ধারাবাহিক উপন্যাস পর্ব ২১
Bengali Serial Novel

খরস্রোত

খবর এল অমরেন্দ্রনাথের কাছে। অদূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন যাদুগোপাল মুখোপাধ্যায় ও অতুল ঘোষ। দু’জনেই ঘোষণা করলেন, “কিছুতেই ধরা পড়া চলবে না। দরকার হলে লড়াই করে প্রাণ দেব।”

Advertisement

গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২১ জুলাই ২০২৪ ০৫:২৩
Share:

ছবি কুনাল বর্মণ।

পূর্বানুবৃত্তি: পাপড়ি বাইকে সঙ্গে নিয়ে বজরায় চেপে প্রমোদ-ভ্রমণে বেরিয়েছে উমানাথ। সঙ্গে আছে নিবারণও। সে মাঝির সঙ্গে গল্প করতে করতে চলেছে। আর বজরার ভিতরে পাপড়ি বাইয়ের সঙ্গে রসালাপে ব্যস্ত উমানাথ। পাপড়ি বাই নিবারণের থেকে জানতে পেরেছে যে, উমানাথের বিয়ের কথাবার্তা চলছে। কিন্তু পাপড়ির মুখে সে কথা শুনে অস্বস্তিতে পড়ে উমানাথ। পাপড়িকে সে জানিয়ে দেয় যে, উমানাথের বিয়ে হয়ে গেলেও, তার জীবনে পাপড়ি যেমন আছে, তেমনই থেকে যাবে। গান ও নেশায় নদীবক্ষে কেটে যায় সময়। অন্য দিকে চন্দননগরের ফেরিঘাটে লুকিয়ে নজর রাখছে বিপ্লবী নলিনী ঘোষ। সে নিজেও আত্মগোপনকারী। জার্মান ষড়যন্ত্রীদের এক জন। ব্রিটিশ পুলিশ তাকে দেখলেই গ্রেফতার করবে, তবু সে এসেছে ফরাসি পুলিশের দেওয়া একটি খবরের সত্যাসত্য স্বচক্ষে যাচাই করতে। নলিনীর সঙ্গে আছে স্থানীয় যুবক মতিলালও।

Advertisement

লঞ্চটি ঘাটে এসে ভিড়ল। গ্যাসলাইটের মৃদু আলোয় দেখা গেল, এক দীর্ঘকায় ইংরেজ সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে আসছে। তার পিছনে জনা দশেকের একটি দল।

নলিনী মতিলালের কানে মুখ ঠেকিয়ে ফিসফিস করে বলল, “টেগার্ট, দ্য বাস্টার্ড!”

Advertisement

তার পর দু’জনেই অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।

খবর এল অমরেন্দ্রনাথের কাছে। অদূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন যাদুগোপাল মুখোপাধ্যায় ও অতুল ঘোষ। দু’জনেই ঘোষণা করলেন, “কিছুতেই ধরা পড়া চলবে না। দরকার হলে লড়াই করে প্রাণ দেব।”

নলিনী ও মন্মথও সহমত হলেন যাদুগোপাল ও অতুলের কথায়। চুপ করে রইলেন অমরেন্দ্রনাথ।

“অমরদা চুপ করে গেলেন যে! কিছু বলুন। এই পরিস্থিতিতে আমাদের করণীয় কী? চন্দননগরে যেখানেই আত্মগোপন করি না কেন, ওরা আমাদের খুঁজে বার করবেই। তার চেয়ে ডাইরেক্ট অ্যাকশনে যাওয়াটাই কি ঠিক হবে না?” যাদুগোপাল বললেন।

অমরেন্দ্রনাথ উত্তর দেওয়ার আগেই অতুল ঘোষ বলে উঠলেন, “কাছেই একটা বাড়ি তৈরি হচ্ছে। চুন, সুরকি, আর ইটের স্তূপ হয়ে আছে। ওইখানে লুকিয়ে থাকলে মন্দ হয় না। মনে হয় না, পুলিশের চোখ ও দিকে যাবে।”

মতিলাল বলল, “ওটা রূপলাল নন্দীর বাড়ি। ওই বাড়িতে কেউ থাকে না। ওখানে অন্ধকারে গা ঢাকা দেওয়া সবচেয়ে সহজ। সকালবেলায় দিনের আলোয় অন্য ব্যবস্থা করা যাবে।”

