মাইকেল মধুসূদন দত্ত। ছবি: কুনাল বর্মণ।
১৮৪২ সাল। নভেম্বর মাস ফুরিয়ে আসছে। ২৫ তারিখে আঠারো বছরের যুবা মধুসূদন খিদিরপুর থেকে চিঠিতে বন্ধু গৌরদাসকে লিখছেন, “আমি যখন ইংল্যান্ডে যাবো, আমার মনে হয় সে-দিন আর খুব দূরে নয়— হয়তো পরের শীতেই, তখন আমি তোমার একটা ছবি, তার জন্য যত দামই দিতে হোক না কেন, নিয়ে যেতে চাই। দরকার হলে আমার সমস্ত জামাকাপড় বিক্রি করে দেবো— তোমার একটা মিনিয়েচার ছবির জন্য। আজ সারাদিন ধরে আমি একথাই ভাবছিলাম, যদি পরিস্থিতি সহায় হয় তাহলে ইংল্যান্ডে যাওয়ার আগেই আমার ইচ্ছে তোমার একটা ছবি নিতে, অবশ্যই নিতে। তোমার যদি সাহেব কিম্বা নেটিভ কোনো শিল্পীর সঙ্গে পরিচয় থাকে তাহলে আমাকে জানিও।”
তীব্র আবেগ-আকুতি ভরা ভালবাসার এই চিঠি যখন লিখছেন তিনি, তখন তাঁর সমস্ত সত্তা দখল করে আছেন এক রোম্যান্টিক কবি, লর্ড বায়রন। টমাস মুরের লেখা ‘দ্য লাইফ অব লর্ড বায়রন উইথ হিজ় লেটারস অ্যান্ড জার্নালস’ সেই সময় পড়ছিলেন মধুসূদন, পড়তে বলছিলেন তাঁর প্রিয়তম বন্ধু গৌরদাসকেও। সে বই তখন বিদেশেও যথেষ্ট টাটকা। এ দেশে হিন্দু কলেজের শিক্ষক রিচার্ডসনের প্রিয় ছাত্র মধুসূদনের হাতে এসে পৌঁছেছে বছর দশেক আগে প্রকাশিত সেই বই।
মধুসূদন রিচার্ডসন ছাড়া হিন্দু কলেজের অন্য শিক্ষকদের তখন পাত্তাই দেন না। দেবেনই বা কেন! রিচার্ডসনই যে তৈরি করে দিয়েছেন মধুসূদনের শেক্সপিয়র পড়ার কান আর মন। অ্যাংলিসিস্টদের কুলগুরু মেকলেও রিচার্ডসনমুগ্ধ— এ দেশের আর সব কিছু নাকি তিনি নিজদেশ ইংল্যান্ডে ফিরলে ভুলে যাবেন, কেবল কানে বাজবে ক্যাপ্টেন রিচার্ডসনের উচ্চারণে শেক্সপিয়রের নাটক আর কবিতা। মধুসূদনেরও কানে বাজে ইংরেজি কবিতা। বাংলা কবিতার থেকে কত উচ্চ সে ভাষা! স্বপ্নে, জাগরণে ইংরেজি ভাষার কাব্যমাধুর্য তাঁকে গিলে খাচ্ছে। এদেশীয় সমাজের রীতি-নীতি তাঁকে ক্রমাগত বিরক্ত করছে। এ চিঠি লেখার কিছু দিন পরে ধর্মান্তরিত হবেন তিনি। বাবার সঙ্গে মধুসূদনের মতান্তর হচ্ছে। রেগে গিয়ে বাবা কলকাতার খিদিরপুরের বাড়ি ছেড়ে দেওয়ার কথা বলেন মধুকে, বলেন “দেশে ফিরে যাও।” গৌরদাসকে সে কথাও জানান মধু, চিঠিতে। জানান, ঝঞ্ঝাময় পারিবারিক পরিবেশের কথা। দেশে ফিরতে বাধ্য হলে গৌরের সঙ্গে দেখা হবে কেমন করে? গৌর তাঁর প্রিয় বন্ধু, ভালবাসার গৌর। মধুর বাংলায় লেখা কবিতাপ্রয়াস ‘বর্ষাকাল’— কবিতাটির প্রতিটি পঙ্ক্তির প্রথম অক্ষর উপর থেকে নীচের দিকে সাজিয়ে পড়লে চোখের সামনে ভেসে উঠবে একটিই নাম ‘গউরদাস’।
স্মৃতিবাহী: কলকাতায় লোয়ার সার্কুলার রোডের সমাধিক্ষেত্রেই শায়িত মধুকবির পার্থিব শরীর।
মধুসূদন ধর্মান্তরিত হলেন। হিন্দু সমাজে উত্তেজনা। ধর্মান্তরের পর বন্ধুদের সঙ্গে সহজে দেখা হচ্ছে না। ‘মধুস্মৃতি’র লেখক নগেন্দ্রনাথ সোমের মতো কেউ কেউ কল্পনা করবেন এই ধর্মান্তরের কারণ কোনও এক খ্রিস্টান রমণীর প্রতি প্রেম। তাঁর নাম তাঁদের মতে ‘দেবকী’ — রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের দ্বিতীয় কন্যা। অবশ্য সত্য নয় তা। ‘সমকালীন’ পত্রিকার পাতায় তর্কতীব্র প্রবন্ধে প্রয়াত অধ্যাপক সুখময় মুখোপাধ্যায় সময়ের হিসাব কষে দেখিয়েছিলেন, মধুসূদন ১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দের ৯ ফেব্রুয়ারি যখন খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করলেন, তখন ‘দৈবকী’র (নাম মোটেই দেবকী নয়) বয়স তিন-চার। নারী প্রেমের চাইতেও ভাষা ও সংস্কৃতি-প্রেম মধুসূদনের পক্ষে প্রবল— কুলধর্ম বদল করে তিনি অন্য এক ভাষা-সংস্কৃতির জগতে স্নান করতে গেলেন। তার পর আর নিজ কুলধর্মে ফেরার বাসনা কখনও জাগেনি, তবে নিজের মাতৃভাষা বাংলায় ফেরার বাসনা ক্রমে প্রবল থেকে প্রবলতর হয়েছে। সে বাসনা অনুশোচনাময় হলেও ইংরেজি ও অন্যান্য পাশ্চাত্য ভাষার চর্চায় যে মানবিক চেতনায় তিনি প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিলেন, সেই চেতনাকে কখনও ফেলে দেননি। তার মনের ভিতরে কাজ করেছে অন্য রসায়ন। বাংলা সাহিত্যকে তার নিজস্ব-ভাবজগতের উপাদান-সহ বিশ্বসাহিত্যের আলোকিত উঠোনে পৌঁছে দিয়েছিলেন।
মধুসূদনের প্রথম ‘সার্থক’ জীবনীকার যোগীন্দ্রনাথ বসু ছিলেন দেওঘরের একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক। স্বদেশপ্রীতি আর সামাজিক সুনীতি এই দুই যোগীন্দ্রনাথের মনের চালিকাশক্তি। স্বদেশপ্রীতির উন্মাদনায় দেওঘরের স্কুলের চাকরিটি হারিয়েছিলেন। কবি হলেও, বাঙালির কাছে তিনি মধুসূদনের জীবনীকার হিসেবেই পরিচিত। মধুসূদনের বন্ধু রাজনারায়ণ বসু তাঁকে মধুসূদনের জীবনী লেখার উৎসাহ দিয়েছিলেন, অনুপ্রেরণাও বলা চলে। বন্ধু সম্বন্ধে তথ্য দিয়েও সাহায্য করেছিলেন। যোগীন্দ্রনাথকে লেখা রাজনারায়ণের চিঠি থেকে বন্ধু মধুসূদনের আবেগতাড়িত আচরণের ছবি স্পষ্ট। রাজনারায়ণ যোগীন্দ্রনাথকে চিঠিতে জানিয়েছিলেন, মধু যখন কলেজে পড়তেন তখন তিনি বেশ ইন্ট্রোভার্ট— রাজনারায়ণের ভাষায় ‘নিভৃত স্বভাব’ ছিলেন। দু’-এক জন ছাড়া অন্যদের সঙ্গে প্রায় কথাই বলতেন না। অনর্গল ইংরেজি কবিতা আবৃত্তি করতে পারতেন। রাজনারায়ণ রামতনু লাহিড়ীর বাসায় এক বার ইংরেজি কবিতা বলার পাল্লায় মধুসূদনের কাছে পরাজিত, হেরে গিয়েও অবশ্য অভিভূত। ১৮৬০ সালে রাজনারায়ণের সঙ্গে মধুসূদনের যোগাযোগ পুনরায় স্থাপিত হল। মধুসূদন তখন মাদ্রাজ থেকে আবার চলে এসেছেন কলকাতায়। তাঁর বাংলা কাব্য ও নাটক লেখার পর্ব এর পর শুরু হবে। মাদ্রাজে থাকার সময় মধু ক্রমাগতই নিজেকে তৈরি করেছেন লেখক হিসাবে, রেবেকা তাঁর স্ত্রী, সন্তানদের জননী কিন্তু মনোধর্মে তাঁর সহচারিণী হয়ে উঠতে পারেননি। মধু তাঁকে না-বলে ছেড়ে এসেছেন, চলে আসার পন্থাটি পলায়নবাদী। কলকাতায় এসে বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে তাঁর হঠাৎই নতুন করে যোগ তৈরি হল— নাটকের সূত্রেই, নাটকীয় কাহিনি কাব্যও ভর করল কলমে।
মধুর ‘তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য’-এর সুসমালোচনা করলেন রাজনারায়ণ, ‘ইন্ডিয়ান ফিল্ড’ পত্রিকায়, ইংরেজিতে। ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ লিখতে শুরু করার পর লেখার দু’-তিনটি সর্গ গুণগ্রাহী রাজনারায়ণকে তমলুকের ঠিকানায় পাঠালেন মধু। নতুন ধরনের বাংলা কাব্য পড়ে রাজনারায়ণ বিস্মিত, কবিতার প্রতি মুগ্ধতা কবিসখার প্রতি গাঢ়ত্বে পরিণত। চিঠিতে জয়দেবের পদ তুলে রাজনারায়ণ লিখলেন, কবে তিনি দেখবেন ‘মধুসূদন-বদন-সরোজং’! রাজনারায়ণ তমলুক থেকে কলকাতায়, মধুসূদনের বাড়িতে। তখন মধুসূদন ‘মেঘনাদবধ’ লেখায় মগ্ন। কবিসুলভ মগ্নতা আর কবিখ্যাতির বাসনা, দুই-ই মধুর প্রবল। রাজকে জিজ্ঞেস করলেন, “উইল নট দিজ় মেক মি ইমমর্টাল?” রাজনারায়ণের মনে হয়েছিল এ বন্ধুর আত্মশ্লাঘা, কথাটা মিথ্যে নয়। অহঙ্কার মধুসূদনের ছিল। তবে ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ যে তাঁকে চিরায়ত খ্যাতি দিয়েছে সন্দেহ নেই। এর পরেও আর এক দিন তাঁদের দেখা, বেশ খাওয়াদাওয়া হল দুই বন্ধুর। মধুসূদনের বন্ধু এক ‘ফিরিঙ্গিও’ ছিলেন। মধুসূদনের প্রণয়িনী হেনরিয়েটা খাওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। যে রাজনারায়ণ জয়দেবের কান্তকোমল পদাবলি থেকে পদ তুলে আবেগের বশবর্তী হয়ে মধুর মুখদর্শন করতে চেয়েছিলেন, সেই মধুসূদন ‘প্রচুর মদ্যপান করিলেন ও বিদায় লইবার সময়... জড়াইয়া ধরিয়া ক্রমাগত মুখচুম্বন করিতে লাগিলেন।’ এই কবিবন্ধুর যশ স্থায়ী করার জন্যই পরবর্তী কালে রাজনারায়ণ যোগীন্দ্রকে জীবনী লেখার কাজে উৎসাহ দিয়েছিলেন।
যোগীন্দ্রনাথ সে সময়ে জীবনী লেখার জন্য খুবই পরিশ্রম করেছিলেন, তারই ফল বইখানি, ‘মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবন-চরিত’। গোলাম মুরশিদের মতো মধুসূদন-জীবনী লেখার জন্য দেশান্তরের সাহায্য যোগীন্দ্রনাথ পাননি— মধুসূদনের নিকটজনেরাই ছিলেন তাঁর ভরসা। সামাজিক সুনীতিবোধ যোগীন্দ্রনাথকে ‘সঙ্গত’ কারণেই মধুসূদনের অস্থির মনের বিচারে চালিত করেছিল— বায়রনের জীবনের সঙ্গে মধুসূদনের জীবনকে তিনি মিলিয়ে মিলিয়ে দেখছেন। মধুসূদনের কাব্যপ্রতিভার চেয়ে প্রেম, দৈনন্দিন জীবনের নানা অভ্যাস এ সবের প্রতি কখনও কখনও যোগীন্দ্রনাথ লক্ষ বেশি। জীবনীকার হিসেবে বেশ ‘জাজমেন্টাল’, মধুসূদনের রচনার বায়োগ্রাফিকাল ক্রিটিসিজ়ম করছেন— সে সময়ের নিরিখে হয়তো স্বাভাবিক, এ পথ তো ঈশ্বর গুপ্তের কবিতা বিচার করতে গিয়ে বঙ্কিমচন্দ্রও গ্রহণ করেছিলেন। যোগীন্দ্রনাথ তুলনা করে লিখছেন “লর্ড বায়রনের বা মধুসূদনের, কাহারও প্রেমে, প্রথমে, আবিলতা ছিল না।
কিন্তু যৌবনের পদার্পণে অতৃপ্ত প্রেম-পিপাসার সঙ্গে ভোগাসক্তি ও রূপলালসা আসিয়া উভয়কে গ্রাস করিল। উভয়েরই সর্বনাশ হইল। সেই অবধি দুজনেই প্রণয়ের নামে, নিজ নিজ জীবন ইন্দ্রিয়-সেবাতেই অতিবাহিত করিয়াছিলেন। পরিতৃপ্তি কাহারও ভাগ্যে মিলে নাই।”
প্রশ্ন হল, কবির ভাগ্যে কি সত্যি সত্যি পরিতৃপ্তি মেলে? বিশেষত ইংরেজি সাহিত্যের সূত্রে যে রোমান্টিক কবিদের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছিলেন বঙ্গদেশের সাহিত্যপ্রেমীরা, সেই শেলি, কিটস, কোলরিজ, বায়রন কে-ই বা জীবনে পরিতৃপ্ত? অতৃপ্তি বিষণ্ণতা নিয়ে তাঁরা বার-বার ব্যক্তিমানুষের স্বাধিকারের কথা উচ্চারণ করছিলেন। সেই ব্যক্তি-স্বাধিকারের প্রশ্ন থেকেই সামাজিক সুনীতির স্থিতিশীল কাঠামোকে তাঁরা ভেঙে দেন বার বার। রক্তাক্ত হন প্রেমে-বিরহে-বিচ্ছেদে— এই আশ্চর্য অতৃপ্ত পার্থিব অস্থিরতাই তো রোম্যান্টিকতার মানুষী অবদান। মধুসূদনও সেই মানুষী উপাদানে গড়া— তীব্র আবেগ তাঁর চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য।
