বাংলা কবিতায় বিনয় মজুমদারই একমাত্র কবি, যাঁর কোনও পত্রপত্রিকায় লেখা প্রকাশ হওয়ার আগেই বই প্রকাশ পেয়েছিল। বইয়ের নাম ‘নক্ষত্রের আলোয়’। ‘গ্রন্থজগৎ’ প্রকাশনার দেবকুমার বসু বিনয়ের পাণ্ডুলিপি পড়ে নিজ উদ্যোগে বইটি প্রকাশ করেন। বিনয়ের প্রথম দিককার বেশির ভাগ বইয়েরই প্রকাশক ইনি, ‘ফিরে এসো চাকা’-সহ। তাঁর পুরনো বইয়ের সংগ্রহের ভিতরে প্রায় অনাদরে কিন্তু সযত্নে কাপড়ে মোড়া ডায়েরির মতো একটা কিছু রাখা ছিল, যা কোনও কারণে আগে খুলে দেখা হয়নি। সম্প্রতি মোড়ক খুলতে দেখা গেল, সেখানে আছে বিনয়ের ব্যক্তিগত ডায়েরি, যেখানে পাতার পর পাতা নানান গণিত বিশ্লেষণ— যার বেশির ভাগটাই উদ্দেশ্যহীন— তারই মাঝে মাঝে তারিখ দিয়ে কবিতার খসড়া করা। কোন কবিতা কোন পত্রিকায় পাঠিয়েছেন, সেটাও লেখা। আছে এমন কিছু কবিতা যা আগে পড়িনি। আর আছে বিভিন্ন জনের চিঠি। যার মধ্যে বিনয়ের বাবাও রয়েছেন, আবার বন্ধু শক্তি চট্টোপাধ্যায়ও আছেন।
ছেলেকে ‘টু’ বলে ডাকতেন বিনয় মজুমদারের বাবা। ওটাই ছিল ডাকনাম। বিনয় তখন ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে দুর্গাপুরে স্টিল প্রোজেক্টে ট্রেনি হিসেবে যোগ দিয়েছেন। থাকেন ট্রেনিদের হস্টেলে, রুম নম্বর চারে। সরকারি চাকরি, সকাল আটটার মধ্যে পৌঁছতে হয়, খাওয়াদাওয়ার অসুবিধা। চাকরিতে মন বসছে না। মাইনেটাও বেশ কম, কলকাতার কবিতার জগৎ থেকে দূরে, ফলে প্রাইভেট কোম্পানির চাকরি খুঁজছেন যাতে কলকাতা চলে আসতে পারেন। চাকরির দরখাস্ত দিয়েছেন সেই সময়ের বিখ্যাত তেলের কোম্পানি ‘এসো’-তে (Esso), আবার পড়ানোর কাজ চেয়ে জ্ঞান ঘোষ পলিটেকনিকেও। কিন্তু বাবা-দাদাদের ইচ্ছে নয় যে বিনয় সরকারি চাকরি ছেড়ে কলকাতায় ফিরে আসুন। প্রাইভেট কোম্পানির চাকরি যে আরও কত কষ্টের ও অনিশ্চিতির, সেই কথা জানিয়ে চিঠি দিচ্ছেন তাঁরা। বাবা লিখছেন, ‘সরকারি চাকরিতে শান্তি আছে, পেনশন আছে, ভবিষ্যৎ আছে। আমার ইচ্ছে তোর ট্রেনিং শেষ হলেই তোকে বিয়ে দেব। ঐখানেই ৩২৫ টাকা পাবি, ওই টাকাতে তোর চলে যাবে। তখন শান্তিতে থাকতে পারবি।’ চিঠির তারিখ ৯ জুন ১৯৬২। তার ক’দিন পরেই, ১৪ জুন বিনয়ের দাদা তাঁকে লিখছেন, ‘চাকরি করতে হলে যতটা তেল মারার ক্ষমতা ও পরিশ্রম করার ক্ষমতা দরকার, তা তোর নেই। উড়ু উড়ু মন নিয়ে সেটা কোনো ক্রমেই সম্ভব নয়। মাইনের লোভে প্রাইভেট ফার্মে না যাওয়াই ভালো।’ এমনকি বিনয় কয়েকদিনের জন্য কলকাতায় আসতে চাইলে দাদা লিখছেন, ‘এখানে বৌদি থাকবে, তাই তোমার এখানে থাকা সম্ভব হবে না।’
