Basanta Chowdhury

শুধু এক জন সংগ্রাহক নন, ছিলেন নিষ্ঠাবান গবেষকও

তবে অভিনেতা বসন্ত চৌধুরীর সেই পরিচিতির কথা জানেন না অনেকেই। শুধু গণেশ কিংবা শাল সংগ্রহই নয়, বাংলা লিপি উৎকীর্ণ আছে, এমন মুদ্রা সংগ্রহেও তাঁর অনুসন্ধিৎসা ছিল প্রবল।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৫ মে ২০২৪ ০৭:৩৫
Share:

শিল্পবেত্তা: মূর্তি পর্যবেক্ষণে মগ্ন বসন্ত চৌধুরী। ছবি: সুকুমার রায়। (সৌজন্যে: সঞ্জীব চৌধুরী)

অভিনয়ের জগতে বসন্ত চৌধুরী একটি সর্বজনবিদিত নাম। আমার কাছে তিনি ছিলেন এক জন মনোযোগী পাঠক, তন্নিষ্ঠ গবেষক, রুচিশীল সংগ্রাহক এবং সবার উপরে, এক জন গুণগ্রাহী বন্ধু।

Advertisement

আমাদের প্রথম দেখা ১৯৬৪ সালের মাঝামাঝি। আমি তখন ইন্ডিয়ান মিউজ়িয়মের আর্ট সেকশনের ডেপুটি কিপার। আমার দায়িত্বে মিনিয়েচার পেন্টিং, কারুশিল্প ও বস্ত্রশিল্পের সুবিশাল সংগ্রহ। আমার অফিস ছিল চৌরঙ্গি বিল্ডিং-এর সর্বোচ্চ তলে, আর্ট কলেজের উপরে। বসন্তদা তখন ‘রাজা রামমোহন’ ছবির নামভূমিকায় অভিনয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আরও অনেক বাঙালি পরিবারের মতো আমাদের পরিবারও ‘মহাপ্রস্থানের পথে’ দেখার পর থেকে এই সুদর্শন অভিনেতার গুণগ্রাহী। তাঁকে আমার অফিসে সামনাসামনি দেখে আমিও যাকে বলে গদগদ। রামমোহন ও তাঁর সমসাময়িক মানুষজনের পোশাকআশাক ও পারিপার্শ্বিক কী রকম ছিল, আমাদের সংগ্রহে সে যুগের ছবি বা কোনও জিনিসপত্র পাওয়া যাবে কি না, জানার উদ্দেশ্যে তাঁর আগমন। আমার শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক সরসীকুমার সরস্বতী তাঁকে আমার কাছে পাঠিয়েছেন বলে জানালেন। দুঃখের বিষয় আমাদের সংগ্রহে তেমন কিছুই ছিল না, যা তাঁর কাজে আসতে পারে।

আমি ওঁকে এগিয়ে দেওয়ার জন্য দ্বিতীয় গেটের লম্বা সিঁড়ি ধরে নীচে নামছি, ওঁর চোখ পড়ল কাপড়ের ডিসপ্লে কেসগুলির দিকে। তার মধ্যে একটিতে রেশমে বোনা একটি পুরনো নামাবলি দেখিয়ে বললেন, “লেবেলে বোধহয় ঠিক লেখা নেই, এটা কিন্তু মুর্শিদাবাদের বালুচরে বোনা, বেনারসের নয়।” আরও বললেন, “বালুচরের তাঁতিরা কখনও জরি ব্যবহার করতেন না।” বলতে পারলাম না লেবেলটা পুরনো, আমার লেখা নয়। তবে আমার মনে ওঁর মন্তব্য গাঁথা হয়ে রইল। বুঝে গেলাম উনি এক জন অভিনেতা মাত্র নন।

