শক্তি চট্টোপাধ্যায় এবং সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।
শক্তি চট্টোপাধ্যায়কেও আদালতের দ্বারস্থ হতে হয়েছিল। সে এক বিচিত্র কাহিনি। ১৯৮৮ সালে ‘দেশ’ পত্রিকায় সাহিত্য অকাদেমি প্রকাশিত একটি বইয়ের আলোচনা করেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। অমরেশ দত্ত সম্পাদিত ‘এনসাইক্লোপিডিয়া অব ইন্ডিয়ান লিটারেচার ভলিউম ওয়ান’ বইটিতে শক্তি চট্টোপাধ্যায় সম্পর্কে উজ্জ্বলকুমার মজুমদার লেখেন, “... হিজ় পোয়েট্রি রিফ্লেক্টেড পয়ন্যান্টলি অল দ্য ফ্রাস্ট্রেশনস অ্যান্ড সেল্ফ-ইনডালজেন্স অব দ্য ইয়ঙ্গার জেনারেশনস অব দ্য ফিফটিজ়। হিজ় ইন্টিমেসি উইথ দ্য আমেরিকান বিটনিকস, সাম অব হুম ওয়্যার ইন ক্যালকাটা অ্যাগ্রেভেটেড হিজ় সামহোয়াট বোহেমিয়ান ফিলিংস অ্যান্ড হি রেলিশড আ ফ্র্যাঙ্ক ডেসক্রিপশন অব মেন্টাল ব্রেকডাউন অর আ ড্রাগ অ্যাডিকশন অর আ সেক্সুয়াল অরজি...” উজ্জ্বলবাবু আরও লেখেন, “ছয়ের দশকে সেই আবেগ খানিকটা ফিকে হয়ে যায়। স্বীকারোক্তিমূলক কবিতার দিকে তিনি ঝুঁকে পড়েন। গড়ে তোলেন একান্ত আপন কথ্য ভাষা। সে কবিতা বাহ্যত তাঁর এ যাবৎ উন্মার্গগামিতার প্রতি প্রবল অনুতাপ এবং অদ্ভুতভাবে নারী, প্রকৃতি এবং ঈশ্বরের কাছে হাস্যময় বা হয়তো অশ্রুময় সমর্পণ।”
গ্রন্থটির আলোচনায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছিলেন, “আর যাই হোক আমরা শক্তির কবিতায় সেক্সুয়াল অরজি পাইনি।”
তখন প্রতি শনিবার ‘দেশ’ পত্রিকা প্রকাশিত হত। ‘দেশ’ পত্রিকার দফতরে দুপুরে অফিস ছুটির পর নিয়মিত বসত আড্ডার আসর। চলত কবি-সাহিত্যিকদের চা-মুড়ি সহযোগে নির্ভেজাল গল্পগাছা। সুনীলদা শক্তিদাকে আগে থেকেই বলে রেখেছিলেন সে দিনের আড্ডায় থাকার জন্য। শক্তিদা সচরাচর শনিবার অফিস যেতেন না, গেলেও দুপুর তিনটের মধ্যে বেরিয়ে পড়তেন।
সুনীলদা সদ্যপ্রকাশিত ‘দেশ’ পত্রিকা শক্তিদার হাতে দিয়ে বললেন, “দেখো, কী লেখা হয়েছে।”
লেখাটি পড়ে শক্তিদা গম্ভীর, মুখ থমথমে। সুনীলদা বললেন, “এরা আমাদের লেখার খবর ভাল করে রাখে না তো বটেই, আবার এমন ভাবে লেখে, যা সাহিত্য অকাদেমি থেকে কোনও রকম খোঁজখবর না নিয়েই ছেপে দেয়। আরও আশ্চর্য কী জানো শক্তি, প্রকাশক, সম্পাদক, লেখক তিন জনই বাঙালি।”
উজ্জলকুমার মজুমদারের এই আলোচনা শক্তিদাকে আহত করেছিল। যা লেখা হয়েছে, সে কথা তাঁর কবিতায় কোনও ভাবেই চিত্রিত নয়। অফিস থেকে বেরিয়ে শক্তিদা খুবই মনমরা। এই ঘটনা তাঁর কাছে কাঙ্ক্ষিত ছিল না। এই রকম সময়ে শক্তিদা দুমড়ে মুচড়ে যান, খালাসিটোলা যেতে মন চায় না, হলাহল পান করতেও ইচ্ছে হয় না। কিছু দিন আগেই মিরাজ থেকে ফিরেছেন, অল্পেই মন অবশ হয়ে যায়। আমায় খুব দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন, “অধিকারী, এর একটা বিহিত করতেই হবে। সুনীল যা বলেছে তা-ই হবে, তুমি দেখো কী করা যায়।”
আমরা আর অন্য কোথাও গেলাম না, কর্নেল বিশ্বাস রোডে শক্তিদার বাড়িতে ফিরে এলাম। এর কিছু দিন পর শক্তিদার বাসা বদল হবে। স্থায়ী আবাস, বেলেঘাটা।
সুনীলদা শক্তিদাকে আদালতে যাওয়ার পরামর্শ দেন। শনিবারের পর সোমবার। আমি দেবকুমার বসুকে আগে থেকেই বলে রেখেছিলাম। দেবকুমার বসু— দেবুদা, শক্তিদার প্রথম গ্রন্থের প্রকাশক এবং বহু লেখকেরই একান্ত দেবুদা। সকালে শক্তিদার কর্নেল বিশ্বাস রোডের বাড়ি থেকে আমরা ব্যাঙ্কশাল কোর্টে হাজির হলাম। প্রথমেই উচ্চ আদালতে না গিয়ে নিম্ন আদালতে একটি মামলা করার জন্য আমরা সিদ্ধান্ত নিই। আবৃত্তিশিল্পী রবীন মজুমদার ব্যাঙ্কশাল কোর্টের তরুণ আইনজীবী। রবীনের সঙ্গে পরামর্শ করে মামলা রুজু করা হল।
রবীন সুন্দর করে হলফনামা তৈরি করে। শক্তি চট্টোপাধ্যায় বনাম সাহিত্য অকাদেমির তৎকালীন সচিব ইন্দ্রনাথ চৌধুরী, বইটির সম্পাদক অমরেশ দত্ত এবং লেখক উজ্জ্বলকুমার মজুমদার। চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের কোর্টে মামলা ওঠে ৭ এপ্রিল ১৯৮৮। এখানে উল্লেখ্য, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ঠিকানা ৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা। সহজেই অনুমেয়, তাঁর কর্মস্থলের সহযোগিতা এ ক্ষেত্রে ছিল।
শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সেই মামলা-সংক্রান্ত কাগজ।
সাক্ষী হিসেবে এই মামলায় ছিলাম, ড. শম্ভুলাল বসাক— শক্তিদার বাল্যবন্ধু, অনুজ দুই লেখক অভী সেনগুপ্ত ও মৃণাল দত্ত, কবি ও সুহৃদ সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত এবং আমি। প্রথম মামলা ওঠার দিন রবীন মজুমদারের সহ-আইনজীবীরা সংশয় প্রকাশ করেছিলেন, শক্তিবাবু এই মামলায় নিয়মিত হাজিরা দেবেন তো? সকল সংশয় উপেক্ষা করে শক্তিদা নিয়মিত আদালতে আসতেন। সহজেই অনুমেয়, কতটা আঘাত তিনি পেয়েছিলেন। তখন তো মোবাইল ফোনের চল ছিল না, মামলার তারিখ জানিয়ে দেওয়া হলে দেবকুমার বসু শক্তিদাকে নিয়ে যথাসময়ে কোর্টে উপস্থিত থাকতেন। আদালতের নির্দেশে গ্রন্থটির প্রকাশক, সম্পাদক ও লেখকের বিরুদ্ধে সমন জারি হয়েছিল, তাঁরাও নির্ধারিত দিনে আদালতে উপস্থিত। বিচারক কোর্টে শক্তিদার নিয়মিত হাজিরা দেওয়া দেখে মুগ্ধ হন।
শেষে দু’পক্ষের সম্মতিতে সমঝোতা হয় ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৯। এক বছর মামলা চলার পর সাহিত্য অকাদেমি থেকে প্রস্তাব দেওয়া হয়, শক্তিদার ‘যেতে পারি, কিন্তু কেন যাব’ গ্রন্থটি পনেরোটি ভাষায় অনূদিত হবে। কিন্তু মামলা নিষ্পত্তি হলে তা আদৌ প্রকাশিত হয়েছিল কি না, সে বিষয়ে আমাদের সম্যক ধারণা নেই।