ছবি: সৌমেন দাস
টিজোকে গার্গী একদম পছন্দ করতেন না। কিন্তু উপায় কী, প্রতিবেশী তো! প্রথম দিনের আলাপের কথা ওঁর এখনও মনে আছে। ল্যান্ডিংয়ে দেখা, গার্গী তখন মর্নিংওয়াকে যাচ্ছিলেন। আচমকা টিজো কোথা থেকে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল গার্গীর গায়ের উপর। পড়তে পড়তেও, লোহার গেট ধরে কোনও রকমে সামলে নিলেন গার্গী নিজেকে। তাতেও নিস্তার নেই, ওঁর গায়ের উপর সামনের পা-দুটো তুলে নিজের ভেজা নাক দিয়ে শুঁকতে লাগল। কয়েক সেকেন্ডেরই ব্যাপার, মি. সরকার দৌড়ে এসে চেন টেনে ধরে ওঁর কাছ থেকে আলাদা করেছিলেন টিজোকে। ‘‘আই অ্যাম সো স্যরি ম্যাডাম! আপনার লাগেনি তো? অ্যাই টিজো, দুষ্টু ছেলে! ক্ষমা করবেন, হাত থেকে চেনটা খুলে গেল... ওর উদ্দেশ্য খারাপ ছিল না কিন্তু। অল্পবয়সি কুকুর তো, সারাক্ষণ খেলতে চায়। বিশেষত সকালে ওর এনার্জি লেভেলটা একটু বেশি থাকে।’’
টিজো একটি গোল্ডেন রিট্রিভার, বয়স চার বছর। সাতের চোদ্দোতে থাকে, তার মালিক মি. সরকারের সঙ্গে। আর সাতের তেরোতে, মানে ঠিক পাশের দরজাতেই থাকেন গার্গী। বয়েস ওঁর এখন প্রায় পঞ্চান্ন। তবে তা বোঝার উপায় নেই। সুন্দর চেহারা। কাঁধ অবধি ছোট করে কাটা চুল, কালো ফ্রেমের চশমা। হালকা লিপস্টিক আর হিলস পরে বেরনোর অভ্যাসটা ওঁর এখনও আছে। বেশ রুচিসম্মত। উনি একাই থাকেন। একা থাকতে ওঁর অবশ্য মন্দ লাগে না। নিজের একটা রুটিন তৈরি করে খুব সুশৃঙ্খল জীবন যাপন করেন। সকালে আধ ঘণ্টা মর্নিংওয়াক, ফিরে ছ’টা ভেজানো কাঠবাদাম, এক কাপ চিনি-ছাড়া চা। ব্রেকফাস্টের পর ঘণ্টা দুয়েক সেতার প্র্যাকটিস। বিকেলে চায়ের পর পুরো এক ঘণ্টা যোগাসন এবং ধ্যান। এই সব করে সারা দিনটা বেশ ভালই কাটে ওঁর। সমস্যা শুধু একটাই, কুকুরের স্পর্শ উনি একেবারে সহ্য করতে পারেন না। কুকুর দেখলেই রাগে গা রি-রি করলেও ভদ্রলোকের বিনয়ের প্রত্যুত্তরে গার্গীকেও লৌকিকতা করতেই হল, ‘‘ঠিক আছে, ঠিক আছে... আমার লাগেনি।’’ মি. সরকার বললেন ‘‘এক দিন আমার বাড়িতে চা খেতে আসুন না... টিজোর সঙ্গেও আলাপটা ভাল করে করিয়ে দেব তা হলে।’’ ‘‘হবে, হবে... আসব এক দিন,’’ বলে সে দিনের মতো নিস্তার পেয়েছিলেন গার্গী।
কিন্তু চা আর খেতে যাওয়া হয়নি, কারণ মি. সরকারের আচমকা মৃত্যু। তাঁর কন্যা রিনি এল আমেরিকা থেকে। সেখানে সে গবেষণা করে। সমস্যা হল টিজোকে নিয়ে। রিনি ফিরে যাবে, টিজো কোথায় থাকবে? রিনি শেয়ার করে একটা বাড়িতে থাকে, সেখানে পোষ্য নিষেধ। তাছাড়া পেট পাসপোর্ট করাতেও সময় লাগবে বেশ। রিনি কেনেলে খোঁজ করল, কিন্তু ওরা এত দিনের জন্য দায়িত্ব নিতে চায় না, বিশেষত এনআরআই পার্টিরা অনেক সময়ই ফিরে আসে না আর। অগত্যা রিনি দ্বারস্থ হল গার্গীপিসির। ‘‘আমি! না না... আমি কুকুর-টুকুর রাখতে পারব না!’’ গার্গী ঝেড়ে কাশলেন। ‘‘আর কোনও রাস্তা থাকলে আমি তোমাকে কখনওই বিরক্ত করতাম না গার্গীপিসি,’’ রিনির সহৃদয় অনুরোধ ঠেলতে গার্গীর খারাপও লাগছে, আবার প্রস্তাবটা মেনে নিতেও পারছেন না। তা হলে উপায়?