অথচ কলকাতায় ফিরে আসতে বিনয় মরিয়া। আত্মীয়দের থেকে ভরসা না পেয়ে শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে অনুরোধ করছেন কলকাতায় থাকার একটা ব্যবস্থা করতে। ১৯৬২ সালের ২৯ অগস্ট শক্তি বিনয়কে লিখছেন, ‘আমি একটি ঘরের সংবাদ পেয়েছি। সেটা সঠিক না জানা পর্যন্ত তোমাকে চিঠি লিখতে পারছিলাম না। কিন্তু সেটা এখনো স্থির হয়নি। যদি সেটা পাওয়া যায় ভালো, নচেৎ ইন্দ্রনীল বলে আমাদের এক বন্ধু গ্রে স্ট্রিটের ঠিক মোড়ে, একটি ঘর নিয়ে থাকে। সেখানে তুমি অনায়াসেই থাকতে পারবে।’ কলকাতায় থাকার একটা সাময়িক ব্যবস্থা করে দেওয়ার পরও বন্ধুকে সতর্কবাণী দিতে ভুলছেন না শক্তি— ‘হঠাৎ চাকরি ছেড়ো না যেন। শেষ পর্যস্ত সত্যিই চাকরি যদি খুব কষ্ট করে করতে হয়, তবে ছেড়ে দেওয়াই ভালো হবে।’ এই যে কলকাতায় ফিরে আসার অদম্য বাসনা ও প্রয়াস, সে কি হস্টেলে থাকার অসুবিধে, না কি সাহিত্যজগৎ থেকে দূরে থাকার কষ্ট, না কি আরও অন্য কিছু?
কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর কবিদের সমসময়ের হয়েও কৃত্তিবাস গোষ্ঠীভুক্ত ছিলেন না বিনয়। এঁদের কেউ বিনয়ের বন্ধু ছিলেন, এমন কথাও শোনা যায় না। সম্প্রতি হাতে পাওয়া বিনয়কে লেখা চিঠিগুলো জানান দেয় বিনয়ের সঙ্গে শক্তির সখ্যের, যা প্রায় নির্ভরতার পর্যায়ের। বেশ কিছু বছর আগে, আশির দশকের শেষের দিকে এক বার এক ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় হাংরি আন্দোলন শুরুর কথা বলতে গিয়ে শক্তি চট্টোপাধ্যায় জানান, বিনয়ের ‘গায়ত্রীকে বইয়ের আলোচনা করতে গিয়ে তার মাথায় ক্ষুধা ব্যাপারটা আসে, যেখান থেকে ক্ষুধার্ত আন্দোলন’-এর ভাবনা। ১ অগস্ট ১৯৬২ তারিখে লেখা শক্তির একটি চিঠিতে তারই উল্লেখ পাচ্ছি— ‘তোমার Reviewটা করে দিয়েছি সম্প্রতি-তে। তাছাড়াও একটা Manifesto খাড়া করে দিয়েছি, Hungry generation— বাংলায় ‘ক্ষুৎকাতর সম্প্রদায়’। সবরকম ক্ষুধার কথাই বলা হয়েছে।’ পঞ্চাশের কবিদের জীবনযুদ্ধও মাঝে মাঝে বেরিয়ে এসেছে ১৯৬২ সালের অগস্ট মাসে লেখা শক্তির এই চিঠিতে। দুর্গাপুরবাসী বন্ধু বিনয়কে তিনি জানাচ্ছেন, ‘কফি হাউসে অপেক্ষা না করে আমার টিউটোরিয়ালে চলে আসবে। দুপুরে থাকি সব দিন।’ পরের লাইনেই জীবনযুদ্ধ ও কবিতা একাকার। শক্তি লিখছেন, ‘তোমার ফিরে এসো চাকা-র কভার দেখলাম পৃথ্বীশের কাছে। খুব ভালো লেগেছে।’ এ ছাড়াও কৃত্তিবাস-এর জন্য বিনয়ের কাছ থেকে লেখা চাইতেন শক্তি-ই। লিখছেন, ‘কৃত্তিবাস বের হবার তোড়জোড় চলছে, অনেক লেখা চাই তোমার কাছ থেকে।’ পুজোর সময় একসঙ্গে বেড়াতে যাওয়ার কথা ভাবছেন। যা অবশ্য আর হয়ে ওঠেনি।
বিনয়ের দ্বিতীয় বই ‘গায়ত্রীকে’— এক ফর্মার চটি বই, সাকুল্যে চোদ্দোটা কবিতা। নাম অনুযায়ী মনে হতেই পারে কবিতাগুলি জনৈক গায়ত্রীকে উদ্দেশ্য করেই। এই গায়ত্রী কে, সে সম্পর্কে পরিষ্কার করে বিনয় কখনও কিছু বলেননি, ইচ্ছে করেই হয়তো অনেকটা ঘনীভূত হতে দিয়েছেন রহস্য।
বিনয়ের সমসাময়িক অনেকের থেকে আমরা জানতে পারি, এই গায়ত্রী পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকে প্রেসিডেন্সি কলেজের উজ্জ্বল ছাত্রী গায়ত্রী চক্রবর্তী, পরবর্তী কালে যিনি গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক নামে খ্যাত। ফরাসি থেকে ইংরেজিতে দার্শনিক জাক দেরিদার ‘অব গ্রামাটোলজি’ বইয়ের অনুবাদ, ‘ডিকনস্ট্রাকশন’ বা অবিনির্মাণ তত্ত্ব (গায়ত্রী বাংলা ভাষায় বিনির্মাণের বদলে এই শব্দটি পছন্দ করেন) থেকে মহাশ্বেতা দেবীকে ইংরেজি ভাষায় বিশ্বের সামনে তুলে ধরা সব মিলিয়ে গায়ত্রী নিজেই আজ এক উজ্জ্বল উদ্ধার। অথচ এঁর সঙ্গে বিনয়ের তখন ভাল করে পরিচয়ই হয়নি। তাঁর জন্য তিনি উন্মাদনার সকল পারদ অতিক্রম করে গিয়েছেন, এক সময় গায়ত্রীকে উপনীত করেছেন ‘ঈশ্বরী’তে, যাতে মনে হতে পারে বিনয়ের ঈশ্বরীই গায়ত্রী। অবশ্য আরও এক গায়ত্রীর সন্ধানও পাওয়া যায়। বিনয় কিছু দিন হিন্দু হস্টেলের আবাসিক ছিলেন। তখন সেখানে সুপারিনটেনডেন্ট ছিলেন অধ্যাপক জনার্দন চক্রবর্তী। তাঁর কন্যার নামও গায়ত্রী, যদিও বয়সে সে বেশ খানিকটা ছোট। যে সময়টা বিনয় হিন্দু হস্টেলে থাকছেন, তখন সেই তরুণীর বয়স চোদ্দো-পনেরো হবে। কিন্তু এই গল্প বেশি দূর এগোয়নি।
বি ই কলেজে পড়ার শেষের দিকে ও ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করার পর কলেজ স্ট্রিটে বিনয়কে পাওয়া যেত হয় কফি হাউসে, অন্যথায় ‘গ্রন্থজগৎ’-এর দফতরে। তখন একের পর এক তাঁর বই প্রকাশ পাচ্ছে গ্রন্থজগৎ থেকে, নিজের ব্যক্তিগত নানান প্রয়োজনে তিনি ব্যবহার করছেন ‘গ্রন্থজগৎ’-এর ঠিকানা। দেবকুমার বসুর কাছে জেনেছি, গায়ত্রীর সঙ্গে বিনয়ের সাক্ষাৎ মাত্র দিন দুয়েকই হয়েছিল, কফি হাউসে— আর তা ছিল নেহাতই সৌজন্যমূলক। কিন্ত সেখান থেকে উন্মাদনায় পৌঁছনো, সে কি কেবলই আর্তি, না কি উন্মাদনার এক সূত্র তাঁর মধ্যে এমনিতেই থেকে গিয়েছিল? দুর্গাপুরে হস্টেলে থাকাকালীন একটি চিঠিতে বিনয়ের বাবা লিখছেন, ‘‘তোকে নিয়ে আমার চিন্তা। তোকে শুধু একটু ‘ভালো ভাবে আছিস’ দেখে যেতে পারলে শান্তিতে মরতে পারব।’’ সম্প্রতি শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়ের (যিনি গায়ত্রী চক্রবর্তীর সহপাঠীও ছিলেন) সঙ্গে এক কথোপকথনের সময় জানতে পারি, এক দিন গায়ত্রী কলেজে ক্লাস করছেন জেনে বিনয় প্রেসিডেন্সির ইংরেজি ডিপার্টমেন্টে এসে হাজির হলে, তাঁর থেকে নিস্তার পেতে গায়ত্রী অন্য দরজা দিয়ে বেরিয়ে যান।
এই সব ঘটনা যখন ঘটছে, বিনয়ের বয়স তখন আঠাশ। ‘ফিরে এসো চাকা’ প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু গায়ত্রী যেন তাঁর অবসেশন হয়ে বসে রয়েছে। একমাত্র কবি বন্ধু শক্তির কাছে বিনয় দুর্গাপুর থেকে জানতে চাইছেন গায়ত্রীর ঠিকানা, যার উত্তরে শক্তি লিখছেন, ‘গায়ত্রীর ঠিকানা আমি সুনীলের ভরসায় না থেকে জোগাড়ের চেষ্টা করছি এবং করে ফেলবোই। এক সপ্তাহের মধ্যে কথা দিচ্ছি তুমি ওর ঠিকানা পাবে। কেয়া বলে মেয়েটির খোঁজে আছি। তার সঙ্গে আমার পরিচয়ও আছে, দেখা হলেই চেয়ে নেব।’ আর একটি চিঠিতে শক্তি লিখছেন, ‘দুদিন কেয়ার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম, দেখা হয়নি। তবে আগামী সপ্তাহে দেখা করে ঠিকানা জোগাড় করব, তুমি সুনীলকে ও বিষয়ে কিছু লিখো না।’ অর্থাৎ বিনয় বোধহয় সুনীলকেও লিখেছিলেন এবং সুনীল বিরক্ত হয়েছিলেন, যার জন্য শক্তির এই বারংবার সতর্কীকরণ। আরও অনেককেই বিনয় লিখেছিলেন। ধানবাদ-নিবাসী জনৈক সলিল চক্রবর্তীকে লিখেছেন, যাঁর সঙ্গে গায়ত্রীর দূর সম্পর্কীয় আত্মীয়তা। তিনি লিখছেন, ‘ওর ঠিকানা জানি না, তবে শুনেছি আমেরিকা গেছে। কিন্তু আমার জিজ্ঞাস্য হল গায়ত্রীকে আপনার কী প্রয়োজন? ওকে কি আপনি ভালোবেসে ফেলেছেন? আমি বলব ওর সম্বন্ধে আপনার কৌতূহল না থাকাই ভালো।’ এই উন্মাদনা কতটা স্বাভাবিক তা প্রশ্নাতীত নয়।
বিনয়ের বিভিন্ন ডায়েরিতে চোখ বোলাতে গিয়ে দেখেছি তা অসংলগ্ন কথাবার্তায় ভরা, একই কথা বারবার লেখা সেখানে। এমনকি নিজের বইয়ের কবিতার লাইন পরিবর্তন করে এমন কোনও শব্দ ব্যবহার করছেন যা সভ্য সমাজে ব্যবহারের উপযোগী নয়, অশালীন বলেই ধরা হয়। সুস্থ কারও কাছ থেকে এগুলো প্রত্যাশিত নয়। আবার ১৯৬২ সালে ডায়েরির পাতার নীচের দিকে অঙ্কের ফরমুলা, উপরে... ‘ভালবাসা অবশিষ্ট নেই/ অথবা গৃহের থেকে ভুলে বহির্গত কোনো শিশু/ হারিয়ে গিয়েছে পথে, জানে না সে নিজের ঠিকানা।’ কে না জানে, অঙ্কের সূত্র আর কবিতা পাশাপাশিই ছুটে যেত বিনয়ের আলোকিত উন্মাদনায়!
১৯৮৭ সাল নাগাদ বিনয় মানসিক ব্যাধির কারণে দীর্ঘ দিন কলকাতা মেডিকেল কলেজে চিকিৎসাধীন ছিলেন। সেই সময় প্রায়ই দেখা করতে যেতাম। কথোপকথনের অনেকটাই থাকত প্রশ্নোত্তরের মতো। উত্তরগুলো হত মজার অথচ অসংলগ্ন। এক বার জিজ্ঞেস করলাম আপনাদের সময়ের কোন কোন কবিকে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়? উত্তর দিতে গিয়ে বললেন, প্রথম দুজনের এক জন শক্তি— বলে চুপ করে গেলেন। জানতে চাইলাম, অন্য জন? বললেন, সেটা সময় বলবে।
এই বিভ্রান্তি জ্ঞানত অজ্ঞানত বিনয় মজুমদার শেষ অবধি সৃষ্টি করে গিয়েছেন। নানান প্রশ্নের উত্তর এক-এক সময় দিয়েছেন এক-এক ভাবে। কিছু দিন আগে পাওয়া ‘এই সব সত্য’ বলে আর একটি পাণ্ডুলিপিতে বিনয় লিখে গিয়েছেন, তিনি নিজেই তাঁর ঈশ্বরী, যাকে সবচেয়ে ভালবেসেছেন তিনি। আসলে বিনয় যে কারণে বিনয় মজুমদার, সেই কবিজীবন খুবই স্বল্পস্থায়ী, বাকিটা তাঁকে ঘিরে গড়ে ওঠা এক রহস্যের আধার।