অভিযাত্রী: ক্যাপ্টেন জেমস কুক। (ছবি: উইকিমিডিয়া কমন্স)
আঠারো শতকের তৃতীয় ভাগে আমেরিকায় ব্রিটেন এবং ফ্রান্সের মধ্যে যুদ্ধ হয়েছিল সাত বছর ধরে (১৭৫৬-১৭৬৩)। যুদ্ধে ফরাসি-অধিকৃত এলাকা দখল করতে সমর্থ হয় ব্রিটিশরা। ওই যুদ্ধে ব্রিটিশদের নৌসেনা জাহাজ এইচএমএস পেমব্রোক-এর প্রধান নাবিক ছিলেন জেমস কুক। তিনি ১৭৫৮ সালে উত্তর আমেরিকার মিয়ামি অঞ্চলে ফরাসিদের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালিয়ে তাদের পরাস্ত করেন। যুদ্ধ চলাকালীনই কুক সমুদ্র এবং তট-সংলগ্ন নদীর তলার ভূপৃষ্ঠের গভীরতা মেপে তার মানচিত্র তৈরি করেন। ফলে ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজ অনায়াসে সমুদ্র থেকে নদীপথে ঢুকে যুদ্ধ চালাতে সমর্থ হয়। যুদ্ধ-পরবর্তী কালে জেমস কুক তিনটি সুদীর্ঘ সামুদ্রিক অভিযানের দায়িত্বভার নেন, যার মধ্যে দ্বিতীয় অভিযানে তিনি পৃথিবীর প্রথম ব্যক্তি হিসেবে আন্টার্কটিক বা কুমেরু বৃত্ত অতিক্রম করার কৃতিত্ব অর্জন করেন। তারিখটি ছিল ১৭ জানুয়ারি ১৭৭৩। আড়াইশো বছর আগে তিনি পৃথিবীকে দেখিয়েছিলেন দক্ষিণ গোলার্ধস্থিত তুষারাবৃত মহাদেশের পথনির্দেশ।
১৭২৮ সালের ৭ নভেম্বর ইংল্যান্ডের ইয়র্কশায়ারে, মার্টন গ্রামে এক কৃষকের ঘরে জেমস কুকের জন্ম। প্রথাগত শিক্ষা না থাকলেও কুক অঙ্ক, জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং মানচিত্র পাঠ ও তৈরিতে দক্ষ হয়ে উঠেছিলেন। ষোলো বছর বয়সে সমুদ্রের ধারে এক মুদির দোকানে কাজ করতে শুরু করেন তিনি। প্রায়ই দোকানের জানলা দিয়ে তিনি সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকতেন। এক দিন কুক দোকান ছেড়ে চলে যান কাছের বন্দর শহরে। সেখানে আলাপ হয় কয়লার ব্যবসায় যুক্ত জাহাজের দুই মালিক জন এবং হেনরির সঙ্গে। কুকের আগ্রহেই তাঁরা কুককে কয়লা বহনের উপযুক্ত ছোট বাণিজ্যিক তরীতে শিক্ষানবিশ করে নেন। এই কাজের ফাঁকে ফাঁকেই তিনি বীজগণিত, জ্যামিতি, ত্রিকোণমিতি, নৌচালনা এবং জ্যোতির্বিদ্যা শেখেন।
তিন বছরের শিক্ষানবিশি শেষে তিনি বাল্টিক সাগরে বাণিজ্যিক জাহাজে যোগ দেন। তত দিনে তিনি মনস্থ করে ফেলেছেন ব্রিটিশ নৌ-সেনায় যোগ দেবেন। তখনই ব্রিটিশরা ‘সাত বছরের যুদ্ধ’-এর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল, ফলে কুকের চাকরিটা হয়ে যায়। প্রথম দিকে নৌ-সেনা হিসেবে কয়েক মাস জাহাজের ক্যাপ্টেনের সহযোগী থাকতে হয়, ক্রমশ সামরিক কম্যান্ডার এবং মাস্টারের দায়িত্বও পালন করতে হয়।
১৯৫৭ সালে তিনি লন্ডনের ট্রিনিটি হাউস থেকে ‘মাস্টার’ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ব্রিটিশ রাজপরিবারের নৌবহর চালানোর কৃতিত্ব অর্জন করেন এবং ক্যাপ্টেন রবার্ট ক্রেগের অধীনে রণতরীতে যোগ দেন। সেখান থেকে ‘সাত বছরের যুদ্ধ’-তে তাঁর সাফল্য এবং সমুদ্রের তল ও তটরেখার মানচিত্র তৈরির ক্ষমতা তাঁকে পরিচিতি এনে দেয়। ১৭৬৬ সালের ৫ অগস্ট সূর্যগ্রহণ থেকে তাঁর এলাকার দ্রাঘিমা নির্ধারণ এবং নানাবিধ জ্যোতির্বিদ্যার পর্যবেক্ষণ রিপোর্ট রয়্যাল সোসাইটিতে জানানো হলে যথাযথ স্বীকৃতি পান ক্যাপ্টেন কুক।
ফারাওয়ের আদেশে মিশরীয়রা অতলান্তিক মহাসাগর পাড়ি দিয়ে উত্তরে ইওরোপীয় দ্বীপগুলোয় যায় এবং দক্ষিণে-পশ্চিম আফ্রিকার তট ধরে ভারত মহাসাগর হয়ে পূর্ব আফ্রিকায় আসে। আরবীয়রাও আরব সাগর, ভারত মহাসাগর ও চিন সাগরে যেত ব্যবসাবাণিজ্য করতে। ভাস্কো-ডা-গামা ১৪৯৮ সালের এপ্রিলে দক্ষিণ আফ্রিকার ‘কেপ অব হোপ’ পৌঁছে আহমেদ ইব মাজিদ নামে এক আরব নাবিকের কাছে ভারত আসার পথ জেনে নেন। প্রধানত বুদ্ধের বাণী প্রচারের জন্যে ভারতীয়রা সমুদ্রে ভাসেন। ক্রিস্টোফার কলম্বাস ১৪৯২-এ ভারতে আসতে গিয়ে আমেরিকা পৌঁছোন। শত শত বছর ধরে মানুষের জ্ঞান-পিপাসা মেটানোর জন্যে এবং ব্যবসায়িক কারণে সমুদ্রে ভেসে চলার ইতিহাস আছে। এর থেকে অনেক তথ্যও জানা গিয়েছে, কিন্তু সে সব বিক্ষিপ্ত। ব্রিটিশ সরকার এই সব তথ্য একত্র করার উদ্দেশ্যে তিনটি সামুদ্রিক অভিযানের পরিকল্পনা করে এবং ১৭৬৮ সালে জেমস কুককে তার দায়িত্ব দেওয়া হয়। উদ্দেশ্য ছিল প্রধানত বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান।
প্রথম অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল অস্ট্রেলিয়া আবিষ্কার। এইচএমএস এনডেভার জাহাজে অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার পথে জেমস কুক দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরে নিউ জ়িল্যান্ডের সম্পূর্ণ তটরেখার মানচিত্র তৈরি করেন। সেখান থেকে তিনি অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিম তীরে এসে পৌঁছন। সেখান থেকে আরও উত্তরে যেতে গিয়ে প্রবাল প্রাচীরের সঙ্গে ধাক্কা লেগে জাহাজের বিশেষ ক্ষতি হয়। জাহাজ সারিয়ে ইন্দোনেশিয়া হয়ে তিনি ফিরে যান ইংল্যান্ড।
ফিরে আসার পর জেমস কুককে সেনা কম্যান্ডার পদে উন্নীত করা হয় এবং রয়্যাল সোসাইটির তরফে দ্বিতীয় অভিযানের জন্যে প্রস্তুত থাকতে বলা হয়। এই অভিযানের মূল উদ্দেশ্য ছিল পৃথিবী পরিক্রমা করে নিউ জ়িল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়ার আরও দক্ষিণে, কুমেরুর কাছে যে বিশাল স্থলভাগের কথা বিজ্ঞানীরা অনুমান করছেন, তার অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া। কুকের ‘এইচএমএস রেজ়লিউশন’ জাহাজ কুমেরু অভিযানে যাত্রা শুরু করে ১৭৭২ সালের জুলাইয়ে। দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগর ধরে আরও দক্ষিণে যেতে যেতে পেরোনো গেল ৬৬ ডিগ্রি ৩০ মিনিট দক্ষিণ অক্ষরেখা। এই প্রথম মানুষ আন্টার্কটিক বৃত্তের মধ্যে প্রবেশ করল। সেই দিনটা ছিল ১৭ জানুয়ারি ১৭৭৩। আড়াই শো বছর আগে। এই মহৎ অভিযানের প্রথম মানুষটি হলেন কম্যান্ডার জেমস কুক, অভিযান করে ফিরে আসার পর তাঁকে ক্যাপ্টেন পদে উন্নীত করা হয়।
এই দ্বিতীয় অভিযানে কুকের জাহাজে ছিল প্রভূত খাদ্যসামগ্রী, জল পরিস্রুত করার যন্ত্র, ছুরি, কুঠার, বন্দুক ইত্যাদি।
আন্টার্কটিক বৃত্ত পেরিয়ে জাহাজ পৌঁছল ৬৭ ডিগ্রি ১৫ মিনিট অক্ষরেখায়। কুক এগিয়ে চললেন আরও দক্ষিণে, কুমেরু মহাদেশের খোঁজে। আরও ১৫ মিনিট অক্ষ দক্ষিণে ভ্রমণ করলে তুষারস্তূপ পথ আটকাল। জাহাজের মুখ ঘুরিয়ে উত্তরে চলতে শুরু করলেন কুক। প্রায় দু’হাজার মাইল চলার পর আবার চেষ্টা। আবার সেই বৃত্ত অতিক্রম। এই নিয়ে তিন বার অতিক্রম করলেন সেই বৃত্ত। ৩০ জানুয়ারি ১৭৭৪, জাহাজ ৭১ ডিগ্রি ১০ মিনিট অক্ষরেখায় পৌঁছে থেমে গেল। সামনে এত বিশাল এবং পুরু তুষারস্তম্ভ যে তাকে ভেদ করার প্রযুক্তিগত কৌশল জানা ছিল না। কুক লিখলেন, “আমি চেয়েছিলাম আরও দক্ষিণে যেতে, কিন্তু পরিস্থিতি অনুকুল ছিল না। মানুষের পক্ষে যত দূর যাওয়া সম্ভব, সেটা পেরেছি। এতেই আমি সন্তুষ্ট।” মহাদেশের আনুমানিক ২৪০ কিলোমিটার দূর থেকে ফিরে যেতে বাধ্য হন কুক। এর কয়েক দশক পর ১৮২০ সালে তুষারাবৃত আন্টার্কটিকা আবিষ্কার করেন রাশিয়ার এক অভিযাত্রী দল।
সম্পূর্ণ মানচিত্রহীন এক সমুদ্র-অভিযান চালিয়ে ক্যাপ্টেন জেমস কুক পৃথিবীর ইতিহাসে, সমুদ্রবিজ্ঞানের ইতিহাসে পাকাপাকি স্থান করে নিয়েছেন।