রিনি শেষে ঠিক করল, রাস্তাতেই ছেড়ে দিয়ে যাবে টিজোকে, যদি সে ভাবেই সে বেঁচে থাকতে পারে। এ বার আর নিষ্ঠুর হতে পারলেন না গার্গী, নিলেন টিজোকে। কিন্তু জানিয়ে দিলেন, ‘‘বেশি কিছু আশা কোরো না। ওকে যা যা ভ্যাকসিন দেওয়ার আছে তা দিয়ে যাবে। আর ডগ ফুড-টুড খাওয়াতে পারব না বাপু। আমি রাতে দুধ-রুটি খাই, ওকেও তাই দেব।’’
রিনি যাওয়ার দিন গার্গীর ফ্ল্যাটে দিয়ে গেল টিজোকে। টিজো কী বুঝল কে জানে, কোনও আপত্তি করল না। মি. সরকার যাওয়ার পর থেকেই ও বড্ড বেশি শান্ত হয়ে গিয়েছে। এখন রিনিও চলে গেল। প্রথম দু’দিন ও সারা দিন ঘরের একটা কোনায় মাথা নিচু করে বসে থাকল অপরাধীর মতো। কোনও ডাকাডাকি না, লাফালাফি না। কিছু খেল না। কিন্তু মুশকিল হল রাতে। আলো নিভলেই টিজোর যে কী হয়, সে পরিত্রাহি ঘেউঘেউ জুড়ে দেয়। শান্ত বাড়িতে থাকার অভ্যাস গার্গীর বরাবর। ছোটবেলা থেকে অগাধ স্বাধীনতায় মানুষ হয়েছেন, ব্যক্তিত্বটাও একটু বেশি প্রখর। বিবাহযোগ্য বয়সে পৌঁছে গার্গী বুঝেছিলেন, আর একটা ব্যক্তিত্বের সঙ্গে সারাটা জীবন মানিয়ে-গুছিয়ে চলাটা বোধ হয় পেরে উঠবেন না তিনি। তাই এই একা থাকাটাকে মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু সমাজ একা মহিলার একা ফ্ল্যাটে থাকা নিয়ে কৌতূহলী তো হবেই। তাই সামাজিকতা করতে গার্গী মিতবাক্যেই কাজ সারেন। কাউকেই খুব বেশি ঘনিষ্ঠ হতে দেন না।
সেই অবস্থায় জীবনে এসে পড়েছে টিজো। যেখানে উনি কোনও পুরুষকেই স্থান দিলেন না জীবনে, সেখানে এখন এই ভেজা নাকওয়ালা একটি চারপেয়ে প্রাণী সারাক্ষণ ওঁর বাড়িময় ঘুরবে আর লোম ছড়াবে, ভেবেই অসুস্থ বোধ করছেন তিনি। তার উপর টিজোর এই রাতের ডাকাডাকি! বালিশ থেকে মাথা তুলে গার্গী ধমকে উঠলেন, ‘‘অ্যাই... চোপ!’’ কোনও লাভ হল না। টিজো কথা কানেই নিল না। বেয়াদপির একটা সীমা আছে। গার্গী বুঝলেন, উঠতেই হবে। সশরীরে প্রকট না হলে ওকে থামানো যাবে না। গার্গী উঠে গিয়ে ডাইনিং স্পেসের লাইট অন করলেন। অবাক কাণ্ড, টিজোর ডাক একদম বন্ধ। ও ঘরের কোনায় আবার মাথা নিচু করে বসল। তা হলে কি অন্ধকারে টিজো ভয় পাচ্ছে? হতেও পারে। গার্গী আলোটা জ্বেলে রেখেই শুতে চলে গেলেন। আবার সেই নীরবতা। গার্গীর হয়েছে বিপদ। কুকুরটার চুপ করে থাকাটাও সমস্যা। এখনও ও রুটির বাটিতেও মুখ লাগায়নি। কী করে খিদে সহ্য করছে কে জানে, নাকি খিদেটাই মরে গিয়েছে একেবারে! তৃতীয় দিন তাই গার্গী নিজেই রুটিটা চটকে দিলেন দুধের মধ্যে। হাতে একটু নিয়ে এগিয়ে ধরল ওর মুখের কাছে। টিজো প্রথমটায় মাথা নিচুই করে রইল। কিন্তু গার্গী সামনে থেকে সরছে না দেখে এ বার আস্তে আস্তে নিজের ভেজা নাক দিয়ে প্রথমে গার্গীর হাত শুঁকল, তার পর চেটে চেটে খেতে লাগল। এর পর থেকে রোজ গার্গী রুটিটা চটকে দিতেন দুধে, টিজো সেটা নিজে নিজেই খেয়ে নিত।
মাস দুই কেটে গিয়েছে, টিজো তার স্বভাব ফিরে পেয়েছে। সকালে ডগ ট্রেনার আসে ওকে হাঁটাতে। গার্গী রিস্ক নেননি। ওঁর হাটুতে ব্যথা। বাড়ি ফিরে আরও হাইপার হয়ে যায় টিজো। একটা ছোট পুরনো বেলন-চাকি ছিল, টিজোকে সামলানোর জন্য সেটাই গড়িয়ে দিলেন মাটিতে এক দিন। টিজো নিজের জায়গায় দু’পাক ঘুরে, দৌড়ে মুখে করে এনে দেয়, আনন্দে ভৌ-ভৌ করে।
সব ঠিকই ছিল, কিন্তু টিজো আবার নিস্তেজ হয়ে পড়ল। গার্গী ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন ওকে। ‘‘টিজো কিছু খাচ্ছে না, সব সময় মনমরা হয়ে বসে থাকে,’’ গার্গীর কথা শুনে ডাক্তার ডিজিটাল থার্মোমিটার বার করে তাতে পেট্রোলিয়াম জেলি লাগাতে শুরু করলেন। টিজো এতক্ষণ বিরসবদনে বসেই ছিল, এ বার সোজা উঠে দরজার দিকে রওনা দিল। অ্যাসিস্ট্যান্টও তৈরি ছিল, চট করে টিজোকে ধরে টেবিলে তুলে দিল। ওর মুখে জাল বাঁধা, কুঁইকুঁই করে কান্না ছাড়া আর কোনও প্রতিবাদ করতে পারল না। ডাক্তার বললেন, ‘‘ঠিক ধরেছি, জ্বর হয়েছে। চিন্তার কিছু নেই। ওর এমনিতে শরীর ভালই।’’ ডাক্তার কিছু ওষুধ লিখে দিলেন। কিন্তু টিজো কিছুতেই ওষুধ খাবে না। ট্যাবলেটগুলো দেখলেই মুখ সরিয়ে নেয়, সোফার তলায় পালিয়ে যায়। অনেক ভেবে গার্গী একটা পিনাট বাটার কিনে আনলেন। তার পর চামচে করে কিছুটা নিয়ে তার মধ্যে গুঁজে দিলেন ওষুধগুলো। চামচটা টিজোর মুখের কাছে ধরলেন। টিজো সন্দিগ্ধভাবে প্রথমে শুঁকল, তার পর একটু চেটে দেখল। ওর জন্য নতুন স্বাদ, কিন্তু মনে হয় ওর বেশ ভাল লেগেছে। চাটতে চাটতে পুরো চামচটা সাফ করে দিল টিজো। কেল্লা ফতে! সময় কিছুটা লাগল, কিন্তু টিজো আবার সুস্থ হয়ে উঠল।
এখন গার্গীর রুটিনটা অনেকটা পাল্টে গিয়েছে। সকালে টিজো হেঁটে এলে গার্গী চা খেতে খেতে ওর সঙ্গে একটু খেলেন। তার পর টিজোর দুধ খাওয়ার সময়। এর পর যখন গার্গী সেতার রেওয়াজ করেন, টিজো এসে নিজের পা-দুটোর উপর মুখ রেখে, চোখ বুজে বসে থাকে। কী বোঝে কে জানে! খাওয়ার জায়গার একটা কোনায় টিজোর জন্য একটা কম্বল পেতে রেখেছেন গার্গী, কিন্তু ও বেশির ভাগ সময়টাই গার্গীর আশপাশে থাকতে পছন্দ করে। টিজোর জন্য একটা স্টিলের দাঁতালো চিরুনি ছিলই, গার্গী সেটা দিয়ে টিজোর লোমগুলো আঁচড়ে দেন, গলায় সুড়সুড়ি দিয়ে দেন। দুটি প্রাণের মধ্যে কোনও বাক্যালাপ হয় না ঠিকই, কিন্তু কেমন একটা পারস্পরিক নির্ভরশীলতা গড়ে উঠেছে।