বঙ্গদেশে উনিশ শতকে যে সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, তার কেন্দ্রীয় চরিত্রগুলিও নানা ভাবে সামাজিক সুনীতির স্থিতিশীল কাঠামোকে তীব্র আবেগে প্রশ্ন করেছে। সামাজিক সুনীতি তো অধিকাংশ সময়েই দেশ-কালের কায়েমি স্বার্থের উপর নির্ভর করে। তাই রামমোহন যখন সতীদাহ প্রথা রদ করতে চাইলেন, তখনও তাঁর এই মানবিক দাবিকে অনেকেরই মনে হয়েছিল স্বেচ্ছাচার। এমনকি একেশ্বরবাদের পক্ষে, মূর্তিপুজোর বিপক্ষে যে রামমোহন, তাঁর বিরুদ্ধে আদালতে সাক্ষ্য দিতে রামমোহন-জননী দ্বিধা করেননি। যে বিদ্যাসাগরকে এখনকার বাঙালি মায়েরা পারলে বুকে করে রাখেন, সেই বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজের ছাত্র হয়েও রক্ষণশীল নন। ঈশ্বরমহিমা সম্বন্ধে বিদ্যাসাগর নীরব, বিধবা বিবাহের পক্ষ নিয়ে সে কালে রক্ষণশীলদের কৌতুকের শিকার। বিধবা হলেই যে নারীশরীর পাষাণবৎ হয়ে যায় না, এই শরীর-মনের সত্য জানতেন বলেই বিধবাদের বিবাহের পক্ষ নিয়েছিলেন। তাঁর এই কাণ্ডজ্ঞান সমাজের মত-বদলের জন্য যথেষ্ট নয়। ‘পরাশর সংহিতা’ থেকে লাগসই শ্লোক উদ্ধার করে প্রমাণ করতে হল, শাস্ত্রমতে স্বামী মারা গেলে বিয়ে করা বিধেয়। এ সবই এক অর্থে সামাজিক সুনীতির বিরোধিতা, বিদ্যাসাগরের নামে সঙের গান হল। সংস্কৃত কলেজের ছাত্র বিদ্যাসাগর কিন্তু হিন্দু কলেজের মধুসূদনকে ভালবাসতে ভুল করেননি। মধুসূদনের যে প্রেমকে যোগীন্দ্রনাথ ‘ইন্দ্রিয়সেবা’ বলেছেন, বিদ্যাসাগর জানেন সেই তীব্র স্বাধিকারকামী আবেগই নানা ভাবে সে-সময়ে নানা কাজে বঙ্গভাষী চিন্তকদের চালিত করছে— এ সে যুগের ধর্ম, স্বাধীন মনেরও ধর্ম। এই তীব্র আবেগই তো বিদ্যাসাগরের ক্ষেত্রে দয়া রূপে প্রকাশিত।
মধুসূদন বিদ্যাসাগরকে উৎসর্গ করলেন তাঁর ‘বীরাঙ্গনা কাব্য’। ‘সীতার বনবাস’ রচনায় বিদ্যাসাগর মহাকাব্যের রামকে বার বার কাঁদিয়েছেন। পত্নীকে ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন রাম, তাই এই কান্না— মহাকাব্যে না থাকলেও বিদ্যাসাগরের রচনায় রামের কান্না আছে। বিদ্যাসাগরের মন সীতাকে বনবাসে পাঠানোর কাজটিকে সমর্থন করে না বলেই তাঁর রাম কঠিন-পুরুষ নন। আর মধুসূদন? ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ রচনা করে আর এক ভাবে মহাকাব্যের জগতে অন্তর্ঘাত ঘটালেন তিনি। রাম নয়, ইন্দ্রজিৎ— রাবণপুত্র ইন্দ্রজিৎ— তাঁর সাহিত্যিক মহাকাব্যের নায়ক। পরবর্তী কালের এক হিন্দু সন্ন্যাসী মধুসূদনের ‘মেঘনাদবধ কাব্য’-এর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিলেন শিষ্য শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তীর কাছে। ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ যে ধ্বনি-ঝঙ্কারময় ভাষায় লেখা, তা স্বামী বিবেকানন্দের খুবই প্রিয়। রাবণের রাজসভার বর্ণনাও বিবেকানন্দের মনে ধরেছে— এই ভাব-ঝঙ্কার রাজসিকতাকে জাগিয়ে তোলে বলে মনে করেন তিনি। বিবেকানন্দ মধুসূদনকে পছন্দ করলেও বিদ্যাসাগরকে ততটা পছন্দ করতেন না। বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ আন্দোলন বিবেকানন্দের সমর্থন পায়নি, আবার বিদ্যাসাগর মেয়েদের প্রতি দয়াশীল বলেই তো মধুসূদন মেয়েদের পত্রকাব্য ‘বীরাঙ্গনা’ বিদ্যাসাগরকে উৎসর্গ করলেন। উনিশ শতকের চালচিত্রে এক চিন্তকের সঙ্গে অপর চিন্তকের সম্পর্কের রসায়নটি বড় বিচিত্র। কে যে কাকে সমর্থন করবেন আর সমালোচনা করবেন স্থির করা কঠিন। অবশ্য সজীবতার লক্ষণও তাই। মধুসূদন, বিদ্যাসাগর, বিবেকানন্দ সকলেই আবেগ-সজীব দ্বন্দ্বময় মানুষ।
মধুসূদনের কাব্যে ইন্দ্রজিৎ-পত্নী প্রমীলা আত্মমর্যাদাবোধে দীপ্ত। হিন্দু কলেজে পড়ার সময় একটি ইংরেজি প্রবন্ধ লিখে পুরস্কার পেয়েছিলেন মধুসূদন। সে প্রবন্ধের শেষে জানাতে ভোলেননি, “ভারতবর্ষে, বলা যেতে পারে প্রাচ্যের সমস্ত দেশেই, এমন হীন চোখে মেয়েদের দেখা হয় যেন পুরুষের পাশব-প্রবৃত্তি তৃপ্ত করার জন্যই রমণীদের সৃষ্টি।” সেই পাশব অধিকারবোধের বাইরে যে প্রেমবাসনা তারই কাব্য ‘মেঘনাদ বধ’, তারই কাব্য ‘বীরাঙ্গনা’। ‘বীরাঙ্গনা কাব্যে’ ভারতীয় সংস্কৃত ভাষা-বাহিত মহাকাব্য ও পুরাণের রমণীরা তাঁদের প্রেমিকদের চিঠি লিখছেন। মধুসূদনের চরিত্রগুলি সংস্কৃত ভাষার, তাদের লেখার ভাষা আধুনিক বাংলা, তাদের মনের ভাব পাশ্চাত্যের হাত-ফেরতা স্বাধিকারবোধ-সম্মত। লেখার রীতি ওভিদের পত্রকাব্যকে মনে করায়। সেই সমস্ত চিঠি সামাজিক সুনীতিকে তোয়াক্কা করে না। মধুসূদনের ‘বীরাঙ্গনা কাব্যে’ আছে গুরুপত্নী তারার প্রেমপত্র। গুরুপত্নী তারার কাছে সামাজিক নিয়মানুসারে শিষ্যরা পুত্রতুল্য। প্রণয়, দুই পরিণত নর-নারীর প্রণয়, সামাজিকতার সুস্থিতিকে মান্য করে না। মধুসূদনের তারাও করেননি। পত্রটির নৈতিকতা ও সামাজিকতা নিয়ে খুবই তোলপাড় হয়েছিল। মধুসূদনের কাব্যের প্রেম যেন বিবেচনাশক্তি রহিত। শুধু সম্পর্কের ক্ষেত্রেই বা কেন! বহু ক্ষেত্রেই বিবেচনার নামে ব্যক্তিমানুষের তীব্র আবেগকে অবিবেচনা ও অতৃপ্তির কারণ বলে আটকাতে গেলে সামাজিক সুনীতির নামে বদ্ধ জলাশয়েই আটকে থাকতে হয়। উনিশ শতক এ দেশে পুকুর, ডোবা ডিঙিয়ে সাগরে যাওয়ার শতক। বিবেচনার স্থিতিতে আঘাত করে অবিবেচনার আবেগকে ঠাঁই দেওয়া মধুসূদনের কাব্যটিকে বিদ্যাসাগর সাদরে গ্রহণ করেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ মধুসূদনের থেকে বয়সে অনেকটাই ছোট। মধুসূদনের ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ রবীন্দ্রনাথের তরুণ বয়সে বেশ অপছন্দই হয়েছিল, ‘ভারতী’ পত্রিকায় মধুসূদনের কাব্যের ধারাবাহিক সমালোচনা করেছিলেন তিনি। এই রবীন্দ্রনাথই পরবর্তী কালে ‘নরনারী’ নামের লেখাটিতে সকৌতুকে সাধারণ ভাবে বাঙালি পুরুষের স্বভাব কেমন তার হদিস দিয়ে লিখেছিলেন, “আমাদের দেশে পুরুষেরা গৃহপালিত, মাতৃলালিত, পত্নীচালিত।” এ সিদ্ধান্ত মিথ্যে বলে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না— তবে উনিশ শতকে যে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের জন্য এখনও পর্যন্ত সর্বভারতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে বাঙালি খাতির পেয়ে থাকেন, সেই আন্দোলনে নানা ভাবে, নানা রূপে যে পুরুষেরা অংশগ্রহণ করেছিলেন, তাঁরা কেউই প্রায় সঙ্কীর্ণ অর্থে ‘গৃহপালিত, মাতৃলালিত ও পত্নীচালিত’ ছিলেন না। মধুসূদন সম্বন্ধেও একই কথা খাটে।
সেই উনিশ শতকও আর নেই, আর উনিশ শতকের বিচিত্র-পুরুষের দলও ‘অস্তমিত’। ‘গ্লোবায়ন’(গ্লোব+অয়ন)-এর ফলে এখন নানা কাজে খিদমত খাটতে ‘বং’দের ছুটোছুটি করতে হয় বটে, কিন্তু এই ‘গ্লোব’ আর সে দিনের ‘ওয়ার্ল্ড’ তো সমার্থক শব্দ নয়। উনিশ শতকের বাঙালিদের মধ্যে যাঁরা বিশ্বের ভাব ও ভাবনা-সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়েছিলেন, কালাপানি ডিঙিয়ে পাশ্চাত্যে গিয়েছিলেন, নিজের ভাষা-ভাবকে সেই সমুদ্রে মিশিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁরা বিশ্বের সঙ্গে যে যোগ স্থাপন করেছিলেন, রবীন্দ্রনাথের ভাষায় সেটা ‘আনন্দের যোগ’। হালে ‘গ্লোবায়ন’ যে যোগ তৈরি করে সেটা নিতান্তই পুঁজি-চালিত কাজের যোগ। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘বিশ্বসাহিত্য’ রচনায় লিখলেন, “দেশে এবং কালে যে মানুষ যত বেশি মানুষের মধ্যে আপনার আত্মাকে মিলাইয়া নিজেকে উপলব্ধি ও প্রকাশ করিতে পারিয়াছেন তিনি ততই মহৎ মানুষ।” নিজেকে নানা দেশের নানা মানুষের সঙ্গে মেলাতে চাইলে গৃহপালিত, মাতৃলালিত, পত্নীচালিত থাকা যেমন চলে না তেমনি গ্লোবাল-পুঁজির দাসানুদাস হওয়াও সম্ভব নয়— শ্রীমধুসূদন ও M. M. S. D. এই দুই সাংস্কৃতিক বৈপরীত্যকে ভেঙে যে মধুসূদন দত্ত ক্রমে জীবনযাত্রায় ও লেখায় বড় হয়ে উঠলেন তিনি ‘বিশ্বমানব’। বিদেশে জীবিকার প্রয়োজনে পড়তে গিয়ে পড়ার চেয়ে মন টানল শিক্ষা-সংস্কৃতি। রবীন্দ্রনাথের জীবনেও তো পরে আরও বেশি করে তা-ই সত্য। স্কুল-পালানো রবীন্দ্রনাথকে বিলেতে পাঠিয়ে পড়াশোনার হিল্লে করার শেষ যে চেষ্টা হয়েছিল তাতে পড়াশোনা হল না— তবে রবীন্দ্রনাথের দু’চোখ আর মন-প্রাণ বিলিতি অপেরা, নাটক, গানে ভরে গেল। বাংলাভাষার রাজমিস্ত্রি হয়ে বিশ্বসাহিত্যের ইমারতের অদৃশ্য প্ল্যানের সঙ্গে নিজের বাংলা লেখাকে খাপ খাইয়ে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ, তাঁর আগে সে কাজ মধুসূদনের হাতে শুরু হয়েছিল।
পরিণত রবীন্দ্রনাথ মধুসূদনের ‘মেঘনাদবধ কাব্য’-এর অংশবিশেষের ইংরেজি অনুবাদ করেছিলেন। ছাত্রদের জন্য মধুসূদনের সনেট ‘বঙ্গভাষা’ থেকে প্রশ্ন দিয়েছিলেন— পড়ুয়াদের জন্য রবীন্দ্রনাথের প্রশ্নটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। “মাইকেল মধুসূদন দত্ত ইংরেজি লাটিন গ্রীক ফরাসি প্রভৃতি ভাষায় পণ্ডিত ছিলেন। তাঁর সাহিত্যরচনার প্রথম সাধনা হয় ইংরেজি ভাষায়। এই চতুর্দশপদী বাংলা কবিতায় তাঁর বলবার বিষয়টা কী?” ‘ভারতী’ পত্রিকায় মধুসূদনের ‘মেঘনাদবধ কাব্য’কে ঠারেঠোরে ইংরেজির গিল্টি করা কাব্য বললেও পরে রবীন্দ্রনাথের মধুসূদন-বিচার ক্রমেই বদলেছে। লিখেছেন, “মাইকেল তাঁর নবসৃষ্টির রূপটিকে সাহিত্যে চিরপ্রতিষ্ঠা দেন নি বটে, কিন্তু তিনি সাহস দিয়ে গেলেন, নতুন লেখকদের উৎসাহ দিলেন। তিনি বললেন, প্রতিভা আপনসৃষ্ট নব নব রূপের পথে সাহিত্যকে নব নব ধারায় প্রবাহিত করে দেয়।”
এই যে নব নব রূপের পথে সাহিত্যকে বইয়ে দেওয়া, তা সম্ভব হয়েছিল বিশ্বসাহিত্য পান করার ফলেই। মধুসূদন তখন ফ্রান্সে। সঙ্গে হেনরিয়েটা। ফ্রান্সে বসে মনে পড়ছে তাঁর নিজের দেশের নদীর কথা। ছেলেবেলার নদী কপোতাক্ষ। লিখছেন সনেটবন্ধে “সতত হে নদ, তুমি পড় মোর মনে।/ সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে;/ সতত (যেমতি লোক নিশার স্বপনে/ শোনে মায়া-যন্ত্র-ধ্বনি) তব কলকলে/ জুড়াই এ কান আমি ভ্রান্তির ছলনে।” সনেট তো বাংলা কবিতার স্বাভাবিক ধরন নয় তখন— তাতে কিছু যায় আসে না। সেই ছন্দে দেশজ নদীর স্বপ্নরূপ অনায়াসে ধরা দিল— মধুসূদন ধরতে পারলেন। বিশ্বসাহিত্যের প্ল্যানে খাপ খেয়ে গেল তাঁর বাঙালি মন। এই সনেট, যা তাঁর ভাষায় ‘চতুর্দশপদী’, তা-ই তো ক্রমে হয়ে উঠবে তাঁর আত্মকথনের ভাষিক বাহন। কাহিনিকাব্য থেকে তিনি ঢুকে পড়ছেন গীতিকাব্যের জগতে।
ইংরেজ সভ্যতার ধারা এ দেশে আসেনি যখন, তখন এ দেশে সংস্কৃত সাহিত্যই মাত্র গড়ে ওঠেনি, সংস্কৃতের রূপ ভেঙে ভাষা-সাহিত্য নিজের পথ তৈরি করেছিল। কৃত্তিবাস, কাশীরাম সেই বাংলা ভাষার কবি— মঙ্গলকাব্যের জগৎ গিয়েছিল খুলে, সওদাগর যাত্রাপথে দেখেছিলেন সমুদ্র-মাঝারে কমলে-কামিনী। মধুসূদন সেই বাংলা ভাষার পাঁচালি আর মঙ্গলকাব্যের জগৎকেই ঠাঁই দিতে পারলেন তাঁর চতুর্দশপদী কবিতায়। শুধু নিজের ভাষার প্রাগাধুনিক সাহিত্যের ভূগোলই নয়, কলিকাতা কমলালয়ের বাইরের ব্রাত্য ভৌগোলিক অঞ্চলও তাঁর কবিতায় ধরা দিয়ে গেল। জীবনের শেষ পর্বে পুরুলিয়ার কাশীপুরের রাজার ডাকে আইনি পরামর্শ দিতে গিয়েছিলেন তিনি। সেখানকার খ্রিস্টধর্মাবলম্বীরা তাঁকে সমাদর করেছিল। তাঁর চোখে ধরা পড়েছিল এই অঞ্চলের পাষাণরূপের নিজস্বতা। এখানে তো তাঁর ছেলেবেলার কপোতাক্ষের জলধারার সন্ধান মিলবে না। এখানে ‘পাষাণময় দেশে’ পরেশনাথ গিরি মাথা তুলে আছে। মধুসূদন লিখলেন, “হেরি দূরে ঊর্দ্ধ্বশিরঃ তোমার গগনে,/ অচল, চিত্রিত পটে জীমূত যেমতি।/ ব্যোমকেশ তুমি কি হে, (এই ভাবি মনে)/ মজি তপে, ধরেছ ও পাষাণ মূরতি?/ এ হেন ভীষণ কায়া কার বিশ্বজনে?” পুরুলিয়ার পরেশনাথ চতুর্দশপদী বাংলা কবিতার আধুনিক ধারায় জায়গা করে নিল। মধুসূদন নিজের আত্মাকে পুরুলিয়ার সঙ্গে আর পুরুলিয়ার ভৌগোলিকতাকে বাংলা কবিতার সঙ্গে মিলিয়ে দিলেন।
এই মিলিয়ে দেওয়ার সাহস ছিল বলেই তো ‘কৃষ্ণকুমারী’-র মতো নাটক লেখা সম্ভব হয়েছিল। রাজস্থান-কাহিনি তখন স্বাদেশিকতা প্রচারের উপায়। রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘পদ্মিনী উপাখ্যান’ (১৮৫৮) লেখার সময় জেমস টড-এর ‘অ্যানালস অ্যান্ড অ্যান্টিকুইটিজ় অব রাজস্থান’ বইয়ের সাহায্য নিয়েছিলেন। যদিও স্বাধীনতার স্পৃহা জাগিয়ে তোলাই রঙ্গলালের উদ্দেশ্য, আর রঙ্গলালের মতোই পরবর্তী কালে বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর ‘রাজসিংহ’ উপন্যাসের মাধ্যমে স্বাধীনতা বোধের জাগরণের জন্য রাজস্থান-কাহিনি ব্যবহার করবেন—মধুসূদন সে পথে যাননি। বিশ্বসাহিত্যের পাঠক বলেই তাঁর মিলিয়ে দেওয়ার পন্থাটি আলাদা। উৎপল দত্ত মধুসূদনের নাটক নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে দেখিয়েছিলেন মধুসূদন তাঁর ‘কৃষ্ণকুমারী’ নাটকে বাংলা ভাষায় প্রথম সার্থক ট্র্যাজেডি রচনা করে বাংলা নাটকের ক্ষেত্রে কেবল নতুন হাওয়াই বইয়ে দিলেন না, শেক্সপিয়রের আর গ্রিক ট্র্যাজেডির থেকে নেওয়া নানা উপাদানের সমবায়ে গড়ে ওঠা এই নাটকে রাজস্থান-কাহিনির মাধ্যমে দেশপ্রেম জাগানোর চেষ্টাও করলেন না। ‘স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে কে বাঁচিতে চায়’— এমন রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়-সুলভ কাব্যদীপ্তি ঘোষণা করা মধুসূদনের উদ্দেশ্য নয়। এ নাটকে কৃষ্ণা নামের একটি মেয়ের পাণিপ্রার্থনার জন্য দেশীয় রাজারা পরস্পরের সঙ্গে সংঘাতে অগ্রসর হচ্ছেন। ঠিক যেন এক জন নারীকে ঘিরে পাশব লালসা প্রকাশ, সহজ বাংলায় পারস্পরিক খেয়োখেয়ি। এই সংঘাতের চাপে নিরুপায় পিতা ভীমসিংহের মান বাঁচাতে মেয়ে কৃষ্ণাকে আত্মঘাতী হতে হচ্ছে। রাজপুত রাজাদের গল্পের মাধ্যমে পুরুষালি বীরত্ব প্রদর্শন করা হচ্ছে না। যে মধুসূদন হিন্দু কলেজে পড়ার সময়, ভারতীয় ও প্রাচ্যদেশীয় মেয়েরা পুরুষের পাশবকামনার তৃপ্তির জন্য সৃষ্ট— এই মতের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন, সেই মধুসূদনই এ নাটকে আর এক বার মুখ দেখালেন। ভারতীয় মেয়েদের অব্যক্ত বেদনা বিদেশের ট্র্যাজেডির রূপে আত্মপ্রকাশ করল। এক দেশের সাহিত্যের রূপের সঙ্গে অন্য দেশের মানুষের, বিশেষ করে মেয়েদের বেদনার ভাবরূপের মিল ঘটল।
ভীমসিংহ তাঁর মেয়ে কৃষ্ণাকে পুরুষের লালসা থেকে বাঁচাতে পারছেন না, আবার এও বুঝতে পারছেন, শক্তিশালী পাণিপ্রার্থী রাজার ইচ্ছার বিরোধিতা রাজ্যের নিরাপত্তার পক্ষে ক্ষতিকর। বৃদ্ধ অসহায় ভীমসিংহের সঙ্গে শেক্সপিয়রের রাজা লিয়রের তুলনা এক রকম করে কেউ কেউ করেছেন— তবে সেই তুলনার চেয়ে কী ভাবে মধুসূদন মেয়েদের নানা রকম অসহায়ত্বকে ভাষা দিচ্ছেন, সে কথা ভাবাই অনেক বেশি জরুরি। টড তাঁর এই বইটি উৎসর্গ করেছিলেন চতুর্থ জর্জকে। আনত উচ্ছ্বাসে জানিয়েছিলেন, রাজপুতানায় যে বেআইনি দমননীতি ছিল, ইংরেজ রাজের অধীনে তার থেকে মুক্তি মিলেছে। এই স্বীকারোক্তি ঔপনিবেশিক রাজতন্ত্রের প্রতি অনুগত ইংরেজ-কর্মচারীর স্বীকারোক্তি। মধুসূদন রাজকর্মচারী নন— ভাষার রাজমিস্ত্রি, তাই বাংলা ভাষার সৌধে মেয়েদের অসহায়ত্বকে খোদাই করছেন। এতে যদি বেআইনি দমননীতির থেকে মেয়েদের রেহাই মেলে। কাজে লাগছে টড-এর বই— অন্য ভাবে।
মধুসূদনের সঙ্গিনী হেনরিয়েটা বাংলা জানতেন। মধুসূদনের লেখার মর্ম অনুধাবন করতে পারতেন। তবে মধুসূদনের লেখালিখির জগৎ এক দিক থেকে দোসরহীন। যে কাব্যটি তাঁকে অমর করেছে সেই ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ বাংলা সাহিত্যে একা— তার কোনও পরম্পরা নেই। মধুসূদনের চতুর্দশপদী তো পরম্পরাহীন নয়। মধুসূদন কপোতাক্ষকে কখনও ভুলতে পারেননি। মধুসূদন বিলেত থেকে ফিরে বন্ধু ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের চুঁচুড়ার বাড়িতে এসেছিলেন। ভূদেবকে বলেছিলেন, “আমাকে কাপড় দেও আমি কাপড় পরিয়া পিঁড়ি পাতিয়া বসিয়া খাইব।” মধুসূদনের ‘চতুর্দশপদী কবিতাবলী’ যেন অন্তরে সেই কাপড়-পরা, পিঁড়িতে বসে খাওয়া বাঙালির নিজস্ব দেহটিকে বহন করছে। বাঙালি তাই মধুসূদনকে পরম্পরারহিত হতে দেয়নি। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের চতুর্দশপদী মধুসূদনকে গ্রহণ করে— উনিশ শতকের মধুকবি স্বাধীনতা পরবর্তী বিশ শতকে পরিগৃহীত হলেন। পুরুলিয়া থেকে ফিরে আর বেশি দিন বাঁচেননি তিনি, বঙ্কিমচন্দ্র ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রে প্রয়াণের পর লিখেছিলেন মধুসূদন ‘জাতীয় কবি’— বাঙালি তাঁকে দুশো বছর পরেও নিজেদের কবিতার ভাষার মুক্তির অভ্যাসে মনে রেখেছে।