স্মৃতি: সন্তোষ, বিধুশ্রী, নিউ রয়্যাল, টাইগার, রূপম কবেই বিদায় নিয়েছে। ধর্মতলার ‘মেট্রো’ সিনেমাও এখন শুধুই অতীত
তাপ্পি-মারা পরদা জুড়ে বিচিত্র পোশাক পরে মেহমুদ আর জয়শ্রী টি নেচে চলেছেন, কিশোর-আশা গীত ‘নাচ মেরি জান/ ফটাফট ফট্’ গানের সঙ্গে। ‘ম্যায় সুন্দর হুঁ’ (১৯৭১) ছবির পুরনো ঝিরিঝিরি রিল, বৃষ্টি-ধোয়া হলুদ ছোপের পরদায় মিশে, ১৯৭৩-৭৪’এর চৈতালি সন্ধ্যায় এক বিচিত্র বর্ণালী তৈরি করেছে। এ সবে ডোন্ট-কেয়ার পঁয়তাল্লিশ পয়সার টিকিটের পাবলিকের একাংশ বদ্ধ-ঘরের ঘেমো জামা খুলে নাচতে শুরু করেছে। হঠাৎ এক ঝলক বসন্তের হাওয়া গুমোট গরমে খানিকটা স্বস্তি বইয়ে দিল। চোখ ঘুরিয়ে দেখা গেল, সহৃদয় ‘টর্চ-ম্যান’ হলের দরজার একটা পাল্লা খুলে দিয়েছে। তার ফাঁক দিয়ে দৃশ্যমান হল, বাজারের ফুট-ফরমায়েশ খাটা বালক-কিশোরের দঙ্গলও হলের বাইরে নেচে চলেছে!
হলের নাম ‘সন্তোষ’। বাজারের হল, বা বাজার-দিয়ে-ঘেরা হল। এখনকার হাই-এন্ড শপিং মলের চলমান সিঁড়ি বেয়ে ওঠা মাল্টিপ্লেক্সের আদি, অতি-অধস্তন (এখনকার সমাজবিজ্ঞানে যাদের ‘সাবঅল্টার্ন’ বা নিম্নবর্গীয় বলার চল) ‘অপর’। পূর্ব-কলকাতার ফুলবাগান থেকে যে রাস্তা বেলেঘাটার পুরনো ‘আলোছায়া’ সিনেমার দিকে চলে গিয়েছে, তার মোড়ে যে বি সরকার বাজার, তারই ভিতরে ‘সন্তোষ’ ১৯৬০-’৭০-এর দশকে দাপটে রাজত্ব চালিয়েছে। তার অনতিদূরে কাদাপাড়ার ‘শুকতারা’ সিনেমার মতোই সেও ওই অঞ্চলের (এখন বন্ধ) জুটমিলের শ্রমিক, ছোটখাটো দোকানি-হাটুরে, বা স্কুলকলেজ-পালানো ছেলের দলের মনোরঞ্জন করেছে অতি সস্তায়। সেই নেই-টিভি-র যুগে এই রকম ‘হল’ কলকাতার নানা জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল, যারা সে যুগের কুলীন বাংলা, ইংরেজি বা হিন্দি সিনেমার হলগুলোর চেয়ে সব দিক থেকেই ব্রাত্য, প্রান্তিক। অনেকে এদের নাম শুনলেও, অবস্থান ঠিক কোথায় তা জানতেন না।
