মনস্বী: রমেশচন্দ্র দত্ত। (ছবি সৌজন্য: উইকিমিডিয়া কমনস)
সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র একখানি ফোটোগ্রাফ চেয়েছিলেন স্নেহভাজন রমেশচন্দ্রের। চৈত্রের যে দহনদিনে বঙ্কিম এই ফুল্ল-কুসুমিত পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবেন, তার আগের দিন। শেষ শয্যায় শায়িত দাপুটে মানুষটি প্রায় অচেতন। তাঁকে দেখতে গেছেন রমেশচন্দ্র দত্ত। বঙ্কিম শুধু তাঁর পিতৃবন্ধু নন, বাংলা ভাষায় লেখালিখির বিষয়ে রমেশকে তিনিই পরামর্শ দিয়েছিলেন। অন্তিম ক্ষণের সেই নিদারুণ মুহূর্তে এক জন যোগ্য উত্তরসূরির কণ্ঠ কানে গেলে মৃত্যুযন্ত্রণাও যেন খানিক অন্তরালে চলে যায়! চোখ মেলে তাকালেন বঙ্কিম: “আমার দিকে চাহিয়া সস্নেহে আমার সহিত কথা কহিলেন,— আমার একখানি ফটোগ্রাফ্ চাহিলেন। সে সময়ে কেন আমার ফটোগ্রাফ্ চাহিলেন, জানি না।”— লিখেছেন রমেশচন্দ্র, প্রায় একশো ত্রিশ বছর আগে, বঙ্কিমচন্দ্রের মৃত্যুর কিছু দিন পর।
তিন কন্যার পিতা বঙ্কিম পুত্রস্নেহে নিজের ভাইপোকে পরম যত্ন করতেন। তেমনই স্নেহধারা বর্ষিত হয়েছিল রমেশচন্দ্রের উপর। বঙ্কিমচন্দ্র এবং রমেশের পিতা ঈশানচন্দ্র এক সঙ্গে খুলনা জেলায় কাজ করতেন। দু’জনেই ডেপুটি কালেক্টর। ঈশানচন্দ্রের তখন অবসর গ্রহণের সময় আসন্ন, বঙ্কিমচন্দ্রের কর্মজীবন সবে শুরু। কলকাতায় রামবাগানের দত্তবাড়িতে এক বার নিমন্ত্রিত হয়ে বঙ্কিম এসেছিলেন। দশ-বারো বছরের বালক রমেশকে সেই প্রথম দেখা, আদরও। পরবর্তী সময়ে এই স্নেহ ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৮৬১ সালে, রবীন্দ্রনাথের জন্মের পরের দিন, কুষ্টিয়ার কাছে একটি খালে নৌকাডুবিতে অকালপ্রয়াত হন ঈশানচন্দ্র: “বঙ্কিমচন্দ্র তখন খুলনায়। তিনি যেরূপ বিলাপ করিয়া একখানি পত্র লেখেন, অদ্যাবধি সেকথা আমার হৃদয়ে জাগরিত রহিয়াছে,” লিখেছেন রমেশচন্দ্র।
মা আগেই মারা গেছেন। এ বার চলে গেলেন বাবা। অনাথ রমেশ ও তাঁর আরও পাঁচ ভাইবোনের দায়িত্ব নিলেন কাকা শশীচন্দ্র। ইনি ইংরেজি সাহিত্যে বিশেষ সুনাম অর্জন করেছিলেন সে কালে। ‘দ্য রিপাবলিক অব ওড়িশা’ তাঁর লেখা একটি সাহসী কল্প-গল্প, যেখানে লেখক দেখিয়েছিলেন ভবিষ্যতের একটি কাল্পনিক যুদ্ধে ব্রিটিশের পরাজয়! তিনি ইংরেজিতে এঁকেছেন বাঙালি কেরানি সমাজের চালচিত্র, প্রশ্ন তুলেছিলেন ব্রিটিশের আফিম-নীতি ও তার ফলাফল নিয়ে। আদর্শবান নীতিনিষ্ঠ কাকাকে রমেশ উৎসর্গ করেছিলেন তাঁর বিখ্যাত ইংরেজি গ্রন্থ ‘দ্য লিটারেচার অব বেঙ্গল’। কাকার ঐকান্তিক ইচ্ছেকে সম্মান দিয়ে রমেশ বিলেতে আইসিএস পড়তে যান। তাঁর তখনকার সঙ্গী দুই সহপাঠীও পরবর্তী সময়ে ভারতখ্যাত হন— বিহারীলাল গুপ্ত এবং সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়।