Advertisement

ক’মাস পরে আমি গবেষণার কাজে তিন বছরের জন্য বিদেশে চলে গেলাম। ফিরে এসে দেখলাম, আমার পুরনো অফিস নতুন থাংকা গ্যালারিতে রূপান্তরিত হয়েছে, আমার ঠাঁই হয়েছে পুরনো প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের লাইব্রেরি ঘরের এক কোণে। তবে সান্ত্বনা, ওই একই তলায় একটি লাইব্রেরি তৈরি হয়েছে, আর আমাকে তার ভারপ্রাপ্ত করা হয়েছে। সেখানেই আবার নতুন করে দেখা বসন্তদার সঙ্গে। সিনেমার ব্যস্ত নায়ক এখানে এক জন মনোযোগী পাঠক। মন দিয়ে নিউমিসম্যাটিক সোসাইটির জার্নালে প্রবন্ধ লেখার জন্য নোট নিচ্ছেন। তখন জানতে পারলাম তাঁর মুদ্রা সংগ্রহের নেশার কথা। তবে যে কোনও প্রাচীন মুদ্রায় তাঁর আগ্রহ নেই। অসম, কোচবিহার, জয়ন্তিয়া, মণিপুর, ত্রিপুরা, আরাকানের রাজাদের সময় যে সব রুপো ও তামার মুদ্রায় বাংলা অক্ষরের লিপি আছে, তাতেই তাঁর আগ্রহ। সংগ্রহ করতে না পারলেও, ওই রকম যত মুদ্রার প্রচলন হয়েছে, তার খুঁটিনাটি তথ্য সংগ্রহ করার জন্যই তাঁর মিউজ়িয়মে আসা— কখনও কয়েন রুমে মুনিরা খাতুন ও ডলি মুখোপাধ্যায়ের কাছে, কখনও লাইব্রেরিতে আমার কাছে।

তখন প্রায়ই তাঁর সঙ্গে থাকতেন আর এক সহ-সংগ্রাহক, পরিমল রায়। তখন রুপোর দাম বাড়ছে, তাই স্যাকরার দোকানে বাড়ির পুরনো মুদ্রা চলে আসত প্রায়ই। তার মাঝে হঠাৎ কোনও দুর্লভ মুদ্রার দেখা মিললে পরিচিত ডিলারদের মারফত তাঁর মতো সংগ্রাহকের হাতে চলে আসত। তখন সদবি, ক্রিস্টিজ় কিংবা স্পিংক্স-এর মতো নিলামঘর ছিল না এ দেশে, তাই কোনও ডিলারের হাতে নতুন মুদ্রা এলেই খবর চালাচালি হয়ে যেত। তাঁদের মধ্যে কেউ হয়তো আগে বসন্তদাকে খবর দিতেন। দাম তাঁর সাধ্যের বাইরে থাকলে তা চলে যেত অন্য কোনও ধনী সংগ্রাহকের কাছে। তার জন্য মনোমালিন্য হত না। বসন্তদা যখন কোনও গবেষণাপত্র লিখতেন, তাঁরা ছবি ও তথ্য দিয়ে সব রকম সাহায্য করতেন। চোরাপথে আসা মুদ্রা কিংবা যার প্রামাণিকতা স্পষ্ট নয়, সে সব জিনিস থেকে দূরে থাকতেন বসন্তদা।

দেখতাম, বসন্তদা শুধু সংগ্রহ করে ক্ষান্ত নন, একটি মুদ্রা কী ভাবে একটি রাজবংশের পুনর্গঠনের উপাদান হয়, সেই মুদ্রায় উৎকীর্ণ মূর্তি ও লিপি কী ভাবে তৎকালীন ধর্মবিশ্বাস ও রাজনৈতিক ইতিহাসের দিগ্‌দর্শন হিসাবে বিবেচিত হয়, তার বিবরণ গবেষক-সংগ্রাহকদের মধ্যে প্রচারিত করার জন্যও সচেষ্ট। তখন তিনি এশিয়াটিক সোসাইটির মাসিক ও বার্ষিক সাধারণ সভায় গবেষণাপত্র পাঠ করতেন। আবার নিউমিসম্যাটিক সোসাইটির জার্নালে প্রকাশের জন্যও পাঠিয়ে দিতেন। তাঁর প্রথম গবেষণাপত্র, যত দূর জানি, সেখানে প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৭১ সালে। তখন বসন্তদার সঙ্গে তৎকালীন ইতিহাসবিদ, গবেষক ও সংগ্রাহকগণ, যেমন অধ্যাপক অমর লাহিড়ী, অধ্যাপক বেলা লাহিড়ী, জি এস ফরিদ, নিকোলাস রোডস, জন ডেয়েল, জে পি সিংহ, আর ডি চৌধুরী, প্রতীপকুমার মিত্র প্রমুখ অনেকের নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। নিকোলাস রোডসের সঙ্গে তাঁর অন্তত দু’টি গবেষণাপত্রের হদিস আমি পেয়েছি। তবে অনেক চেষ্টা করেও তাঁর প্রকাশিত প্রবন্ধের তালিকা সম্পূর্ণ করতে পারিনি, তাঁর সব বক্তৃতার বিবরণও খুঁজে পাইনি। আমার তালিকায় মোট ১৭টি প্রবন্ধ ও নোটস রয়েছে, তার শেষ প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছে ১৯৯৭ সালে, ‘জার্নাল অব এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ’-এ। অনেক বিশেষজ্ঞ যেমন সংগ্রাহক নন, আবার অনেক সংগ্রাহক অতটা গভীরেও যেতে পারেন না। বসন্ত চৌধুরী সেই বিরল ব্যক্তিত্ব, যিনি শুধু সংগ্রাহক নন, এক জন উচ্চমানের গবেষকও।

