ছবি: কুনাল বর্মণ
ষাটের দশক। দিল্লিতে সদ্য চালু হয়েছে দূরদর্শন। অল ইন্ডিয়া রেডিয়ো-র সহযোগিতায় কয়েকটা ছোটখাটো অনুষ্ঠান আর প্রতিভা পুরী-সালমা সুলতানদের সংবাদপাঠ। সেই দূরদর্শন দূর অস্ত্, টেলিভিশন নামক আজব বিনোদন-বাক্স থেকেই তখন যোজন দূরে বাকি দেশের আমজনতা। ১৯৬৭। কাজের সূত্রে বম্বে থেকে দিল্লি এসে একটি দোকানের সামনে থমকে দাঁড়ালেন এক যুবক। জানালা দিয়ে সেই প্রথম বার দূরদর্শনের পর্দায় বিস্ময়ে তাঁর চোখ রাখা। স্কুলপড়ুয়াদের নিয়ে বসেছে কুইজ়ের আসর। কিছু ক্ষণের মধ্যে বিস্ময় বদলে গেল হতাশায়। সেই যুবকের নিজের কথায়, “দিল্লির মতো শহরে ফি বছর রামলীলায় দশ দিন ধরে রামায়ণের কত দৃশ্য অভিনীত হয়। সেই শহরে বেড়ে উঠেও ওরা রামের মায়ের নাম বলতে পারল না! অথচ চার্চিল, সক্রেটিস সম্বন্ধে সব প্রশ্নেরই জবাব ছিল ওদের কাছে!”
অনন্ত পাই নামে ওই যুবক তখন পকেটে অল্প কিছু টাকা আর একরাশ স্বপ্ন নিয়ে বড় শহরে পা রেখেছেন। ছোটবেলাতেই বাবা-মা’কে হারিয়েছেন। আত্মীয়দের ঘরে মানুষ হয়ে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছেন। প্রথম চাকরি নিয়েছেন টাইমস অব ইন্ডিয়া-র মুদ্রণ বিভাগে। তাঁরই পরামর্শে এ দেশের পাঠকের জন্য কমিক্স স্ট্রিপ ছাপা শুরু করে এই খবরের কাগজ। পাই বেছে দেন লি ফক-এর ‘ফ্যান্টম’ সিরিজ়। দীর্ঘ দিন ওই সিরিজ় সামলানোর পরে পাই যোগ দেন ‘ইন্ডিয়া বুক হাউস’ (আইবিএইচ) নামে বম্বের একটি পুস্তক সংস্থায়। তার কাজেই দিল্লি গিয়ে অমন অভিজ্ঞতা। পাই বুঝতে পারছিলেন, এই নতুন প্রজন্ম ভারতীয় সংস্কৃতি ও ইতিহাসের কিছুই জানে না। তার জন্য তাদের তেমন দোষও কি দেওয়া চলে? স্বাধীনতার পরেও এ দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় কলোনিয়াল হ্যাংওভার দূর হয়নি। বাড়িতে, স্কুলে ভর্তি বিদেশি বই। রামায়ণ-মহাভারত নয়, এই প্রজন্ম তখন তোলপাড় ‘হার্ডি বয়েজ়’, ‘ন্যান্সি ড্রিউ’, ‘ববসি টুইন্স’-দের নিয়ে। দেশের শিকড়ের সঙ্গে জুড়ে নেই তাদের বেড়ে ওঠা। পাই-এর কথায়, “দোষ আমাদেরই। আমরা নিজেরাই তো তখন এনিড ব্লাইটন পড়ছি। আমাদের ছেলেমেয়েরা যে পড়বে, আমাদের নিজেদের তেমন গল্প তখন কোথায়?”
পাই-এর আগে সেই গল্প খোঁজার কথা যে কারও মাথায় আসেনি, তা নয়। বছরখানেক আগেই (১৯৬৫) বেঙ্গালুরু শাখার কর্মী জি কে অনন্তরামের পরামর্শে আইবিএইচ-এর মালিক-প্রকাশক কে টি (মতান্তরে জি এল) মিরচন্দানি ১০টি বিদেশি ইংরেজি ক্লাসিকের (পিনোকিয়ো, অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড, থ্রি লিটল পিগ্স ইত্যাদি) কন্নড় ভাষায় অনুবাদ করে কমিক্স সিরিজ় ছেপেছিলেন। দেশীয় ভাষার এই সিরিজ় থেকেই প্রেরণা নিয়ে মিরচন্দানিকে নানা পৌরাণিক কাহিনি নিয়ে কমিক্স ছাপার অনুরোধ করেন বলে পরবর্তী কালে জানিয়েছেন অনন্তরাম। সেই সময় অনন্ত পাই তাঁর নিজস্ব আইডিয়াটি নিয়ে এলে তা লুফে নেন মিরচন্দানি। কিন্তু পাই প্রথমেই দেশীয় ভাষার বাজারে নামতে রাজি ছিলেন না। কারণ, তাঁর প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল তুলনায় উচ্চ মধ্যবিত্ত, ইংরেজিতেই বেশি স্বচ্ছন্দ সেই সব ছেলেমেয়ে, যারা ছিল অনেক বেশি পশ্চিম-নির্ভর। কাজের অভিজ্ঞতা থেকে পাই জানতেন, এই ধরনের বইপত্রের কাটতি একমাত্র ইংরেজি ভাষার বাজারেই রয়েছে। অচিরেই মিরচন্দানিকে বুঝিয়ে, বিস্তর খেটে অনন্ত পাই বাজারে নামলেন। ভারতীয় ভাষায় পাশ্চাত্য ক্লাসিকের বদলে, আত্মপ্রকাশ করল ইংরেজিতে লেখা, ভারতীয় ক্লাসিকের কমিক্স সিরিজ়— ‘অমর চিত্র কথা’। যার শুরুর ইতিহাসের সঙ্গে জুড়ে তিনটি নাম— অনন্তরাম, মিরচন্দানি এবং অবশ্যই অনন্ত পাই। এর পরের ইতিহাস কেবল তৃতীয় ব্যক্তিটি এবং তাঁর লড়াইয়েরই।
পাই-এর জীবনে এই ‘অমর চিত্র কথা’ (এসিকে) এক রোমাঞ্চকর অ্যাডভেঞ্চার বই কিছু নয়। অঙ্কনশিল্পী রাম ওয়াইরকরকে সঙ্গে নিয়ে পাই সম্পাদিত ‘অমর চিত্র কথা’ সিরিজ়ের প্রথম টাইট্ল ‘কৃষ্ণ’ জন্ম নিল (১৯৬৯)। গোটা সিরিজ়কে কার্যত একা হাতে তিনিই দাঁড় করিয়েছেন। প্রথম কয়েকটি সংখ্যা একা সম্পাদনা করলেও পরবর্তী সময়ে তিনি সুব্বারাও, লুই ফার্নান্দেজ় এবং কমলা চন্দ্রকান্তকে নিয়ে একটি এডিটোরিয়াল টিম গড়লেন। পাই বেশি করে নজর দিলেন ‘অমর চিত্র কথা’র মার্কেটিং-এ। বিপণনে নিত্য নতুন আইডিয়া নিয়ে হাজির হলেন। কখনও রেস্তোরাঁর সামনে বইয়ের র্যাক নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেছেন। ভারতীয় পুরাণের জ্ঞানবৃদ্ধির ক্ষেত্রে এই কমিক্স বই কতটা উপকারী হতে পারে, স্কুলে স্কুলে গিয়ে দিনের পর দিন তার ক্যানভাসিং করেছেন। স্কুলপড়ুয়াদের বিনামূল্যে দেদার সিরিজ় উপহারও দিয়েছেন। ফল মিলেছে হাতেনাতে। রামায়ণ, মহাভারতের টেস্টে আগের চেয়ে ভাল ফল করতে শুরু করল ছেলেমেয়েরা। প্রথম দিকে পাই-কে দুচ্ছাই করে তাড়িয়ে দিত যারা, সেই স্কুলগুলির গ্রন্থাগারই ক্রমে ভরে উঠতে শুরু করল ‘অমর চিত্র কথা’য়। স্কুলগুলির জন্য ডাকযোগে বই পাঠিয়ে বাৎসরিক গ্রাহক ব্যবস্থাও করলেন পাই। কমলার কথায়, “আমরা সমাজের এমন একটি অংশের গ্রাহকদের জন্য এগুলো লিখছিলাম— যাঁরা বাড়িতে কোনও একটি ভারতীয় ভাষায় কথা বলেন। কিন্তু তাঁদের ছেলেমেয়েরা ইংরেজি পড়ুক, জানুক, তা তাঁরা চান।”