নলিনী বলে উঠল, “ঠিকই বলেছে মতিলাল। ও চন্দননগরের ছেলে। ওর মতামতের একটা গুরুত্ব আছে। তা ছাড়া বাড়িটা আমিও দেখেছি। ডাইরেক্ট অ্যাকশনের জন্য উপযুক্ত জায়গা।”

অমরেন্দ্রনাথ চেয়ারে বসে সকলের মতামত শুনছিলেন। এ বার একটু নড়েচড়ে উঠলেন। যেন তাঁর ধ্যানভঙ্গ হল। বললেন, “তোমাদের প্রত্যেকের মতামত শুনে আমার মনে হল, তোমরা কেউ ধরা দিতে চাও না, আর ধরা পড়ার থেকে লড়াই করে মৃত্যুবরণ করাকেই শ্রেয় মনে করো, তাই তো?”

“একদম। আপনি ঠিকই ধরেছেন অমরদা। এ বার আপনি বলুন আমরা কী করব?” যাদুগোপালের কণ্ঠস্বরে উদ্বেগ স্পষ্ট।

অমরেন্দ্রনাথ উঠে খানিক ক্ষণ পায়চারি করলেন। তার পর আবার চেয়ারে বসে পড়লেন। বললেন, “আমার কথা যদি শোনো, তা হলে কাউকে ধরাও পড়তে হবে না, লড়াইও করতে হবে না। তবে ঝুঁকি আছে। সেই ঝুঁকিটা নিতে হবে। রাজি আছ?”

“আপনার প্ল্যানটা তো বলুন আগে,” যাদুগোপাল বললেন।

অমরেন্দ্রনাথ বললেন, “সানাই বাজছে, শুনছ?”

সঙ্গে সঙ্গে মতিলাল বলল, “কেন শুনব না। সকাল থেকেই বাজছে। হারুকাকার মেয়ের বিয়ে আজ। কিন্তু এর সঙ্গে আমাদের কী সম্পর্ক?”

“আপনি কি সিরিয়াস?” অতুল ঘোষের কণ্ঠস্বরে বিরক্তি স্পষ্ট।

“তোমাদের থেকেও বেশি, অতুল। পুরো পরিকল্পনাটা শোনো আগে,” অমরেন্দ্রনাথ বললেন।

“বলুন অমরদা,” যাদুগোপাল বললেন।

অমরেন্দ্রনাথ শুরু করলেন, “আমার ধারণা টেগার্ট তার দলবল নিয়ে ভোররাতে রেড করবে। সুতরাং আমাদের লক্ষ্য হবে, এখন থেকে ওই সময় পর্যন্ত গা ঢাকা দিয়ে থাকা। পাশের ওই বিয়ে বাড়িতে এত লোকজনের মধ্যে মিশে যাওয়া খুব সোজা। কনেপক্ষ ভাববে, আমরা বরপক্ষের লোক। আর বরপক্ষ ভাববে, আমরা কনেপক্ষের। ঝুঁকি আছে মানছি, তবে একটু অভিনয় করতে পারলে, এর থেকে ভাল আইডিয়া আর হয় না।”

“অসম্ভব। ওটা হারুকাকার বাড়ি। ওখানে আমায় সবাই চিনে ফেলবে,” মতিলাল জোর গলায় তার অসম্মতি জানাল।

“জানি, তোমার পক্ষে এখানে গা ঢাকা দেওয়া সম্ভব নয়। তাই তুমি তোমার বাড়ি ফিরে যাবে,” অমরেন্দ্রনাথ বললেন।

“আর আমার বাড়িতে যদি রেড হয়?” মতিলালের গলায় উদ্বেগ।

“তার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। আমার ধারণা, টেগার্টের লক্ষ থাকবে এই বিশেষ অঞ্চলটা। আমরা যে এই অঞ্চলে আত্মগোপন করে আছি, সেটা আর ইংরেজ গোয়েন্দাদের অজানা নেই,” অমরেন্দ্রনাথ উত্তর দিলেন।

“তা হলে তো আমরা মতিলালের বাড়িতে গিয়েই উঠতে পারি,” নলিনী ঘোষ যুক্তি দিলেন।

অমরেন্দ্রনাথ বললেন, “পারতাম, যদি মতিলালের বাড়ি পাশেই হত। এত জন মিলে এত রাতে ওর বাড়িতে গেলে, ওর প্রতিবেশীদের মধ্যে সন্দেহ জাগতে পারে।”