এক বার বসন্তদার বাড়িতে গিয়ে তাঁর বইয়ের শেলফগুলি দেখে বুঝেছিলাম, কত বিস্তৃত তাঁর অনুসন্ধিৎসা। তাঁর প্রিয় গণেশ মূর্তিগুলি দেখে মনে হয়েছিল, তিনি নাগপুরের মানুষ, তাই সিদ্ধিদাতার প্রতি শ্রদ্ধা একটু বেশি। পরে তিনি বলেছিলেন, শুটিং বা অন্য কাজে যখনই বাইরে গেছেন, তখনই গণেশের খোঁজ করেছেন। প্রাচীনকাল থেকে বিভিন্ন মন্দিরের বাইরে ও ভিতরে, পাথর ছাড়াও পোড়ামাটি, কাঠ, কাচ, দুর্লভ রত্ন, সোনা, রুপো, ব্রোঞ্জ কিংবা পোর্সেলিন দিয়ে বিভিন্ন গণেশের মূর্তি নির্মাণ হয়েছে। কিন্তু তাঁর লক্ষ্য ছিল শুধুই ছোট আকারের মূর্তির দিকে, তার প্রাচীনত্বের দিকে নয়। আমার বন্ধু প্রতাপাদিত্য পালের আগ্রহে ও প্রচেষ্টায়, তাঁর সম্পাদিত মার্গ ফাউন্ডেশনের ‘গণেশ দ্য বেনিভোলেন্ট’ বইয়ে (মুম্বই, ১৯৯৫) বসন্তদা তাঁর গণেশের সংগ্রহ নিয়ে অনেক কথা লিখেছেন। সেই লেখা পড়লে জানা যায় সংগ্রাহক হিসেবে তাঁর বিভিন্ন অনুভূতি ও অভিজ্ঞতার কথা।

অনেক সময় অনায়াসে বা অপ্রত্যাশিত ভাবে গণেশের কোনও মূর্তি বসন্তদা পেয়ে গিয়েছেন, আবার অনেক চেষ্টা করেও কোনও প্রত্যাশিত মূর্তি হাত থেকে বেরিয়ে গিয়েছে। তিনি লিখেছেন, কী ভাবে তাঁর পছন্দের একটি গণেশ মূর্তি, অন্য সংগ্রাহকের কাছে চলে যাওয়ার পরও, তাঁর আগ্রহ ও অনুরাগের পরিচয় পেয়ে সেই সংগ্রাহক তাঁকে মূর্তিটি উপহার দিয়ে দিয়েছেন। বলেছেন, “আমি বুঝেছি এই মূর্তি তোমার কাছে আমার চেয়ে বেশি যত্ন ও শ্রদ্ধা পাবে।” বসন্তদা তাঁর অত্যন্ত প্রিয় গণেশজননীর একটি টেরাকোটার মূর্তির কথা লিখেছেন, কী ভাবে তাঁর পরিচিত এক জন পুরনো ডিলার ব্যবসা গুটিয়ে ফেলার আগে তাঁকে সেই অপরূপ মূর্তিটি উপহার দেন। এই লেখার সঙ্গে তাঁর সংগ্রহের বারোটি গণেশ মূর্তির ছবি ছাপা হয়েছিল। ‘মার্গ’ পত্রিকায় বা বইয়ে অত্যন্ত উঁচু মানের ছবি ছাপা হয় বলে প্রতাপাদিত্য এক জন নামী ফোটোগ্রাফার সুরিথ দত্তকে বসন্তদার কাছে পাঠান। আলোর ব্যবহারে দীর্ঘকালের অভিজ্ঞতা থাকায় বসন্তদা প্রত্যেকটি মূর্তি কোন অ্যাঙ্গল থেকে তোলা হবে, কী ভাবে আলোর প্রক্ষেপণ হবে, সব কিছু তদারক করেন। দুঃখের বিষয়, তার সতেরো বছর পরে ইন্ডিয়ান মিউজ়িয়ম থেকে প্রকাশিত ‘গণদেবতা: হান্ড্রেড গণেশ আইকনস ফ্রম বসন্ত চৌধুরী ইন দি ইন্ডিয়ান মিউজ়িয়ম (কলকাতা ২০১২)’ ক্যাটালগে তাঁর সংগৃহীত মূর্তিগুলির যে ছবি ছাপা হয়েছে, তা অনেকটাই নিম্নমানের। একটাই সান্ত্বনা, কর্তৃপক্ষ ক্যাটালগের শুরুতে বসন্তদার ‘মার্গ’-এর জন্য লেখা প্রবন্ধটি ছবি-সহ পুনর্মুদ্রণ করেছেন। এখানে উল্লেখ্য যে, তাঁর সারা জীবনে গভীর আগ্রহে সংগৃহীত, অপার মমতায় সংরক্ষিত গণেশ মূর্তিগুলি তিনি ইন্ডিয়ান মিউজ়িয়মকে দান করে যান। শেষ জীবনে তিনি মিউজিয়মের অছি পরিষদের সদস্য ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর অনেক বছর পেরিয়ে গেলেও নানা কারণে সেই সংগ্রহ প্রদর্শনের ব্যবস্থা নিতে দেরি হয়। ভারত সরকারের তৎকালীন অধিকর্তা জহর সরকারের প্রচেষ্টায় সংগ্রহটি মিউজ়িয়মের ব্রোঞ্জ গ্যালারিতে স্থান পায় ও ক্যাটালগটি প্রকাশিত হয়।

