নামপ্রণেতা: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং ডান দিকে, সুকুমার রায়।
আমাদের দেশের সমুদ্র উপকূলভাগ সুরক্ষিত রাখতে তখন পাহারা দিত ব্রিটিশ নেভিগেশন কোম্পানির নৌবহর। সেই নৌবহরটিতে বেতারযন্ত্রের ব্যবস্থা করতে মার্কনি কোম্পানি একটি অফিস খুলেছিল কলকাতা হাইকোর্টের সামনে টেম্পল চেম্বার্সে। ১৯২২-এর ১২ মার্চ এই মার্কনি ওয়ারলেস সেট-এর সাহায্যেই পাঠানো হয়েছিল কলকাতার প্রথম বেতার-বার্তা। বার্তাটি ছিল— “হ্যালো, হ্যালো দ্য স্টেটসম্যান। স্পিকিং ফ্রম বারাকপুর রেসকোর্স…”
পক্ষান্তরে আজ আমরা যাকে ‘আকাশবাণী’ বলে জানি, সেই কলকাতা বেতারের সর্বপ্রথম ঘোষণাটি ঝঙ্কৃত হয়েছিল দু’টি মাত্র শব্দে—“ক্যালকাটা কলিং”। সেই তারিখটি ছিল ১৯২৭-এর২৬ অগস্ট।
কলকাতা থেকে প্রথম বেতার অনুষ্ঠান সম্প্রচার শুরু করেছিল ‘ইন্ডিয়ান স্টেট অ্যান্ড ইস্টার্ন এজেন্সি’ ১৯২৩ সালে। টেম্পল চেম্বার্সের স্টুডিয়ো থেকে ‘রেডিয়ো ক্লাব অব বেঙ্গল’ প্রতি সন্ধ্যায় এক ঘণ্টায় ইউরোপীয়, আর এক ঘণ্টা ভারতীয় সঙ্গীত প্রচার শুরু করে। এর বছর দুয়েক পরে ‘স্পেকট্রোস্কোপি’-তে ডক্টরেট শিশিরকুমার মিত্র, ইউনিভার্সিটিকলেজ অব সায়েন্সে তাঁরই প্রতিষ্ঠিত গবেষণাগার থেকে, সান্ধ্যকালীন অনুষ্ঠান সম্প্রচার শুরু করেছিলেন। ট্রান্সমিটারটিও ছিল তাঁর নিজের হাতে গড়া। গবেষণারত ছাত্রছাত্রীদের জন্য পরীক্ষামূলক ভাবে সপ্তাহে পাঁচ দিন এই সম্প্রচারের ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি।
ব্যক্তিগত মালিকানায় গড়ে ওঠা ইন্ডিয়ান ব্রডকাস্টিং কোম্পানির তত্ত্বাবধানে কলকাতার ১ নম্বর গার্স্টিন প্লেসের নতুন স্টুডিয়োতে শুরু হয়েছিল কলকাতা বেতারের পথ চলা। বেসরকারি উদ্যোগে শুরু হলেও সরকারি তত্ত্বাবধানে এবং বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ‘ইন্ডিয়ান ব্রডকাস্টিং সার্ভিস’ নামে আমাদের দেশে প্রথম বেতার সম্প্রচার শুরু যে ওই গার্স্টিন প্লেস থেকেই, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। এর প্রথম পরিচালক ছিলেন বিবিসি-র প্রতিনিধি সি সি ওয়ালিক। প্রায় দু’দশক পরে প্রতিষ্ঠানটির নামকরণ হয়েছিল ‘আকাশবাণী’।
অভিধান বলে, ‘আকাশবচন’ বা ‘আকাশবাণী’ দৈববাণীরই সমার্থক। রায়গুণাকর ভারতচন্দ্রের রচনায় পাই, ‘হইল আকাশবাণী অন্নদা আইল’। কিন্তু আমাদের দেশের বেতার কেন্দ্রের জন্য অভিজাত ও বহুদিকস্পর্শী এমন নামটি আহরণ করলেন কে, যাঁর দৌলতে ‘আকাশবাণী’ নামটি হয়ে গেল সর্বজনমননিবাসী ?
অনেকেরই ধারণা, এ নামটি দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কিন্তু কী ভাবে হল সে নামকরণ? শ্রদ্ধেয় বেতার-ব্যক্তিত্ব বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র জানিয়েছেন, “স্বাধীনতার পরবর্তী কালে বি ভি কেশকার ‘বেতার জগৎ’ পত্রিকার এক পুরাতন বিশেষ সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথ লিখিত ‘আকাশবাণী’ কবিতাটির সন্ধান লাভ করিয়া ‘অল ইন্ডিয়া রেডিয়ো’ নামের পরিবর্তে ‘আকাশবাণী’ নামটি প্রচারের নির্দেশ দেন।” এখানে কিন্তু কবে থেকে এ নাম চালু হল, তার কোনও উল্লেখ নেই। কিন্তু কবিতাটি কবে এবং কেন লেখা হয়েছিল, সে তথ্য কিন্তু দুর্লভ নয়। তবে সে কথায় আসার আগে জানাই, ধন্দ জাগে ‘আকাশবাণী’ নামকরণের বিষয়টিতেই। যদি ধরে নেওয়া যায় যে, ‘বেতার জগৎ’-এ প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতা থেকেই নামটি নেওয়া, তা হলেও কিছু প্রশ্নের অবকাশ থেকে যায়। ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত ইউ এল বড়ুয়া-র লেখা ‘দিস ইজ় অল ইন্ডিয়া রেডিয়ো’ বইটি থেকে জানা যায় যে, ১৯৩৫-এর ১০ সেপ্টেম্বর মহীশূরে ‘আকাশবাণী’ নাম দিয়ে বেতার সম্প্রচার শুরু হয়েছিল। মহীশূর বিশ্ববিদ্যালয়ের মনস্তত্ত্বের অধ্যাপক ড গোপাল কৃষ্ণ তাঁর বাড়িতে ৩০ ওয়াটের একটি ট্রান্সমিটার স্থাপন করেন। পরে ২৫০ ওয়াটের একটি ট্রান্সমিটার আমদানি করা হয়। মহীশূর পুরসভা ও জনগণের সহযোগিতায় পাঁচ বছর ধরে সেখান থেকে সম্প্রচার চলার পর ১৯৪১-এ মহীশূর স্টেট এটি অধিগ্রহণ করে। কুড়ি বছর ধরে মহীশূরের আকাশবাণী কেন্দ্র সুপরিচালিত ছিল। ১৯৫৫ সালে অল ইন্ডিয়া রেডিয়ো-র বেঙ্গালুরু কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাকালে মহীশূরের মহারাজার ‘আকাশবাণী’ তার অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়।
১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দের অগস্ট মাসে কলকাতা বেতার কেন্দ্রের সম্প্রচার ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী করার জন্য ১০ কিলোওয়াটের একটি শর্ট ওয়েভ ট্রান্সমিটার বসানো হয়। এই উপলক্ষে সেই বছরই ‘বেতার জগৎ’ পত্রিকার ১৬ অগস্ট সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতা প্রকাশিত হয় তৎকালীন পত্রিকা সম্পাদক নলিনীকান্ত সরকারের উদ্যোগে। তাঁর অনুরোধেই শিরোনামহীন একটি কবিতা স্বহস্তে লিখে দিয়েছিলেন কবি। কবিতাটির প্রথমেই ছিল “ধরার আঙিনা হ’তে ঐ শোনো / উঠিল আকাশবাণী।” কবিতাটির নীচে বাঁ দিকে তারিখ লেখা ছিল— ৫ অগস্ট, ১৯৩৮।
