সমন্বয়স্থল: উপযুক্ত সংরক্ষণের অভাবে ক্রমশ মাটিতে মিশে যাচ্ছে ভোটবাগান মঠের ঐতিহাসিক স্থাপত্য।
জনবহুল গিরিশ ঘোষ রোডের শেষ মাথায় এসে পূর্ব দিকে, এবং তার পর উত্তর দিকে জয় বিবি রোড ধরে যেতে হবে পাঁচ নম্বর গোসাঁই ঘাট স্ট্রিট। সেখানেই চরম অবজ্ঞা আর অবহেলায় ধীরে ধীরে কালের গ্রাসে বিলীয়মান ঐতিহাসিক স্থাপত্য, হাওড়ার ঘুসুড়ি অঞ্চলের ভোটবাগান মঠ— ভারতের প্রথম তিব্বতীয় বৌদ্ধ বিহার। শুধু ভারত নয়, এটিই ছিল বিংশ শতকের আগে পর্যন্ত দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার অন্যতম প্রধান তিব্বতীয় বৌদ্ধ ধর্মের কেন্দ্র। ‘ভোট’ কথাটির আক্ষরিক অর্থ ছিল তিব্বত, ‘মঠ’ মানে মন্দির তথা বিহার। ‘ভোটবাগান মঠ’ কথাটি তিব্বতী বৌদ্ধবিহার অর্থেই ব্যবহৃত।
অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ভুটানের সঙ্গে তার অধীনস্থ রাজ্য কোচবিহারের সংঘর্ষ বেধেছিল। ভুটানের দাবি ছিল, কোচবিহারের শাসক নির্বাচনে তাদের মতামত থাকবে। ভুটানের তদানীন্তন রাজা ড্রুক ডেশি ঝিদার কোচবিহার আক্রমণ করেন এবং তৎকালীন মহারাজা রুদ্রনারায়ণকে বন্দি করেন। রুদ্রনারায়ণের ছেলে ধরেন্দ্রনারায়ণ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গর্ভনর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস-এর সহায়তা প্রার্থনা করেন। হেস্টিংস তাঁর সৈন্যবাহিনীর সাহায্যে ঝিদারকে পরাজিত করেন, কিন্তু বিনিময়ে কোচবিহারের বার্ষিক রাজস্বের অর্ধেক এবং যুদ্ধকালে ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনীর ভরণপোষণের খরচ চেয়ে বসেন। আর পরাজিত ভুটান সাহায্য প্রার্থনা করে তিব্বতের কাছে।
তখন তিব্বতের শাসক অষ্টম দলাই লামা। কিন্তু তিনি নাবালক হওয়ায় শাসন পরিচালনা করেন ষষ্ঠ পাঞ্চেন লামা। তিনি ভুটানের সঙ্গে বিরোধ না করে ওয়ারেন হেস্টিংসকে শান্তিপূর্ণ মীমাংসার অনুরোধ জানিয়ে চিঠি লেখেন। এই সন্ধিপত্র তিনি কলকাতায় পাঠিয়েছিলেন যে দূতের মাধ্যমে, তিনি দশনামী সম্প্রদায়ভুক্ত হিন্দু সন্ন্যাসী, পুরাণ গিরি গোসাঁই। তিনি কলকাতায় এসে পৌঁছন ১৭৭৪ সালের ২৯ মার্চ।
হেস্টিংস পুরাণ গিরি গোসাঁইয়ের সংস্পর্শে প্রভাবিত হন। এক মাসেরও কম সময়ে তিনি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান মেনে নেন। এর পর তিব্বতের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক দৃঢ় করার জন্য তিনি ব্যক্তিগত সচিব জর্জ বোগলেকে পাঞ্চেন লামার কাছে পাঠান। তাঁর মূল উদ্দেশ্য ছিল তিব্বতের কোয়ানলঙ রাজত্বের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন। বিনিময়ে পাঞ্চেন লামা হেস্টিংসের কাছে ভারতে তিব্বতীয়দের উপাসনার জন্য গঙ্গার তীরে জমি প্রার্থনা করলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তা মঞ্জুর করে। সেই থেকে ভোটবাগান বিহারের সূত্রপাত।
১৭৭৫ সালের ডিসেম্বর মাসে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পাঞ্চেন লামার প্রতিনিধি পুরাণ গিরি গোঁসাইকে গঙ্গার পাড়ে হাওড়ার ঘুসুড়ি অঞ্চলে একশো বিঘা আট কাঠা জমি ভাড়ায় দেন। এখানে বিহার নির্মাণ এবং হুগলি নদীর ধারে ঘাট নির্মাণও সম্পন্ন হয়। পাঞ্চেন লামার নির্দেশে অনিন্দ্যসুন্দর একটি উদ্যান নির্মিত হয়। বিহারটি সেই থেকে ভোটবাগান বিহার নামে পরিচিত হয়।
পুরাণ গিরি তিব্বতীয় বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের জন্য বাসস্থান নির্মাণ করেন। মোহন্তের ভূমিকা পালনের সঙ্গে সঙ্গে তিনি পাঞ্চেন লামা ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মধ্যে সেতুবন্ধনের কাজও করেন। সেই থেকে এই বিহার তিব্বতীয় বৌদ্ধ ভিক্ষুদের অতিথি আবাস ও পাঞ্চেন লামার আনুষ্ঠানিক দূতাবাসে পরিণত হয়।
ভোটবাগান বিহার প্রারম্ভে মিশ্র ধর্মীয় প্রভাবে প্রভাবিত হয়েছিল। তিব্বত থেকে ভারতে ফেরার সময় জর্জ বোগলেকে পাঞ্চেন লামা বেশ কিছু তিব্বতী দেবদেবীর মূর্তি দিয়েছিলেন, সেগুলি ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে মঠ প্রতিষ্ঠার সময় সেখানে স্থাপিত হয়েছিল। আরও আনা হয়েছিল ১০০টি সোনার পাত, ধ্বজা ও গালিচা। সেখানে বুদ্ধের মূর্তি না থাকলেও ছিল মুখ্য দেবতা মহাকাল ভৈরবের মূর্তি। উনিশ শতকের পণ্ডিতদের ব্যাখ্যায় মূল্যবান ধাতুনির্মিত মূর্তিটি ন’টি মস্তক, আঠারোটি পদ, ছত্রিশটি বাহু-সহ অস্ত্রসজ্জায় সজ্জিত ছিল। অন্যান্য দেবদেবীর মধ্যে ছিলেন আর্যতারা, চক্রসম্ভব, গুহ্যসমাজা, বজ্রভৃকুটী। পুরাণ গিরি ও তাঁর শিষ্যদের জন্য সংরক্ষিত ছিল শিবলিঙ্গও।
পরবর্তী কালে ভোটবাগান মঠ প্রতিষ্ঠার পর ১৭৭৯ খ্রিস্টাব্দে ওয়ারেন হেস্টিংস পুনর্বার পাঞ্চেন লামার সঙ্গে সচিব জর্জ বোগলের যোগাযোগের চেষ্টা করেন। কিন্তু ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দে পিকিংয়ে বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান পাঞ্চেন লামা। ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় বোগলে সাহেবেরও মৃত্যু হয়।
ভোটবাগান বিহার নির্মাণের সময় হাওড়ার ঘুসুড়ি ছিল জনবিরল গ্রাম। প্রায়ই সেখানে দুর্বৃত্তদের উপদ্রব হত। ১৭৯৫ সালে এক দল সশস্ত্র ডাকাত গুপ্তধনের সন্ধানে ভোটবাগান আক্রমণ করে। পুরাণ গিরি প্রবল বাধা দিলেও ব্যর্থ ও নিহত হন। মূল মহাকাল-মূর্তিটি চুরি হয়ে যায়। এর স্থান নেয় আর্য তারার বিগ্রহ। স্থানীয় পুরোহিতরা প্রমাদবশত এই মূর্তিটিকেই মহাকাল বলে পরিচয় দেন। ১৭৯৫ সালে পুরাণ গিরির মৃত্যুর পর তাঁর উত্তরাধিকারী হন তার শিষ্য দলজিৎ গিরি গোসাঁই। পরবর্তী কালে তাঁর মৃত্যুর পর থেকেই এই বিহারের সঙ্গে তিব্বতীয়দের যোগসূত্র বিনষ্ট হয়ে যায়।
গোঁসাইদের মৃত্যুর পর তাঁদের সমাধিস্থলেই গড়ে উঠেছে আটচালা শৈলীর সৌধ। তেমনই ন’টি স্মৃতিসৌধ পূর্বে বিরাজ করলেও অধিকাংশ সৌধের অস্তিত্ব বর্তমানে বিপন্ন। সৌধের মধ্যবর্তী স্থানে শিবলিঙ্গ স্থাপিত। শিল্পের প্রসারে বারংবার জমি হস্তান্তর হওয়ায় শতাধিক বিঘা জমির আর ছ’বিঘাও অবশিষ্ট নেই। ১৯০৫ সালে ভোটবাগানের মোহন্ত উমরাও গিরির মৃত্যুর পর আবার দশনামী সম্প্রদায় আসরে নেমে ত্রিলোকচন্দ্র গিরিকে মোহন্ত করেন। কিন্তু ১৯৩৫ সালে তাঁকে আর্থিক তছরুপের জেরে অপসারিত হতে হয় এবং মঠটির ভার কোর্টের অধীনে প্রশাসকের হাতে ন্যস্ত হয়।
২০০৫ সালে বিহার সংস্কারের নিদর্শন হিসেবে পিতা-মাতার স্মৃতির উদ্দেশে মুকুলকুমার চট্টোপাধ্যায় ও দীপককুমার চট্টোপাধ্যায় নির্মিত মার্বেলফলক এখনও রয়েছে। ২০১০ সালের আর একটি ফলকে বিহার অঙ্গনে হলঘর নির্মাণ-সহ মঠের সঙ্গে যুক্ত সদস্যদের নামের তালিকাও বর্তমান। হেরিটেজ কমিশনের বিজ্ঞপ্তিতে মঠের ক্ষতিসাধনে বিরত হতে বলা আছে। স্থানীয় মানুষ এই ঐতিহাসিক বৌদ্ধ মঠটিকে ভ্রমবশত শিবমন্দির তথা শঙ্কর মন্দির বলেন। আর্য তারার মূর্তি ও অন্যান্য মূর্তি লৌহবেষ্টনীর শৃঙ্খলে আবদ্ধ। হয়তো এ ভাবেই ক্রমশ বিলীন হয়ে যাবে হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্ম সমন্বয়ের এই ঐতিহাসিক স্থাপত্য।