বছর ঘুরতে চলল, টিজো এখন এই বাড়িরই পাকাপাকি সদস্য, এটা দু’জনেই জেনে গিয়েছে। শীতের শুরু, ডিসেম্বরের পয়লা সপ্তাহ। এক দিন সকালে ফোন বাজল। ও পার থেকে রিনি জানাল, সে একটা ফ্ল্যাট পেয়েছে, তাই টিজোকে নিতে আসছে খুব তাড়াতাড়ি। গার্গী একটু ধাক্কা খেলেন। যেন আশা করেনি। অথচ জানা তো ছিলই। ‘‘কিন্তু ও সারা দিন একা কী করে থাকবে?’’ ফোনেই জিজ্ঞেস করলেন গার্গী। ‘‘ফ্ল্যাটটা ক্যাম্পাসের মধ্যেই। আমি মাঝেমধ্যে এসে ওকে দেখে যাব। তা ছাড়া একা থাকা তো একটা অভ্যেস... তুমিও তো একা একাই থাকো,’’ রিনির যুক্তি অকাট্য। গার্গী বুঝলেন।
রিনি আবার বলল, ‘‘এই এক বছর ধরে তুমি অনেক করেছ পিসি, আমি কখনও ভুলব না।’’ ফোন কেটে গেল।
রিনি এল রাতের ফ্লাইটে। ওকে দেখে খুব খুশি হয়েছে টিজো, ওদের স্মৃতি তো দারুণ। এ ক’দিন রিনিকে নিজের ফ্ল্যাটেই রেখেছেন গার্গী, আর যতটা সময় টিজোকে সঙ্গে রাখা যায়। রিনি আর টিজো, এই দুটি অল্পবয়সি প্রাণের ছোঁয়ায় গার্গীরও সময়টা ভাল কাটছিল, শুধু মেয়াদটা এত কম যে ঠিক উপভোগ করতে পারছিলেন না।
অবশেষে দিনটা এল। ট্যাক্সি নীচে এসে গিয়েছে। ল্যান্ডিংয়ে রিনির সুটকেস রাখা। টিজোর কম্বল আর খাওয়ার বাটি একটা ব্যাগে ভরে দিয়েছেন গার্গী। এই ক’দিন টিজোর থেকে একটু দূরে দূরেই থেকেছেন তিনি। অভ্যাস হওয়া ভাল। এ বার এক বার টিজোর গলায় সুড়সুড়ি দিয়ে গার্গী বলল, ‘‘ভাল করে থাকিস, কেমন...’’ টিজো কী বুঝল কে জানে, দৌড়ে গিয়ে বেলনটা মুখে করে নিয়ে এসে ধরল গার্গীর সামনে। গার্গী ওর মুখ থেকে সেটা নিয়ে রিনিকে দিয়ে বললেন, ‘‘ওর কোনও খেলনা ছিল না তো, তাই এটা দিয়েই খেলত। নিয়ে যাও... ওর কমফর্টেবল লাগবে।’’ রিনি ওটা ব্যাগে ভরে নিল। বলল, ‘‘চল টিজো।’’ টিজো জিভ বার করে রিনির মুখের দিকে তাকাল, তার পর গার্গীর দিকে। গার্গীর এমনিতে মন শক্ত, কিন্তু আজ ওঁরও চোখে জল। টিজো হঠাৎ গার্গীর পিছনে গিয়ে বসে পড়ল মাটিতে। আর নড়ে না। রিনি বলল, ‘‘কী করছিস টিজো... প্লেনের সময় হয়ে যাচ্ছে... চল, চল।’’ কিন্তু টিজো বসেই রইল মাথা নিচু করে, কারও সঙ্গে চোখাচোখিও সে করবে না।
রিনিরই নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল, গার্গী তা জানেন। এখন সে কথার অন্যথা করাটা ছেলেমানুষি হবে। কিন্তু গার্গী আজ বলেই ফেললেন, ‘‘থাক না রিনি, ও যখন যেতে চাইছে না...’’ রিনি এত দিন ধরে ব্যাপারটা ঠিকই ধরেছিল। শুধু টিজো নয়, গার্গীপিসিরও ইচ্ছে নেই।
মেন গেট দিয়ে ট্যাক্সি বেরিয়ে গেল, রিনি জানালা দিয়ে হাত নাড়ছে। গেটের কাছে দাঁড়িয়ে গার্গীও তাঁকে হাত নাড়ছে, পাশে বসে রয়েছে টিজো। আনন্দে সে লেজ নাড়ছে ক্রমাগত।