশ্চয়ই আপনাকে জানিয়েছে...” বলে নমস্কার জানালেন ভদ্রলোক।
“হ্যাঁ হ্যাঁ, হেমন্ত একটু আগে এসেছিল লেখা জমা দিতে। বলল আপনার কথা। আমার সৌভাগ্য, আপনি এসেছেন। বসুন এখানে...” বলেই উপেন্দ্রনাথ একটি খালি চেয়ার দেখালেন।
আগন্তুক ভদ্রলোক বসতে বসতে বললেন, “আপনার সঙ্গে একটু আলোচনার প্রয়োজনে এখানে এলাম।”
উপেন্দ্রনাথ হরপার্বতীর দিকে তাকালেন।
হরপার্বতী ও শশিকান্ত তত ক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে। হরপার্বতী নিজেও বুঝতে পেরেছে যে, আলোচনাটা খুবই ব্যক্তিগত। তাদের সেখানে থাকা চলে না। উপেন্দ্রনাথের থেকে বিদায় নিয়ে দুই বন্ধু সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করে।
নামতে নামতে শশিকান্ত বলে ওঠে, “এই ভদ্রলোকের ছবি আমি কাগজে দেখেছি।”
হরপার্বতী বলে, “আমিও শুনেছি ওঁর কথা। বিলেতে আইসিএস পরীক্ষায় সফল হয়েও সরকারের বড় চাকরি না করে দেশসেবা করছেন। চিত্তরঞ্জন দাশের খুব কাছের মানুষ। আগামী দিনের নেতা। দেখ, এই সুভাষচন্দ্র বসুর হাতেই এক দিন স্বাধীনতা আসবে।”
“সে আসুক। কিন্তু হর, ভীম নাগ যে চলে যাচ্ছে...” শশিকান্ত বলে।
‘‘ভোলোনি দেখছি!’’ বলে মৃদু হেসে হরপার্বতী শশিকান্তকে নিয়ে ভীম নাগের দোকানে ঢোকে।
ক্রমশ