ধ্যানমগ্ন: তুষারাবৃত এভারেস্ট। নীচে, তেনজিং নোরগে।
তেনজিং নোরগের কাছে দেশের যে ত্রিবর্ণ পতাকাটি ছিল, সেটা আনন্দবাজার পত্রিকার সাংবাদিক রবীন্দ্রনাথ মিত্র তাঁকে দেন। রবীন্দ্রনাথবাবু জাতীয় পতাকা হাতে তুলে দেওয়ার সময় বলেছিলেন, “বন্ধু, এভারেস্টে যদি উঠতে পারো, তবে আমার দেশের পতাকাটাও সেখানে উড়িয়ো।” সেই আবেগ তেনজিংকে ছুঁয়ে গিয়েছিল, বুকের ভিতরে ঝড় উঠেছিল দেশের পতাকা হাতে নিয়ে।
তার পর তেনজিং জয় করলেন পৃথিবীর সর্বোচ্চ শীর্ষ। তাঁর হাতে-ধরা কুড়ুলে চারটি পতাকা বেঁধে তুলে ধরলেন। জোরালো হাওয়ায় উড়েছিল রাষ্ট্রসঙ্ঘ, ভারত, নেপাল আর ব্রিটেনের পতাকা। তিনটে করে দস্তানা পরা হাতে ক্যামেরা ভাল করে ধরা যায় না, তবু তেনজিং-সঙ্গী এডমন্ড হিলারি ছবি তুলে গেলেন অক্লান্ত। তারিখটা ২৯ মে ১৯৫৩। প্রায় সত্তর বছর আগে দুই ভিনদেশি পর্বতারোহীর পারস্পরিক আলিঙ্গন হিমালয় শীর্ষে রচনা করে দিল এক অনন্য বন্ধুত্বের স্মারক।
মাউন্ট এভারেস্ট। উচ্চতা উনত্রিশ হাজার দুই ফুট। নির্ভুল গণনা করেছিলেন রাধানাথ শিকদার। সেই ‘আবিষ্কার’-এর প্রায় শতবর্ষ পরে তেনজিংদের শৃঙ্গজয়। তবে ‘জয়’ শব্দে ভারতীয় নোরগের আপত্তি আছে, তাঁর মতে ও সব অহঙ্কারী ভাবনা ইউরোপীয়দের। শেরপা তেনজিং নোরগের কাছে হিমালয় ঈশ্বরের প্রত্যক্ষ রূপ, তাঁকে জয় করা যায় না। এভারেস্ট-শীর্ষে দাঁড়িয়ে তিনি ক্ষমাপ্রার্থনা করেছিলেন: “হে দেবতা, যদি আমাদের কলঙ্কী পদস্পর্শ তোমাকে অপবিত্র করে থাকে তবে অবোধজ্ঞানে, সন্তানজ্ঞানে আমাদের মার্জনা কোরো।” ১৯২১ সালে প্রথম এভারেস্ট অভিযান শুরু হয়েছিল। ব্যর্থতা আর মৃত্যুর ধারাপাত তিন দশক ধরে লাগাতার চলেছে। অবশেষে এভারেস্ট তার মুকুটমণিতে স্থান দিল এই দুই অদম্য জেদিকে। কে আগে ওই চূড়ায় পা রেখেছিল? এই প্রশ্নে বিরক্ত হতেন তেনজিং। তিনি উত্তর দিতেন: “আমরা দু’জনেই এক সঙ্গে এভারেস্ট চূড়ায় উঠেছি।”
পৃথিবীর এই উচ্চতম স্থানগুলিও ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে। তুষারাবৃত শৈলশিখরে তার অভিঘাত বর্ণনাতীত। “কঠিন স্থির হিমানী-তরঙ্গসমূহ সহসা মুহূর্তের মধ্যে যেন চঞ্চল হয়ে উঠল। বিশালায়তন অচল হিমশৃঙ্গগুলি হঠাৎ একই সঙ্গে অথচ পর পর নেচে উঠল। নৃত্যের যেন একটা সুস্পষ্ট গতি, দিগন্তের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত, অথচ নৃত্যচঞ্চল নটেরা নিজ নিজ পটভূমিতে দৃঢ়-সম্বন্ধ!”— এই দৃশ্য কাঞ্চনজঙ্ঘার পথে, চৌংরিকিয়াং মূল শিবির থেকে দেখেছিলেন বিশ্বদেব বিশ্বাস। ১৯৫৬ সালের এপ্রিল মাসে এনসিসি-র এই অভিযানে তাঁরা ছিলেন মোট ছাব্বিশ জন। এই রোমাঞ্চকর আরোহণ চলতে চলতে তাঁদের গতি রুদ্ধ করে দাঁড়াল ভয়ঙ্কর হিমানী-সম্প্রপাত। পর্বতের মতোই বিরাটাকার তুষারস্তূপ উপর থেকে ধেয়ে আসছে। উল্কাপতনের মতো তার গতি, শত কামান-গর্জনের মতো একটানা, বিচ্ছেদহীন, চাপা শব্দের আক্রোশ! অগ্রসর হতে নিষেধ করছে কাঞ্চনজঙ্ঘা। তবু তাঁরা সেই নিষেধ অমান্য করেছিলেন সে বার।
