গরমের ছুটিতে আমেরিকায় বেড়াতে এসেছে লালি। তার মাসি নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটান এলাকায় থাকেন। মা আর মাসির সঙ্গে সারা শহরটা চষে বেড়াচ্ছে সে। তবে তার সবচেয়ে পছন্দের জায়গা হল মাসির বাড়ির কাছের পার্কটা।
বিকেল হতে না হতেই মা-মাসির সঙ্গে সেই পার্কে গিয়ে হাজির হয় লালি। পার্কটার গা ঘেঁষে বয়ে যাচ্ছে ইস্ট রিভার নামের একটা নদী। আর কী যে সুন্দর সব ফুল ফুটেছে সেখানে! কী গালভরা নাম তাদের। রডোডেনড্রন, হাইড্র্যানজিয়া, ফরসিথিয়া, অ্যাজালিয়া। এ দেশের মানুষেরা ভারী স্বাস্থ্য সচেতন। সাদা-কালো-বাদামি রঙের মানুষরা জগিং করছেন, সাইকেল চালাচ্ছেন। এমনকী লালির দাদু-দিদার বয়েসি মানুষরাও!
গরমকালে এখানে সূর্যাস্ত হয় দেরিতে। রাত আটটা অবধি দিনের আলো থাকে। সন্ধে সাতটা নাগাদ নদীটা হঠাৎ উলটো মুখে বইতে থাকে। মাসি বলছিলেন, কাছেই আটলান্টিক মহাসাগরের মোহনা। তাই যখন জোয়ার আসে সমুদ্রে, তখন এই নদীটাও ফুলেফেঁপে দিশেহারা হয়ে ছুটতে থাকে উলটো দিকে। রোজ রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে নদীটার পাগলামি দেখে লালি।
আর একটা মজার ব্যাপার দেখেও হেসে কুটিকুটি হয় সে। পার্কটার ভেতরেই আছে আর একটা ছোট্ট পার্ক। বড় পার্কটার চাইতে ফুট চারেক উঁচু সেই চত্বরটা। চমৎকার ঝকঝকে টালি দিয়ে বাঁধানো মেঝে, চার পাশে নিচু লোহার রেলিং। আর সেখানে খেলা করে ছোট ছোট কুকুরেরা। রোজ খানিকটা সময় তাদের খেলা দেখে লালি।
কয়েকটা ষন্ডা মতো লোক আবার জার্মান শেফার্ড, বুলডগের মতো বড় বড় কুকুরদের নিয়ে দৌড়য়ও। লালির মাসি বলেছেন, ওদের বলে ডগ ওয়াকার। ওরা ঘণ্টা প্রতি টাকা পায়। আসলে এ অঞ্চলের লোকেরা ডগ লাভার। বিশেষ করে বুড়ো বয়সে যখন একা হয়ে যান, তখন তো অবশ্যই কুকুর পোষেন। মানুষের চেয়েও বেশি বিশ্বস্ত তো তারা। তবে পুষলেই তো শুধু হবে না, তাদের যত্ন নিতে হয়, তাদেরকে সময় মতো খাবার দিতে হয়। তাদের দাঁতের ব্যায়ামের জন্য রোদে শুকানো শুয়োরের কান চিবোতে দিতে হয়। তাদের পেশি মজবুত করার জন্য দৌড়তে নিয়ে যেতে হয়। তবে নিজেরা বুড়ো হয়ে গেলে তো কুকুরের সঙ্গে দৌড়তে পারেন না, তাই ডগ ওয়াকার রাখেন।
তবে একটা ব্যাপার দেখে একটু ঘেন্না করে লালির। যেটা সে রোজই দেখে এখন। কুকুরদের ইভনিং ওয়াকে নিয়ে গেলে প্রায়ই তারা হিসি আর পটি করে। কিন্তু এ দেশের আইন-কানুন খুব কড়া। ধরা পড়লেই কয়েকশো ডলার ফাইন হয়ে যায় কুকুরের মালিকের। তাই তাঁরা যখনই কুকুর নিয়ে বেরোন, পকেটে গ্লাভস নিতে ভোলেন না। কুকুর পটি করার সঙ্গে সঙ্গে হাতে গ্লাভস পরে সোনামুখ করে সেই ‘হাতে গরম’ পটি তুলে গ্লাভস সুদ্ধ গারবেজে ফেলে দেন। তবে কোথাও বেড়াতে গেলে অবশ্য ডায়াপার পরিয়ে নেওয়া হয় তাদের।
আজ পার্কে একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখে থমকে দাঁড়াল লালি। একটা গোল্ডেন রিট্রিভারকে প্র্যামে বসিয়ে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছেন এক ভদ্রমহিলা। দেখে খুব হাসি পেল ওর। এমন কাণ্ডও হয় এ পৃথিবীতে? কিন্তু তার মুখের কৌতুক ভরা হাসিটি মিলিয়ে গেল মুহূর্তে। মানুষও এমন করুণাময় হতে পারে, জানা ছিল না তার।
ভদ্রমহিলার পরিচিত একটি ছেলে এসে জিজ্ঞেস করল, আপনার গোল্ডি কেমন আছে ম্যাডাম?
এখন একটু ভাল। ডাক্তার বলেছেন, সপ্তাহ খানেক বাদে ও নিজেই হাঁটতে পারবে। বললেন ভদ্রমহিলা।
ভদ্রমহিলার কথা শুনে লালি বুঝতে পারল, তাঁর গোল্ডির চোখের ছানি কাটা হয়েছে ক’দিন আগে। হাজার পাঁচেক ডলার খরচা হয়েছে তাঁর। কিন্তু সে এখন চোখে দেখতে পাচ্ছে বলে তাঁর খুব আনন্দ হচ্ছে। গোল্ডি ঘরে বসে বসে বোর হয়ে যাচ্ছে তো, তাই আজ একটু হাওয়া খাওয়াতে নিয়ে এসেছেন তাকে। কলকাতার রাস্তার কুকুরগুলোর জন্য বুকের ভেতরটা চিনচিন করে উঠল লালির।
সপ্তাহ তিনেক কেটে গেছে। আর এক সপ্তাহ বাদেই মায়ের সঙ্গে কলকাতায় ফিরে যাবে লালি। জুনের মাঝামাঝিতে তার স্কুল খুলছে।
দুপুরে হঠাৎ ঝড়-বৃষ্টি হয়ে পথঘাট কাদা মাখা হয়ে আছে। বিকেলে পার্কে এসে লালি দেখল, নদীটা আরও ফুলে উঠেছে। ফুলগাছগুলো এলোমেলো হয়ে আছে। মানুষজনের উপস্থিতি অনেকটাই কম। কুকুরগুলোও তেমন আসেনি। তবে সাদার ওপরে কালো ছোপের একটা ডালমেশিয়ানকে নিয়ে এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক এসেছেন। লালি দেখল, কুকুরটার চার পায়ে লাল টুকটুকে গামবুট!
বাড়ি ফেরার পথে লালির মাসি বললেন, একটু গ্রসারি স্টোরে যেতে হবে, অনেক কিছু নাকি কেনার আছে। ফার্স্ট অ্যাভেনিউয়ের গ্রসারি স্টোরটায় যাবার পথে লালি দেখল, একটা বিল্ডিংয়ের একতলায় একটা মস্ত হল ঘর। বাইরের সাইনবোর্ডে লেখা আছে, ‘বিউটি অ্যান্ড বাথ’। হলটার রাস্তার দিকের দেওয়ালটা কাচের, তাই ভেতরটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। অনেকগুলো কুকুর ঘোরাঘুরি করছে সেখানে। লালির চোখে-মুখে প্রশ্ন দেখে ওর মাসি বললেন, বুঝলি তো লালি, এটা এখানকার কুকুরদের বিউটি পার্লার।
লালি জিজ্ঞেস করল, মানে?
মানে এখানে কুকুরদের হেয়ারকাট হয়, শ্যাম্পু করানো হয়, নখ কাটা হয়।
সত্যি?
দেখছিস না কুকুরদের কেমন আদর এখানে?
সেটা অবশ্য লালি নিজেও দেখছে। এ দেশে মানুষের চাইতে কুকুরের আহ্লাদ বেশি। যেন কুকুর হয়ে জন্মগ্রহণ করে কেউকেটা হয়ে উঠেছে তারা।
মাসির সঙ্গে গল্প করতে করতে লালি দেখল, কুকুরদের পার্লারটা থেকে বেরিয়ে এল একটা বাদামি রঙের পুড্ল। তার কোঁকড়ানো লোমগুলোকে কেটে কী সুন্দর করে যে ডিজাইন করেছে! মাথাটা দেখে মনে হচ্ছে বুফঁ করে খোঁপা বেঁধেছে। গলায় নেকলেসের মতো দেখতে কী দারুণ একটা বকলস। হাসি মুখে, জিভ লকলকিয়ে একটা বড় গাড়ির পেছনের সিটে গিয়ে বসল সে। যেন কোনও পার্টিতে যাচ্ছে।
হাঁ করে দেখছে লালি। পাড়ার ঘিয়ে ভাজা কুকুরগুলোর জন্য মন কেমন করছে তার। মনে মনে একটা শপথ নিল সে। দেশে ফিরে গিয়ে একটা ডগ লাভার্স ক্লাব তৈরি করবে। রাস্তার নেড়িগুলোর যত্ন নেবে। জলাতঙ্কের টিকা দেওয়ার, আর তাদের খাবারের ব্যবস্থা করবে। পেট ভরে খেয়ে, স্বাস্থ্যে ঝলমল করে, ভৌ ভৌ করে পাড়াটা পাহারা দিতে তো পারবে তারা। নাই বা থাকল তাদের বিউটি পার্লার!