যাদুগোপাল অনেক ক্ষণ চুপ করে ছিলেন। এই বার বললেন, “অনেক ভেবে দেখলাম, অমরদার প্রস্তাবটাই ঠিক। ঝুঁকি আছে, আবার মজাও আছে। প্রত্যেকে পাট-ভাঙা ধুতি ও পিরান পরে নাও। এক্ষুনি বেরোতে হবে।”

অমরেন্দ্রনাথ হাসেন। হাসতে হাসতেই বলেন, “সবাই পিস্তল সঙ্গে রেখো।”

মতিলাল বেরিয়ে যাচ্ছিল। অমরেন্দ্রনাথ তাকে থামালেন। বললেন, “তোমাকে আর একটি কাজের দায়িত্ব দিচ্ছি। সকাল সাতটা-সাড়ে সাতটার মধ্যে এখানকার হালচাল আমাদের জানাতে হবে। আশা করি, তার মধ্যেই টেগার্টের অপারেশন হয়ে যাবে। আমরাও স্বস্থানে ফিরে আসব।”

“ঠিক আছে,” বলে মতিলাল বেরিয়ে গেলে, অন্যরা অমরেন্দ্রনাথের নেতৃত্বে বিয়েবাড়ির উদ্দেশে যাত্রা করল। বিয়েবাড়িতে অনেক লোক। রাত্রির লগ্নে বিয়ে। সুতরাং মেয়েরা ভিড় করেছে ছাঁদনাতলায়। অমরেন্দ্রনাথ আর সকলে ও দিকে না গিয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকল। এক সময় সুযোগ বুঝে পাতে বসে খেয়েও নিল। সব কিছুই ঠিকঠাক চলছিল। কিন্তু কে ভেবেছিল, ঝাঁকড়ির বর রাজশেখরকে এখানে দেখতে পাবেন অমরেন্দ্রনাথ! ঝাঁকড়ি অমরন্দ্রেনাথের পিসতুতো বোন। রাজশেখর অমরেন্দ্রনাথকে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করে বসল, “আপনি এখানে অমরদা?”

অমরেন্দ্রনাথ মনে মনে ভাবলেন, যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধে হয়। তবু সাহসে
বুক বেঁধে বললেন, “তুমি কোন পক্ষের ভাই— বরের না কনের?”

রাজশেখর সহাস্যে বলল, “বর আমার খুব কাছের বন্ধু, অমরদা।”

অমরেন্দ্রনাথ এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিলেন। রাজশেখরকে হাত ধরে একটা নিরিবিলি জায়গায় নিয়ে গিয়ে সব বললেন।

রাজশেখর বলল, “কোনও চিন্তা করবেন না অমরদা, আমি সব সামলে দেব। এই মুহূর্ত থেকে আপনারা বরপক্ষের লোক। কেউ জিজ্ঞেস করলে, তা-ই বলবেন। বাকিটা আমার কাজ। আপনাদের মতো বড় কাজ হয়তো করতে পারব না। এই সামান্য কাজটুকু যদি করতে না পারি, তা হলে কিসের জীবন? আপনারা নিশ্চিন্ত থাকুন।”

অনেক রাতে বরযাত্রীদের সঙ্গে এক সঙ্গে শুয়ে পড়েছিলেন অমরেন্দ্রনাথ-সহ সকলে। রাজশেখর থাকায় কোনও অসুবিধে হয়নি কারও। সকলে ঘুমোলেও, অমরেন্দ্রনাথ ঘুমোননি। আশপাশ থেকে কোনও শব্দ এলেই, পকেটের ধাতব যন্ত্রটাকে চেপে ধরেছেন। এই ভাবেই রাতটা কেটে গেল এক রকম।

সকালের দিকে চোখটা লেগে গিয়েছিল। রাজশেখরের ডাকে উঠে বসলেন অমরেন্দ্রনাথ। খারাপ কিছু খবর শোনার অপেক্ষায় তাকিয়ে রইলেন রাজশেখরের দিকে। রাজশেখর বললেন, “আপনার সঙ্গে এক জন দেখা করতে এসেছে। নাম বলছে মতিলাল।”

“আমি তো তার অপেক্ষাতেই আছি। ডেকে নিয়ে এসো তাকে!”’ অমরেন্দ্রনাথ বললেন।

মতিলাল এলে তার কাছ থেকে জানা গেল, এলাকার সব ক’টা বাড়ি খানাতল্লাশি হয়েছে। রূপলাল নন্দীর বাড়িতে অনেক ক্ষণ ধরে তল্লাশি চালিয়েছে টেগার্ট বাহিনী। কাউকে না পেয়ে টেগার্ট নাকি গালিগালাজ করেছে।

সবটা শুনে অমরেন্দ্রনাথ বললেন, “টেগার্ট এখন কোথায়, কিছু খবর পেলে?”

“এত ক্ষণে কলকাতায় পৌঁছে গেছে। খুব সকালেই একটা লঞ্চ ছেড়ে গেছে চন্দননগর। টেগার্টের দল তাতেই ছিল...” মতিলাল বলল।

“এক্সেলেন্ট! সব প্ল্যান মতোই হয়েছে,” বলেই অমরেন্দ্রনাথ দেখলেন, রাজশেখর দাঁড়িয়ে আছে, যেন কিছু বলার জন্য।

“কিছু বলবে, রাজশেখর?” অমরেন্দ্রনাথ জিজ্ঞেস করলেন।

“হ্যাঁ, একটা কথা ছিল, অমরদা,” কুণ্ঠিত ভাবে বলল রাজশেখর।

“হ্যাঁ, বলো না...”

অমরেন্দ্রনাথের সায় পেয়ে রাজশেখর বলল— বরযাত্রীদের অনেকেই তাদের ব্যাপারে কৌতূহলী হয়ে উঠেছে। বিশেষত দীর্ঘদেহী অমরেন্দ্রনাথ সম্পর্কে। তাদের কৌতূহল নিবৃত্ত করতে রাজশেখরকে মিথ্যে বলতে হয়েছে। বলেছে, এরা কনের বাড়ির লোক। তবে কনেপক্ষের কেউ কৌতূহল দেখানোর আগে সরে পড়াই মঙ্গল।

যাদুগোপাল বললেন, “হ্যাঁ, চলো, যাওয়া যাক। আপদ বিদেয় যখন হয়েছে, তখন এখানে গা ঢাকা দিয়ে থেকে লাভ কী?”

বিয়েবাড়ি থেকে সদলবলে যখন অমরেন্দ্রনাথ বেরিয়ে এলেন, তখন ভিতর-বাড়িতে শঙ্খধ্বনি দেওয়া হচ্ছে। পিত্রালয় ত্যাগ করার আগে বর-কনেকে আশীর্বাদ করছেন বয়োজ্যেষ্ঠরা। অমরেন্দ্রনাথও মনে মনে তাদের আশীর্বাদ করলেন। তার পর সামনের দিকে পা বাড়ালেন।

২২

অনেক রাতে দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনে ঘুম থেকে উঠে পড়ল রাজশেখর। আরও এক বার ভাল করে শুনে, বিছানা থেকে নেমে সদর দরজা খুলতে যাচ্ছিল। হাত চেপে ধরল তার স্ত্রী। বলল, “কোথায় যাচ্ছ এত রাতে?”

“শুনতে পাচ্ছ না দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ?” রাজশেখর বলল।

“শুনেছি। এত রাতে আবার কে আসবে? ও নিশ্চয়ই কোনও চোর-ডাকাতের কাজ। তুমি দরজা খুললেই বাড়িতে ঢুকে সর্বনাশ করে দেবে। সালকেতে এখন খুব এ সব হচ্ছে। পুলিশ থেকে বারবার সবাইকে সতর্ক করা হয়েছে।” রাজশেখরের স্ত্রী ইরাবতীর কণ্ঠে উদ্বেগ।

আবার এক বার কড়া নাড়ার শব্দে, ইরাবতীর হাত ছাড়িয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল রাজশেখর। উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা নিয়ে বিছানায় জড়সড় হয়ে শুয়ে রইল ইরাবতী।

দরজা খুলে লন্ঠনের আলোয় যাকে দেখল রাজশেখর, তাকে কল্পনাতেও ভাবতে পারেনি সে।

“আপনি! এ সময়ে!” বলে সবিস্ময়ে তাকিয়ে রইল আগন্তুকের দিকে।

“তোমাদের কি খুব অসুবিধে হবে, যদি আজকের রাতটা...”

“না না, কী বলছেন অমরদা! এ আমাদের পরম সৌভাগ্য যে আপনার মতো মানুষের পায়ের ধুলো পড়েছে আমাদের বাড়িতে। দেখো, কত বড় ডাকাতকে দরজা খুলে নিয়ে এলাম!” বলে ইরাবতীকে ডাকল রাজশেখর।

ইরাবতী ঘুমচোখে অমরেন্দ্রনাথকে দেখে
ভূত দেখার মতো চমকে উঠল। বলল, “দাদা, তুমি এ সময়ে?”

