Bengali Feature

ক্যাপ্টেন ফিট্‌জ়রয় ও তাঁর সহযাত্রীর বিবর্তনবাদ

ক্যাপ্টেন ছিলেন আবহাওয়ার পূর্বাভাস নির্ধারণের পথিকৃৎ। কর্মঠ ও গুণী এই মানুষটি চেয়েছিলেন তাঁর সফরসঙ্গী বাইবেল-অনুসারে জীবের সৃষ্টিতত্ত্ব লিখুন। তাঁর আশা পূর্ণ হয়নি। কারণ সঙ্গীর নাম চার্লস ডারউইন।

Advertisement

গায়ত্রী সেন

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৭ ডিসেম্বর ২০২৩ ০৭:৫৮
Share:

সমুদ্রবেত্তা: ক্যাপ্টেন ফিটজ়রয়।

বিবর্তনবিদ চার্লস ডারউইনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে যে বিখ্যাত জাহাজ, তার নাম এইচ এম এস বিগল। এই জাহাজে চেপে ক্যাপ্টেন রবার্ট ফিট্‌জ়রয়-এর সঙ্গে মাত্র বাইশ বছর বয়সে ডারউইন সাত সমুদ্র ও বারো দ্বীপ পরিক্রমার পথে বেরিয়ে পড়লেন। তারিখটি ছিল ২৭ ডিসেম্বর, ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দ।

Advertisement

ডারউইনকে তাঁর পিতা, ডাক্তার রবার্ট ডারউইন চিকিৎসক করে তুলতে পারেননি। তার বদলে ছেলে প্রকৃতিবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করলেন। বাবা চাইলেন ছেলে পাদরি হওয়ার শিক্ষা নিয়ে চার্চের কাজে যোগ দিক। ডারউইন সে পথেও হাঁটলেন না। তবে এ লেখা ঠিক তাঁকে নিয়ে নয়। এ লেখা তাঁর জাহাজের অধিকর্তা এবং ক্যাপ্টেন, ফিটজ়রয় সাহেবকে নিয়ে।

ফিট্‌জ়রয় ছিলেন এক অসাধারণ মানুষ। ইংল্যান্ডের এক অভিজাত পরিবারে তাঁর জন্ম হয় ১৮০৫ সালে। সে যুগে নৌবাহিনীর কঠোর নিয়মশৃঙ্খলার ফলে জাহাজি ক্যাপ্টেনদের জীবন ছিল অত্যন্ত নিঃসঙ্গ। ফিট্‌জ়রয় শুধু দক্ষ ক্যাপ্টেনই ছিলেন না, তিনি আধুনিক আবহাওয়া পূর্বাভাসের স্রষ্টাও। সমুদ্রে ঝড়ের কবলে পড়ে কত নাবিকের, কত মানুষের প্রাণ যায়। তিনি মানুষের জীবন রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের বহু চেষ্টা করে গিয়েছেন। তিনি ছিলেন এক জন দক্ষ অনুসন্ধানী ও জরিপকার। দক্ষিণ আমেরিকার পূর্ব ও পশ্চিম কূলে তখনকার দিনে পালের জাহাজে চড়ে ঝড়ঝাপটার মধ্যে তিনি যে দুঃসাহসিক জরিপের কাজ করে গেছেন, তা অতুলনীয়।

Advertisement

বিগল জাহাজটি ছিল তিন মাস্তুলের একটি পালতোলা জাহাজ। জাহাজটি দোতলা। জলরেখার নীচের তলায় মালপত্র রাখার জায়গা, সারি সারি জলাধার, কয়লার গুদাম, খাবার রাখার বাক্স, রান্নার জায়গা। দোতলায় ক্যাপ্টেনের কেবিন, নাবিকদের মেস, বন্দুকের ঘর, রোগীর ঘর ইত্যাদি। বাইরের দিকে মস্ত বড় একটা ঘুরনচাকা বা স্টিয়ারিং আছে, যেটি ঘুরিয়ে জাহাজের দিক পরিবর্তন করা হয়। চাকাটির বেড়ের ওপর খোদাই করা একটি লাইন— ‘ইংল্যান্ড এক্সপেক্টস এভরিওয়ান টু ডু হিজ় ডিউটি’। এই বাণী ইংল্যান্ডের নৌ-সেনাপতি নেলসন উচ্চারণ করেছিলেন, ডারউইনের জন্মের কয়েক বছর আগে।

ক্যাপ্টেন ফিট্‌জ়রয় এক জন ভদ্র, শিক্ষিত সঙ্গী খুঁজছিলেন, যাঁর সঙ্গে সমুদ্রযাত্রায় নানা বিষয়ে আলোচনা করে সময় কাটানো যাবে। তাঁর নিঃসঙ্গতা দূর হবে। ক্যাপ্টেন ছিলেন গভীর ভাবে ঈশ্বরবিশ্বাসী। বাইবেলের সৃষ্টিতত্ত্বে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি মনে করতেন, পৃথিবীর বিরাট জীবজগতের সদস্যদের ঈশ্বর মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে এক বারে তৈরি করেছিলেন এবং তার পর থেকে তারা একই রকম রয়ে গেছে।

সে সময় চার্লস লায়েল নামে এক জন ভূতাত্ত্বিক একটা বই ছাপিয়ে বাইবেলের মহাপ্লাবন, জীবকুলের সৃষ্টি, পৃথিবীর আয়ু ইত্যাদি বিষয়ে বাইবেল-বিরোধী বক্তব্য রেখে সে সময় বিস্তর আলোড়ন তুললেন। ফিট্‌জ়রয় দূরদূরান্তের মহাদেশ, দ্বীপগুলিতে ঘুরে বেড়িয়ে মানুষের মতামত সংগ্রহ করে এর বিরুদ্ধে বক্তব্য রেখে সমুচিত জবাব দেবেন ঠিক করলেন। তাই তিনি এমন এক জন সঙ্গীও খুঁজছিলেন যিনি বিভিন্ন দেশ ঘুরে বাইবেলের মত প্রতিষ্ঠা করে বই লিখবেন। স্টিভেন্স হেন্সলো নামে এক জন উদ্ভিদবিজ্ঞানী ও ধর্মযাজক চার্লস ডারউইনকে নিয়ে এলেন ক্যাপ্টেনের কাছে। ডারউইনকে ক্যাপ্টেনের সঙ্গী হিসেবে নির্বাচন করলেন। কিন্তু প্রকৃতির কী পরিহাস! ডারউইনের সমীক্ষা বাইবেলের ধারণাকে সম্পূর্ণ ধরাশায়ী করে দেবে, সে কথা কে জানত!

বিগল জাহাজে চেপে অজানা পথে পাড়ি দিলেন ডারউইন। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই ক্যাপ্টেনের সঙ্গে তাঁর মতবিরোধ ঘটতে লাগল ধর্ম ও জাতিবৈষম্য নিয়ে। দক্ষিণ আমেরিকার সমুদ্রপথের একটি ভাল মানচিত্র তৈরি করা এবং ওখানকার প্রাকৃতিক সম্পদ ও বৈচিত্রের খোঁজখবর নেওয়া সেই যাত্রার উদ্দেশ্য ছিল। দক্ষিণ আমেরিকা, গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জ, অস্ট্রেলিয়া, তাহিতি, আফ্রিকা ঘুরে ফের দক্ষিণ আমেরিকা ছুঁয়ে পাঁচ বছর পর তাঁরা ইংল্যান্ডে ফিরে এলেন ১৮৩৬-এ। পাঁচ বছরের এই দীর্ঘ ভ্রমণ এবং তার সঙ্গে প্রকৃতি পর্যবেক্ষণের মনোরম বিবরণ ডারউইন লিখেছেন তাঁর ‘জার্নাল অব রিসার্চ’-এ।

ফিট্‌জ়রয়ও তাঁর যাত্রাপথের বিবরণ লিখে গিয়েছেন, যা তাঁর সরকারি কাজের প্রয়োজনে লাগবে। ফিট্‌জ়রয় এক সময় ব্রিটিশ সংসদের সদস্য ছিলেন। ১৮৪৩-এ নিউ জ়িল্যান্ডের রাজ্যপাল হন। কিন্তু সেখানকার আদিবাসী মাওরিদের ন্যায্য অধিকার রক্ষা করতে গিয়ে শাসনকর্তাদের কুনজরে পড়েন। তিনি দেশে ফিরে যেতে বাধ্য হন। তখন রাজ্যপালদের ‘নাইট’ উপাধি দেওয়া হত, তাঁর ভাগ্যে তাও জুটল না। তবু তিনি নিরাশ না হয়ে আবহবিদ্যার কাজে আগ্রহী হয়ে উঠলেন। সমুদ্রে ঝড়বাদলে কত নাবিকের, কত মানুষের মৃত্যু হয়, এ ব্যাপারে তিনি সর্বদা চিন্তাভাবনা করতেন। তাই ঝড়ের পূর্বাভাস জানিয়ে দিয়ে মানুষের জীবনরক্ষার জন্য আবহাওয়া পূর্বাভাসের মূল নীতিগুলি প্রতিষ্ঠা করলেন। তিনি ইংল্যান্ডের আবহাওয়া অফিসের প্রতিষ্ঠাতা এবং সর্বপ্রথম তিনিই ‘টাইমস’ কাগজে দৈনিক আবহাওয়ার খবর ছাপাতে শুরু করলেন। ‘ওয়েদার ফোরকাস্ট’ শব্দবন্ধটি তাঁরই সৃষ্টি।

ফিট্‌জ়রয় যদি ডারউইনকে সঙ্গী হিসেবে সমুদ্রযাত্রায় না নিতেন, তা হলে হয়তো ডারউইনকে এক জন ধর্মযাজক হয়েই দিন কাটাতে হত। তাই ডারউইনের আবিষ্কারের পিছনে তাঁর অবদান মনে রাখতেই হবে।

ফিট্‌জ়রয় অত্যন্ত স্পর্শকাতর ছিলেন, সমালোচনা সহ্য করতে পারতেন না। ডারউইন তাঁর সম্বন্ধে লিখেছেন, “আমি যত দূর বুঝেছি, তিনি এক জন অসাধারণ ব্যক্তি। আর কোনও ব্যক্তি সম্বন্ধে আমার মনে হয়নি যে, তিনি নেপোলিয়ন
বা নেলসন হতে পারতেন। ক্যাপ্টেনের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হল অত্যধিক চিন্তার ফলে তার কঠোর নীরবতা। তাঁর মতো গুণী, সাহসী ও জোরালো চরিত্রের সংস্পর্শে আমি আর কখনও আসিনি।”

পাঁচ বছর ধরে ডারউইন ক্ষেত্র পর্যবেক্ষণ, কিংবদন্তি, প্রাণীদের দেহ ব্যবচ্ছেদের বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন। বিভিন্ন ধরনের পাথর, পোকামাকড়, জীবাশ্ম, বোতলবন্দি অ্যালকোহলে নিমজ্জিত ছোট ছোট প্রাণীদের দেহ, পাখির বাসা ইত্যাদি ডাকযোগে লন্ডন ও কেমব্রিজের বিশেষজ্ঞদের কাছে পাঠিয়ে দিতেন গবেষণার জন্য। এ ব্যাপারে ক্যাপ্টেনের কাছ থেকেও অনুমতি আদায় করে ছেড়েছেন। এ সব পরবর্তী কালে তাঁর বিবর্তনবাদ তত্ত্ব নিয়ে গবেষণা ও বই লেখার কাজে প্রভূত সাহায্য করেছিল।

ধর্মপ্রাণ ফিট্‌জ়রয় ডারউইনের বিবর্তনবাদ তত্ত্ব মেনে নিতে পারেননি। ডারউইনের বার্তায় দুনিয়া বদলে দেওয়ার সত্য ছিল। সেই প্রথম স্পষ্ট বলা হল, পৃথিবীর সমস্ত জীব একে অপরের আত্মীয়। মানুষ ঈশ্বরের কোনও স্বতন্ত্র, বিশেষ সৃষ্টি নয়।

ফিট্‌জ়রয় ডারউইনের লেখা ‘অরিজিন অব স্পিশিস’ বইটির কঠোর সমালোচনা করেছিলেন। ডারউইন তাঁকে যেন এক প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন— বাইবেলের সৃষ্টিতত্ত্ব না বিবর্তনবাদ? কোনটি গ্রহণযোগ্য আর কোনটি নয়? শেষ বয়সে ক্যাপ্টেন নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছিলেন। অবসাদ ও বিষণ্ণতায় ভুগে আত্মঘাতী হন।

আর ডারউইন? তাঁর ক্রমবিকাশ তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার পর তিনি ক্রমশ নাস্তিকতার দিকে ঝুঁকে পড়লেন। অনাদিকাল জীবনের যে প্রবাহ চলতে দেখেছিলেন, তার আবিষ্কার করে নিজেকে এই প্রবাহের এক ধারারূপে কল্পনা করেছিলেন। এই প্রত্যয়বোধ থেকে মৃত্যুশয্যায় বলেছিলেন— “আমি মরতে একদম ভয় পাই না।” তিনি অনুভব করতেন এই প্রকৃতির জীবনধারার সঙ্গে তিনি মিশে থাকবেন অনাদি, অনন্ত কাল।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement