সলমন খানকে দোষী সাব্যস্ত করে সাজা শুনিয়েছিল আদালত। তামাম বলিউড সেদিন কোথাও অশ্রু কোথাও গ্লিসারিনে স্যাঁতসেঁতে। আর ঠিক তখনই কহানি মে টুইট! হুড় হুড় দাবাং দাবাং ভঙ্গিতে মাঠে নামলেন গায়ক অভিজিৎ। তাঁর ছোট ছোট বাক্যগুলি গোটা দেশেরই বড্ড কানে লাগছিল। বড় আলটপকা যেন। অতঃপর সোশ্যাল নেটওয়ার্কও স্বাভাবিক কারণেই অভিজিৎ-কে ঝেড়ে কাপড় পরাতে দেরি করেনি। সোনাক্ষী সিংহ, বাবুল সুপ্রিয় কিংবা ঋষি কপূরের মতো অনেকেই তাঁর মন্তব্যের উপযুক্ত বিরোধিতায় সরব হন। ভারতীয় দণ্ডবিধির ১৫৩, ১৫৩-এ, ৫০৪ এবং ৫০৬ নম্বর ধারায় নাকি এফআইআরও দায়ের হয় বিহারের কোনও একটি জেলা আদালতে।
কী টুইট করেছিলেন সে দিন অভিজিৎ? ‘কুত্তা রাস্তায় শোবে, কুত্তার মতোই মরবে। রাস্তা গরিবদের বাপের সম্পত্তি নয়। এক বছর আমার কোনও বাড়িঘর ছিল না, কখনও রাস্তায় শুইনি।’ এ বক্তব্যের রেশ ধরেই তার পর এমন আরও কয়েকটি টুইট করেন। যে ভঙ্গিতে শিল্পী অভিজিৎ এই মন্তব্য ছুড়ে দিয়েছিলেন, তা বেসুরোই ছিল। হয়তো এর নেপথ্যে গভীর কোনও স্বার্থ, হীন ধান্দাবাজির বীজও আছে; চট করে বলা মুশকিল। কিন্তু ব্যক্তি অভিজিৎ ভট্টাচার্যকে যদি সাময়িক সরিয়ে রাখি, তা হলে তাঁর এই মন্তব্যের কনটেন্টকে কি উড়িয়ে দেওয়া যায়? বরং সলমনের সাজা প্রসঙ্গে টুইট থেকে বাইট আ-বলিউড যে যেখানে যা কপচেছে, তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও সমর্থনযোগ্য মনে হয় অভিজিতের এই মন্তব্যকেই।
আদালত সিদ্ধান্ত জানিয়েছে, সেই রাতে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় সলমনই স্টিয়ারিং-এ ছিলেন। সুতরাং সলমন সম্ভবত তাঁর প্রাপ্য সাজাই পাচ্ছেন, পাওয়া উচিতও। কিন্তু কথা হচ্ছে, দুর্ঘটনাটি তো নেহাতই যান্ত্রিক কারণেও হতে পারত। ব্রেক ফেল হতে পারত, টায়ার বার্স্ট করে গাড়ি ফুটপাতে উঠে যেতে পারত। কিংবা নিছক ড্রাইভারের বোকামি কিংবা ভুলবশত, মানুষমাত্রেরই যেমন ভুল হয় আর কী, পুকুরপাড়ে পা পিছলে যায়, স্টেপ আউট করতে গিয়ে বলের ফ্লাইট মিস হয়, সেই রকমও কিছু ঘটতেই পারত! অর্থাৎ দুর্ঘটনা যদি একই ঘটত, অথচ সলমন মদ্যপ অবস্থায় না থাকতেন, সে ক্ষেত্রে? সলমনের সাজা হয়তো খানিক কম হত, কিন্তু নুরুল্লা মেহবুব শরিফের প্রাণ কি বাঁচত? আবদুল্লা রউফ শেখ কি জীবনে আর দু-পায়ে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াতে পারতেন? সেই ২০০২ সালে গোটা দেশে পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছিল ৮৪,৬৭৪ জনের। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ও রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে, দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যাটাও প্রতি বছরই বাড়ছে। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো-র হিসেব অনুযায়ী ২০১৩ সালে গড়ে প্রতি দিন ৩৭৭ জনের মৃত্যু হয়েছে পথ দুর্ঘটনায়। রোজ আহত হয়েছেন ১২৮৭ জন। এত এত দুর্ঘটনার, এত এত মৃত্যুর সবগুলি নিশ্চয়ই ড্রাইভারের দোষে নয়। কেবল মদ্যপান করে গাড়ি চালানোর কারণে তো নয়ই। এ কথা ঠিক, বেশির ভাগের জন্য ড্রাইভারই দায়ী, কিন্তু পথ দুর্ঘটনা মানেই ড্রাইভার ভিলেন, তা ঠিক নয়। সরকারি খতিয়ান বলছে, ২০১১ সালে ভারতে যে সংখ্যক পথ দুর্ঘটনা হয়, তার মধ্যে ২২.৫% ক্ষেত্রে ড্রাইভারের দোষ ছিল না। অর্থাৎ, দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে সেখানে কাজ করেছিল পথচারীর দোষ, যান্ত্রিক গোলযোগ, খারাপ রাস্তা, খারাপ আবহাওয়া ইত্যাদি অনেক কিছু। আর থাকে মদ্যপানের প্রসঙ্গ। কমিউনিটি এগেনস্ট ড্রাঙ্কেন ড্রাইভিং (ক্যাড)-এর মতো সংস্থার বক্তব্য যথার্থ। বহু দুর্ঘটনার নেপথ্যেই রয়েছে মাত্রাতিরিক্ত নেশাগ্রস্ততা। সারা বিশ্বেই এটি এখন বিরাট দুশ্চিন্তার কারণ। কিন্তু পরিমিত মদ্যপান আর বেহেড মাতাল হয়ে যাওয়া তো এক জিনিস নয়। দুর্ঘটনা ঘটলেই মদের বোতলকে কাঠগড়ায় তোলার সুযোগ খোঁজা কি এক প্রকার বায়াস্ড অপচেষ্টা নয়? স্বামী-স্ত্রীর বিচ্ছেদ, প্রিয়জনের সঙ্গে তুমুল মনোমালিন্য, অফিসে কোণঠাসা অবস্থান, সহকর্মীদের অবিরাম হ্যাটা— এক কথায়, জীবনযুদ্ধে বিচ্ছিরি ভাবে ক্রমশ হেরে যেতে থাকা— এ সবেও তো কত সময়ই মাথার ঠিক থাকে না। চালককে তো সে সবও কয়েক মুহূর্তের জন্য বেখেয়াল করে দিতে পারে, যার পরিণতি হতে পারে মারাত্মক। ২০১৩ সালের নিরিখে ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো-র আর একটি তথ্য বলছে, সন্ধে ৬টা থেকে রাত ৯টার মধ্যেই সবচেয়ে বেশি পথ দুর্ঘটনার খবর মিলেছে। ৭৪,৪১১টি। কাজেই নেশাতুর রাতের নিশিডাক শুনতে পাওয়ার ঢের আগেও যে সময় ঘনিয়ে আসে, সে সম্ভাবনাকেও কি একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায়?
পথ দুর্ঘটনা ঘটলে, তা তো পথেই ঘটবে, ড্রয়িং রুমে বা খেলার মাঠে নয়। কাজেই পথে বা পথের পাশে যিনি রয়েছেন, সচেতন থাকাটা তাঁরও দায়িত্ব। আর সেখানে ঘুমে অচেতন হয়ে পড়ে থাকাটা কি নিজের মৃত্যুকেই আমন্ত্রণ জানানো নয়? রাস্তা বা ফুটপাত যেমন কখনওই উচ্চবিত্তের 'বাপের সম্পত্তি' নয়, একই ভাবে সত্যিই তো নিম্নবিত্ত মধ্যবিত্ত কোনও কাউকেই তাঁর পিতৃদেবও সেটি গত বারের জন্মদিনে গিফ্ট করেননি। রাস্তার ধারে ফুটপাত দখল করে এক জন শোবেন কেন? কলকাতার বহু ফুটপাত ধরে হাঁটার চেষ্টা করুন, করদাতা হয়েও কোনও মতে দু’পা এগিয়েই মনে হবে, এই ফুটপাতে হাঁটার কোনও অধিকার আপনার নেই। মনে রাখা উচিত, ফুটপাত দিয়ে হাঁটতে না-পারাটাও কিন্তু দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। অর্থাৎ, ফুটপাতে ঘর-বাঁধা, পথকে আরও দুর্ঘটনাপ্রবণ করে তুলছে। এক, পথে-হাঁটা মানুষজনের ঝুঁকি বাড়ছে। দুই, পথের পাশে বসবাসকারীদের জীবন তো সর্বদা বিপন্ন থাকছেই। এই দখলদারিও কি আগাগোড়া অনুচিত বেআইনি কাজ নয়? ফুটপাত জুড়ে, এমনকী ফুটপাত ছাপিয়ে রাস্তা ছুঁই-ছুঁই অজস্র ঝুপড়ির অবস্থানকে যদি সমর্থন করতে হয়, তা হলে তো ফুটপাতের বেআইনি হকারদেরও মেনে নেওয়া উচিত। এই হকাররাও তো পেটের টানে, বাধ্যতই সেখানে বসছেন। হাতিবাগান কি গড়িয়াহাটের বেদখল হওয়া ফুটপাত নিয়ে তবে আর হা-হুতাশ কেন!
শখ করে কেউ ফুটপাতে ঘর বাঁধেন না, ঠিক। বাধ্য হয়েই এক-ফালি জায়গা দখল করে ছিঁড়ে-আনা ফ্লেক্স টাঙিয়ে ঘর সাজিয়ে তোলার চেষ্টা করেন। দুর্ঘটনায় পা-হারানো আবদুল্লা রউফ শেখ তো কাজ করতেন আমেরিকান এক্সপ্রেস বেকারিতে। তাদের কর্মচারীকেই বা বেকারির সামনের ফুটপাতে নিশিযাপন করতে হত কেন? সে দায় তো তারাও এড়াতে পারে না। রাতে খোলা আকাশের নিচে শুয়ে থেকে যাঁর প্রাণ গেল, তাঁর সুরক্ষার দায়িত্ব কি রাষ্ট্রেরও ছিল না? মাথার উপর ছাদও কিন্তু এক অর্থে আমাদের মৌলিক অধিকার। যে দেশ তার নাগরিকের মাথায় ছাদ দিতে পারে না, তার আইনই যদি সেই নাগরিকের দুর্ঘটনায় মৃত্যুর বিচার চালায়, একটু তলিয়ে ভাবলে তাকে কত দূর নিরপেক্ষ বলা যায়? সলমন যেমন দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন, তেমনই মুম্বই কর্পোরেশনেরও কি এই দুর্ঘটনার জন্য সমান দায় নেই? দায় নেই ৬৮ বছরের স্বাধীন ভারতের?
‘নবান্ন’ নাটকে বুভুক্ষু মানুষ আর কুকুরকে একই ডাস্টবিনের সামনে দাঁড় করিয়েছিলেন বিজন ভট্টাচার্য। দেখিয়েছিলেন ক্ষুধার যন্ত্রণা। এ দেশে আজও কুকুর-মানুষে ফারাকটা বাড়েনি। অথচ এ সত্যিটা আমরা মেনে নিতে পারি না। ‘পথের পাঁচালী’ হোক বা ‘স্লামডগ মিলিয়নেয়ার’— দারিদ্র নিয়ে ব্যবসার অভিযোগ তুলি। অথচ ‘কুত্তে কি মওত’-ও কুকুরের সব সময় হয় না। ‘কুত্তা’-র মতো মরণ যে আসলে আমাদেরই ভবিতব্য, আমরা যারা ঘুমিয়ে রয়েছি মহান ভারতের ফুটপাতে কিংবা বেডরুমে, তা আর এক বার বুঝিয়ে দিয়েছে সাম্প্রতিক এই মন্তব্য।