বলা বাহুল্য, ‘সন্তোষ’ একটি একচালা, একতলা হল, যার কোনও ব্যালকনি ছিল না। কলকাতায় তখন এমন বেশ কয়েকটি হল রমরমিয়ে চলত। যেমন, শিয়ালদা অঞ্চলে সার্কুলার রোড থেকে ইএসআই-টাকি স্কুলের গলিতে (যেটা খালের দিকে চলে গিয়েছে) ‘নিউ রয়্যাল’, এন্টালির ডা. সুরেশ সরকার রোডের ‘এন্টালি টকিজ’, বা খন্না সিনেমা পেরিয়ে গ্রে স্ট্রিটের ‘বিধুশ্রী’। কর্পোরেশন বিল্ডিং-এর পাশের ‘রিগ্যাল’ সিনেমাও একতলা, এবং সত্তরের দশকে বি-গ্রেডের হিন্দি ছবি দেখাত (ছেলেবেলায় সত্যজিৎ রায় এখানে ইংরেজি ছবি দেখেছিলেন), কিন্তু স্থান-মাহাত্ম্যে কুলীন! ধর্মতলার ‘টাইগার’ও একতলা ও সস্তা। সেখানে হলিউডের ‘ওয়েস্টার্ন’ (আঠারো-উনিশ শতকের আমেরিকার পশ্চিম অঞ্চলে বন্দুকবাজ দুর্বৃত্ত ও আইনরক্ষকদের মধ্যে লড়াইয়ের মারকাটারি ছবি) মুভি দেখানো হত। কিছু হল আবার গজিয়েছিল পুরনো হলের মধ্যেই, যেমন এন্টালির ‘জেম’-এর ভিতর ‘মিনি জেম’, লেক টাউনে ‘জয়ার’ পাশে ‘মিনি জয়া’। এম জি রোডের মোড়ে ‘প্রভাত’, নাখোদা মসজিদের কাছে ‘নাজ’, শ্রদ্ধানন্দ পার্কের উলটো দিকে তারাচাঁদ দত্ত স্ট্রিট পেরিয়ে পৌঁছনো যেত ‘কৃষ্ণা’য়। কিন্তু এরা কেউই সন্তোষ বা নিউ রয়্যাল-দের সমগোত্রীয় নয়। এদের কোনওটাই ‘বাজারের মধ্যে’ ছিল না। ‘সন্তোষ’ তাই অনন্য।
একতলা বাজারের মুদি-দশকর্মা-লন্ড্রি-সেলুন-দর্জি-চায়ের দোকানের গলির মাঝামাঝি ছিল হলটা। শোনা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এটা চালের গুদাম ছিল। ‘বিধুশ্রী’ও তা-ই ছিল বলে শুনেছি। সেই গুদামই পরে হয়ে ওঠে সিনেমা হল। ‘সন্তোষ’ খুব সস্তা ছিল, পঁয়তাল্লিশ পয়সাতেও টিকিট পাওয়া যেত। আগে পঁয়ত্রিশ পয়সা ছিল, বাংলাদেশ যুদ্ধের পর দশ পয়সা ট্যাক্স বেড়ে পঁয়তাল্লিশ হয়, পুরনো পঁয়ষট্টি হয় পঁচাত্তর। জানা-শোনা হলগুলোর মধ্যে কলেজ স্ট্রিট-বউবাজারের মোড়ে ছানাপট্টির পাশে ছিল ‘রূপম’। গরমের দিনে সন্তোষে ঢুকেই সামনের সারির সস্তার টিকিটধারীরা (এরা সবাই পুরুষ, মেয়েদের এই শ্রেণির টিকিট বেচা হত না) তাদের শরীরের ঊর্ধ্বাঙ্গের পোশাক খুলে দেওয়ালে পোঁতা সারি সারি গজালের মতো হুকে ঝুলিয়ে রাখত। গায়ে জামা পরে গরমে সিনেমা দেখা যেত না। তাতে অবশ্য ছারপোকার হাত থেকে বাঁচা যেত না!
ছারপোকার উৎপাত অবশ্য এই শ্রেণির সব হলের সামনের সারিতেই ছিল। কাঠের চেয়ারে এই কীটশ্রেণি প্রজন্ম-পরম্পরায় সস্তার দর্শকদের রক্ত শোষণ করত। এদের সান্ত্বনা দিতেই বোধহয় দেবানন্দ একটি ছবিতে শচীনকত্তার বিখ্যাত গান ‘নিশীথে যাইও ফুলবনে’র সুরে গেয়েছিলেন, ‘ধীরে সে জানা খাটিয়ন মে, ও খটমল...’। তাতে অবশ্য দর্শককুলকে দমানো যেত না। অনেক রক্ত-ঘাম ঝরিয়ে সস্তার টিকিট সংগ্রহ করতে হত। বেশির ভাগ হলে একটি সাড়ে পাঁচ ফুট উচ্চতার আঁকাবাঁকা খাঁচার মধ্যে কোনওমতে সেঁধিয়ে অন্য টিকিট-প্রত্যাশীদের সঙ্গে তুমুল ধাক্কাধাক্কি, কখনও মারামারিও করে, একদম ডারউইনের ‘সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট’ নীতি মেনে, টিকিট কাউন্টারে পৌঁছনো যেত। ফলে, এই বীরবাহিনী ছারপোকা তো কোন ছাড়, কিছুতেই পরোয়া করত না। কেবল মাঝে মাঝে রিল কেটে গেলে (যা প্রায়ই হত) বা পরবর্তী রিল অন্য হল থেকে সাইকেল-বাহিত কুরিয়ার মারফত জলদি এসে না পৌঁছলে এরা হট্টগোলে ফেটে পড়ত। কাঠের চেয়ার সশব্দে উঠিয়ে একেবারে ভেঙে ফেলার জোগাড় করত। প্রসঙ্গত, তখন এই সব হলগুলির পক্ষে চলচ্চিত্র-পরিবেশকদের থেকে গোটা ছবি ভাড়া নেওয়া সম্ভব ছিল না। অনেক সময়েই ভাড়া বেশি হলে, দু’টি হল মিলে একটি গোটা ছবির রিল ভাড়া নিয়ে, শো-টাইম কিছুটা আগুপিছু করে, রিল দেওয়া-নেওয়া করে ম্যানেজ করত।
কিছু কিছু হল-এ অনেক সময় জল ঢুকে পড়ত। যেমন, টালিগঞ্জের আদিগঙ্গার পাড়ের ‘প্রদীপ’। টালিগঞ্জ ব্রিজে চড়ে বেহালা-নিউ আলিপু্রমুখো বাঁ-হাতি সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে গেলে ‘প্রদীপ’। আদিগঙ্গায় বান এলে তা হল-এ ঢুকে পড়ত। পুরীষ ও কাদাময় সেই ঘোলা জলরাশি ঢোকার আগে কর্তৃপক্ষ প্রদর্শন সাময়িক থামিয়ে পরদায় পূর্ব-নির্মিত স্লাইড ভাসিয়ে দিতেন: ‘আসিতেছে! আসিতেছে!! বান আসিতেছে!!! জুতা খুলিয়া, পা তুলিয়া বসুন’। অসতর্ক বা অনভ্যস্ত থাকলে জুতোর পাটি ভেসে গিয়ে হাফ টাইমে ‘জুতা বিভ্রাট’ ঘটত। ঠনঠনিয়ার কাছে ‘বীণা’তেও এমনটা হত। সেখানে অবশ্য নদী নয়, বর্ষার জল রাস্তা উপচে হল-এ ঢুকত। উত্তর কলকাতার সুকিয়া স্ট্রিট-আমহার্স্ট স্ট্রিটের মতো নিচু জায়গার চেয়েও নিচু এই বীণা সিনেমায় জল ঢুকলে সহজে বেরোত না। ধীরে ধীরে সেই জল সামনের সারির সামনে থিতিয়ে গেলে পরদায় সিনেমা না দেখে নীচে জলের দিকে তাকালেই উলটোভাবে সিনেমা দেখা যেত!
দোতলা হল-এ, বেশির ভাগ সময়েই একপাশে মেয়েদের সস্তার পৃথক আসন হত। তবে ‘ব্যালকনি’র মতো সামনাসামনি নয়, এক পাশে ঠাঁই হত তাঁদের। সেখান থেকে ঘাড় বাঁকিয়ে বা উঁচু করে তাঁরা ম্যাটিনির আনন্দ উপভোগ করতেন। রাজাবাজারের সংখ্যালঘু অধ্যুষিত অঞ্চলের ‘তসবীর মহল’-এ পরদানশিন মেয়েদের জন্য দোতলায় ‘চিক’ ঝোলানো থাকত। এখানেই প্রথম ‘জুয়েল থিফ’ সিনেমায় বৈজয়ন্তীমালার ‘হোটোঁ মে অ্যায়সি বাত...’ গানের সঙ্গে উত্তাল নাচ শুরু হলে পরদার দিকে তাক করে, তীক্ষ্ণ শিসের সঙ্গে মুহুর্মুহু পয়সা ছুড়তে দেখেছি। তেমন মারকাটারি ‘ডায়লগ’, ‘ফাইটিং’ বা নাচের দৃশ্য থাকলে ওই দৃশ্য আবার দেখতে দর্শকরা সমস্বরে দাবি করত ‘রিল ফির ঘুমাও’। হাতে সময় থাকলে রসিক ও সহৃদয় প্রোজেকশন-মাস্টার সেই দাবি পূরণও করতেন। পাবলিক থিয়েটারে নাটক দেখে আগে যে ‘আনকোর্’ (encore) বলার সম্ভ্রান্ত প্রথা চালু ছিল, এ হল তার নতুন অনভিজাত নকল— যে যুগের শিল্পকে বিশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংস্কৃতি-ভাবুক ওয়াল্টার বেঞ্জামিন, ‘দ্য ওয়ার্ক অব আর্ট ইন দি এজ অব মেকানিক্যাল রিপ্রোডাকশন’ (১৯৩৫) নামে চিহ্নিত করেছিলেন।
কালের নিয়মে, অর্থনীতি ও জনরুচির তীব্র বদলে, এই হলগুলির অধিকাংশই উঠে গিয়েছে। প্রয়াত জ্যাকিদা (যতীন চক্রবর্তী) যাকে পরে ‘অপ-সংস্কৃতি’ আখ্যা দিয়েছিলেন, সেটা তখন চালু না থাকলেও, এই হলগুলোর পরিবেশ ও সেখানে পরিবেশিত ছবির সংস্কৃতি— কোনওটাই ভদ্রসমাজের অনুমোদিত ছিল না। ভাল স্কুল-কলেজের ছেলেরা মুখ্যত পয়সার অভাবে (তখন সম্পন্ন পরিবারেও ছেলেদের প্রয়োজন-অতিরিক্ত হাতখরচা দেওয়ার চল ছিল না) এখানে সিনেমা দেখতে এলেও, তাদের সহ-দর্শকদের অধিকাংশই স্কুলের মুখ দেখেনি। নব্বই শতাংশ দর্শকই পুরুষ, মেয়েরা নৈব নৈব চ। মধ্যবিত্ত তো বটেই, নিম্নবর্গীয় মেয়েদেরও বিশেষ দেখা যেত না। ফলে, কখনও কপালের ফেরে পুরনো, মাঝে-মাঝে-রিল-ছিঁড়ে-যাওয়া ধ্রুপদী ছবি (অশোককুমার-কানন দেবী অভিনীত দেবকী বসুর ‘চন্দ্রশেখর’ আমি ‘সন্তোষ’-এই দেখি) দেখে ফেললেও সুধী-সমাজে তা বলার উপায় ছিল না। বটতলার সাহিত্যের মতোই এই পরিসরের একটা নিষিদ্ধ ব্যাপার ছিল। গত কয়েক দশকে কলকাতায় একদা-ব্রাত্য ‘বটতলা’য় প্রকাশিত বই নিয়ে চর্চা, শিক্ষিত আভাঁ-গার্দ শ্রেণির ‘কালাচারাল স্টাডিজ’-এর কল্যাণে বড়লোকের বৈঠকখানায় উঠে এসেছে। হয়তো কালের গর্ভে তলিয়ে যাওয়া কলকাতার সিনেমাহল-সংস্কৃতির প্রান্তবাসী এই সব হল ও তার সংস্কৃতিও এক দিন সেই গৌরবের আলোয় উজ্জ্বল হয়ে উঠবে!