ভোরবেলায়, সূর্যের তেজ তখন কোমল, এক নবীন ম্যাজিস্ট্রেট মেহেরপুরের পথ ধরে অক্লান্ত ভাবে ঘোড়া ছুটিয়ে খোঁজ নিচ্ছেন দুর্ভিক্ষতাড়িত প্রজাদের। কিছু দূরে যুদ্ধখ্যাত পলাশি। ১৮৭৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে ঘোড়সওয়ার রমেশচন্দ্রের এই ছুটে চলা ছিল প্রতিদিনের দৃশ্য। নদীর জলপ্লাবনে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির পর হা-অন্ন মানুষের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার তাগিদে তিনি কার্যত ক্লান্তি ভুলে গিয়েছিলেন। জুটত না ঠিকমতো বিশ্রামও। নানা অঞ্চলে অন্নসত্র খোলা হয়েছিল, সেগুলির তদারকি করতেন। গ্রীষ্মকালের রোদের তেজ প্রখর, তাই বেরিয়ে পড়তেন ভোরবেলায়। একে একে সর্বত্র নিজে উপস্থিত থেকে ত্রাণ ও সেবাকর্মের তত্ত্বাবধান করতেন। সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখ, সুবিধে-অসুবিধের কথা শুনতেন।
কর্মক্ষম পুরুষদের ত্রাণকার্যের পাশাপাশি রাস্তা তৈরির কাজে যুক্ত করলেন। অনেক অন্তঃপুরিকা প্রকাশ্যে লঙ্গরখানায় আসতেন না বলে তাদের জন্য চাল ও অর্থসাহায্য বাড়ির দুয়ারে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল তাঁর হস্তক্ষেপে। বনগ্রাম মহকুমার দায়িত্ব নিয়ে গ্রামে গ্রামে পাঠশালা ও নৈশ বিদ্যালয় স্থাপন, ভাঙা স্কুলবাড়ির সংস্কার, শিক্ষক ও ছাত্রদের উৎসাহভাতা দিয়ে শিক্ষা প্রসারের ব্যাপক উদ্যোগ করেছিলেন। নিজের মাইনে থেকে টাকা খরচ করে অনেক ছাত্রের পড়াশোনা বন্ধ হতে দেননি। বরিশালের গৈলা বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রীরা তাঁকে বরণ করে নিয়েছিল সে কালের নান্দনিক-প্রথামতো দীর্ঘ কবিতা লিখে: “এ ক্ষুদ্র পঠনালয়ে, তব আগমনে/ যে আনন্দ, কি বলিবে, অবোধ বালিকা।/ ফোটে না আননে বাণী, বলিবে কেমনে;/ প্রকৃতি আবরে যেন ঘন কুহেলিকা।/ … শুনি শিক্ষকের মুখে তুমি কবি-বর,/ সে বঙ্গবিজেতা আদি কাব্য-চতুষ্টয়,/ কল্পনার সুতুলিতে আঁকি মনোহর;/ রাখিলে জগতে যশ অতুল, অক্ষয়।”
১৮৮৪ সালে বরিশালে মিউনিসিপ্যালিটি ভোট হয়। রমেশচন্দ্র প্রতিটি ওয়ার্ডে নিজে যেতেন, নিয়ম মেনে কাজ হচ্ছে কি না, তার তদারকি করতেন। সে বারের নির্বাচনে কোথাও কোনও রকম কারচুপি হতে দেননি সৎ, সাহসী, প্রয়োজনে নির্মমচিত্ত
এই ম্যাজিস্ট্রেট।
সাহিত্যচর্চায় দত্ত পরিবারের প্রায় সকলেই ব্যবহার করেছেন ইংরেজি ভাষা। শশীচন্দ্র ছাড়া আর এক কাকা কৈলাশচন্দ্র দত্ত, খুড়তুতো বোন অকালপ্রয়াত তরু দত্ত ভারতীয় ইংরেজি সাহিত্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য নাম। রমেশচন্দ্রও কবিতা লিখতেন ইংরেজিতে: “বর্ষাকালে গভীর নিশীথ সময়ে যখন সকলে নিদ্রায় অভিভূত, আকাশ মেঘাচ্ছন্ন, মুষলধারায় বৃষ্টি পতিত হইতেছে,… রমেশবাবুর চক্ষে নিদ্রা নাই, তিনি সেই সময় একাকী কল্পনার আবেশে গৃহ প্রকোষ্ঠে শনৈঃ শনৈঃ পদচালন পূর্ব্বক ইংরাজীতে কবিতা রচনা করিতেছেন”— এই দৃশ্যের সাক্ষী তাঁর জীবনীকার আশুতোষ ঘোষ।
‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকার কাজে বঙ্কিমচন্দ্র তখন ভবানীপুরের একটি ছাপাখানায় প্রায়ই যেতেন। আলিপুরে পোস্টিং বলে রমেশচন্দ্র ছাপাখানাটির কাছে একটি বাসায় থাকতেন। ১৮৭২ সাল। বৈশাখে ভূমিষ্ঠ হল ‘বঙ্গদর্শন’, ওই বছরেই রমেশচন্দ্রের প্রথম বই ‘থ্রি ইয়ার্স ইন ইউরোপ’ প্রকাশিত হয়েছে। আড্ডা জমে উঠত সেই ছাপাখানার অফিসঘরে। এক দিন বাংলা সাহিত্যের প্রসঙ্গ উঠেছে, বঙ্কিমবাবুর উপন্যাস নিয়ে উচ্ছ্বসিত রমেশ। প্রশংসা শুনে বঙ্কিম তাঁকে বললেন: “বাংলা পুস্তকে তোমার যদি এতই ভক্তি আর ভালবাসা, তবে তুমি বাংলায় লেখো না কেন?” এই কথায় ঈষৎ হতচকিত হয়ে পড়লেন রমেশ: “আমি যে বাংলা লেখা কিছুই জানি না। ইংরেজি স্কুলে পণ্ডিত মশাইকে ফাঁকি দেওয়াই নিয়ম, ফলে বাংলা ভাল করে শিখিনি, রচনা পদ্ধতিও জানি না।” কথাটা শুনে গম্ভীর স্বরে সাহিত্যসম্রাট বললেন: “রচনা পদ্ধতি আবার কী, তোমরা শিক্ষিত যুবক, তোমরা যা লিখবে তাই রচনা পদ্ধতি হয়ে উঠবে। তোমরাই ভাষাকে তৈরি করে নেবে!” এই আশ্চর্য কথোপকথনের বিবরণ দিয়ে রমেশচন্দ্র লিখেছেন: “এই মহৎ কথা আমার মনে বরাবর জাগরিত রহিল, তাহার তিন বৎসর পর আমার বাঙ্গালা ভাষায় প্রথম উদ্যম ‘বঙ্গবিজেতা’ প্রকাশ করিলাম।” বাংলা ঐতিহাসিক উপন্যাসে রমেশচন্দ্র দত্তের মহৎ দু’টি অবদানের শিরোনাম ‘মহারাষ্ট্র জীবন-প্রভাত’ এবং ‘রাজপুত জীবন-সন্ধ্যা’। সুকুমার সেন অবশ্য এই দু’টি উপন্যাসের তুলনায় কথাসাহিত্যিকের ‘সমাজ’ এবং ‘সংসার’ নভেল দু’টিকে অধিক উপাদেয় বলে মনে করতেন। এ ছাড়া তাঁর মূল্যায়ন সংশয়াতীত কারণে সত্য: “রমেশচন্দ্রের হস্তে বাঙ্গালা গদ্য কতক পরিমাণে নমনীয়তা ও সৌন্দর্য লাভ করিয়াছিল। বঙ্কিমচন্দ্রের আওতায় পড়িয়াছিলেন বলিয়া রমেশচন্দ্র তাঁহার সময়ে, এমনকি এখনকার কালেও উপযুক্ত সম্মান প্রাপ্ত হন নাই।”
প্রশাসনিক পেশার সূত্রে দেখেছেন দুর্ভিক্ষ, নিরন্ন মানুষের অসহায়তা; সেই সঙ্গে গভীর বিদ্যা ও অভিজ্ঞতার মিশেলে বুঝেছিলেন ভারতের অর্থনীতির দুরবস্থা। চাকরি থেকে স্বেচ্ছা-অবসর নেওয়ার পর এ দেশে ব্রিটিশ শাসনের ত্রুটি-বিচ্যুতি বিষয়ে ভারত ও ইংল্যান্ডে জনমত গড়ে তোলার কাজে এগিয়ে আসেন। ‘ফেমিন ইন ইন্ডিয়া’ এবং ‘ইকনমিক হিস্ট্রি অব ব্রিটিশ ইন্ডিয়া’-র মতো অত্যন্ত পরিশ্রমী গ্রন্থ রচনা করে সে কালের রাজনৈতিক পরিসরে ঝড় তুলে দিয়েছিলেন। কথাসাহিত্যিক প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় তখন বিলেতে। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির স্নেহ-আশীর্বাদ নিয়ে তাঁর এই বিলেত-যাত্রা। সেই সূত্রে তিনি রমেশচন্দ্র দত্তেরও কাছের মানুষ হয়ে উঠেছিলেন। লন্ডনে বসে ‘ইকনমিক হিস্ট্রি অব ব্রিটিশ ইন্ডিয়া’ লেখার কাজ সবে শুরু করেছেন— সেই পর্বের বিবরণ দিয়ে ‘রমেশচন্দ্র-স্মৃতি’ তর্পণে প্রভাতকুমার লিখেছেন: “একদিন বৈকালে তাঁহার নিকট গিয়া দেখি বিস্তর ব্লু-বুক লইয়া ভদ্রলোক ব্যতিব্যস্ত। আমাকে বলিলেন, “এই আড়াইশো ভলুম ব্লু-বুক কিনেছি। পেন্সন থেকে টাকাগুলি দিতে হয়েছে। এতে স্থানে স্থানে যে সব জিনিষ আছে, চমৎকার। আমাদের দেশের যে সমস্ত ইতিহাস আছে, তা শুধু রাজা আর যুদ্ধের ইতিহাস। দেশের অবস্থা কি ছিল, কি হ’ল, তার কোনও ইতিহাস নেই। সেই রকম ইতিহাস একখানা লিখব ব’লে বইগুলো কিনেছি। এ বড় rare collection— আমি মরবার সময় এ বইগুলো এমন কোনও একটা সাধারণ পাঠাগারে দিয়ে যাব, যাঁরা এর মর্য্যাদা বুঝে যত্নে রাখবে— আর দেশের লোকও অবাধে পড়তে পারবে।”
বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের প্রথম সভাপতি রমেশচন্দ্র অব্রাহ্মণ হয়েও ‘ঋগ্বেদ’ অনুবাদ করে বিতর্কের জন্ম দিয়েছিলেন। শেষ জীবনে বরোদার দেওয়ান পদে বৃত ছিলেন, ১৯০৯-এ সেখানে দেহাবসান ঘটে। ১৮৪৮-এর ১৩ আগস্ট জন্ম। এ বছর পূর্ণ হচ্ছে তাঁর জন্মের ১৭৫ বছর। তাঁকে আমরা বিস্মৃত হয়েছি, তাই কোথাও আর সাহানা-ঝাঁপতালে শোনা যায় না এই গীতি: “এস এস হে রমেশ সবে করি আবাহন/ ভালোবাসা উপহার করহে কর গ্রহণ।/ …গভীর বিস্তৃত তব স্বদেশানুরাগ/ বিপুল সহানুভূতি সব মহৎ লক্ষণ।/ নিজ গুণে পাইয়াছ সব হৃদয়ে আসন।”