ছবির পর ছবি এঁকে ঘটনা নির্মাণ। বেলুন বক্সে সংলাপ। অনেক সময় ফুটনোটও (‘সর্পসূত্র’ কী ইত্যাদি)। অলঙ্করণের ক্ষেত্রে যতটা যত্ন দিয়ে এবং নিপুণ করে চরিত্রগুলিকে নির্মাণ করা হয়েছে, ততটা গুরুত্ব দেওয়া হয়নি পশ্চাৎপটের ক্ষেত্রে। চরিত্রদের পোশাক ও সাজপোশাকের ব্যাপারে বিশেষ নজর দেওয়া হয়। পাঠকের কাছে চরিত্রগুলোকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলাই ছিল প্রধান উদ্দেশ্য। শিল্পী রাম ওয়াইরকর, প্রতাপ মল্লিকেরা নিজস্ব একটি ঘরানা তৈরি করে ফেলেন। অমর চিত্র কথা-র এই সব অলঙ্করণ এ দেশে এক ব্যাপক সামাজিক প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হয়। পরবর্তী কালে, এমনকি আজও বহু ক্ষেত্রে প্রিন্ট ও টেলিভিশনে পৌরাণিক চরিত্রগুলির নির্মাণের ক্ষেত্রে ‘অমর চিত্র কথা’ই প্রাথমিক রেফারেন্স হিসেবে অনেকের মাথায় ভাসে!
এক দিনে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি এই সিরিজ়। প্রথম ভলিউম ‘কৃষ্ণ’-এর দশ হাজার কপি বিক্রি করতে প্রায় তিন বছর সময় লেগে গিয়েছিল। প্রাথমিক ভাবে মাসে একটি, আরও পরে (১৯৮০) পনেরো দিনে একটি করে সিরিজ প্রকাশিত হত। প্রথম দিকে এই কমিক্স সিরিজ় সম্পূর্ণ রঙিনও ছিল না। হলুদ-নীল-সবুজ— এই তিন রঙের প্যানেলে ছাপা হত। জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অন্য ভাষায় এই সিরিজ় ছাপারও সাহস দেখালেন পাই। প্রাথমিক ভাবে শুরু হল হিন্দি, কন্নড়, গুজরাতি, তেলুগু ও মরাঠি অনুবাদ; আরও পরে বাংলা, অসমিয়া, মালয়ালম, তামিল, পঞ্জাবি, উর্দু, সংস্কৃত প্রভৃতি ভাষাতেও। উচ্চ মধ্যবিত্তের গণ্ডি ছাড়িয়ে ‘অমর চিত্র কথা’ পৌঁছে গেল আমজনতার কাছে। দেশ ছাড়িয়ে জনপ্রিয় হল বিদেশেও। বিশেষ করে প্রবাসী ভারতীয়দের দ্বিতীয় প্রজন্মের কাছে।
নতুন এই প্রজন্মকে ‘প্রকৃত ভারত’ সম্পর্কে জানাতে প্রাথমিক উৎস হিসেবে দিদিমা-ঠাকুমাদের স্থান নিয়ে নিল এই ধরনের ‘ক্লাসিক ইলাস্ট্রেটেড কমিক্স সিরিজ়’। কুড়ি বছরের মাথায় ১৯৮৬ সালে ৫ কোটি, ১৯৮৮-তে সাড়ে ৭ কোটি কপি বিক্রি করে আইবিএইচ। প্রচারে কোনও খামতি রাখেননি পাই। নিয়মিত কুইজ়, ফ্যান্সি ড্রেস প্রতিযোগিতার আয়োজন করতেন। শহরের প্রায় প্রতিটি পেট্রোল পাম্প, বুক স্টোরের ডিসপ্লে-তে এসিকে-র উজ্জ্বল উপস্থিতি সুনিশ্চিত করলেন। সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের দিয়ে নতুন নতুন সিরিজ়ের উদ্বোধন (‘মার্চ টু ফ্রিডম’ সিরিজের উদ্বোধন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গাঁধী, লোকসভায় দাঁড়িয়ে যিনি নিজের অমর চিত্র কথা-প্রীতির কথা জানিয়েছিলেন) করাতে থাকলেন। ক্রমেই রাজনৈতিক নেতা, সরকারি কর্তাদের নয়নের মণি হয়ে উঠলেন পাই। ১৯৯২ সাল নাগাদ দেশি-বিদেশি মিলিয়ে মোট ৩৮টি ভাষায় অনূদিত হল এসিকে। লক্ষ লক্ষ শিশু-কিশোরের কাছে তত দিনে অনন্ত পাই হয়ে উঠেছেন আদরের ‘আঙ্কল পাই’।
আইবিএইচ-এর ১৯৮৬ সালের একটি ক্যাটালগ থেকে দেখা যাচ্ছে, পুরাণ (৯০টি), সংস্কৃত ক্লাসিক (১২), আঞ্চলিক ক্লাসিক (১৩), শিক্ষক ও সন্ত (২৭), কবি ও সঙ্গীতশিল্পী (৭), লোকগাথা ও কিংবদন্তি (৫৬), বৌদ্ধ (২৪), জৈন (৬), প্রাচীন ভারতের ইতিহাস (১৪), মধ্যযুগের ভারতের ইতিহাস (৫), মুঘল (১০), রাজপুত (৫), মরাঠা (৬), শিখ (৮), ব্রিটিশ ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামী (২), ভারতের বিপ্লবী (৫), ১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহ (৪), স্মৃতিসৌধ ও যুদ্ধ (৩), ভারতের মহীয়সী নারী (১৩), আধুনিক ভারতের নির্মাতা (১৩), বিজ্ঞানী ও চিকিৎসক (৪)— এমন অজস্র ক্ষেত্রে অজস্র ভাষায় কমিক্স সিরিজ় বানিয়ে ফেলেছিল এসিকে। আরও পরে বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’-এর মতো উপন্যাস, বিশ শতকের গোড়ায় নেপোলিয়ন, লুই পাস্তুর, হিউয়েন সাং, জিশুখ্রিস্ট, জওহরলাল নেহরুর জীবনী নিয়েও তারা হাজির হবে। বর্তমান প্রজন্মের হাতে এসে গিয়েছে এসিকে-র
তৈরি জেআরডি টাটা, কল্পনা চাওলাদের জীবনী কমিক্স সিরিজ়ও।
যদিও বিষয় এবং ক্ষেত্রের এই বিপুল বিস্তৃতি এসেছে এসিকে জনপ্রিয় ও প্রতিষ্ঠিত হওয়ার একটা বড় সময়ের পরেই। ১৯৮০ সালে পাই নিয়ে আসেন স্কুলপড়ুয়াদের পাঠ্য ‘টিঙ্কল’, যা ছিল ইতিহাস বা পুরাণ থেকে ভিন্ন, সম্পূর্ণ আলাদা এক জগৎ। সেখানে শিশু-কিশোর পাঠকেরা নিজের লেখা গল্পও পাঠাতে পারত। এসিকে যখন প্রথম বাজারে আসে, তাদের প্রথম দশটি সিরিজেরই উৎস ছিল প্রাচীন ‘হিন্দু’ সংস্কৃতির আঙিনা— কৃষ্ণ, শকুন্তলা, পাণ্ডব রানি, সাবিত্রী, রাম, নল-দময়ন্তী, হরিশ্চন্দ্র, রামের পুত্রেরা, হনুমান এবং মহাভারত। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, ‘কৃষ্ণ’-এর হাত দিয়েই ‘অমর চিত্র কথা’ সিরিজের আত্মপ্রকাশ হলেও মুদ্রণে এটিকে ‘১১তম টাইট্ল’ বলে চিহ্নিত করা হয়। অনন্তরামের তৈরি ১০টি কন্নড় ভাষার কমিক্স সিরিজ়ের ইতিহাসকে সম্মান দিতেই আইবিএইচ এমনটা করে বলে অনুমান। এর কয়েক বছরের মধ্যেই শুধু রামায়ণ-এর নানা গল্প নিয়েই ১১টি, মহাভারত থেকে ২১টি মিনি সিরিজ় এবং আরও পরে (১৯৮৫) ৬০টি ভলিউমের পূর্ণাঙ্গ মহাভারত সিরিজ় ছাপেন পাই।
বিশিষ্ট সমালোচক অরুণা রাও জানাচ্ছেন, দেশ স্বাধীন হলেও ব্রিটিশদের তৈরি করা সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার ক্ষমতা-কাঠামোর বীজ তখনও পুরোপুরি উৎপাটিত হয়নি। সোশ্যালিস্ট সরকারের সঙ্গে তার দ্বন্দ্বে ভারতবাসী ক্রমেই একটি বৃহত্তর, সংহতিপূর্ণ ‘দেশ’-এর আইডিয়া তৈরি করছেন। নেহরু মডেলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রভূত উন্নতি হলেও ভারতবাসীর মনে গাঁধীজির আদর্শ (‘দেশ’-এর নির্মাণ কেবল শিল্প-অর্থনীতির উন্নয়নেই সীমিত নয়) তখনও চিনচিনে ব্যথার মতো মাঝে মধ্যেই জেগে উঠছে। অরুণাদেবীর কথায়, ভারতীয় পরিবার তখন পশ্চিমের থেকে মুখ ফেরাতে চাইছে না। আবার দেশীয় ইতিহাস-ধর্ম-সংস্কৃতির ঐতিহ্য না জানার বেদনাও তাকে স্বস্তিতে থাকতে দিচ্ছিল না। ওই সময় খ্রিস্ট ও ইসলাম ধর্মের অনুকরণে সংসক্তিপ্রবণ হিন্দুধর্মকে বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদের ছাঁচে ফেলাটা প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। আর সেই কাজটা করতেই ওই সব ভারতীয় বাবা-মায়েদের একটি সহজ পথ খুলে দিল এসিকে-র মতো একটি জনপ্রিয় কমিক্স সিরিজ়।
গত বছরই ৫০-এ পা রেখেছে এসিকে। সাত বছর হল চলে গিয়েছেন অনন্ত পাই-ও। এগারো বছর আগে হাত বদল হয়ে আইবিএইচ বর্তমানে ‘এসিকে মিডিয়া’ হয়েছে। ওয়েবসাইট, অ্যাপ এসেছে। সম্প্রতি আধুনিক অলঙ্করণে রামও সিক্স-প্যাক হয়েছেন। তৈরি হয়েছে অ্যানিমেশনও। আজ অবধি প্রায় ৪৫০টি টাইট্ল প্রকাশিত হলেও সমালোচকদের একাংশের হাত থেকে রেহাই পায়নি তুমুল জনপ্রিয় শিশুপাঠ্য এই সিরিজ়ও।
একটু তলিয়ে দেখলে প্রদীপের নীচে অন্ধকার ঠিকই ধরা পড়বে। অনেক গবেষকই দেখিয়েছেন, কী ভাবে সমান্তরালে পাঠকের সামনে অজান্তেই একটি ব্রাহ্মণ্যবাদী ‘হিন্দু’ সাংস্কৃতিক আধিপত্যের নির্মাণকে ‘স্বাভাবিক’ করে দেয় এসিকে। এ যেন ইতিহাসের ‘আদর্শায়িত’ ‘স্বচ্ছ’ নির্মাণ (যেখানে রামও যাবতীয় দোষত্রুটিমুক্ত)। অনেক নিন্দুকই পাই-এর এই ‘সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ’-এর মধ্যে কিঞ্চিত হিন্দু পুনরুত্থানবাদী দর্শনের গন্ধ পেয়েছেন। এ দিকে, এসিকে-র কমিক্সের জগতে মেয়েদের ভূমিকার সীমাবদ্ধতাও বেশি করে চোখে পড়ে। সিরিজ়গুলি যেন আধুনিক কালের ‘সুশীলার উপাখ্যান’। বারবার প্রাচীন ঐতিহ্যের নিরিখে তৈরি করা একটি চিরাচরিত ভূমিকাকে মেয়েদের সামনে ‘রোল মডেল’ হিসেবে তুলে ধরাই যার মুখ্য উদেশ্য। ‘রণক দেবী’, ‘পদ্মিনী’র মতো সিরিজ়ে সতী, জহর ব্রতের মতো বর্বর প্রথাকে কি মহিমান্বিত করেনি এসিকে? আবার প্রান্তিক মানুষ, বা বিশেষত মুসলিম চরিত্র নির্মাণেও তুমুল বিতর্ক রয়েছে। ‘ভাল’ ও ‘খারাপ’ চরিত্র নির্মাণে বাঁধাধরা অলঙ্করণ পাঠক-মনে শৈশবেই জাতি ও বর্ণবিদ্বেষের বীজ বুনে দেয়। সব মিলিয়ে ‘জাতীয় সংহতি’ নির্মাণের প্রকল্পে এসিকে-ও এ দেশের একটি একমাত্রিক চেহারাকেই পুষ্ট করে।
কথা উঠেছে, ‘খারাপ’ ‘ওদের’ প্রত্যাখানের মাধ্যমে ‘আমাদের’ ‘ভাল’ প্রতিষ্ঠার আদর্শ ‘দ্য মার্চ টু ফ্রিডম’ সিরিজ়ের জাতীয়তাবাদী দর্শনের ভিত্তি। এখানে ‘ওরা’ কারা? অবশ্যই ব্রিটিশরা। তাদের যতটা সম্ভব ‘খারাপ’ করেই দেখিয়েছে এসিকে। আর ‘আমরা’র মধ্যে বিশেষ জোরের সঙ্গে ঠাঁই দেওয়া হয়েছে তফসিলি জনজাতিকে (বাবাসাহেব অম্বেডকর, গুরু রবিদাস, নারায়ণ গুরু প্রভৃতি সিরিজ়)। আর ঠাঁই পেয়েছেন মুসলিমরা। একটি সিরিজ়ে এক মুসলিম পুলিশ অফিসার আশফাকউল্লাহ-কে প্রশ্ন করেন, “হিন্দু ভারতের জন্য মুসলিমরা কেন লড়বেন?” আশফাকের মুখে সংলাপ বসানো হয়েছে, “খান সাহেব, আমি নিশ্চিত, হিন্দু-ভারত ব্রিটিশ-ভারতের থেকে অনেক ভাল হবে।” এর পরেই সিরিজ়ের কথকের সংযোজন— “আশফাকউল্লাহ, বিসমিল এবং অন্যান্যরা অবশ্যই দেশের সবার জন্য লড়ছিলেন।” আরও পরে ৮৬তম টাইট্ল-এ বঙ্কিমের আনন্দমঠে মুসলিম-বিরোধী পরিকল্পনাকে আড়াল করতে সক্রিয় ছিল এসিকে। সেখানে কথকের মুখে মুসলিম শাসককে ‘ইংরেজের হাতের পুতুল’ বলে চিহ্নিত করে দেওয়া হয়।
‘হিন্দু’ আর ‘ভারতীয়ত্ব’-কে এক করে ‘হিন্দুত্ব’-এর রাজনৈতিক দর্শনের প্রচারক সাভারকরকে কী ভাবে দেখিয়েছে এসিকে? ‘দ্য মার্চ টু ফ্রিডম’ সিরিজ়েই মূলত রয়েছে তাঁর আন্দামানে বন্দিদশার চিত্রণ। সেই বর্ণনা সেরেই সাভারকর ‘স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয় ভূমিকা নেন’ বলে ঘোষণা করে দেওয়া হয়েছে। অথচ এই নেতার বিতর্কিত মতাদর্শ, আন্দামানে থাকার সময় তাঁর মরিয়া হয়ে ব্রিটিশদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা, ব্রিটিশ সরকারের সেবা করার অঙ্গীকার— সবটাই চেপে গিয়েছে এসিকে। সাভারকর ঠাই পেলেও গাঁধীকে নিয়ে তত দিনেও (দীর্ঘ কাল পরে তাঁর সিরিজ় প্রকাশ করা হয়) কোনও সিরিজ় ছাপেনি এসিকে! শুরু থেকে পরবর্তী ২০ বছরের মধ্যে আশ্চর্যজনক ভাবে ঠাঁই পাননি মতিলাল নেহরু, জওহরলাল নেহরু, সর্দার পটেলের মতো আরও অনেকেই।
আবার ‘মেকার্স অফ মডার্ন ইন্ডিয়া’ সিরিজ়ে কোনও মহিলাকে স্থান না দেওয়া নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। সরোজিনী নাইডু থেকে ইন্দিরা গাঁধী— ঠাঁই হয়নি কারওই। গোটা ‘অমর চিত্র কথা’ সিরিজ়ের কোথাও কোনও শিক্ষিত, উচ্চাকাঙ্খী মহিলার গল্প (কল্পনা চাওলারা একেবারেই সাম্প্রতিক সংযোজন) নেই। এই সিরিজে স্থান পাননি তেমন মুসলিম ব্যক্তিত্বও। নেই জাকির হোসেন, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, খান আবদুল গফফর খান, সৈয়দ আহমেদ খান। রয়েছেন কেবল থানেদার হাসান আস্কারি। এসিকে-র কোনও শিখ ‘মেকার্স অফ ইন্ডিয়া’ও নেই।
ইন্দ্রজাল কমিক্স, ডায়মন্ড কমিক্স আসার আগে দীর্ঘ কাল বাজারে এসিকে-র মোনোপলি চলেছে। তার বিস্তার এবং প্রভাব ছিল ব্যাপক। ‘টিঙ্কল’-এর স্মৃতিচারণায় সুব্বারাও একটি গল্প শুনিয়েছিলেন। পাঠকের পাঠানো হাজার হাজার গল্পে (যা পুরাণ, ইতিহাস নয়) কোনও অহিন্দু চরিত্র থাকত না। এমনকি মুসলিম পরিবারের শিশুদের পাঠানো গল্পেও আশচর্যজনক ভাবে সমস্ত চরিত্রই থাকত হিন্দু। সুব্বারাও-এর কথায়, “হিন্দু সংস্কৃতির আধিপত্য এতটাই তীব্র হয়ে পড়েছিল যে মুসলিম মহল্লা থেকেও তাদের জগতের কোনও গল্প উঠে আসছিল না।” এই অভিজ্ঞতা থেকেই সুব্বারাও ‘টিঙ্কল’-এর জন্য আনোয়ার নামে একটি চরিত্র তৈরি করেন। যা সব মহলেই তুমুল জনপ্রিয় হয়েছিল। কিন্তু পাঠকের দুনিয়া থেকে আনোয়ারদের উঠে না আসা ছিল ভীষণই উদ্বেগজনক।
এসিকে-র এমন সব আঁধার নিয়ে সে সময়েও বারবার সমালোচনার ঝড় বয়েছে। তার জবাবে এসিকে কর্তৃপক্ষ সমকালের প্রেক্ষিতে না দেখে ‘ইতিহাস’কে ‘অবিকৃত’ দেখানোর শিল্পের স্বাধীনতার পক্ষেই সওয়াল করেছেন। যদিও এই সমালোচনার মুখে পড়েই কিছুটা বদল আসে। মহিলা, প্রান্তিক, মুসলিম এবং অন্যান্য অহিন্দু ‘নায়ক’ চরিত্রের গল্পের খোঁজ শুরু হয়। টেক্সটও অনেক বেশি সচেতন হয়ে এডিট করা শুরু হয়। কিন্তু তা যে প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট ছিল না, তা সংখ্যার হিসেব দিয়েই প্রমাণ করা যায়।
পরবর্তী কালে ভিন্ন ধর্ম ও জনজাতিকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা পাই করেছিলেন বটে। কিন্তু এসিকে-র প্রথম কুড়ি বছরের সিরিজ়গুলির তুলনায় সমাজে তা তেমন ভাবে ছাপ ফেলতে পারেনি। এসিকে-র ৫০টি বেস্টসেলারের মধ্যে ২১টিই হিন্দু দেবতাদের গল্প, ১৪টির উৎস হিন্দু পুরাণ, ১৩টি ঐতিহাসিক চরিত্র (মাত্র এক জন করে মুসলিম, বৌদ্ধ ও জৈন) এবং ২টি বৌদ্ধ জাতকের গল্প। ফলে দুটি ভারতীয় প্রজন্মের ভুলতে না পারা, শৈশবের মায়া-জড়ানো এই সিরিজ়ে ‘হিন্দু’ এবং ‘ভারতীয়ত্ব’র মধ্যেকার সীমারেখা শেষমেশ অস্পষ্টই রয়ে গিয়েছে। বরং প্রত্যক্ষ হোক বা পরোক্ষ, গৈরিক বাহিনীর রাজনৈতিক মতাদর্শের ঐতিহ্যের নির্মাণকেই তা আরও পুষ্ট করেছে। তাই আশ্চর্যজনক ভাবে কিছু দেশবাসীর কাছে আজও ইতিহাস আর অমর চিত্র কথা একাকার হয়ে যায়!