সত্তর গড়িয়ে আশির দশকেও আকাশবাণী কলকাতার ‘অনুরোধের আসর’ বসত সপ্তাহে দু’দিন। রবিবার দুপুর একটায় আর সোমবার দুপুর তিনটে থেকে। রবিবারের শিল্পীদের তুলনায় সোমবারের গাইয়েদের হাঁকডাক একটু কম। আর সেটাই ছিল বড় আকর্ষণ। কলেজ থেকে একটু আগে ফিরে রেডিয়ো অন করতেই কখনও বেজে উঠত বাসু মনোহারীর সুরে ভূপিন্দর সিংহের বিরহগীত ‘তুমি তো আপন ছিলে/ কেন মন ভেঙে দিলে’। বাংলা উচ্চারণ বেশ আড়ষ্ট, আড়ষ্টতা অনেক, কিন্তু গায়কি শুনে সমব্যথী হতে সাধ হত, মন ছুঁয়ে যেত সেই রোম্যান্টিক দরদ। সেই শিল্পীকেই গজলের আঙিনায় বাঙালি আবিষ্কার করল দূরদর্শনের ‘আরোহী’ অনুষ্ঠানে। অসম্ভব দুরন্ত আর অকৃত্রিম ছিল দূরদর্শনের সেন্ট্রাল প্রোডাকশন টিমের সেই নিবেদন। আর মুখিয়ে থাকতাম ৩১ ডিসেম্বর, বর্ষশেষের অনুষ্ঠানের জন্যও। সেই আসরে কখনও একক, কখনও দ্বৈত ভাবে স্ত্রী মিতালি মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে অবধারিত উপস্থিতি থাকত ভূপিন্দর সিংহের। বেদনা, উচ্ছ্বাস সবই ওঁর কণ্ঠে নিজস্ব অনুভবে বাজত। সেই গায়নে ধার করা অতিরেক বা আরোপিত সৌন্দর্যের লেশমাত্র ছিল না।
আসলে তো তিনি ছিলেন অন্তরালের কর্মী। লিড গিটারিস্ট। টুয়েলভ স্ট্রিং-সহ সব ধরনের গিটার বাজাতেন অনায়াসে। সেটাই ছিল তাঁর পেশা। রাহুল দেব বর্মণের শিহরন সৃষ্টিকারী ‘দম মারো দম’-এর গীতি-শরীর তৈরিই হয়েছিল ভূপিন্দরের গিটারের জাদুতে। এ কথা সাধারণের জানার কথাও নয়। ‘চুরা লিয়া হ্যায়’ গানের গিটারের অংশগুলোর কথা মনে করে দেখুন, সেগুলো অনস্ক্রিন জিনাত আমনের চেয়ে কিছু কম বিদ্যুৎবাহী ছিল না! ভাবুন ‘শোলে’-র ‘মেহবুবা মেহবুবা’, বাপ্পি লাহিড়ীর সুরারোপে ‘চলতে চলতে’ গান দু’টিতে অ্যাকস্টিক গিটারের অনবদ্য ইন্দ্রজাল ‘ভূপিভাই’য়ের হাত থেকেই তৈরি। মনে পড়লে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে। মনে আসে নজরুলের গানের কথাগুলি, ‘যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পারো নাই, কেন মনে রাখো তারে?’ গিটার-বাদনে তাঁর অসামান্য কৃতিত্বের পরিচিতি বা স্বীকৃতি জনমানসে তিনি কোনও দিনই সে ভাবে পাননি।
বিশিষ্ট সুরকার চন্দন রায়চৌধুরী জানালেন ভূপিসাহেবকে নিয়ে তাঁর মুগ্ধতার কথা। স্বপন-জগমোহন জুটির স্বপনবাবু স্টুডিয়ো ফ্লোরে আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন ভূপিন্দরের সঙ্গে। আজও মনে আছে চন্দনের, খুব দামি একটি ইলেকট্রিক গিটার ছিল ওঁর হাতে। পরবর্তী কালে হায়দরাবাদ থেকে মুম্বইগামী বিমান দশ ঘণ্টা দেরিতে পৌঁছলে চন্দন জানতে পারেন, ওঁর হিন্দি সিরিয়ালের জন্য গাইতে এসে ভূপিন্দর বহু ক্ষণ ফ্লোরে অপেক্ষা করে বাড়ি ফিরে গিয়েছেন। সে যাত্রায় মাতৃআজ্ঞা পালন করে পরের দিনই অবশ্য ফের ফ্লোরে এলেন শিল্পী। চন্দন বুদ্ধি করে ফোনে ওঁর মাকেই ধরেছিলেন যে! এমনিতে সিরিয়ালের গান কেউ মনে রাখে না। কিন্তু রবি ওঝা মুম্বই গিয়ে ভূপিন্দরের যে গান রেকর্ড করে নিয়ে এসেছিলেন ওঁর ‘এক আকাশের নীচে’-র ‘টাইটল সং’ হিসেবে, সেটি কিন্তু বাঙালি রেখে দিয়েছে স্মৃতির সুরসিন্দুকে। সেই গানটি হল ‘কিছু মেঘ কিছু রোদ্দুর/ পালাবে কোথায় বলো কত দূর?’ না, স্বকীয়তায় ভরা এমন মেধাবী আর মায়াবী কণ্ঠ তালাত মাহমুদ বা পিন্টু ভট্টাচার্যের পরে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রেই আর আসেনি।
গানের সঙ্গে সখ্য গড়ে দিত তো রেডিয়োই। তখন একটিই নিরীহদর্শন সেটে বড়দের খবর শোনা, মায়েদের ‘মহিলা মহল’, বেশি রাতে তার হাতবদল, বে-আইনি শ্রবণ-চর্চা। সে সময় ‘বিবিধ ভারতী’ শোনার প্রায় নিষিদ্ধ আকর্ষণ ও আনন্দ এখনকার একশো-দু’শো চ্যানেলের সেট টপ বক্স দিতে পারবে না। এক ঘরে ঘুমন্ত পরিবার। অপর ঘরে রেডিয়ো সেটে তখন ভূপিন্দর গাইছেন ‘বিতি না বিতাই রয়না’, যার গীতিকার ও সুরকার যথাক্রমে গুলজ়ার সাহেব আর রাহুল দেব বর্মণ। ‘পরিচয়’ ছবির এই গানের মাখনকণ্ঠটি আরও ক্ষুরধার ‘কিনারা’ ছবির ‘মিঠে বোল বোলে’ গানটিতে। দু’টি গানেই সহশিল্পী লতা মঙ্গেশকর। হিন্দি ছবির বাঁধা ছকে সমুদ্রপারের দূতের মতো নতুন বাতাস নিয়ে এসেছেন এই নব্য গায়ক। গান সাজাতে সাজাতে শ্রীকান্ত আচার্য বললেন, ‘কিনারা’-র এই গানে প্রায় নেশা লেগে যাওয়ার উপক্রম। তার পরে পর পর এসেছে ‘মৌসম’ ছবির ‘দিল ঢুন্ডতা হ্যায়’, জয়দেবের সুরে ‘এক আকেলা এক শহর মে’। চূড়ান্ত উদ্দীপক ‘দো দিওয়ানা’তে সহশিল্পী রুনা লায়লার সঙ্গে নিজেকে আকাশছোঁয়া উচ্চতায় নিয়ে গেলেন ভূপিন্দর সিংহ। আর পিছনে তাকাতে হয়নি। তাঁর মানসিকতা ছিল প্রকৃত শিল্পীর, কখনও খ্যাতির পিছনে দৌড়োননি, গানের সংখ্যা কম কি বেশি, কিংবা লাভ-লোকসানের হিসাব নিয়ে কখনও চিন্তা করেননি। “একদম নিজের ভেতরে ঢুকে থাকা মানুষ...” যথার্থই বললেন শ্রীকান্ত।
নিজের জায়গা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন না একেবারেই। নইলে কেউ অন্যকে স্টেজ ছেড়ে দেয়? ২০০৬ সালে হোটেল হিন্দুস্থান ইন্টারন্যাশনালের এক আয়োজন, সম্ভবত কোনও চ্যানেলের অনুষ্ঠান। ভূপিন্দর দুরন্ত গজ়ল শোনানোর পর পরই অতর্কিতে স্টেজে আগমন নচিকেতা চক্রবর্তীর। নচিকেতার সেই ভরা সময়ে হাসিমুখে তাঁকে অভ্যর্থনা জানান ভূপিন্দর। কিছু পরে দেখা যায়, হারমোনিয়াম হাতে ভূপিন্দর ডুয়েট গাইছেন নচিকেতার সঙ্গে!
শ্রীকান্তর মনে পড়ছে ভূপিন্দরের সঙ্গে তিনটি অনুষ্ঠানের বাংলাদেশ সফর। ২০১৮ সালে গুলজ়ার সাহেবের সঙ্গে কলকাতায় আগমনী অনুষ্ঠানে গাইতে এসেছিলেন ভূপিন্দর-মিতালি জুটি। কলকাতার গাইয়েরা থাকুন ওঁর অনুষ্ঠানে, সর্বদা চাইতেন। তখন হাতে লাঠি, শোনার সমস্যা হচ্ছে। শ্রোতাও দেখেছেন, গাইতে গেলে চোখ ভরে জল আসছে শিল্পীর। কিন্তু অসম্ভব শৃঙ্খলা ওঁর গানে, শিল্পী ব্যক্তিত্বেও। সব সময় সহৃদয়তার মান রক্ষা করেছেন। পাশে সর্বদা ছিলেন অর্ধাঙ্গিনী মিতালি। তিনি বাংলার নামী গাইয়ে। ভূপিন্দরের গলায় তাই বাংলা গান সংখ্যায় কম নয়। ‘ডেকো না আমায় ফিরে’ বা ‘চুপি চুপি রাত’ তো মনেই আসে। কিন্তু আশি সালের পর থেকে আমূল পাল্টালেন নিজেকে। মদনমোহনের ডাকে মুম্বইয়ে এসে প্লেব্যাক গায়ক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করল যে যুবক, আশির পর থেকে কণ্ঠে তাঁর শুধুই গজ়ল।কখনও একক, কখনও স্ত্রী মিতালির সঙ্গে যৌথ ভাবে। অনেক অনুষ্ঠান, অনেক অ্যালবাম।
সেই সব অ্যালবামের মধ্যে, স্মৃতির সরণিতে ‘সুরমাই রাত’, ‘আনন্দ লোক মে’, ‘এক আরজ়ু’, ‘গুলমোহর’, ‘গজ়ল কে ফুল’ আজও উজ্জ্বল। ভূপিন্দরের গানের কাছে সংখ্যা দুর্বল হয়ে পড়ে। কত হাজার গেয়েছেন, কী কী পুরস্কার পেয়েছেন— এ সব প্রসঙ্গ গানের উৎকর্ষের কাছে ফিকে হয়ে যায়। নাম-খ্যাতির তোয়াক্কা না করে নিঃশব্দে সঙ্গীতের সেবা করে গেলেন তিনি। সেই পরিচয়েই তিনি শ্রোতার হৃদয়ে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।