ঐতিহাসিক: দারায়ুসের উত্তরসূরির সমাধিতে হিঁদুশ জাতির ভাস্কর্য। ডান দিকে, জাতিসমূহের চিত্রণে হিয়েরোগ্লিফিক হরফে লেখা ‘হিন্দুশ’। ছবি সৌজন্য: উইকিমিডিয়া কমনস।
হিন্দুস্তান নামটা সুলতানি যুগের আগে ছিল না, এ রকম একটা ধারণা প্রচলিত আছে। কিন্তু তার এক হাজার বছর আগে প্রাক-ইসলামিক ইরানে সম্রাট শাপুরের ‘নকশ-এ-রোস্তম’ শিলালেখতে আমরা দেখতে পাই ‘হিন্দেস্তান’ নামটি। তৃতীয় শতকে। হিন্দুস্তান বা হিন্দেস্তানের তুলনীয় শব্দের লিখিত ইতিহাস অবশ্য আরও প্রায় এক সহস্রাব্দ পুরনো। গৌতম বুদ্ধের সমসাময়িক ছিলেন ইরানের সম্রাট দারায়ুস। তাঁর সমাধিতে পাওয়া যায় তাঁর অধীনস্থ ঊনত্রিশটি জাতির সৈনিকদের ভাস্কর্য। প্রতিটি ভাস্কর্যের নীচে খোদাই করা আছে সেই জাতির নাম। এদের মধ্যে রয়েছে তিনটি ভারতীয় জাতির নাম— গান্ধার, থতগুষ আর হিঁদুশ। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে পশ্চিম ভারতীয় উপমহাদেশের ওই তিনটি অঞ্চল অধিকার করেন দারায়ুস। ‘হিঁদুশ’ হল সিন্ধু উপত্যকা। সিন্ধু থেকে হিন্দ, হিন্দু, হিঁদুশ শব্দগুলোর ব্যুৎপত্তি। ইরানের সুসাতে প্রাপ্ত দারায়ুসের মিশরীয় মূর্তির বেদিতে জাতিসমূহের চিত্র আছে, আর তার মধ্যে এক জন মানুষের ছবির নীচে হিয়েরোগ্লিফিক হরফে লেখা আছে ‘হিন্দুশ’। দারায়ুসের প্রাসাদে আর তাঁর উত্তরসূরিদের সমাধিতেও হিঁদুশ জাতির চিত্রণ ও নামোল্লেখ পাওয়া যায়।
এই ইরানীয় চিত্রগুলি থেকে সিন্ধু উপত্যকার পুরুষের বেশভূষার ধারণা মেলে। তারা দাড়ি রাখত, ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত বা উত্তরীয়যুক্ত, নীচে ধুতি বা স্কার্ট। হরপ্পার শেষ পর্যায় আর মৌর্য যুগের মাঝের দীর্ঘ সময়ে ভারতীয় মানুষের আর কোনও মূর্তিরূপ পাওয়া যায়নি। কিন্তু এই হিঁদুশ বা হিন্দুশ কি শুধুই সিন্ধু উপত্যকার লোকেরা? সম্ভবত তা-ই। কারণ দারায়ুস সিন্ধু অববাহিকা থেকে বেশি দূর এগোতে পারেননি। দারায়ুসের এই ‘হিঁদুশ’ শব্দটা ভারতের সবচেয়ে পুরনো খোদাই করা নাম, তবে এটা সম্পূর্ণ ভারতবর্ষকে বোঝাত না।
‘হিন্দু’ শব্দটিরও বহুলপ্রয়োগ দেখা যায় প্রাচীন যুগেই। তবে ভারতে নয়, ইরানে। সংস্কৃতে হিন্দু শব্দটা ছিল না, বরং ‘জেন্দ আবেস্তা’-য় একাধিক বার ব্যবহৃত। কখনও ‘হপ্তহিন্দু’ (সপ্তসিন্ধু) রূপে— ভৌগোলিক অঞ্চল বোঝাতে। আবার কখনও শুধু হিন্দু কথাটা ব্যবহার হয়েছে, কোথাও সিন্ধুনদ অর্থে, কোথাও একটা ভৌগোলিক অঞ্চল বোঝাতে, আবার কোথাও সেটা পর্বতের নাম। জরথুষ্ট্রীয় ধর্মের ঈশ্বর অহুর মজদা তৈরি করেছিলেন ষোলোটি আর্যভূমি, যার মধ্যে একটি হপ্তহিন্দু।
এই হিঁদুশ বা হিন্দু শব্দটা ইরানীয়দের হাত ধরে গ্রিসে পৌঁছয়। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকে ইতিহাসকার হেরোডোটাস ভারতের জন্য যে গ্রিক নাম ব্যবহার করেছিলেন সেটা ছিল ‘হিন্দিকে কোরে’। ‘কোরে’ মানে দেশ। ‘হিন্দিকে’ হল হিন্দ-সম্বন্ধীয়। হিন্দ লিখলেও গ্রিক উচ্চারণটা ইন্দ আর হিন্দের মাঝামাঝি, হালকা হ-এর মতো। পরে গ্রিক সাহিত্যে ‘হিন্দ’ শব্দটা দাঁড়াল ‘ইন্দোই’। বহুবচনে ‘ইন্দোস’। ইন্দোই বলতে ভারত ভূখণ্ড আর ইন্দোস বলতে ভারতের মানুষদের বোঝাত। ইন্দোই শব্দটা পরবর্তী কালের গ্রিক ও ল্যাটিন ভাষায় ‘ইন্ডিয়া’ হয়েছে।
হেরোডোটাস নিজে ভারত দেখেননি, তবে এই ‘হিন্দ’ সম্পর্কে কিছু নির্ভুল তথ্য দিয়েছেন। যেমন, এ দেশে বহু জাতির বসবাস ছিল, অনেকে নিরামিষভোজন করত। আবার কল্পনা আর জাতিবিদ্বেষের রঙে অতিরঞ্জিত তথ্যও দিয়েছেন। যেমন, এ দেশে অনেকে কাঁচা মাছ খায়, নরখাদকও আছে যারা গোষ্ঠীর অসুস্থ লোকেদের শুশ্রূষা না করে তাদের মেরে খেয়ে ফেলে।
হেরোডোটাসের ‘হিন্দিকে কোরে’ সিন্ধু-উপত্যকাকেই বোঝাত, কারণ তার পুব দিকে মরুভূমি ছিল। কিন্তু কয়েক শতকের মধ্যে শব্দটার ভৌগোলিক প্রসার বৃদ্ধি পায়। তৃতীয় খিস্টপূর্বাব্দের গ্রিক ভূগোলবিদ এরাটোস্থেনিস, ইন্দোই বলতে প্রায় পুরো উপমহাদেশকেই বুঝিয়েছেন। গ্রিকরা ভারত সম্পর্কে প্রত্যক্ষ জ্ঞান লাভ করা শুরু করেছিল আলেকজ়ান্ডারের প্রাচ্য-অভিযানের পর থেকে, আর তার পর থেকে তারা তথ্যনিষ্ঠ ভাবে ভারতের বর্ণনা নথিভুক্ত করা শুরু করে। দক্ষিণ ভারত যে একটা উপদ্বীপ, সেটা এরাটোস্থেনিসই নথিবদ্ধ করেন। মেগাস্থিনিস রচিত ‘ইন্ডিকা’র মাধ্যমে একটা সম্মিলিত ইন্দোই বা ইন্ডিয়া-র ধারণা গ্রিক ইতিহাসকার ও ভূগোলবিদদের মধ্যে পৌঁছেছিল। তার বিস্তার সিন্ধু থেকে গঙ্গার মোহনা অবধি বা তার কিছু বেশি ছিল। পরবর্তী কয়েক শতক জুড়ে বিভিন্ন গ্ৰিক ও রোমান লেখক, যেমন, প্লিনি, আরিয়ান দক্ষিণ ও উত্তর ভারতকে সম্মিলিত ভাবে ইন্ডিয়া বলেছেন। গ্রিক সাহিত্যে অর্থটা বদলালেও ইরানীয় ভাষায় ‘হিন্দ’ শব্দটার অর্থ অত দ্রুত বদলায়নি। তৃতীয় শতকে ইরান-সম্রাট শাপুর ‘হিন্দেস্তান’ বলতে যা বুঝিয়েছেন, তা সিন্ধু উপত্যকা, কারণ এর থেকে পুবে তাঁর নিয়ন্ত্রণ ছিল না।
গ্রিক ও ল্যাটিনে জাতি বা ভাষার সঙ্গে ‘ইয়া’ যোগ করে দেশের নাম হয়, যেমন রাশিয়া, সার্বিয়া, সিরিয়া। আর ফার্সিতে ‘স্তান’ যোগ করে, যেমন তাজিকিস্তান, আফগানিস্তান। সাধারণ ভাবে যে সব দেশে গ্রিক-ল্যাটিনের প্রভাব বেশি, অর্থাৎ পাশ্চাত্যে— ব্যবহার হয় ইন্ডিয়া বা তুলনীয় নামগুলো। আর যে সব দেশে পারসিক ভাষার প্রভাব বেশি, সে সব দেশে হিন্দ-হিন্দুস্তান জাতীয় নাম বেশি ব্যবহার হয়। যে রকম, তুরস্কে ভারতের সরকারি নাম হল ‘হিন্দিস্তান’। আরবি ভাষায় ভারতকে ‘অল-হিন্দ’ বলা হয়, তাজিক ভাষায় ‘হিন্দুস্তোন’, কাজ়াক ভাষায় ‘উন্দিস্তান’।
গ্রিক আর ইরানীয় নামগুলো বিশ্বব্যাপী প্রচলিত হলেও দেশের ভিতরে প্রাচীন যুগে সাধারণত ওই নামগুলো ব্যবহার হত না। কিন্তু একটি ব্যতিক্রমও আছে। সম্রাট কণিষ্ক দ্বিতীয় শতকে রাজত্ব করেছিলেন মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে— আমু দরিয়া নদী থেকে মধ্য-গাঙ্গেয় উপত্যকা অবধি। আফগানিস্তানে প্রাপ্ত রবাতক শিলালেখতে কণিষ্ক তাঁর অধীনস্থ অঞ্চলকে ‘ইন্দো’ বলে উল্লেখ করেছেন। রবাতক লিপির বর্ণনা অনুযায়ী ইন্দো ভূখণ্ডের বিস্তার সাকেত, কৌশাম্বী হয়ে পূর্বে পাটলিপুত্র অবধি। কণিষ্কের কয়েক শতাব্দী আগে অবধিও আফগানিস্তান ইন্দো-গ্রিক সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল, ফলে গ্রিক সংস্কৃতির প্রভাব তখনও ছিল। তাই কনিষ্ক স্বাভাবিক ভাবেই গ্রিক-ঘেঁষা নাম ব্যবহার করেছেন। এটাই সম্ভবত ভারতীয় উপমহাদেশে প্রাপ্ত একমাত্র প্রাচীন শিলালিপি যেখানে ভারতের বিদেশি নাম ব্যবহৃত।
পূর্ব এশিয়ায় বৌদ্ধধর্ম ও ভারতীয় সংস্কৃতি পৌঁছে দেওয়ার কৃতিত্ব অনেকটাই কণিষ্কের। প্রাচীন যুগের চিনা লেখকরা ভারতকে দুটো নামে ডাকতেন, ‘তিয়ানজ়ু’— সিন্ধুর অপভ্রংশ আর ‘য়িন-দু’— হিন্দ বা ইন্দোই-এর সঙ্গে তুলনীয়। আধুনিক চিনা ভাষাতেও ভারতের নাম য়িন-দু। জাপানি ও কোরিয়ান ভাষায় ইন্দো। কণিষ্ক যেহেতু ‘ইন্দো’ নামটা ব্যবহার করেছেন, তাই তাঁর মাধ্যমেই চিন-জাপান-কোরিয়ায় ‘য়িন-দু’ বা ‘ইন্দো’ নামগুলো আসা স্বাভাবিক।
কণিষ্কের কিছু আগে খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে অশোক ভারত-ভূখণ্ডকে চিহ্নিত করেছিলেন জম্বুদ্বীপ নামে। অশোকের সাম্রাজ্যের বিস্তার ছিল উত্তরে আফগানিস্তান থেকে দক্ষিণে কৃষ্ণা নদীর অববাহিকা অবধি। এত বড় সাম্রাজ্য মৌর্যদের আগে কখনও হয়নি, আর মৌর্য যুগের আগে ভারতের কোনও শিলালেখ বা পুঁথি পাওয়া যায়নি। তাই ভারতের নামের প্রথম অভ্যন্তরীণ পাথুরে প্রমাণ হল ওই ‘জম্বুদ্বীপ’। প্রাকৃত বানানে ‘জম্বুদীপ’। বৈরাঠ, ব্রহ্মগিরি, সাসারাম-সহ অশোকের অনেক শিলালেখতে জম্বুদ্বীপকে এক বিস্তীর্ণ ভৌগোলিক অঞ্চল হিসেবে দেখানো হয়েছে, যার ধর্ম ও আইনের নিয়ন্তা অশোক। অশোকের সিংহভাগ শিলালিপি লেখা হয়েছিল একটি মধ্য-ইন্দো-আর্য প্রাকৃত ভাষায়, যাকে এখন ‘অশোকান প্রাকৃত’ বলা হয়। এর থেকে অনুমেয় যে, উত্তরে খাইবার-পাখতুনখওয়া থেকে দক্ষিণে কর্নাটক, পশ্চিমে গিরনার থেকে পুবে ধৌলাগিরি অবধি এই ভাষা একটা বড় সংখ্যক সাক্ষর মানুষের কাছে বোধগম্য ছিল। তবে অশোক এক ভাষা চাপানোর চেষ্টা করেননি। কারণ শিলালেখগুলি একই প্রাকৃতের আলাদা আলাদা স্থানীয় উপভাষায় লেখা।
ইন্ডিয়া, হিন্দুস্তান, জম্বুদ্বীপ— সব নামের ইতিহাস জানার পর সেই নামের উৎস খোঁজার পালা, যে নামে আমরা আজ দেশকে চিনি,অর্থাৎ ‘ভারত’। বৈদিক যুগে এ দেশের সামাজিক একক ছিল ‘জন’ আর ‘বিশ’। বিশ ছিল ছোট ছোট গোষ্ঠী, আর অনেকগুলো বিশের সমাহার হত জন। পুরু, যদু, ভারত এগুলো বিভিন্ন জনের নাম। অনেকগুলি জন-এর একটির নাম ছিল ভারত। তা হলে সমস্ত জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে ‘ভারত’ জন-এর নামটাই কেন সমগ্র দেশের নাম হয়ে দাঁড়াল?
তার কিছু উত্তর আছে ঋগ্বেদে আর কিছু মহাভারতে। ঋগ্বেদের সপ্তম মণ্ডলে আমরা দেখি ‘দাশরাজ্ঞ যুদ্ধ’-এর কথা, অর্থাৎ দশ রাজার যুদ্ধ। অন্তত দশটি জনজাতির মধ্যে এই যুদ্ধ হয়। বিজিত পক্ষে ছিল অনু, ভৃগু, যদু, দ্রুহ্য, মৎস্য, পুরু, পণি ইত্যাদি জনজাতিগুলি, আর বিজয়ী ছিল ভারত জনজাতি। ভারত জনজাতির রাজার নাম ছিল পৈজবন সুদাস। অন্য পক্ষ সংখ্যায় ভারী হলেও জিতেছিল ভারতরা। যুদ্ধের ফলে প্রথমে ইরাবতী ও পরে যমুনা নদীর উপত্যকায় ভারত জন-এর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা হয়। ঋগ্বেদের বিজয়ী ভারত জনজাতি থেকে পুরো দেশের নাম ভারত হওয়াটা আশ্চর্যের নয়, বিশেষ করে যেখানে তাদের জয়ের ফলে উত্তর ভারতের রাজনৈতিক সমীকরণের আমূল পরিবর্তন হয়েছে। গোসম্পদ ও একাধিক নদীর উপর ভারত জন-এর অর্থনৈতিক আধিপত্য স্থাপিত হয়। তবে একটা বিষয়ে সতর্ক হওয়া দরকার। এই যুদ্ধ খ্রিস্টপূর্ব ১৪০০ সাল নাগাদ হয়েছিল বলে অনুমান, আর তার পরেও দীর্ঘ দিন ভারত শব্দটা ভারত ভূখণ্ড অর্থে ব্যবহার হয়নি। ঋগ্বেদে ভারত একটা জনজাতির নাম, ভূখণ্ড নয়।
মহাভারতের সিংহভাগ জুড়ে ‘ভারত’ বলতে ভারত বংশকে বোঝানো হয়েছে, তবে মহাভারতেই প্রথম ‘ভারত’ কথাটা ভূখণ্ড অর্থেও ব্যবহৃত হয়েছে। বংশ বোঝাতে ‘ভারত’, আর ভৌগোলিক অঞ্চল বোঝাতে ‘ভারতবর্ষ’। দুষ্মন্ত-শকুন্তলার পুত্র ভরত, তাঁর নাম থেকে বংশের নাম ভারত। মহাভারতের ভারতবংশ ঋগ্বেদের ভারত জনজাতি কি না, সেই নিয়ে দ্বিমত আছে। মহাভারতে যদু, দ্রুহ্য, পুরু এরা সবাই যযাতির বংশধর, আর ভারতরা পুরুবংশের অংশমাত্র। অন্য দিকে, ঋগ্বেদের দাশরাজ্ঞ যুদ্ধে এরা সবাই ভারত গোষ্ঠীর প্রতিদ্বন্দ্বী। তবে ভিন্ন ভিন্ন জনজাতিকে কাল্পনিক ভাবে এক পূর্বসূরির সঙ্গে জুড়ে দেওয়া অপ্রচলিত নয়।
মহাভারতে ভীষ্মপর্বের প্রথম দশটি অধ্যায় ‘জম্বুখণ্ড-বিনির্মাণ পর্ব’ নামে পরিচিত। জম্বুখণ্ড অর্থাৎ জম্বুদ্বীপ। এই অংশে ভারতবর্ষ নামটা একাধিক বার এসেছে। যুদ্ধের শুরুতে অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রকে সঞ্জয় পৃথিবীর রূপ বর্ণনা করছেন, সেখানে বর্ণিত হয়েছে ভারতবর্ষের রূপ। জম্বুখণ্ড-বিনির্মাণ পর্বে সঞ্জয় বিভিন্ন নদী, পর্বত, জাতি ও অঙ্গ-বঙ্গ-কেরল-সহ অনেক জনপদের নাম বর্ণনা করেছেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, মহাভারতের যুদ্ধ ১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের আশপাশে হলেও, মহাভারত লিখিত হয় চারশো খ্রিস্টপূর্ব থেকে চারশো অব্দের মধ্যে, অর্থাৎ মৌর্য যুগ থেকে গুপ্ত যুগ অবধি সময়কালে। মৌর্য যুগে যে সুবিশাল সাম্রাজ্য ও সম্মিলিত ভারতবর্ষের ধারণা গড়ে ওঠে, তার প্রভাব দেখা যায় মহাভারতে, যখন এটি লেখা হচ্ছিল।
ভারতবর্ষ নামের প্রথম পাথুরে প্রমাণ মেলে মৌর্য যুগের সামান্য পরেই। কলিঙ্গরাজ খারবেলের হস্তিগুম্ফা শিলালেখতে। এটি দ্বিতীয় খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে প্রথম শতকের মাঝের সময়ের। যে সময়ে মহাভারতে ভারতবর্ষের ধারণা গড়ে উঠছে, প্রায় সেই সময়কার। এখানে প্রাকৃত ভাষায় ‘ভারধবস’ শব্দটা ব্যবহার হয়েছে একটা ভৌগোলিক অঞ্চল বোঝাতে, এবং এটাকে ভারতবর্ষ শব্দের অপভ্ৰংশ ধরা হয়। কলিঙ্গরাজ এখানে রাজগৃহ, মথুরা, ত্রমিরদেশ (দ্রাবিড়) ইত্যাদির পাশাপাশি ভারধবস আক্রমণ করছেন এবং সেটিকে কলিঙ্গের বাইরের একটা ভৌগোলিক অঞ্চল হিসেবে ধরেছেন।
স্বাধীনতার পর ইন্ডিয়া-র পাশাপাশি সরকারি নাম হিসেবে বেছে নেওয়া হয় ভারতকেও। স্বাধীনতা সংগ্রামের যুগে হিন্দ, হিন্দুস্তান নামগুলোও বহুপ্রচলিত ছিল। তবে ভারত নামটাই বেছে নেওয়া হয়, আর সঙ্গে যোগ করা হয় গণরাজ্য কথাটাও। বৈদিক ‘গণ’ থেকে উত্তর-বৈদিক যুগে গড়ে উঠেছিল ‘গণসঙ্ঘ’, যাকে তুলনা করা হয় পাশ্চাত্যের রিপাবলিক-এর সঙ্গে। এখনও ভারত গণরাজ্য নামটা বৈদিক যুগের ভারত এবং গণ শব্দ দুটোর স্মৃতি বহন করে।