বাঙালি মায়েদের পুজোআচ্চা-ব্রতষষ্ঠী ইত্যাদি নিত্যকৃত্যের মধ্যে জামাই-বাবাজীবন যে কী ভাবে জুড়ে গেলেন, তার খুব একটা প্রাচীন পূর্বসূত্র পাওয়া যায় না। সমাজতাত্ত্বিকরা মনে করেছেন, সম্ভবত আঠারো শতক বা তার কিছু আগে জামাইষষ্ঠী পর্বের গোড়াপত্তন। জামাইষষ্ঠী, ভেঙে বলা যায়, জামাইয়ের জন্যে ষষ্ঠী। কিন্তু পুরাণে এই দু’টি শব্দের মধ্যে কোনও যোগ পাওয়া যায়নি। জামাইষষ্ঠী অর্বাচীন কালের লোকাচার। সময়ের স্রোত জামাই আর ষষ্ঠীকে নিকটবর্তী করেছে। মূল বিষয় ষষ্ঠীপুজো। পৌরাণিক তাৎপর্যে অরণ্যষষ্ঠী। এই ষষ্ঠী দেবীকে শুধু বঙ্গে নয়, বৃহত্তর ভারতেও নানা ভাবে পূজার্চনা করা হয়।
বায়ুপুরাণে যে ৪৯ জন দেবীর কল্পনা করা হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হলেন ষষ্ঠীমাতা। সমস্ত মাতৃদেবীর মধ্যে ষষ্ঠী দেবীকে ‘আরাধ্যতমা’ বলে মনে করা হয়েছে সেখানে। স্মৃতিশাস্ত্রে, বিশেষ করে যাজ্ঞবল্ক্য স্মৃতিতে রয়েছে এই দেবী প্রসঙ্গে নানা কথা। এখানে তিনি স্কন্দদেবের পালিতা মা, রক্ষয়িত্রী জননী, ইনি সন্তানদাত্রী। এই দেবী আদি প্রকৃতির ষষ্ঠাঙ্গ অংশভূতা, তাই ষষ্ঠী। একাধিক নামে পূজিতা হন এই দেবী— কৌমারী, বালি, স্কন্দজায়া ইত্যাদি। তাঁর স্মরণেই বাঙালি মায়ের মুখে ষাট্ ষাট্!
হিন্দু ধর্মগ্রন্থের কোথাও কোথাও ষষ্ঠীমাতাকে দেখানো হয়েছে যুদ্ধরতা বেশে। শিশুদের সঙ্গে নিয়ে যুদ্ধদেবতা স্কন্দের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন তিনি। গৌরবর্ণা ও দ্বিভুজা এই দেবী। জগদ্ধাত্রীর সঙ্গে নাকি ষষ্ঠীমাতার চিরবৈরিতার সম্পর্ক। কিংবদন্তি আছে, জগদ্ধাত্রীর বাহন বাঘ বলে ষষ্ঠীমাতা নিজের বাহন করেছেন বাঘের মাসি বেড়ালকে। তবে লোকসাহিত্যের গবেষকেরা কিছু ভিন্ন কথা বলেন। এক সময় নাকি মনে করা হত, নিঃসন্তান রমণী বেড়ালের দুধ পান করলে গর্ভধারণ করতে সক্ষম হবেন। বন্ধ্যা রমণীর জন্যে মার্জারদুগ্ধ ছিল মহৌষধি। সেই দিক থেকে বিবেচনা করলে ষষ্ঠীর বাহন হিসেবে বেড়ালের মান্যতা বাড়ে বইকি। নারীর পূর্ণতা মাতৃত্বে, বহমান কালের এই ধারণা থেকেও বেড়ালের মিথটি তৈরি হতে পারে।
বাংলা সাহিত্যে প্রধান ও অপ্রধান মঙ্গলকাব্যের তালিকাটি ছোট নয়। সেখানেই রয়েছে ষষ্ঠীমঙ্গল কাব্যের কথা। পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় পূর্ববঙ্গে ষষ্ঠী-পুজোর ধরনধারণ আলাদা। এ রাজ্যে ষষ্ঠীমায়ের কোনও মূর্তির প্রচলন নেই। কিন্তু পূর্ববঙ্গে মাটির মূর্তি গড়ে ষষ্ঠী পূজা করা হয়। মার্জারবাহনা, দ্বিভুজা দেবী। কোলে এক বা একাধিক পুত্র নিয়ে বসে আছেন বটবৃক্ষের তলে। পিছনে দুধপুকুর। বটবৃক্ষ আসলে দীর্ঘজীবিতা এবং দুধপুকুর সন্তানের ক্ষুন্নিবৃত্তির প্রতীক। এমন ভাবনা থেকেই হয়তো মৃন্ময়ী মূর্তির পরিকল্পনা ও তার অনুষঙ্গ তৈরি হয়েছিল। এই দেবীর উপাসনায় মায়েদের কৃচ্ছ্রসাধন, উপোস, উপচার-সংগ্রহে তৎপরতা এবং অবশেষে সন্তানের মাথায় সমস্ত পুণ্যের সুফল নামিয়ে দেওয়াতেই পরম শান্তি। আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে, এ শুধু কবির কল্পনা নয়, মায়ের বুকের গভীর থেকে উঠে আসা প্রত্যয়ও বটে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সন্তানের মঙ্গলকামনায় মায়েরা হাজারও রকমের ব্রতষষ্ঠী করে থাকেন, বঙ্গজীবনে এ আর নতুন কথা কী! কিন্তু জামাই বাবাজীবনকে সেই ষষ্ঠীপুজোর প্রধান অঙ্গ করে তোলার পিছনে সত্যিই কোনও কারণ আছে কি না, তা খুঁজে দেখা দরকার। সাধারণ ভাবে বেশির ভাগ বঙ্গজননী সারা বছরে তিনটি ষষ্ঠীর উপবাস করবেন-ই। একটি হল দুর্গাষষ্ঠী, দ্বিতীয়টি চৈত্র সংক্রান্তিতে নীলষষ্ঠী আর শেষেরটি অরণ্যষষ্ঠী। প্রথম দু’টির ক্ষেত্রে অবশ্য জামাইকে সে ভাবে যুক্ত করা হয়নি। কিন্তু শেষেরটিতে জামাই-ই হয়ে উঠেছেন মুখ্য। পুরনো পত্রপত্রিকা ঘাঁটলে দেখা যাবে, জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি থেকে প্রকাশিত একাধিক পত্রিকার পাতায় বাঙালি রমণীর ষষ্ঠীব্রত নিয়ে নানা ধরনের লেখা প্রকাশিত হত। সেখানে যোগেশচন্দ্র চক্রবর্তী আজ থেকে ঠিক একশো বছর আগে ‘অর্চনা’ পত্রিকায়, ১৩২৯ বঙ্গাব্দের জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায় অরণ্যষষ্ঠী নিয়ে প্রথম একটি লেখা প্রকাশ করলেন। সেখানে তিনি বলেছিলেন, মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ও ধর্মচিন্তা থেকেই মেয়েলি নানা ব্রতকথার উদ্ভব। সেই সব ব্রতকথার আরাধ্য দেবী লক্ষ্মী, চণ্ডী, ষষ্ঠী প্রমুখ। মজার ব্যাপার হল, এই সব দেবদেবীদের বাহন হিসেবে এখন যাদের দেখা যায়, এক সময় সেই সব বাহনকেই পুজো করবার প্রথা ছিল। যেমন লক্ষ্মীর পেঁচা, সুবচনীর হাঁস কিংবা ষষ্ঠীর বেড়াল ইত্যাদি। এই সঙ্গে আদিম বৃক্ষপূজার একটা ধারাও চোরাস্রোতের মতো বহমান ছিল সমাজজীবনে। ফলে এই সব দেবীর পূজার উপচার হিসেবে উঠে আসত বটের ডাল, ফণিমনসার ডাল, অশ্বত্থের ডাল, মোচার খোলা, কলার পেটো, দূর্বাঘাস, হলুদ ইত্যাদি। সমস্ত উপকরণ হাতের কাছে গুছিয়ে নিয়ে মা বসেন কৃচ্ছ্রসাধনায়। সন্তান তাঁর দীর্ঘজীবী হোক। শৌর্যে সম্পদে শান্তিতে ভরে উঠুক সন্তানের ভবিষ্যৎ। সেই সন্তানের তালিকা ক্রমবর্ধমান হল সপ্তদশ শতক শেষ হতে না হতেই। ছেলেমেয়েদের পাশাপাশি জামাই বাবাজীবনও স্থান পেয়ে গেলেন শ্বশ্রূমাতার বাৎসল্যতালিকায়।
একটু পিছন ফিরলে দেখা যাবে, অষ্টাদশ শতকের বাঙালি পরিবার যে সব বিধিনিষেধের অনুশাসনে তটস্থ থাকত, তার মধ্যে অন্যতম ছিল ‘গৌরীদান প্রথা’। বাঙালি পরিবারের কন্যা অষ্টমবর্ষীয়া হওয়ার আগেই তাকে গোত্রান্তর করতে হত। তা না হলে কন্যার পিতা হতেন একঘরে। তার ধোপা-নাপিত বন্ধ হত। আর কন্যা হত ভ্রষ্টা। কাজেই কুলীন জামাতা যত বৃদ্ধই হোক, তার হাতে অষ্টমবর্ষীয়া কন্যা সম্প্রদান করে দায়মুক্ত হতেন বাবা-মা। বৃদ্ধ জামাতার স্বল্পায়ু, কন্যার সন্তানধারণ প্রসঙ্গ, সহমরণের শঙ্কা ইত্যাদি বিষয়গুলি নিয়ে চিন্তার শেষ থাকত না বাবা-মায়ের। সব চাইতে বড় কথা, যত দিন কন্যার গর্ভস্থ সন্তান ভূমিষ্ঠ না হচ্ছে, তত দিন মেয়ের বাবা-মা যেতে পারতেন না কন্যার শ্বশুরালয়ে। এমনটাই ছিল সামাজিক অনুশাসন। তাই ষষ্ঠীপুজোর অছিলায় মেয়ের পাশাপাশি জামাইকেও নিমন্ত্রণ করে নিয়ে আসার প্রথা তৈরি হল এই সময় থেকেই। উন্নাসিক ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের দিয়ে সেই প্রথা অনুমোদনের জন্যে কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি সে কালে।
জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্লা ষষ্ঠীতে মেয়ে-জামাইকে ‘ষেটের বাতাস’ দিয়ে মা আশীর্বাদ করবেন এবং তাঁদের জন্য মা ষষ্ঠীর কৃপাভিক্ষা করবেন। এই উদ্দেশ্যেই তৈরি হয়েছিল জামাইষষ্ঠী। আর একটি কথা। এই সময়ে বহুবিবাহেরও রেওয়াজ ছিল। প্রতিটি কন্যার পিতামাতাই চাইতেন, অন্যান্য শ্বশুরবাড়িতে না গিয়ে তাঁদের জামাই বাবাজীবন যেন একমাত্র তাঁর বাড়িতেই আসে। সে জন্য আপ্যায়নের বিপুল খরচ করতে গিয়ে মুক্তকচ্ছ হতেও তাঁর আপত্তি নেই। সেই ভাবে জামাই আপ্যায়নের ঐতিহ্য এখনও টিকে রয়েছে।
জামাইষষ্ঠীর নাম শুরুতে ছিল অরণ্যষষ্ঠী। অনেকে বলেন বাঁটাষষ্ঠী বা স্কন্দষষ্ঠী। কিন্তু অরণ্যষষ্ঠী নামটিই অধিক প্রচলিত। কেন অরণ্যষষ্ঠী? তার কারণ হল, অরণ্যের সম্পদের প্রতি (অ্যাগ্রোফরেস্ট্রি), কৃষিনির্ভর সভ্যতার প্রতি সম্মান বা আনুগত্য। জ্যৈষ্ঠে প্রকৃতি-মা যেমন আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে ফলে ফসলে পরিপূর্ণ করে তোলেন, তেমন করেই ষষ্ঠীমাতা যেন সন্তানের মঙ্গলকামনায় উদারহস্ত হন এই বিশেষ সময়টিতে। প্রকৃতি-মায়ের কাছে যেমন কেউ পর নন, পরিবারের কল্যাণময়ী জননীর কাছেও তেমনি জামাতা আপন পরিবারভুক্ত হয়ে ওঠেন। এই পাঠ প্রকৃতিই শেখায় আমাদের। তাই জননী তাঁর আঁচলে ভরে নেন প্রকৃতির অকৃপণ ডালা। আম, জাম, জামরুল, কাঁঠাল, মেঠো খেজুর, ফলসা, আঁশফল, কুসুম, গাব, কেন্দু, কামরাঙা— প্রকৃতির সর্বস্ব হয়ে ওঠে জননীর উপচার। বৎসরান্তে একটি বারের জন্য মেয়ে-জামাইকে চোখের দেখা দেখার আর্তি মিশে থাকে মায়ের প্রশ্বাসে। কে জানে কখন আবার বন্যায় ভেসে যাবে বঙ্গদেশের নদীনালা ঘরদোর! তার আগে বাৎসল্যের এই সযত্ন আয়োজনটুকু জননী সাজিয়ে রাখেন তাঁর প্রিয় জামাতাটির জন্যে, মেয়ের জন্যে তো বটেই। বাকিটা নেহাৎই ব্রতকথার গল্পগাছা। বেড়ালের নামে দোষ চাপিয়ে বেনেবাড়ির বৌ চুরি করে সব খেয়ে নিচ্ছে। তার পর বিপাকে পড়ে পচা বেড়ালের উপর দই ফেলে চেটে খাচ্ছে। সম্পূর্ণ হচ্ছে পাপের প্রায়শ্চিত্ত। ষষ্ঠীমাতা খুশি হয়ে সন্তানসুখে ভরিয়ে তুলছেন সংসার। অরণ্যষষ্ঠী আর জামাইষষ্ঠীর এই সম্পৃক্ততা পরিবেশ-প্রেমিক বাঙালির কাছে এক স্বতন্ত্র গবেষণার বিষয় হয়ে উঠতে পারে।
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।