১৯৭২ সালে চাকরিসূত্রে জয়পুরে চলে যাওয়ার আগের কয়েক বছরে আমি এশিয়াটিক সোসাইটি, অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টস, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল ও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগের উদ্যোগে আয়োজিত অনেক প্রদর্শনী, আলোচনাচক্র ও বক্তৃতামালায় অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ পেয়েছি। বসন্তদা যখন শহরে থাকতেন, কাজের মধ্যে সময় বার করতে পারলে উপস্থিত হতেন। জয়পুরে দীর্ঘ প্রবাসকালে কলকাতার সঙ্গে আমাদের যোগসূত্র অনেকটা ক্ষীণ হয়ে আসছিল। তবে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল-এর অধ্যাপক নিশীথরঞ্জন রায় ও অধ্যাপক হীরেন চক্রবর্তী এবং ইন্ডিয়ান মিউজ়িয়মে রমেশচন্দ্র শর্মা ডাইরেক্টর থাকাকালীন বেশ কয়েক বার বক্তৃতা দেওয়ার ও আলোচনাচক্রে প্রবন্ধ পাঠের আমন্ত্রণ পেয়ে ছুটে এসেছি। প্রায় প্রত্যেক বার বসন্তদার সঙ্গে দেখা হয়েছে। এক বার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে মোগল চিত্রকলার উপর তিনটি বক্তৃতার একটি সিরিজ়ে অভাবনীয় সাড়া পেয়েছিলাম। বসন্তদাকে একেবারে সামনে সারিতে শ্রোতা হিসেবে পেয়েছিলাম। অনুষ্ঠান শেষে তাঁর প্রশ্ন শুনে অনুভব করতে পারতাম, তিনি কতখানি মনোযোগ দিয়ে বিষয়টি অনুধাবন করেছেন।