পরবর্তী কালে নলিনীবাবুর মনেও প্রশ্ন জেগেছিল, অল ইন্ডিয়া রেডিয়োর নাম ‘আকাশবাণী’ রাখলেন কে এবং কবে। প্রথমত, রবীন্দ্রনাথ তাঁর এই কবিতার কোনও শিরোনাম দেননি। কবিতাটির ভাবব্যঞ্জনা এবং ‘আকাশবাণী’-র মতো তাৎপর্যপূর্ণ শব্দটির ব্যবহার থেকেই যে এই নামকরণ, এমন তো মনে করা যেতেই পারে। দ্বিতীয়ত, রবীন্দ্রনাথ কবিতাটি রচনা করেন ১৯৩৮-এ। কিন্তু তারও বছর তিনেক আগেই তো ‘আকাশবাণী’ নাম ধারণ করে মহীশূরের বেতার কেন্দ্রটি প্রতিষ্ঠিত হয়। নলিনীকান্ত সরকার তাঁর ‘আসা যাওয়ার মাঝখানে’ বইয়ে লিখেছেন, “দেশের একটি রাজ্যে ‘আকাশবাণী’ বেতার কেন্দ্র থাকাকালে অল ইন্ডিয়া রেডিও-র নাম আকাশবাণী হয়েছিল, এটা সম্ভবপর বলেমনে হয় না। এই আকাশবাণীর অবলুপ্তির পর হয়তো অল ইন্ডিয়া রেডিও-র আকাশবাণী নামকরণ হয়ে থাকতে পারে।”
সাহেবি আমলে যে ‘রেডিয়ো’ শব্দটির চল হয়েছিল, তার একটি অর্থ আমাদের দেশে করা হয়েছিল বেতার বা বেতারের গ্রাহক বা প্রেরকযন্ত্র। আর এ বিষয়েই, ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে সুকুমার রায় একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন ‘সন্দেশ’ পত্রিকায়। প্রবন্ধটির নাম ছিল ‘আকাশবাণীর কল’। এর বছর দুয়েক আগে বিশ্বের প্রথম বাণিজ্যিক বেতার কেন্দ্রটি সম্প্রচার শুরু করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পিটসবার্গ থেকে। সুকুমার রায় তাঁর প্রবন্ধটিতে একেবারে সহজ সরল ভাষায় ব্যাখ্যা করেছিলেন বেতার বার্তা বা বেতার সম্প্রচারের ব্যাপারটি। তিনি লিখেছিলেন, “আমাদের গল্পে ও পুরাণে যে আকাশবাণীর কথা শুনতে পাই— এও যেন সেই আকাশবাণীর মতো। কোথাও কোনো আওয়াজ নাই, জনমানুষের সাড়া নাই, অথচ কলের মধ্যে কান দিলেই শুনি আকাশময় কত কণ্ঠের কত ভাষা, কত বিচিত্র গান আর কত যন্ত্রের সুর!”
রবীন্দ্রনাথের কবিতাটি রচিত হওয়ার প্রায় ১৬ বছর আগেই তো সুকুমার রায় লিখেছিলেন ‘আকাশবাণীর কল’। সম্ভবত রেডিয়ো-র বাংলা প্রতিশব্দ হিসেবে প্রথম ‘আকাশবাণী’ কথাটি সুকুমার রায়ই ব্যবহার করেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা থেকে সরাসরি গৃহীত বলে তাঁর নামটিই এখানে অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িয়ে গিয়েছে।
স্বনামখ্যাত এই প্রতিষ্ঠানটি পেরিয়ে এল ৯৫টি বছর। কিন্তু শতবর্ষের দ্বারে এসে পৌঁছলেও ‘আকাশবাণী’ নামটি যে কবে রাখা হয়েছিল, সে বিষয়টি বুঝি রয়ে গেল অনুসন্ধানসাপেক্ষই, আজও।