শৈলবালা ঘোষজায়া
প্রবাসী পত্রিকায় ১৩২২ বঙ্গাব্দের বৈশাখ থেকে ফাল্গুন পর্যন্ত প্রকাশিত ধারাবাহিক উপন্যাসটি পড়তে পড়তে চমকে উঠছেন পাঠকরা। জনপ্রিয়তার শিখর ছুঁয়ে-যাওয়া ‘শেখ আন্দু’ উপন্যাসের পটভূমি যেমন অভিনব, ভাষা আর রচনাশৈলীতেও তেমনই মুনশিয়ানার ছাপ। যথেষ্ট সাহসী কলমে দুই ভিন্নধর্মী নায়ক-নায়িকার শাশ্বত প্রেমকাহিনিকে অসামান্য দক্ষতায় প্রশ্রয় দিলেন সেই নবাগতা কথাশিল্পী। রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্রের উজ্জ্বল প্রভাবপুষ্ট, সমকালীন বাংলা সাহিত্যজগতে নিজস্ব ঘরানায় স্পর্ধিত পদচারণা শুরু হল শ্রী শৈলবালা ঘোষজায়ার। আত্মপরিচয়ের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত রাখার জন্যেই নামের আগে ‘শ্রী’ এবং ব্যাকরণসম্মত ‘ঘোষজায়া’ পদবি ব্যবহার করতেন তিনি।
এর আগে অবশ্য ‘মোহের প্রায়শ্চিত্ত’ নাটক লিখেছেন সতেরোর তরুণী, কিন্তু প্রকাশিত হয়েছে পরে। তার আগেই ‘শেখ আন্দু’র হাত ধরে বৃহত্তর পাঠকসমাজে লেখিকার আত্মপ্রকাশ। মামুলি আবেগসর্বস্বতাকে এক রকম পাশ কাটিয়ে বরং কিছুটা ইঙ্গিতধর্মিতায় হিন্দু-মুসলমানের সেই প্রণয়-আখ্যান সমাজের কাছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জোরালো বার্তা পৌঁছে দিল। লেখিকার এমন দুঃসাহসকে নিশ্চয়ই সমর্থন করেনি সমকালীন পরিবেশ ও পরিমণ্ডল, কিন্তু স্বামী নরেন্দ্রমোহন ঘোষের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা এবং আন্তরিক অনুপ্রেরণা তাঁর সেই সময়ের সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের একমাত্র চালিকাশক্তি। ১৯১৭ সালে ‘গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এ্যান্ড সন্স্’ থেকে পুস্তকাকারে প্রকাশিত হল ‘শেখ আন্দু’। ১৯২১-এ দ্বিতীয় সংস্করণ। অনুমান করতে অসুবিধে হয় না, যথার্থই পাঠকনন্দিত কাহিনি হিসেবে চিহ্নিত হয়ে রইল কথাশিল্পীর সেই প্রথম উপন্যাস। এতখানিই নিবিড় মগ্নতায় লেখিকা তাঁর প্রিয় নায়ককে গড়ে তুললেন যে নিজেই তাকে ‘আমার স্নেহের আন্দু’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন।