সে যুগে ব্রিটিশ কাউন্সিল, ইউএসআইএস ও অন্য কিছু দূতাবাস কলকাতার সাংস্কৃতিক মানচিত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিত। ব্রিটিশ কাউন্সিলের দু’জন কর্তা টিম স্কট ও জন হাইন্ডমার্শের সান্ধ্য জমায়েতে বেশ কয়েক বার ডাক পেয়েছি। অনেক নামী মানুষের সঙ্গে দেখা হয়েছে সেখানে, তাঁদের মধ্যে ছিলেন উৎপল দত্ত, শোভা সেন, চিদানন্দ দাশগুপ্ত, অপর্ণা সেন, গণেশ ও খুকু বাগচী, নির্মল ও মীরা মুখোপাধ্যায়, মৃণাল সেন ও আরও অনেকে। কিন্তু আমাদের প্রধান আকর্ষণ ছিলেন বসন্তদা। এক বার শীতের সময় তিনি একটি অতুলনীয় জামেওয়ার শাল গায়ে দিয়ে এসেছিলেন। আমরা কাছে গিয়ে যখন তারিফ করছি, তখন বলেছিলেন, “তোমাদের সংগ্রহে এর চেয়ে অনেক ভাল জিনিস আছে, তবে হাত দিয়ে ছোঁয়া যায় না।” অবশ্যই তিনি মিউজ়িয়মের সংগ্রহের কথা বলেছিলেন। তিনি শুধু সংগ্রহ করতেন না, যত্ন করে রাখতেন এবং সুযোগমতো ব্যবহার করতেও দ্বিধা করতেন না। এ বিষয়ে জহর সরকার ‘গণদেবতা’ বইয়ের ভূমিকায় লিখেছেন, “আমি তাঁর শাল ও অন্য দুর্লভ বস্ত্র সংগ্রহ দেখার সুযোগ পাইনি বলে আফসোস থেকে গেছে। তবে নিশ্চিত জানি, তাঁর জহুরির চোখ সেরাটুকুই বেছে নিয়েছে।”

আমাদের জয়পুর প্রবাসকালে অন্তত দু’বার আমাদের সঙ্গে দেখা করেছেন বসন্তদা। প্রথমবার ১৯৭৩-এর শেষের দিকে। শ্যামলী এক দিন আমাদের সঙ্গে খাওয়ার নেমন্তন্ন করতে উনি রাজি হয়ে গেলেন, তবে একটি শর্তে— রান্নাটা খাঁটি বাংলা পদের মতো হতে হবে। উনি শুটিং-এর ব্যস্ততা কাটিয়ে কলকাতায় ফেরার আগের দুপুরে আমাদের মিউজ়িয়মে এলেন। সময় নিয়ে আমার সঙ্গে মিউজ়িয়মের সব গ্যালারি দেখলেন। তার পর রাজপ্রাসাদের এক কোণে আমাদের আস্তানায় এসে পুত্রের সঙ্গে আলাপ করে খেতে বসলেন। তখন জয়পুরে বাঙালিসুলভ আনাজপাতি তেমন পাওয়া যেত না, তবুও কাঁচকলা, বিউলির ডালের বড়ি, পলতা পাতা জোগাড় করে শুক্তো রান্না করা হয়েছিল। মজার কথা, আর সব জিনিস ছেড়ে ওই শুক্তোটাই তাঁর ভাল লাগল। শ্যামলী আর একটু শুক্তো দেবে বলে শুক্তোর পাত্রটা আনতেই উনি আমাদের অবাক করে বললেন, “পুরোটা দিয়ে দাও।” আমাদের চোখে আজও ভাসে তাঁর সেই পরিতৃপ্ত মুখচ্ছবি।

এর পর এক বার একটি সুন্দরী প্রতিযোগিতায় জুরিপ্রধান হয়ে জয়পুরে এসেছিলেন বসন্তদা। ঠাসা প্রোগ্রাম, হাতে সময় নেই তাই প্রাতরাশের সময় আমাদের রামবাগ প্যালেসে ডেকে পাঠালেন। ওঁর স্যুইটে গল্প করার মাঝে ওঁর প্রাতরাশ এল। রুপোর রেকাবিতে পাকা পেঁপের একটি বড়সড় ফালি, পাশে ক্রিমারে সিরাপ, ছোট বাটিতে লেবুর টুকরো। সঙ্গে কালো কফি। তার পর অনেক দিন ওঁর সঙ্গে দেখা হয়নি। বেশ কিছু কাল পরে জয়পুর ছেড়ে শান্তিনিকেতনের দিকে পা বাড়ালাম। তখন কোনও কাজে শান্তিনিকেতনে এলে দেখা করতেন। এক বার সকালে কোনও খবর না দিয়ে বাড়িতে এসেছেন, আমরা দু’জনেই তখন কোনও কাজে বাইরে গিয়েছি। ফিরে আসার সময় দেখা হতেই উনি আবার ফিরে এলেন। তখন উনি ওঁর গণেশের সংগ্রহটি ইন্ডিয়ান মিউজ়িয়মকে দান করার জন্য মনস্থির করেছেন বলে জানালেন। মৃত্যুর কিছু দিন আগেও তিনি মিউজ়িয়মের কিউরেটরদের ডেকে প্রত্যেকটি জিনিসের বিবরণ লিখিয়ে দিয়েছেন। সেই ক্যাটালগ তিনি দেখে যেতে পারেননি।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement