ছবি: মহেশ্বর মণ্ডল
চেকে পেনশন হোল্ডারের সইটা একদম মিলছে না। কাঁপা কাঁপা হাতের সইটা বেশ অস্পষ্টও। লাইনও বাঁকা। চেকের পিছন দিকে এক জন মহিলার নাম সই করা। ডাকতেই এগিয়ে এলেন মহিলাটি। বললাম, “পেনশন হোল্ডার আপনার কে হন?”
“আমার মা।”
“সইটা তো একদম মিলছে না।”
“বুঝতে পারছি, কী করব বলুন, এর থেকে ভাল সই তো মা করতে পারছেন না। নার্ভের পেশেন্ট। হাত কাঁপে। দীর্ঘ দিন ধরে স্পাইনাল কর্ডের ব্যথায় শয্যাশায়ী। কোমরে বেল্ট বেঁধে কোনও মতে ঘরের ভিতরে একটু চলাফেরা করতে পারেন।”
“কিন্তু সই না মিললে আমাদেরও তো কিছু করার থাকে না।”
“তা হলে কী উপায়?”
“একটু কষ্ট করে ওঁকে এক দিন ব্যাঙ্কে নিয়ে আসুন। আমরা একটা নতুন সিগনেচার কার্ডে ওঁর ডান হাতের বুড়ো আঙুলের একটা ছাপ নিয়ে নেব। এর পর থেকে উনি চেকে সইয়ের পরিবর্তে টিপছাপ দিয়েই টাকা তুলতে পারবেন। তবে সেটা ব্যাঙ্কে এসেই তুলতে হবে।”
“কিন্তু মায়ের যা শরীরের অবস্থা, তাতে তো মা-র পক্ষে ব্যাঙ্কে আসাই সম্ভব নয়।”
“এক দিন অন্তত নিয়ে আসুন। আমরা টিপছাপটা নিয়ে নেব। তার পর যে ডাক্তারবাবু ওঁকে দেখছেন, তাঁকে নিজের লেটার হেডে রেজিস্ট্রেশন নম্বরসহ ওঁর অসুস্থতা ও অক্ষমতার কথা লিখে দিতে হবে এবং চেকের পাতায় একটা টিপছাপ নিয়ে সেটি ভেরিফাই করে দিতেহবে, তা হলে আপনি এসেও টাকা তুলতে পারবেন। তবে তার আগে আপনিই যে আপনার মায়ের হয়ে প্রতি মাসে পেনশনের টাকা তুলবেন সেই ব্যাপারে আপনার মায়েরও একটা সম্মতিসূচক চিঠি ব্যাঙ্কে জমা দিতে হবে।”
“আচ্ছা, এই সব ক্ষেত্রে আপনারা নাকি অফিস থেকে কাউকে পাঠিয়ে বাড়ি থেকেও মায়ের সই বা টিপছাপ নিয়ে আসতে পারেন?”
“হ্যাঁ, পেনশন হোল্ডার খুব অসুস্থ হলে ব্যাঙ্কের কোনও অফিসার তাঁর বাড়ি গিয়ে সই কিংবা টিপছাপ নিয়ে আসতে পারেন। কিন্তু আমাদের ব্রাঞ্চে এমনিতেই স্টাফ কম, তার উপর দু’জন কোভিডে আক্রান্ত। অফিসে আসতে পারছেন না... ”
“তাও যদি একটু সময় করে কেউ এটা করেন, তা হলে খুব উপকার হয়। আমিই মায়ের একমাত্র সন্তান। একটু দূরে থাকি। নিজের ঘরসংসার সামলে মায়ের কাছে আসতে হয়। যদি অন্তত এটুকু সাহায্য করেন...” কাতর অনুরোধ মহিলাটির গলায়।
বললাম, “আপনি এক বার চিফ ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলুন। উনি যদি কাউকে দায়িত্ব দিতে পারেন।”
*****
সে দিন ছুটির মুখে চিফ ম্যানেজার আমাকেই বললেন, এক দিন বাড়ি ফেরার পথে ওই পেনশনারের বাড়ি গিয়ে সই বা টিপছাপ নিয়ে আসতে। বললেন, “ভদ্রমহিলা ফোন নম্বর দিয়ে গেছেন। যে দিন যাবেন সে দিন একটু জানিয়ে দেবেন। ওঁর মা সই করতে পারলে ভাল, তা না হলে সিগনেচার কার্ডে রাইট থাম্ব ইমপ্রেশনই নিয়ে নেবেন।”
দিন তিনেক বাদে কাজের চাপ কম থাকায় ভদ্রমহিলাকে ফোন করলাম। বাড়ির লোকেশন জানতে চাইলে বললেন, “শিয়ালদায় সন্তোষ মিত্র স্কোয়ারের পূর্ব দিকে আমাদের বাড়ি। মা দীর্ঘ দিন শিক্ষকতা করেছেন। এলাকার সবাই চেনেন। আপনাদের বৌবাজার ব্রাঞ্চ থেকে খুব বেশি হলে মিনিট পনেরো লাগবে।”
ঠিক করলাম বিকেল পাঁচটা নাগাদ যাব। কাজ সেরে শিয়ালদা থেকে ট্রেন ধরব। আমি বনগাঁ লাইনের দমদম ক্যান্টনমেন্টে থাকি। দেরি হলে ও দিকের ট্রেনে খুব ভিড় হয়ে যায়। ভদ্রমহিলাকে জানাতে তিনি বললেন, উনি আগেই তাঁর মায়ের কাছে পৌঁছে যাবেন।
বিকেলে ঠিক সময়েই গেলাম। পুরনো আমলের বাড়ি। সঙ্কীর্ণ সিঁড়ি। নোনা ধরা দেওয়াল। তিনতলায় থাকেন ওঁরা। বাড়ি ঢোকার ঠিক আগেই ফোন করেছিলাম। দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলেন ভদ্রমহিলা।
ঘরে বৃদ্ধা শুয়েছিলেন। ধীরে ধীরে উঠে বসলেন। পানপাতার মতো মুখ, কাশফুলের মতো সাদা ধবধবে চুল। শীর্ণ চেহারা। অসুস্থতার চিহ্ন সারা শরীরে।
মহিলাটি একটা চেয়ার এগিয়ে দিয়েছেন আমাকে।
বসে বৃদ্ধাকে বললাম, “আপনার সই তো একেবারেই মিলছে না।”
“আজকাল লিখতে গেলেই হাত কাঁপে। লাইন সোজা করে যে সইটা করব সেটুকুও পারি না। আপনাকে কষ্ট করে আসতে হল। শুনলাম আপনি দমদম ক্যান্টনমেন্টে থাকেন। কোথায় বলুন তো?”
“বান্ধবনগর, চেনেন?”
“হ্যাঁ, বান্ধবনগর কলোনি তো?”
“এক সময় ওই নামই ছিল। এখন শুধুই বান্ধবনগর। আপনার পরিচিত কেউ থাকেন ও দিকে?”
“কলোনির শিবমন্দিরের পাশে আমরাই তো ভাড়া থাকতাম এক সময়। সে অবশ্য অনেক দিন আগে। সেই সত্তরের দশকে।”
“কাদের বাড়ি বলুন তো?”
“অজিতেশবাবুদের।”
“অজিতেশ মুখার্জি? রেলে চাকরি করতেন?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন।”
“তিনি তো আমার বাবা।”
আমি সামনে রাখা পাশবইতে নামটা আর এক বার দেখে নিলাম। বললাম, “ওই বাড়ির বাবলুর কথা মনে আছে আপনার?”
বৃদ্ধা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছেন দেখে বললাম, “আমিই তো সেই বাবলু।”
“বাবলু! মানে রাণুদির ছেলে?”
“হ্যাঁ।”
“ও মা, তাই! তা হলে আমি আর আপনি আপনি করে কথা বলছি কেন, তুমিই বলি।”
বললাম, “ছেলেবেলায় আমাকে তুই বলতেন।”
ওর বিস্ময় শেষ হয় না, “বাব্বা, সে কত যুগ আগের কথা রে! এই ইলাদির কথা তোর মনে আছে?”
“হ্যাঁ। একটু একটু।”
“তোর সঙ্গে যে আবার দেখা হবে, তা তো ভাবতেই পারিনি কখনও। হ্যাঁ রে, রাণুদি কেমন আছেন?”
“বাবা দু’হাজার দশে, মা বারোয় মারা গেছেন।”
“ইশ! আমাকে যে কী ভালবাসতেন রাণুদি। বিকেলে চুল আঁচড়ে বিনুনি করে দিতেন।”
“তা তুমি যে এখানে থাকো, সেটাই তো জানতাম না। কত ছোটবেলায় তোমাকে দেখেছি। কত বছর হয়ে গেল বলো তো?”
কাঁপা কাঁপা হাতে পিঠে ছড়িয়ে পড়া খোলা চুলগুলো মুঠো করে বাঁধতে বাঁধতে ইলাদি বলল, “তা ধর প্রায় বছর চল্লিশ তো হলই।”
*****
দমদম ক্যান্টনমেন্টের বান্ধবনগর কলোনিতে তখন পূর্ববঙ্গ থেকে আসা উদ্বাস্তুরা যে যার মতো এক টুকরো করে জমির দখল নিয়ে বসতবাড়ি করা শুরু করেছে। চার পাশে মুলি বাঁশের বেড়া। উপরে টিন বা টালির চাল। মাটির মেঝে। কলোনিতে ঢোকার ঠিক আগে শিবমন্দিরের পাশে সাড়ে তিন কাঠা জমি কিনে ছোট্ট একটা বাড়ি করেছিলেন বাবা। বাড়তি আয়ের আশায় পাশে দু’কামরার একটা টালির ঘরও বানিয়েছিলেন তিনি। ওই ঘরেই ভাড়াটে হিসেবে এসেছিল ইলাদিরা। আমি তখন সবে স্কুলে ঢুকেছি।
পরে যখন ফাইভ কী সিক্সে পড়ি, তখন এক দিন দেখি ইলাদিদের ঘরে আমাদের স্কুলের অঙ্কের শিক্ষক পুণ্যব্রত স্যর। আমি তো অবাক। স্কুলের শিক্ষক ইলাদিদের ঘরে কেন!
সে দিন বাইরে থেকে স্যরকে দেখেই ভয়ে পালিয়ে গিয়েছিলাম। মাত্র ক’দিন আগেই হোমটাস্কে সিঁড়িভাঙা অঙ্ক ভুল করেছিলাম বলে পুরো ক্লাসটাই আমাকে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন তিনি।
এর পরেও বেশ কয়েক বার স্যরকে দেখেছি ইলাদিদের ঘরে বসে অঙ্ক শেখাতে।
কিছু দিন পর শুনলাম, ইলাদি বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছে। কানাঘুষোয় জানলাম, ইলাদি নাকি পুণ্যবাবু স্যরকে বিয়ে করেছেন। ইলাদির বাবা গোঁড়া ব্রাহ্মণ। মেয়ে অব্রাহ্মণের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধায় তিনি কঠিন মুখে বলে দিয়েছেন, বেঁচে থাকতে আর ওই মেয়ের মুখদর্শন করবেন না।
এর পর বেশ ক’দিন ইলাদিকে নিয়ে খুব চর্চা চলল। তার পর আস্তে আস্তে সব থিতিয়ে গেল।
এর কয়েক মাস পরে হঠাৎ এক দিন শুনলাম, পুণ্যবাবু স্যরকে নাকি পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে।
চুরি, ডাকাতি, মারামারি করলে পুলিশে ধরে। কিন্তু স্কুলের স্যরকে কেন পুলিশে ধরবে, ওই বয়সে সেটা আমার বোধগম্য হয়নি। মাকে জিজ্ঞেস করলে মা বিরক্ত স্বরে বলেছিল, “শুনলাম কী সব রাজনীতি করত। তোর ওসব খোঁজে কী দরকার! তুই মন দিয়ে পড়াশোনা কর।”
আমি আর কথা বাড়াইনি। এই ঘটনার পর পুণ্যবাবুর জায়গায় ক্লাসে অঙ্ক করাতে এলেন ব্রজেনবাবু স্যর।
বছরখানেক পর ইলাদির বাবাও এই পাড়া ছেড়ে অন্যত্র বাড়ি ভাড়া নিয়ে উঠে গেলেন।
*****
আমি তাঁর মায়ের পূর্বপরিচিত জেনে, মহিলা এক কাপ চা আর দুটো বিস্কুট নিয়ে এলেন। মৃদু আপত্তি করলেও ইলাদির জোরাজুরিতে কাপটা হাতে নিয়ে চুমুক দিলাম।
কিছু ক্ষণ চুপ করে থেকে ইলাদি বলল, “তুই কতটা কী জানিস বাবলু আমি জানি না। তোর পুণ্যস্যরের সঙ্গে বিয়েটা আমার বাবা মেনে নেবে না জানতাম। তাই বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছিলাম। তোর স্যর আমাকে নিয়ে এসে উঠল এই বাড়িতে। এটাই ওদের পৈতৃক বাড়ি। এখন সব ভাগাভাগি হয়ে গেছে। ও রাজনীতি করত জানতাম। কিন্তু তার পরিণতি যে কতটা ভয়াবহ হতে পারে, সে সম্পর্কে আমার ধারণাই ছিল না। পছন্দ না করলেও ওর কাজে বাধা দিইনি কখনও। সত্তরের সেই উত্তাল সময়ে নিজের অনিশ্চয়তা নিয়ে ও বেশ দ্বিধা-সংশয়ে ছিল বলেই আরও কিছু দিন অপেক্ষা করতে চেয়েছিল। আমাকে বুঝিয়েওছিল। আমিই রাজি হইনি। জেদ করেই ওর সঙ্গে চলে এসেছিলাম। কয়েক মাস পরে এক দিন গভীর রাতে পুলিশ এসে ঢুকল এ বাড়িতে। চার দিক ঘিরে রেখেছিল। ও পালানোর সুযোগটুকুও পেল না। কানাঘুষোয় শুনলাম, পুলিশ কাস্টডিতে নাকি খুব অত্যাচার করছে ওদের উপর। দিন পনেরো বাদে আবারও এক দিন পুলিশ এল। তবে এ বার সকাল বেলায়। আমার শাশুড়িমাকে আর আমাকে ওদের গাড়িতে করে নিয়ে গেল ওর মৃতদেহটা শনাক্ত করার জন্য। পুলিশ হেফাজতে থাকার সময় ও নাকি পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল।
“তোমরা গিয়ে কী দেখলে?”
“দেখলাম আপাদমস্তক সাদা চাদরে ঢাকা দিয়ে ওকে শুইয়ে রেখেছে থানার ভিতর। মুখের কাপড়টা একটু সরিয়ে দেখাল। মুখটা খুব ফোলা মনে হল। কিন্তু কেন, কী জন্য, সে সব ভাবার মতো পরিস্থিতি তখন আমার ছিল না। আমার শাশুড়িমাকে সামলানোই তখন দায় হয়ে উঠেছিল। আর তখন কে-ই বা কাকে সান্ত্বনা দেবে বল! শেষে ওরাই আবার ওদের গাড়িতে করে আমাদের বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছিল। এই মেয়ে তখন পাঁচ মাসের পেটে।”
“তোমাদের বাড়িতে আরকখনও যাওনি?”
“না। কার কাছে আর যাব বল? মা-বাবার কাছ থেকে তো স্বেচ্ছায় চলে এসেছিলাম। আমার জন্যই বাবা তোদের বাড়ি ছেড়ে অন্য জায়গায় গিয়ে বাড়ি ভাড়া নিয়েছিলেন।”
“মেসোমশাই, মানে তোমার বাবা মারা যাওয়ার খবর পেয়েও যাওনি?”
“না রে। মুখ পুড়িয়েছি বলে বেঁচে থাকতেই তিনি আমার মুখদর্শন করতে চাননি। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর ইচ্ছেটাকে আমি মর্যাদা দেব না কেন? তিনি তো তা চাননি কখনও। এই ভাবেই চলে যাচ্ছে... যাক্গে, আমার অবস্থা তো নিজের চোখেই দেখে গেলি। সই করতেই পারছি না। এখন থেকে প্রতি মাসে পেনশনের টাকাটা তুলব কী করে বল?”
আমি ব্যাগ থেকে সিগনেচার কার্ড আর স্ট্যাম্প প্যাড বার করে কার্ডে একটা টিপ ছাপ নিয়ে নিলাম। ওঁর মেয়ের কাছ থেকে চেকের একটা পাতা চেয়ে নিয়ে তাতেও দু’পিঠে টিপ ছাপ নিয়ে ইলাদিকে বললাম, “ব্যাঙ্ক ম্যানেজারকে অ্যাড্রেস করে একটা চিঠি লিখে দিয়ো যে তোমার অসুস্থতার জন্য এখন থেকে তোমার মেয়েই প্রতি মাসে পেনশনের টাকা তুলতে যাবে। চিঠির বাঁ দিকে মেয়েকে দিয়ে সই করিয়ে সইয়ের পাশেও অ্যাটেস্টেড কথাটা লিখে টিপছাপ দিয়ে মেয়েকে ব্যাঙ্কে পাঠিয়ে দিয়ো।”
ইলাদি চিন্তিত মুখে বলল, “এ বার না-হয় দিয়ে দিলি। এর পর?”
“চিন্তা কোরো না। প্রতি মাসেই তুমি চেকে টিপছাপ দিয়ে মেয়েকে পাঠিয়ো। আমি যে ক’দিন এই ব্রাঞ্চে আছি, কোনও অসুবিধে হবে না। তবে আমি বদলি হয়ে গেলে তোমার হাউজ় ফিজিশিয়ানকে দিয়ে টিপছাপটা ভেরিফাই করে পাঠিয়ো।”
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি, কথায় কথায় কখন যে দু’ঘণ্টা সময় পেরিয়ে গিয়েছে খেয়ালই করিনি। ইলাদিকে বলে বাইরে বেরিয়ে এলাম।
শীতের রাত। গাঢ় অন্ধকার নেমেছে চার পাশে। তারাবিহীন আকাশে মেঘের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে এক ফালি চাঁদ। ছেলেবেলার সেই ইলাদিকে দেখলাম কত দিন পর। পানপাতার মতো মুখ, ফর্সা রং, উজ্জ্বল মুখশ্রী বয়সের ভারে মলিন। বসন্তদিনে ঝরে পড়ার অপেক্ষায় থাকা হলুদ পাতার মতো বিবর্ণ।
সে দিন শিয়ালদা স্টেশনে ফেরার পথে আমি যেন চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম স্মৃতিতে প্রায় ধূসর হয়ে আসা একটা বহু পুরনো দিনের ছবি। বাতাসে বোমা, বারুদের গন্ধ। শিবমন্দিরে সন্ধ্যারতি শেষ হয়েছে। পাশে বান্ধবনগর কলোনিতে মুলি বাঁশের বেড়া দেওয়া সারি সারি ঘরে হারিকেনের আলো জ্বেলে বারান্দায় মাদুর পেতে পড়তে বসেছে ছোট ছোট ছেলেমেয়ের দল।
এ দিকে আমাদের বাড়ির এক প্রান্তে বেড়ার ঘরের ভিতরে খাটে বসা ইলাদিকে চেয়ারে বসে অঙ্ক শেখাচ্ছেন পুণ্যবাবু, আমাদের স্কুলের পুণ্যব্রত স্যর।