আসলে, ‘শেখ আন্দু’ একটি ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত। সমকালীন রক্ষণশীল সমাজব্যবস্থায় যখন নারীস্বাধীনতার ভাবনাটা ছিল একেবারেই স্বপ্নাতীত, ঠিক তখনই কালি-কলমে সমাজবিপ্লবের অভিষেক ঘটাতে চাইলেন শৈলবালা। তাঁর সারস্বত সাধনার সেই সূচনালগ্নেই চিরাচরিত বিষয়বস্তুকে এড়িয়ে এক হিন্দু বিধবা মেয়ের সঙ্গে দরিদ্র মুসলমান ড্রাইভারের পরিচ্ছন্ন সংযত প্রেমকাহিনিতে, সে যুগে কষ্টকল্পিত হলেও, সংস্কারমুক্ত সমাজভাবনার সঙ্কেত পাওয়া গেল। ‘উন্নতির হাত-পা নেই, তাকে নিজের হাতে গড়ে নিতে হয়...।’ আবাল্য মেধাবী শৈলবালা যথেষ্ট দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়ে রক্ষণশীল ধ্যানধারণাকে নস্যাৎ করার সাহস দেখাতে পারলেন। আর তখন থেকেই আমৃত্যু নিজের মধ্যে লালন করে চললেন এক স্বতন্ত্র প্রতিবাদী সত্তা।
বর্ধমানের সরাইটিকরের বাসিন্দা কুঞ্জবিহারী-হেমাঙ্গিনী নন্দীর ছয় সন্তানের অন্যতম শৈলবালার জন্ম ১৮৯৪-এর ২ মার্চ, তৎকালীন চট্টগ্রামের কক্সবাজারে। বর্ধমানের খোক্কর সায়েবের মাজার-সন্নিহিত ২৩ নং পুরাতনচকে বসবাস সূত্রে শিক্ষাজীবনের আদিপর্ব রাজবাড়ি সংলগ্ন তদানীন্তন রাজ বালিকা বিদ্যালয়ে।
তেরো বছর বয়সে মেমারির কেশবলাল ঘোষের পুত্র নরেন্দ্রমোহন ঘোষের সঙ্গে পরিণয়, কিন্তু সুস্থ, স্বাভাবিক দাম্পত্যজীবন বলতে যা বোঝায় তা ছিল মাত্র বারো-তেরো বছরের। ‘শেখ আন্দু’ প্রকাশের বছর দুয়েকের মধ্যেই ‘স্বামী ঘোর উন্মাদ— দুর্দান্ত।’ নিজেই লিখেছেন শৈলবালা—‘১৩২৭ সাল আমার জীবনের সবচেয়ে দুর্বৎসর।’ উন্মাদ স্বামীর চিকিৎসা আর সেবাযত্নের জন্যে দশটা বছর ফুরিয়ে গেল, তবু বাঁচানো সম্ভব হল না নরেন্দ্রমোহনকে।
আশ্চর্যের ব্যাপার, পারিবারিক জীবনে কিন্তু তিনি পুরোপুরি অসুখী একজন গৃহবধূ। জ্ঞানচর্চা কিংবা সাহিত্যসৃজনের স্পর্ধা রক্ষণশীল একান্নবর্তী শ্বশুরবাড়ির সুনজর, সহমর্মিতা এবং সমর্থন থেকে চিরদিনই বঞ্চিত। শুধু মনের জোর, অধ্যবসায় আর প্রতিভাকে সঙ্গী করে নানান প্রতিকূলতা আর প্রতি মুহূর্তের প্রবল মানসিক বিক্ষোভ সত্ত্বেও প্রতিবাদী আপোসহীন জীবনসংগ্রামী এক কথাকার নিরন্তর সাহিত্যসাধনায় নিমগ্ন। মধ্য-তিরিশের নিঃসন্তান বিধবা যুবতী শৈলবালার কাছে তখন মানসিক সুস্থিতির সেটাই একমাত্র অবলম্বন। সামান্য শান্তিসুখের সন্ধানে আশ্রয় নিতে চাইছেন কখনও বর্ধমানে, কখনও মেমারিতে, কখনও বা স্বামী অসীমানন্দ সরস্বতীর কাছে দীক্ষিত হয়ে পুরুলিয়ায় বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর আশ্রমে। তিনি দোহাই দিচ্ছেন ভাগ্যের। কোনও একটা নির্দিষ্ট জায়গায় পাকাপাকিভাবে উদ্বেগহীন থিতু হওয়া যেন তাঁর কপালে নেই!
ব্যক্তিজীবনের নানা তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকেই শৈলবালা সংগ্রহ করছেন সাহিত্যের রসদ। লিখছেন, ‘এদেশের মেয়েকে বড় লাঞ্ছনা সহ্য করতে হয়...।’ তাঁর অনুসন্ধানী উপলব্ধির ভাষাতেও রয়েছে হতাশার আবহ। বিশ শতকের প্রথমার্ধের নারীসমাজকে নিজের জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে এতটাই অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করলেন যে তাঁর সৃষ্ট নারীচরিত্রগুলি বাস্তব অভিজ্ঞতার অবিকল্প প্রতিবিম্ব হয়ে উঠল। পুরুষশাসিত সমাজে উপেক্ষা আর অবহেলার শিকার নারীজাতির অবমাননায় ব্যথিত শৈলবালা নানা রকম সমাজসেবামূলক কাজেও নিজেকে জড়িয়ে রাখলেন। মহিলাদের উপযুক্ত সামাজিক মর্যাদার লক্ষ্যে স্ত্রী-শিক্ষা, কিংবা তাদের স্বনির্ভর হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়ে শামিল হলেন হরেক কর্মকাণ্ডে। শৈলবালার নিজস্ব সম্পদ বলতে অফুরান আত্মপ্রত্যয়, জেদ, নিষ্ঠা, আত্মসম্মানবোধ আর সৃজনশীলতায় আত্মস্থ হয়ে অবিরাম অনুশীলন। উপন্যাস, গল্প, আত্মকথা, শিশুসাহিত্য, ঐতিহাসিক কাহিনি, নাটক—সব মিলিয়ে তাঁর প্রকাশিত-অপ্রকাশিত রচনাসম্ভার পঞ্চাশের কম তো নয়ই। ‘মহিমা-দেবী’, ‘অরু’, ‘গঙ্গাপুত্র’, ‘জয়পতাকা’, ‘রঘুসর্দার’, ‘পাহাড়গড়’, ‘নমিতা’— বিচিত্র পটভূমি, বিপুল সৃষ্টিজগৎ, একেবারেই নিজস্ব ঘরানা। দুর্ভাগ্য, একদা সাড়া-জাগানো এই বইগুলোর অধিকাংশই আজ বিরল। ফলে আজকের প্রজন্মের কাছে এই মেধাবী লেখিকা অনেকাংশেই অজ্ঞাত।
জীবনের প্রান্তবেলায় পৌঁছে অবশ্য কিছু স্বীকৃতি জুটেছিল। পেয়েছিলেন ‘সরস্বতী’, ‘রত্নপ্রভা’, ‘সাহিত্যভারতী’-র মতো সম্মান। যদিও ব্যক্তিজীবনের বিষাদখিন্ন স্মৃতিতাড়িত শৈলবালা তেমন আপ্লুত নন। বয়সের ভারে নানান শারীরিক সমস্যা, পারিবারিক সঙ্কট, আর্থিক অনটন, একাকিত্বে জর্জরিত কথাশিল্পীকে পঁচাত্তর বছর বয়সে আশ্রয় নিতে হল আসানসোলে, ভাসুর মুরারি ঘোষের নাতি শ্যামসুন্দর ঘোষের বাড়িতে। অপরাহ্ণবেলায় অনেকখানি স্বস্তি দিয়েছিলেন শ্যামসুন্দর আর তাঁর স্ত্রী ভারতীর আতিথেয়তা। ১৯৭৪-এর ২১ সেপ্টেম্বর আশি বছর বয়সে সেখানেই প্রয়াত হলেন জীবনশিল্পী।
দরদি মন ও মননের বলিষ্ঠ কথাকার শৈলবালা তাঁর জীবদ্দশায় বিপুল সাহিত্যসম্ভারের ঐশ্বর্যে নিশ্চয়ই বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছিলেন, কিন্তু যথাযথ মূল্যায়নের অভাবে প্রায়-বিস্মৃতির পর্যায়ে পৌঁছে যেতেও তো বেশি সময় লাগল না। এটাকে ভবিতব্য হিসেবে মেনে নেওয়া ছাড়া আর
কী-ই বা বলা যায়! সমকালের তুমুল জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও সাহিত্যে নিবেদিতপ্রাণ এক সাধিকার সৃষ্টিজগতের অনেকখানিই অধরা থেকে গেল উত্তরপুরুষের কাছে।