আনন্দবাজার পত্রিকার তৎকালীন সম্পাদক অশোককুমার সরকার নিজে হাওড়া স্টেশনে উপস্থিত ছিলেন ১৯৬০ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর। নন্দকান্ত নন্দাঘুন্টি অভিযানে আট জন বাঙালি অভিযাত্রীর দল যাত্রা করছেন; এই শৃঙ্গাভিযানের মূল প্রেরণা আনন্দবাজার গোষ্ঠী, খরচের দায়িত্বও তাঁদের। অশোকবাবু অভিযাত্রীদের শুভেচ্ছা জানাতে এসেছিলেন, দলনায়ক সুকুমার রায়ের হাতে তুলে দিয়েছিলেন জাতীয় পতাকা শোভিত একটি তুষারগাঁইতি।
২২ অক্টোবর, বিকেল তিনটে পাঁচ। নিজের হাতের ঘড়িতে সময়টা দেখে নিয়েছিলেন আর এক অভিযাত্রী দিলীপ। কুড়ি হাজার আটশো ফুট উচ্চতায় উঠে তাঁরা যে চাতালটা পেলেন, তার ব্যাস প্রায় তিরিশ ফুট। এটাই নন্দাঘুন্টির চূড়া! আনন্দবাজার পত্রিকার দেওয়া জাতীয় পতাকাটি সুকুমার তুষারগাঁইতিতে বেঁধে পুঁতে দিলেন সেখানে। এর পর এক বান্ডিল দড়ি সেখানে গোল করে পুঁতে দেওয়া হল। তার মধ্যে একটা জাতীয় পতাকা পেতে অভিযাত্রীদের সকলের নাম লেখা কাগজ পরম যত্নে রেখে দিলেন পিটন চাপা দিয়ে। নামগুলো আজও ইতিহাসকে ছুঁয়ে আছে সোনার অক্ষরে: সুকুমার রায়, দিলীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, গৌরকিশোর ঘোষ, বীরেন্দ্র সিংহ, ধ্রুব মজুমদার, অরুণ কর, বিশ্বদেব বিশ্বাস, নিমাই বসু। এ ছাড়া ছিলেন আঙ্ শেরিং, আজীবা, টাসী, নরবু। এঁরা সকলে শতবর্ষী গৌরকিশোরের বিখ্যাত ‘নন্দকান্ত নন্দাঘুন্টি’-তে উপন্যাসোপম চরিত্র হয়ে বিরাজ করছেন, যেগ্রন্থ উৎসর্গ করা হয়েছে ‘বাংলাদেশের প্রথম পর্বতারোহীদল এবং তাঁদের পৃষ্ঠপোষক শ্রীঅশোককুমার সরকার মহাশয়কে’।
চুঁচুড়া থেকে পাহাড়-চূড়ায় পৌঁছনোর অনন্য নজির বার বার তৈরি করেছেন পিয়ালি বসাক। বাঙালি নারীর পাহাড় চড়ার ইতিহাসে দীপালি সিংহকে মনে রাখতে হবে পূর্ব ভারতের প্রথম পর্বতারোহিণী নারীদলের নেত্রী হিসেবে। সুদীপ্তা সেনগুপ্ত, সুজয়া গুহ, স্বপ্না মিত্র, লক্ষ্মী পাল, শীলা ঘোষ, স্বপ্না নন্দী এবং ইন্দিরা বিশ্বাস— এই সপ্তপার্বতী ছিলেন তাঁর দলে। সেই দলের নাম ‘পথিকৃৎ মহিলা পর্বতারোহণ সংস্থা’। ১৯৬৭ সালে তাঁরা আট জন উঠেছিলেন রন্টি গিরিচূড়ায়, যার উচ্চতা উনিশ হাজার ন’শো ফুট। অক্সিজেন ছাড়া এভারেস্ট জয়ের কৃতিত্ব পিয়ালি বসাকের; এই সর্বোচ্চ শৃঙ্গে প্রথম নারী হিসেবে পদচিহ্ন রেখে এসেছিলেন জাপানের জুনকো তাবেই। ১৯৭৫ সালে, জুনকো তখন বয়সে পঁয়ত্রিশের ঘর ছুঁয়ে ফেলেছেন!
রাজা রামমোহন রায় পিতৃগৃহ থেকে বিতাড়িত হয়ে দুর্গম তিব্বতে পৌঁছেছিলেন। কোনও সমস্যার পাহাড়ই তাঁর কাছে অনতিক্রম্য ছিল না। রামমোহনের জন্মের এক যুগ আগে সুইটজ়ারল্যান্ডের এক ধনী ঘোষণা করেছিলেন, সে দেশের মঁ ব্লাঁ পর্বতের শীর্ষে যে আরোহণ করতে পারবে, তাকে পুরস্কৃত করা হবে। ১৭৮৬ সালে জ্যাক ব্যালমেট ও প্যাকার্ড জয় করলেন আল্পস পর্বতমালার বিশেষ আকর্ষণ মঁ ব্লাঁ। আনুষ্ঠানিক পর্বতারোহণের সূচনা ঘটল সেই। তবে ‘প্রথম’ শব্দ নিয়ে বিতর্ক আছে। ১৪৯২ সালে ফ্রান্সের রাজা অষ্টম চার্লসের নির্দেশে তাঁর সভাসদ আন্তোয়েন ডি ভিলে আল্পসের মাউন্ট অ্যাউগুইলিতে উঠেছিলেন, অনেকের মতে এটাই ‘প্রথম পর্বতারোহণ’।
বাঙালি যুবক শরৎচন্দ্র দাশ ১৮৭৯ সালে ‘এভারেষ্ট গিরিশৃঙ্গের প্রায় কাছাকাছি গিয়া পৌঁছিয়াছিলেন।’ এর একটা প্রেক্ষাপট আছে। উনিশ শতকের মাঝামাঝি ক্যাপ্টেন মন্টগোমারি ছিলেন ভারতীয় জরিপ বিভাগের উচ্চপদস্থ কর্মচারী। বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি সহযোগে কী ভাবে অভিযান করতে হয় তা তিনি হাতে-কলমে শিখিয়েছিলেন এক দল উচ্চাকাঙ্ক্ষী ভারতীয়কে। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে এই শিক্ষার্থীদের ‘পণ্ডিত এক্সপ্লোরার্স’ বলা হত, তখন এই দলের মুসলমান সদস্যদের ‘পণ্ডিত’ সম্বোধনে কারও আপত্তি ছিল না কোনও। কিষণসিংহ, লালা, কিনথাপ, আতা মুহম্মদ, শরৎচন্দ্র দাশের মতো সেই বিস্মৃত ‘পণ্ডিত অভিযাত্রী’দের কথা জে বি নোবেল বিস্তারিত লিখেছেন তাঁর ‘থ্রু টিবেট টু এভারেস্ট’ গ্রন্থে। অভিযাত্রীরা জমির পরিমাপ, পর্বতসমূহের দূরত্ব, উচ্চতা, নদ-নদী, হ্রদ ইত্যাদি সন্ধান করতেন।
তেনজিং নোরগে। গেটি ইমেজেস
সিন্ধু নদের উৎস সন্ধানে যাত্রা করেছিলেন মোল্লা আতা মুহম্মদ। ১৮৭৮ সালের জুলাই মাসের বর্ষণমুখর পার্বত্যপথে এই অভিযানে তিনি এক সঙ্গীকে নিয়ে অনাহারে কাটিয়েছিলেন দু’দিন।
যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত ব্যক্তিগত উদ্যোগে জরিপ বিভাগের নানা রিপোর্ট-দস্তাবেজ সংগ্রহ করে এই বিবরণী প্রকাশ করেছিলেন তাঁর ‘হিমালয়-অভিযান’ গ্রন্থে। বইটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষার সিলেবাসে ছিল গত শতকের চল্লিশের দশকে।
পাঠ্যক্রমে ঢোকার ফলে জলধর সেনের ‘হিমালয়’ বইটির তুমুল চাহিদা তৈরি হয়েছিল। লেখক পঞ্চম সংস্করণের ভূমিকায় লিখেছিলেন, যে বই প্রথম প্রকাশের পর পাঁচ বছরে হাজার কপিও বিক্রি হয়নি, হঠাৎই তার এমন চাহিদার পিছনে রয়েছে পরীক্ষা পাসের আকুতি, ‘বাঙালী নরনারী কি পড়িতে যে ভালোবাসেন, কোন গ্রন্থে তাহার আসক্তি’ বুঝতে গেলে অন্তর্যামী হতে হয়।
অমিত আর লাবণ্যর জন্য রবীন্দ্রনাথ বেছে নিয়েছিলেন শিলং পাহাড়। আর সেই অবশ্যম্ভাবী দুর্ঘটনার একটু আগে প্রেক্ষাপট এঁকেছেন লেখক— “এমন সময়ে আষাঢ় এল পাহাড়ে পাহাড়ে বনে বনে তার সজল ঘনচ্ছায়ার চাদর লুটিয়ে।” সেই সহস্রাব্দ আগে কালিদাস মেঘকে দূত করে পাঠিয়েছিলেন বিরহী যক্ষের হয়ে, বেদনাতুর সেই কলমটিকে রবীন্দ্রনাথ আবার এনে স্থাপন করলেন চেরাপুঞ্জির গিরিশৃঙ্গের বুকে, ‘শেষের কবিতা’য়। এই ভাবে বহু দূর অতীত থেকেই বাঙালির ভ্রমণ আর সাহিত্য মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে তার পর্বতপ্রীতির সানুদেশে।