“এটাই তো আমার সময় রে ঝাঁকড়ি! সব সময় তো পুলিশের ফেউ লেগে আছে। এখানেও আসতে পারে। তবে মনে হয় না আজ রাতে আর আসবে। তাই আজকের রাতটা তোদের এখানে কাটিয়ে কালই সরে পড়ব।” অমরেন্দ্রনাথ বললেন।

ঝাঁকড়ি অমরেন্দ্রনাথের দূরসম্পর্কের এক পিসিমার মেয়ে। বয়সে অনেকটাই ছোট তাঁর থেকে। ছেলেবেলায় এক সঙ্গে খেলাধুলোও করেছে অনেক। ভাগলপুরে মামাবাড়িতে ঝাঁকড়ির মা শান্তিপিসিমা যখন গিয়ে থাকতেন, তখন ঝাঁকড়ির সঙ্গে অনেক খুনসুটি করেছেন অমরেন্দ্রনাথ। একমাথা কালো কোঁকড়ানো চুল ছিল বলে, অমরেন্দ্রনাথই ঝাঁকড়ি বলে খেপাতেন বোনকে। পরে ইরাবতীর এই নামটাই ডাকনাম হয়ে ওঠে। ইরাবতী এখন ঝাঁকড়ি। যদিও, তার ঝাঁকড়া চুলের বহর আর নেই।

“তুমি আজকের রাতটা কেন, কয়েকটা দিন এখানে থেকে যাও,” ইরাবতী বলল।

অমরেন্দ্রনাথ ম্লান হাসলেন। বললেন, “তা যদি পারতাম রে, ঝাঁকড়ি! আমি থাকলে তোরাও বিপদে পড়বি। আমাকে বরং একটা জায়গা দেখিয়ে দে, আমি গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়ি।”

“তেমন ছোটখাটো চেহারা যেন তোমার!” ইরাবতী বলল।

“চেহারাটাই তো সমস্যা রে। পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিতে পারছি না। ঠিক দেখে ফেলছে বেটারা!” হাসতে হাসতে বললেন অমরেন্দ্রনাথ।

“তুমি কি অমরদার সঙ্গে বকেই চলবে? অমরদার জন্য খানকতক লুচি ভেজে দাও। আমি সদর দরজাটা দিয়ে আসি...” বলে রাজশেখর সদরের দিকে এগোয়।

অমরেন্দ্রনাথ ইরাবতীকে বলেন, “ও সব লুচি-ফুচির দরকার নেই। আমার খিদে পায়নি। তুই বরং আমায় শোওয়ার জায়গাটা দেখিয়ে দে। একটু গা এলিয়ে চোখ বুজি।”

ইরাবতী অমরেন্দ্রনাথকে নিয়ে একটা ঘরে আসে। বিছানা ভাল করে ঝাঁট দিয়ে পরিষ্কার করে মশারি টাঙিয়ে দিয়ে বলে, “নাও, এ বার শুয়ে পড়ো। তোমাকে দেখলেই বোঝা যাচ্ছে, অনেক দিন ভাল করে ঘুমোওনি।”

অমরেন্দ্রনাথ হাসেন। তার হাসি মিলিয়ে যায় রাজশেখরকে দেখে। রাজশেখর সদর দরজা বন্ধ করে এসে বলে, “অমরদা, তোমার সঙ্গে কি আর কেউ এসেছে?”

‘‘না তো... কেন?’’ অমরেন্দ্রনাথ বলেন।

“বাইরে অনেক লোকের কণ্ঠস্বর পেলাম।”

অমরেন্দ্রনাথের চোখ-মুখ বদলে গেল। পকেট থেকে এক লহমায় বার করে ফেললেন তার মাউজ়ার পিস্তলটা। তার পর কী ভেবে আবার সেটা পকেটে ঢুকিয়ে ফেললেন। বললেন, “শোনো, তোমাদের বাড়ি ঘিরে ফেলেছে পুলিশ। এই অবস্থায় আমার পক্ষে পালানো অসম্ভব। আমার কাছে দুটো রাস্তা খোলা। হয় ধরা দেওয়া, নয়তো লড়াই করে মৃত্যুবরণ করা। আমি তোমাদের কথা ভেবে প্রথমটাই করব ঠিক করলাম। ঝাঁকড়ি, পিস্তলটা কোথাও লুকিয়ে রাখ, আর রাজশেখর, তুমি গিয়ে দরজা খুলে দাও।”

ক্রমশ

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement