অদূরে দাঁড়িয়ে আছেন চণ্ডীদাস, পাশে রামি রজকিনি। সামনে দিয়ে চলে গিয়েছে পথ। ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে এগিয়ে চলা বাস, কষ্টে বোঝা বয়ে চলা ঠেলাগাড়ি, ক্ষয়াটে বাইসাইকেল, স্কুল থেকে ফেরা ঘাম-সপসপে কিশোর-কিশোরী, তাদের পাশ দিয়ে হুঙ্কার দিয়ে পেরিয়ে যাওয়া সাতলাখি-দশলাখি গাড়ি, ঝলমলে বিপণির পাশে ম্লান মুদিখানা, চায়ের দোকান। এ সব ছাড়িয়ে চোখ চলে যায় সাতশো বছর পিছনে। হয়তো সে দিনও আজকের মতোই সূর্য আগুন ঢালছিল, ধনাঢ্যের গৃহে বিশ্রান্তরা ছাড়া বাকিদের সর্বাঙ্গ ভিজে যাচ্ছিল ঘামে। সেই দ্বিপ্রহরেও হয়তো রামি রজকিনি অভ্যস্ত দু’হাতে অন্যের পরনের ময়লা কাপড় মাথার উপর দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পাটায় আছড়ে পরিষ্কার করছিলেন। অনন্য সেই সৌন্দর্য কবির চোখে ‘কামগন্ধ নাহি তায়’। হয়তো কোনও চাষি মাথায় ফসলের বোঝা নিয়ে ফিরছিল, কেউ কোদাল চালাচ্ছিল, তালপাতা ছাওয়া ভাঙাচোরা রান্নাঘরে ধোঁয়া এড়িয়ে, ঘাম মুছে শীর্ণ হাত উনুন থেকে তুলে আনছিল ভাতের হাঁড়ি, কুমোর ঘুরিয়ে চলছিল চাক, থরে থরে সাজিয়ে রাখছিল মৃৎপাত্র, কামার অবিশ্রান্ত হাতুড়ির আঘাতে নেহাইয়ের উপর রাখা গনগনে লোহা পিটিয়ে গড়ছিল লাঙলের ফাল, কুড়ুল। ময়রা গড়ে চলছিল মিষ্টান্ন, জেলের কুশলী হাত থেকে ছড়িয়ে নামছিল জাল ফেলার শিল্প। এখানেই কোথাও, পুকুরপাড়ে বা মাটির দাওয়ায়, রচিত হয়েছিল, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’।
প্রত্যয় হয় না। এখানেই লেখা হয়েছিল, ‘পিরীতিনগরে বসতি করিব/ পিরীতে বাঁধিব ঘর’? গত দু’দশক ধরে চণ্ডীদাসের নানুর সংবাদ শিরোনামে। মানুষে মানুষে সংঘাত, রক্তপাত, প্রাণহানি নৈমিত্তিক। বোমা-বারুদের অন্তহীন সক্রিয়তায় অ-প্রেমের অখণ্ড বিস্ফোরণ। নেতায় নেতায় যুদ্ধ, অনুগামী বেতনভুক কর্মীদের নিজ-নিজ নেতাদের জন্য জান লড়িয়ে দেওয়া।
“না দিয়ে উপায় কী?” বললেন চল্লিশেই বুড়িয়ে যাওয়া চায়ের দোকানি। “কী আর করবে? এই দেখুন আমাকে। লেখাপড়া করতে পারিনি, পারলেও যে চাকরি পেতাম তার ঠিক ছিল না। পুঁজি নেই যে বড় ব্যবসা করব। পরের খাটতে যাব, তারও উপায় নেই। কাজ কোথায়? কারখানা নেই, ব্যবসা নেই। চাষবাস ভরসা। বেশির ভাগ ছোট চাষি, বর্গাদার, পাট্টাদার। আর সব খেতমজুর। এত খেতমজুর কাজ পাবে কোথা? দলে দলে ছেলে বাইরে যাচ্ছে কাজের খোঁজে। আমার ছেলেও গেল। মাধ্যমিক পাশ করল, আর পড়ল না। বললাম, বাপ রে, পড়। কষ্টেমষ্টে চালাব। বলল, পড়ে কী হবে? চাকরি তো পাব না। পাবেই বা কী করে? আমার তো টাকা নেই। দশ-বারো লাখ না দিলে চাকরি হবে না, সবাই জানে। মজুরই বা কে খাটাবে? সেই তো চাষের ক’দিন। তার চেয়ে এই ভাল, বাইরে যা হোক মাসে চার-পাঁচ হাজার টাকা হয়। সেও ভারী কষ্ট— সারা দিন খাটা, রাতে ঘুপচি ঘরে গাদা মেরে শুয়ে থাকা। অসুখবিসুখে দেখার কেউ নেই। তবু ভাল। এখানে থাকলে তো প্রাণে মরবে। কত দিন আগলে রাখব? বোমা মারতে পারলে, গুলি চালাতে পারলে মজুরি। যে যত পারে তার মজুরি তত বেশি।”
“নেতারা কোথায় টাকা পায়? জানলেও বলা বারণ,” বললেন উদয়াস্ত মুখে রক্ত তুলে সরকারি প্রকল্পে সরকার-ঘোষিত মজুরির চেয়ে অনেক কম টাকায় খেটে চলা এক মহিলা। “যদি জানতে পারে অমুক একটু ট্যারা কথা বলছে, তার হয়ে গেল। সরকার থেকে কিছু তো পাবেই না, পুরো একঘরে হয়ে যাবে। ভুল কেস দিয়ে পুলিশও তুলে নিতে পারে। নেতাদের ক্ষমতা বিরাট।…তাও কেন ওদের বিরুদ্ধে বলছি? আপনি কি আর ওদের কাছে বলতে যাচ্ছেন? তা ছাড়া নিরলে বলছি, সবার সামনে বলা যায় না।...আচ্ছা বলুন তো, পেটের কথা পেটে রেখে বাঁচা যায়? কাউকে না কাউকে তো বলতেই হবে। এই কথা বলেই যেটুকু শান্তি। সেটুকুও আড়ে-সাড়ে।…ওদের খুব ভয়, ভয়ে শুকিয়ে থাকে বলে এত লম্ফঝম্প। সারা ক্ষণ ভাবছে এই বুঝি কেউ আমার সঙ্গে বেইমানি করল। আমার বিরুদ্ধে আর এক জনের কাছে লাগাল, ওর দলে যোগ দিল। বিরোধী দল সাফ হয়ে যাওয়ার কথা বলছেন? তা ঠিক, এখন একটাই দল, অন্তত বাইরে তো তাই। পঞ্চায়েত ভোট করারও দরকার নেই। দু’লক্ষেরও বেশি লোক এই ব্লকে, তাও অন্য পার্টির কেউ ভোটে দাঁড়াল না। কোনও বিরোধী নেই। সব আমাদের পার্টির সাপোর্টার হয়ে গেছে। আমিও এই পার্টির। কিন্তু এখন আমরাও বিরোধী, মানে সন্দেহ করে। বিরোধী পার্টি না থাকলে আর কী করবে? নিজের লোককেই বিরোধী বানাবে! সব নেতার নিজের নিজের দল। কেউ বড়, কেউ ছোট। যে ছোট সে বড় হতে চায়, আর যে বড় সে অন্যদের ছোট রাখতে চায়... এই চলছে। কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না। যার যেমন সুযোগ, তেমন ছুরি মারে।”
“নিজেরা তো আর মরবে না। মরছি আমরা,” জানালেন এক মিস্তিরি। “আমরা গরিব মানুষ, চিরকাল খেটে খাই। কারও কাছে কিছু চাইতে যাই না। দুঃখ সয়ে বেঁচে থাকি। সারা দিন খাটলে দু-আড়াইশো টাকা, সেই টাকায় ভাত, বাচ্চার পড়াশোনা, জ্বর-অসুখ, বিয়ে-শাদি। আসল কথা কি জানেন? গরিবের উন্নতি কোনও পার্টি চায় না। সবাই চায় গরিব দয়ার দানে বেঁচে থাক। বামফ্রন্ট কী করল? জমি দিল। আমার বাবাও পেয়েছিল দশ কাঠা। আমরা দু-ভাইতে এখন পাঁচ কাঠা করে চষি। ওতে কী হবে? লেখাপড়া করতে পারলাম না। মাধ্যমিক পাশ করেছিলাম। কিন্তু বাপ টিউশন খরচ চালাতে পারল না। টিউশন ছাড়া পাশ করা যায় বটে, পড়াশোনা হয় না। এই সরকারও আমাদের অনেক দিচ্ছে, মিছে বলব না। দু’টাকা কিলো চাল দিচ্ছে। সাইকেল দিচ্ছে। সবাই কিছু না কিছু পাচ্ছে। কিন্তু যেটা হলে গরিব লোকে মানুষ হতে পারে তার ব্যবস্থা নাই।… আমার এক ছেলে, এক মেয়ে। ইস্কুলে কী পড়ায় না পড়ায় তার ঠিক নেই। ঠিক করলাম, খেতে পাই না পাই ওদের ভাল করে পড়াব। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করে দিলাম। মাসে দু’জনের শুধু বেতন দিতে হয় দেড়শো দেড়শো তিনশো। তার উপর জামা-জুতা-ঠাটবাট। এ বার হিসাব লাগান, মাসে দশ কেজি চাল পাই, তাতে আমার কত বাঁচল? ধরুন দুশো টাকা। কিন্তু ইস্কুলের ফি দিচ্ছি তিনশো। চাল দিলে ভাল, কিন্তু ইস্কুলটার উন্নতি করে দিলে আমার কত উপকার হত ভাবুন তো! আমি কি আর পয়সা খরচা করে বাচ্চাদের পড়াতাম? তাও দু-নম্বরি ইংলিশ মিডিয়াম ইস্কুলে! এই পাড়াগাঁয়ে এক নম্বরি পাবেন কোথায়? কিন্তু তার আগে যাওয়ার আর উপায় নেই।”
“যাবে কেমন করে?” মহিলা কর্মীটির প্রশ্ন। “এক হাতে দিচ্ছে, অন্য হাতে কেড়ে নিচ্ছে। কন্যাশ্রী দিচ্ছে, সাইকেল দিচ্ছে, চাল দিচ্ছে, কিন্তু একশো দিনের কাজের সব টাকা লুট। আপনি এক দিনও কাজ করেননি, আপনার নামে টাকা তোলা হয়ে যাচ্ছে। কাজ দিলে কি আর ছেলেছোকরারা বোম বাঁধতে যেত, না পিস্তল নিয়ে ছুটত? বোম-পিস্তল চালাবার লোক না থাকলে পার্টি চলবে কী করে?... আর পার্টি মানে টাকা, টাকা ছাড়া এখন পার্টি হয় না। আগে নেতাদের দেখেছি, সাইকেলও ছিল না। তার পর মোটর সাইকেল, আর এখন দেখুন না গাঁয়ে গাঁয়ে ধূলা উড়িয়ে গাড়ির মেলা।… টাকা থাকলে ঝামেলা থাকবে। যে কম পেল তার রাগ। যে বেশি পেল তার ভয়, ওরা বিরোধী হয়ে গেল! আর বোম মারামারি। প্রথমে বিরোধীদের খতম করো, এখন বিরোধী নেই, তাই নিজেদের ভেতর বিরোধী খোঁজা। আপনারা শহরের মানুষ, বুঝবেন না, রাজনীতি কত রগড়ের ব্যাপার! শত্রু না থাকলে রাজনীতি হয় না, তাই সারা ক্ষণ শত্রুতার চাষবাস!” সে জন্যেই কি ২০১৩-র মতো এ বারেও একই বিরোধীশূন্য ছবি? গত বারের পঞ্চায়েত ভোটে নানুর ব্লকে ১১টা পঞ্চায়েতেই শুধু লড়াই হয়েছিল। শত্রুতা এখানে তৈরি করা হয়।
“না না, ও কথা ঠিক নয়। শুধু শত্রুতা থাকলে আর আমরা আছি কী করে? মানুষ কি এত সহজে হার মানে? আমরা আমাদের মতো বাঁচার রাস্তা খুঁজে নিই,” কথায় কথা জোড়েন এক নাপিত। “চাঁদা চাইলে দিয়ে দিই, মিছিলে যেতে বললে চলে যাই, ফিরে এসে আবার নিজের নিজের কাজে। কথায় বলে, যে সয়, সে রয়। মানুষের চেয়ে বেশি কে আর সইতে পারে? পার্টি নিয়ে চুপচাপ থাকি, হরিকীর্তন করি, জলসা করি। দল বেঁধে মেলায় যাই। পাড়ায় পাড়ায় কত খুড়া-খুড়ি, তাদের নিয়ে থাকি। হ্যাঁ, ছেলেছোকরাদের বিপদ। তাদের কাঁচা টাকা দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তারা মারছে, মরছে। যারা বুঝছে তারা ঘরে ফিরছে, চলে যাচ্ছে চেন্নাই, হায়দরাবাদ। আর কিছু উলুখাগড়া হয়ে থাকছে। যেমন চিরকাল হয়।”
সারা চৈত্র জুড়ে কালচিনি থেকে বান্দোয়ান পর্যন্ত বাংলার রাজনীতি ও লোকসমাজের যে ছবি দেখেছি, সেই ছবি নানুরেরও ঘরে। এক দিকে দরিদ্রের কুটির, অন্য দিকে সদ্য গজিয়ে ওঠা বিলাসের ভয়-জাগানো প্রদর্শনী। একই ধনিকের পুঁজিনিবেশে গজিয়ে উঠেছে এক প্রমোদকানন, সেখানে পরজীবীদের জন্য রেস্তরাঁ আর বেসরকারি হাসপাতাল— সরকারি স্বাস্থ্যবিমার দিকে চোখ রেখে। কুটির থেকে ভেসে আসছে ভাতের গন্ধ। ভাঙাচোরা এক বাড়ি, ততোধিক ভাঙাচোরা চেহারার এক স্ত্রীলোক রান্না সারছেন। কয়েকটা বাচ্চা রোদে দৌড়ে বেড়াচ্ছে। আর, বৈভবের পরাকাষ্ঠার সামনে মাথায়-মুখে আবির মাখানো বিনা-প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত এক দল পঞ্চায়েত সদস্যা, জয় উদ্যাপন করতে তাঁদের ধরে আনা। তাঁদের মুখে কতটা সুখ, কতটা বাড়ি ফেরার উদ্বেগ, রৌদ্রের বিকট ঔজ্জ্বল্যে ধরা গেল না। বোঝা গেল না, তাঁরা কতটা নিজস্ব বিশ্বাসে দলের অনুগামী, আর কতটা ক্ষমতার হুকুমে।
সেও বোধ হয় এক রহস্য। রবীন্দ্রনাথের পাঠে, চণ্ডীদাসের কবিতায়, “কতটা কথা একেবারে বলাই হয় নাই! ...যাহা বলা হইল না পাঠকদিগকে তাহাই শুনিতে হইবে!” গ্রাম বাংলার রাজনীতি ও সমাজ সম্পর্কেও একই কথা— যতটা ব্যক্ত, তার চেয়ে অনেক বেশি অব্যক্ত। যা দেখা যায়, তার চেয়ে অনেক বেশি অ-প্রকাশ্য। এখানে ভয় যেমন সত্য, রক্তপাত, ক্ষমতার আস্ফালন, পরের ধন লুট করে নেওয়ার অশ্লীল অট্টহাসি, পরের উপর অত্যাচার যেমন সত্য, এবং নির্জলা মিথ্যা যেমন সত্য, তেমনি সত্য মানুষের চিরন্তন এক সঙ্গীত: ‘পিরীতি লাগিয়া আপনা ভুলিয়া/ পরেতে মিশিতে পারে/ পরকে আপন করিতে পারিলে/ পিরীতি মিলয়ে তারে।’ আপন আপনার দিকে টানবে, আপন পরের দিকেও টানবে। পরকে আপন, আপনকে পরের আপন করে তোলার যে সাধনা, রাজনীতির অপ্রেম তাকে হত্যা করতে সফল হবে, এমনটা বিশ্বাস করা কঠিন। স্ব-প্রেমে, অন্যপ্রেমে যৌবনেই প্রৌঢ় দোকানি, অথবা, দিনমজুরি করে সংসার টানা, টিবি রোগগ্রস্ত, স্বামীর পরিচর্যা করা, অপুষ্টির প্রতিচ্ছায়া নারী, কিংবা অভাবের চাপে হাইস্কুলের পড়া ছেড়ে রাস্তার ধারে চুল-দাড়ি কাটার বিবর্ণ দোকান খুলে বসা যুবা, অথবা সরকারি অন্যায্য ব্যবস্থাপনায় উদয়াস্ত খেটে চলা কর্মী, স্ব-রোজগার দলের সদস্যা, মিড-ডে মিলের রাঁধুনি, সাইকেলে পসরা বেঁধে স্থান-স্থানান্তরে ফেরি করতে বেরোনো, শিক্ষিত, চাকরি না পাওয়া যুবক, এঁদের বেঁচে থাকাটাই তো মানুষের সত্যতার গাথা। রাজা-রাজপুরুষ এই মানুষকে
ভয় পায়, ভয় পায় তার দুঃখকে সুখে বদলে নেওয়ার মানুষী ক্ষমতাকে। সত্যকে চেনা সহজ নয়, তাই সে চিরন্তন।